১৯১৭ সালে ৭ নভেম্বর। সেদিন পৃথিবীর বুকে মাথা তুলেছিল প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণী দুনিয়ার বুকে এ সত্য প্রতিষ্ঠিত করে যে, শ্রমিক শ্রেণী রাষ্ট্র পরিচালনার সামর্থ্য রাখে। তারা সেই শ্রেণী যারা নিজের শ্রম দিয়ে এ বিরাট সভ্যতা গড়ে তুলেছে এবং শ্রম ছাড়া যাদের দেয়ার মতো আর কিছুই নেই। তারা পুরনো সমাজের শোষণ-অন্যায়-অত্যাচারের সমস্ত শৃঙ্খল ভেঙ্গে দিয়ে শোষণ-বৈষম্যহীন এক নতুন সমাজ গড়ে তোলার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারে। রাশিয়ার বিরাট সংখ্যক কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে তাদের মিত্র হিসেবে এ লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে। এ বছর ৭ নভেম্বর মহান রুশ বিপ্লব ৯৯তম বার্ষিকী পূর্ণ করে শততম বর্ষে পদার্পণ করছে। মহামতি লেনিনের নেতৃৃত্বে প্রতিষ্ঠিত সেই রাষ্ট্র এক নতুন সভ্যতার জন্ম দিয়েছিলো, দেখিয়েছিল – মানুষের উপর মানুষের শোষণ কোনো চিরস্থায়ী ব্যাপার নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অসাম্য-বৈষম্য-শোষণের অবসান একমাত্র তখনই হতে পারে, যখন ব্যক্তিমালিকানা ও সর্বোচ্চ মুনাফাভিত্তিক এই ব্যবস্থার বদলে সামাজিক মালিকানা ও সুষম বন্টন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। তখনকার সময়ে ইউরোপ-আমেরিকার যেকোনো পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের তুলনায় পিছিয়ে থাকা সেই দেশ অল্প কয়েক বছরের মধ্যে ঘোষণা করতে পেরেছিলো – এদেশে কোনো বেকার নেই, অভুক্ত নেই। নারীদেরকে সকল প্রকার অপমান-জবরদস্তি থেকে মুক্ত করে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো। রাষ্ট্রের উদ্যোগে সকলের জন্য শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলো। সাংবিধানিকভাবে প্রত্যেক কর্মক্ষম মানুষের কাজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলো। পুঁজিবাদী সমাজের সমস্ত নোংরামি সমাজ থেকে মুছে ফেলেছিলো। সে দেশে ভিখিরি ছিল না, বেশ্যাবৃত্তি ছিল না। নতুন এ সভ্যতার অভ্যুদয় অবাক চোখে স্বাগত জানিয়েছিলেন রমা রঁল্যা, বার্ট্রান্ড রাসেল, আইনস্টাইনসহ বিশ্ববরেণ্য মনীষীরা, আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, নজরুল-এর মতো বড় মানুষেরা। রুশ বিপ্লব তাই মানব ইতিহাসে মহত্তম, সবচেয়ে গৌরবজনক ও দিকনির্দেশকারী ঘটনা।
বিপ্লবের শিল্পী, রূপকার ও স্থপতি – কমরেড লেনিন
জারের বিরুদ্ধে লড়াইরত প্রায় সমস্ত দলগুলো মিলে গড়ে তুলেছিল সোভিয়েত। সোভিয়েত কথাটির অর্থ পরিষদ। উৎপাদকদের বিভিন্ন স্তরের আলাদা আলাদা সোভিয়েত ছিল – যেমন শ্রমিকদের সোভিয়েত, কৃষকদের সোভিয়েত, সৈনিকদের সোভিয়েত প্রভৃতি। প্রতিটি শহর, নগর ও গ্রামে ছিল নির্বাচিত স্থানীয় সোভিয়েত, বড় বড় জেলাগুলোতে ছিল জেলা সোভিয়েত, ছিল আঞ্চলিক ও প্রাদেশিক সোভিয়েত। রাজধানীতে সারা রুশ সোভিয়েতের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি ছিল। মার্চ বিপ্লবের পরপরই প্রায় সর্বত্র শ্রমিক প্রতিনিধিদের ও সৈনিক প্রতিনিধিদের সোভিয়েতগুলি সম্মিলিত হয়ে যায়। সোভিয়েতগুলোতে বলশেভিকরা ছিল সংখ্যালঘিষ্ঠ, কিন্তু নভেম্বর বিপ্লবের আগে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন চলমান, ফ্রন্টগুলোতে সৈন্যরা তখন শান্তির জন্য ব্যাকুল, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে, শ্রমিকরা একের পর এক বিরাট বিরাট ধর্মঘট করছে, কৃষকরা ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে জমির দাবিতে আন্দোলন করছে – এ সবকিছুকে এক নিপুণ শিল্পীর মতো একসূত্রে গেঁথে তুলেছিলেন লেনিন। তিনি বিপ্লবের সম্ভাবনা, পরিণতি, সংকট, তার সম্ভাব্য আঁকাবাঁকা পথ – সবকিছুকেই কাঁচের মতো স্পষ্ট দেখতে পেতেন। বিপ্লবের চারদিন আগে পেত্রোগ্রাদে একটি ঐতিহাসিক বৈঠক হয়েছিল বলশেভিক নেতাদের। সেখানে লেনিন বলেন, “৬ নভেম্বর খুবই আগে হয়ে যাবে। অভ্যুত্থানের জন্য আমাদের দরকার একটা সারা রুশ ভিত্তি, অথচ ৬ নভেম্বরের মধ্যে কংগ্রেসের সমস্ত প্রতিনিধি এসে পৌঁছাবে না। অন্যদিকে ৮ নভেম্বর খুবই দেরি হয়ে যাবে। ততদিনে কংগ্রেস বসে যাবে এবং মস্ত একটা সংগঠিত সভার পক্ষে দ্রুত ও চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন। আমাদের ঘা মারতে হবে ৭ তারিখেই, যেদিন কংগ্রেস শুরু হবে, যাতে কংগ্রেসকে আমরা বলতে পারি, ‘এই রইল ক্ষমতা! বলুন কি করবেন?’”
বিপ্লবের আগের দিন অর্থাৎ ৬ নভেম্বর লেনিন দলের কেন্দ্রীয় কমিটিকে একটি চিঠি দেন। সেখানে তিনি বলেন, “আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে কমরেডদের এই সত্য অনুধাবন করতে আহবান করছি যে, সমগ্র বিষয়টাই এখন সুতোয় ঝুলছে; আমরা যে সমস্যার সম্মুখীন তা সম্মেলন বা কংগ্রেস করে (এমনকি সোভিয়েতগুলোর কংগ্রেস করে) সমাধান করা যাবে না, এর সমাধান একমাত্র জনগণ, ব্যাপক জনগণ, সশস্ত্র জনগণের সংগ্রামের দ্বারাই সম্ভব। . . . বিপ্লবের সাফল্য, শান্তি প্রস্তাব, পেত্রোগ্রাদের মুক্তি, দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি, চাষীর হাতে জমি দেয়া – এ সবই বিপ্লবীদের উপর নির্ভর করছে। একথা জেনেও এ সুযোগ হাতছাড়া করা বিপ্লবীদের পক্ষে সীমাহীন অপরাধ। দুনিয়ার সকল বিপ্লবের ইতিহাস এর সাক্ষ্য দেয়।”
বাস্তবিকপক্ষে লেনিনের সেই দিনের সেই সঠিক বিশ্লেষণ, পরিস্থিতির সূক্ষ্ম পরিবর্তন ধরতে পারার ক্ষমতা, সামান্যতম দ্বিধাদ্বন্দ্বহীনভাবে জনগণের উপর প্রবল আস্থা রাখতে পারার মন – এ সবকিছুই সেদিন নভেম্বর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে বিজয়ী করেছিল। তাই কমরেড স্ট্যালিন লেনিন সম্পর্কে বলেছিলেন, “লেনিন জন্মেছিলেন বিপ্লবের জন্য। সত্যই তিনি ছিলেন বিপ্লবী অভ্যুত্থানের মহত্তম প্রতিভা, বিপ্লবী নেতৃত্বের সর্বোত্তম শিল্পী।”
যাদের শ্রমে সম্পদ তৈরী হয় পুঁজিবাদী সমাজে তারাই সবচেয়ে বঞ্চিত, সমাজতন্ত্রে এরাই দেশের মালিক
আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষের কথা ভাবুন। যে কৃষক আমাদের মুখের অন্ন জোগায়, তার মুখে আহার জোটে না। ফসল ফলিয়ে উৎপাদন খরচই তার ওঠে না। কারখানায় কাজ করে যে শ্রমিক বৈদেশিক মুদ্রা বয়ে আনে; সে ন্যায্য মজুরি পায় না। দাবি তুললে জোটে পুলিশের লাঠি-গুলি। কখনো ভবন ধ্বসে কিংবা কখনো আগুনে পুড়ে মরে। এই সেদিন ফয়েল পেপার তৈরির কারখানায় পুড়ে মরল ৩৫ জন শ্রমিক! সমাজতন্ত্র দেখিয়েছিল – সম্পদের স্রষ্টা যে, সম্পদ ভোগের অধিকারও তার। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিক খাটে জীবিকার কাছে সে বাঁধা বলে। সমাজতন্ত্রে তার শ্রম সৃজনশীল, সে শুধু পেট চালানোর জন্য খাটে না।
সোভিয়েত ইউনিয়নে তাই হয়েছিলো। লেনিন বিপ্লবের ছয় বছর পরেই মারা যান। তখন গৃহযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। গোটা রাশিয়া বিপর্যস্ত। খাদ্য নেই, বস্ত্র নেই, গরম কাপড় নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই পর্যন্ত নেই অনেক মানুষের। সেই দেশকে অমিত শক্তিতে দাঁড় করিয়েছিলেন লেনিনের সুযোগ্য শিষ্য কমরেড স্ট্যালিন। তিনি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। রাশিয়ার জনগণকে এই চেতনায় দাঁড় করালেন যে, গোটা পৃথিবীর শ্রমিকশ্রেণী রাশিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। রাশিয়ার জনগণের ব্যর্থতা সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতা হিসেবেই পরিগণিত হবে, আর দেশে দেশে শ্রমিকশ্রেণীর মুক্তি আন্দোলন পিছিয়ে যাবে কয়েক যুগ। রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণী তখন আনন্দচিত্তে দিন-রাত কর্মযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। পৃথিবীর সবচে’ বড় ট্রাক্টর কারখানা, সবচে’ বড় যন্ত্র তৈরীর কারখানা – কি করেনি সোভিয়েত শ্রমিকরা! পাঁচ বছরের পরিকল্পনা চার বছরে সমাপ্ত করেছিল। বিরাট বিরাট সমবায় ও যৌথ খামার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। হাজার হাজার স্কুল গড়ে উঠেছিল কৃষকদের কৃষি সম্পর্কিত বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার জন্য। শুধু ইউক্রেনে দু’বছরে ৭ হাজার ‘ল্যাবরেটরী কুটির’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। রাশিয়া ভ্রমণকালে রবীন্দ্রনাথ অবাক হয়েছেন এ দেখে, এ শ্রমজীবি মানুষরাই প্রবল ঔৎসুক্যে রাত পর্যন্ত থিয়েটার দেখছে। বড় বড় লেখক-গায়ক-নাট্যকারের জন্ম হয়েছিলো সেদিন, জন্ম হয়েছিলো রুচিবান দর্শকের।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েতের ভূমিকা বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে লড়াকু মানুষকে প্রেরণা ও শক্তি জুগিয়েছিল
বাজার দখলে উন্মত্ত সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহ যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকায় গোটা পৃথিবীকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল, প্রতিরোধ দুর্গ হয়ে তখন হিটলারের বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়েছিলো সোভিয়েত। সোভিয়েত ইউনিয়নের আড়াই কোটি মানুষ জীবন দিয়ে সেদিন হিটলারকে ঠেকিয়েছিলো। রোগশয্যায় শায়িত রবীন্দ্রনাথ সে সময় রেড আর্মির অগ্রযাত্রার খবর শুনে আনন্দে উদ্ভাসিত হতেন। বলেতেন, ‘পারবে, ওরাই পারবে সভ্যতাকে রক্ষা করতে’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েতের প্রতিরোধ সংগ্রামের অগ্রযাত্রায় পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো সমাজতন্ত্র। দেশে দেশে উপনিবেশ বিরোধী মুক্তি সংগ্রাম গতি পেয়েছিল, উপনিবেশের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়েছিল বহুদেশ। সুয়েজখালের দখল নিতে তৎপর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স সোভিয়েতের এক হুংকারে হাত গুটিয়ে নিয়েছিল। পরাক্রমশালী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের অকুতোভয় লড়াইয়ের প্রেরণা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। আজ দেশে দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নির্মমতা চলছে। গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে রক্তের স্রোত বইছে, ছারখার করে দেয়া হয়েছে ইরাক-আফগানিস্তান-লিবিয়া-সিরিয়া-ইয়েমেন-ফিলিস্তিনকে। আজ যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকতো, আমেরিকাসহ সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহ নির্বিচার এই আগ্রাসন চালাতে পারতো না। দেশে দেশে মানুষ নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারছে, কি ক্ষতি হয়ে গেলো, কতবড় ভুল ঘটে গেলো। গোটা মানবজাতিকে, তার মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এই বিরাট প্রতিরোধশক্তি আজ আর নেই। আজ পৃথিবী অভিভাবকহীন।
সোভিয়েতের বেদনাদায়ক পতনে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের অকার্যকারিতা প্রমাণ হয় না
এতসব মহৎ কীর্তি স্থাপনকারী সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন হল কেন — স্বভাবতই প্রশ্ন আসে। সমাজতন্ত্র হলো পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে উত্তরণের অন্তবর্তী ধাপ। দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও জনগণের মধ্যে বুর্জোয়া ভাবধারা দূর হয়ে যায় না। একদিকে উৎপাদন ব্যবস্থায় ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি মালিকানার অবসানের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ, অন্যদিকে তীব্র আদর্শগত ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের এক কঠিন ও কষ্টকর পথে তাকে অগ্রসর হতে হয়।
সোভিয়েত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা পুঁজিপতি শ্রেণির নিরন্তর ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপ যেমন ছিল, পাশাপাশি ছিল সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের নানা চক্রান্ত। অপরিসীম মূল্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রবল ধাক্কা সামাল দিতে গিয়ে আদর্শগত চেতনার ক্ষেত্রে দুর্বলতা তৈরি হয়েছিলো। আর অন্তর্ঘাতমূলক নানা চক্রান্ত তো ছিলই। সমাজতন্ত্রের অভ্যন্তরে পুঁজিবাদী ব্যক্তিস্বার্থের প্রবণতা ক্রমেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিলো। আদর্শগত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাকে পরাস্ত করার যে সংগ্রাম চলছিলো তার মধ্যে ব্যক্তিস্বার্থ-ব্যক্তিবাদকে প্রসার ঘটাবার জন্য কিছু সুবিধা দেয়া ক্রুশ্চেভ আমল থেকে শুরু হলো। পুঁজিবাদী সমাজের সাথে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে উৎপাদন বাড়ানোর ঝোঁকে ব্যক্তিগত ইনসেনটিভ দেয়া শুরু হলো।
কালক্রমে ১৯৯২ সালে এসে গর্বাচেভের হাত ধরে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন ঘটল। এ বিপর্যয় বাইরের শক্তি ঘটাতে পারেনি, অভ্যন্তরের শক্তিই ঘটিয়েছিল। কমরেড লেনিন ও কমরেড স্ট্যালিন এ বাপারে পূর্বেই হুশিয়ারি দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে কমরেড মাও সে তুং সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, কমরেড শিবদাস ঘোষ বারবার সতর্ক করেছেন। তাদের দেখানো পথে চললে মানবজাতির এতবড় বিপর্যয় ঘটতো না। কিন্তু সোভিয়েত পার্টির শোধনবাদী নেতারা সে পথে চললেন না। এর ফলে সোভিয়েতের পতনের পর একে একে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোরও পতন ঘটল।
বহু জয়-পরাজয়ের মধ্যে দিয়েই কোনো আদর্শ সমাজে স্থায়ী হয়
যে কোনো আদর্শ ও সমাজব্যবস্থার চূড়ান্ত জয়লাভের জন্য দীর্ঘ সময় লাগে। বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ইউরোপে সাড়ে ৩’শ বছর লড়াই হয়েছে। ধর্মীয় আদর্শগুলোকেও বহু জয়-পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়েছে। সেক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র টিকে ছিল ৭০ বছর। পেছনের হাজার হাজার বছরের শোষণমূলক ব্যবস্থার ইতিহাস মুছে দেয়ার জন্য ৭০ বছর সময় খুবই সামান্য। আজ গৌরব ও অর্জনের শিক্ষা যেমন আছে, পতনের শিক্ষাও সামনে আছে। যথার্থভাবে এ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশে দেশে বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে উঠবেই। কারণ পুঁজিবাদী শোষণ থেকে মুক্তির জন্য সমাজতন্ত্র ছাড়া আর কোনো পথ নেই। তাই বলে কেবল আকাঙ্খা দিয়ে এ লড়াই সঠিক পথ পাবে না। এজন্য চাই সঠিক বিপ্লবী দল।
বুর্জোয়া পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র আজ প্রহসনের অন্য নাম
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনে একদিন যারা জয়োল্লাস করেছিলো, বলেছিল এর অবসানে পৃথিবীতে স্থায়ী শান্তি আসবে — আজ তারা মানবজাতির সামনে কিভাবে মুখ দেখাবে? পৃথিবীতে আপাত ভারসাম্য যেটুকু ছিল, তা নষ্ট হয়ে গোটা পৃথিবী আজ সাম্রাজ্যবাদীদের বিষ নখরে রক্তাক্ত। বাজারের দখলের লড়াইয়ে সৃষ্ট দু’ দুটি বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত এখনো শুকায়নি। গোটা পৃথিবীর অর্থনীতির ওপর প্রভুত্ব করতে দেশে দেশে চলছে আগ্রাসন। মধ্যপ্রাচ্যে ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের বিভাজন সৃষ্টি করে লুটে নিচ্ছে তেল-গ্যাস। ইরাক দখল করে হত্যা করেছে ১৫ লক্ষ মানুষ। লিবিয়াকে ধ্বংস করেছে। ফিলিস্তিন-সিরিয়ায় প্রতিদিনই রক্ত ঝরছে। জাতিগত দাঙ্গায় ক্ষত-বিক্ষত আফ্রিকা। কখনো যুদ্ধ, আবার কখনো শান্তির বাণী ফেরি করে এরা বিশ্বের দেশে দেশে চালাচ্ছে আগ্রাসন। যতই উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশ হোক না কেন পুঁজিবাদের উপসর্গগুলো আড়াল করতে পারেনি। গণতন্ত্রের ভেক নিয়ে জনমতকে এরা দমন করে নানা কায়দায়। খোদ আমেরিকায় এখন বর্ণ ও ধর্ম বিদ্বেষী প্রচার চলছে। নির্বাচনের নামে এরা এমন পরিস্থিতি এরা তৈরী করে, যাতে দুইভাগে বিভক্ত ধনকুবেরদের কোন এক প্রতিনিধিকে মানুষ বেছে নিতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশেও গণতন্ত্রের ঠাঁটবাট আছে কিন্তু গণতন্ত্র নেই
বাংলাদেশেও যে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের জয়গান করা হয়, তার চেহারা কি? কত কত নির্বাচন হল, জনগণের অধিকার পূরণ হল কি? নির্বাচনে জনমতের কোন প্রতিফলন ঘটে না। এখানে প্রথম ও শেষ কথা মানি ও মাসল পাওয়ার। তারপরও যতটুকু ঠাঁটবাট ছিল, আওয়ামী মহাজোট তারও ধার ধারেনি। ভোটবিহীন নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় দফা ক্ষমতাসীন হয়ে চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা চালু করেছে। উন্নয়নের মুখরোচক শ্লোগান আউড়ে দুর্নীতি ও লুটপাটের ষোলকলা পূর্ণ করছে। জনমতের তোয়াক্কা না করে সুন্দরবন বিনাশী রামপাল প্রকল্প বাস্তবায়নের অযৌক্তিক সিদ্ধান্তে অটল আছে। অতীতে ক্ষমতাসীন ও বর্তমান শাসকরা ভোটের স্বার্থে ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার এবং ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সাথে আপোষ-সমঝোতা করে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার এমন পরিবেশের জন্ম দিয়েছে, যার ফলে খুন হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বিচারহীনতার এমন এক সংস্কৃতি এরা তৈরি করেছে যে, এ থেকে অসহায়ত্ব ও উদ্বিগ্নতার পাকচক্রে মানুষ হারিয়ে ফেলেছে লড়াইয়ের মনোভাব। গুম-খুন ও ক্রস ফায়ার চলছে সমানে। শিক্ষাসহ জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রেই যুক্তিবাদ-বিজ্ঞানমনস্কতাকে মেরে দেয়া হচ্ছে। বৈষয়িক স্বার্থের রাজনীতির পঙ্কে নিমজ্জিত করে হরণ করা হচ্ছে তরুণদের প্রতিবাদের শক্তি। মাদক নেশার করাল গ্রাসে নিপতিত হচ্ছে যুবসমাজ। এভাবে নৈতিকতার চরম অবনমন ঘটিয়ে পুজিঁবাদী সমাজব্যবস্থা নির্বিঘœ হয়ে আছে। কিন্তু এভাবেই কি চলবে?
সঠিক পথে লড়াই ভিন্ন মুক্তির পথ নেই
এভাবে চলতে পারে না। হতাশা কিংবা সংগ্রামবিমুখতা পুঁজিবাদের দুঃশাসনকে আরো দীর্ঘায়িত করবে। আবার যেকোন পথে লড়লেই মুক্তি আসবে না। এজন্যই বিপ্লবী দল প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে ১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর আজকের মার্কসবাদ-লেনিনবাদের যুগোপযোগী ধারণা – শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে আমরা বাসদ নামে দল গড়ে তুলেছিলাম। কিন্তু চলতে চলতে ঘোষিত আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে অনেকেই আমাদের সঙ্গে থাকতে পারেনি। বর্তমানে আমরা বাসদ (মার্কসবাদী) সে ধারা বহন করে চলেছি। আপনাদের কাছে আমাদের আহ্বান, আমাদের দলকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করুন। আপনাদের শক্তির ওপর ভর করে আমরা সর্র্বসাধ্য দিয়ে লড়তে চাই।