Sunday, December 22, 2024
Homeবিশেষ নিবন্ধবাঁচাও সুন্দরবন, বাঁচাও প্রাণ-প্রকৃতি-জনগণ

বাঁচাও সুন্দরবন, বাঁচাও প্রাণ-প্রকৃতি-জনগণ

খঞ্জনারা কেন নাচে? বুলবুলি দুর্গাটুনটুনি কেন ওড়াউড়ি করে
বনে বনে?
আমরা যে কমিশন নিয়ে ব্যস্ত-ঘাঁটি বাঁধি- ভালোবাসি নগর ও
বন্দরের শ্বাস- ঘাস যে বুটের নিচে শুধু- আর কিছু নয় আহা- মোটর যে
সবচেয়ে বড় এই মানবজীবনে।
খঞ্জনারা নাচে কেন তবে? ফিঙে-বুলিবুলি কেন ওড়াউড়ি করে
বনে বনে?’

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদের আধার আমাদের প্রিয় সুন্দরবন
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদের আধার আমাদের প্রিয় সুন্দরবন
জীবনানন্দ দাশের সেই সময় অনেক আগেই চলে গেছে। খঞ্জনা-দুর্গাটুনটুনি-ফিঙে আর বুলবুলি ইতোমধ্যে নতুন প্রজন্মের কাছে অপরিচিত নাম। রাস্তা-ঘাট আর বসতি স্থাপনের প্রয়োজনে বন উজাড় করতে করতে মানুষ আরেকটি সত্যও জেনেছে। সেটি হলো প্রকৃতির প্রতি যত্নশীল না হলে মানুষ নিজেও রক্ষা পায় না। প্রকৃতিকে রক্ষা করা প্রয়োজন মানুষের নিজের জন্যে। শুধু সংবেদনশীল কবি-মনের আকুতি রক্ষার্থে নয়, বন প্রয়োজন মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু জানলে কি হবে? মাদকদ্রব্য মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর জানলেই কি মাদক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে? উত্তরটা সহজ। মুনাফার প্রশ্ন যুক্ত বলে এত সহজে বন্ধ হবে না। বেশিরভাগ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও না। অধিকাংশ মানুষের সচেতনতা যদি সময়মত অনৈতিক মুনাফার রাশ টেনে ধরতে না পারে তাহলে সে জানা অর্থহীন। আবার একথাও সত্য যে, ভবিষ্যতে ঠিক কি কি ক্ষতি হতে যাচ্ছে তা বুঝতে পারাটাও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, মাদকসেবনের ক্ষতিকর প্রভাব শুরুতে বিশেষ বোঝা যায় না। কিন্তু যখন বোঝা যায় তখন আর মাদকের ছোবল থেকে ফিরে আসা যায় না। শিক্ষিত মানুষজন তাই কৌতুহলবশতও মাদক নিতে মানা করেন। বড় ধরনের মানুষ-সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয়ও অনেকটা তাই। প্রথম দিকে ঠিক ক্ষতির মাত্রা অনুধাবন করা না গেলেও যখন একবার একটি বন হারিয়ে যায় বা কোনো একটি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়, তা আর ফেরত পাওয়া যায় না। তাই প্রকৃতিতে যেকোন বড় পরিবর্তনের আগে বারবার বিচার করে দেখা শিক্ষিত মানুষের কাজ।
মধুপুর, পার্বত্য চট্টগ্রাম, শালবন বিহার সবই ক্রমাগত নিঃশেষিত হয়ে আসছে মানুষের আগ্রাসনে। সুন্দরবন নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে অনেক লড়াই করে। কিন্তু এখন আর তার নিজের লড়াইয়ের উপর ভর করে বাঁচবার সুযোগ নেই। কারণ তার শত্রু এবার আরও বড়, আরও সংঘবদ্ধ। সুন্দরবনের মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে ভারতের কুখ্যাত দূষণকারী কোম্পানি ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন (এনটিপিসি) কে ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে দিতে বাংলাদেশ চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এর জন্য ইতোমধ্যে ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে প্রায় ১৮৩৪ একর। পাশেই হবে দেশীয় কোম্পানি ওরিয়নের ৫৬৫ মেগাওয়াটের আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এছাড়া গড়ে উঠবে প্রায় ১৫০টা শিল্প-কলকারখানা। বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে, বেশি দামে বিক্রি হবে, কোম্পানির মালিকদের মুনাফা হবে, দেশের আরও কিছু জায়গায় আলোর রোশনাইও ছুটবে। কিন্তু বনের কী হবে? একথা যেমন ঠিক যে, দুই লক্ষ বছর আগে পলি মাটির উপর গড়ে ওঠা নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এই জলাবন বাংলাদেশের সামগ্রিক ইকো সিস্টেমের বৈচিত্র্যময় ও উল্লেখযোগ্য অংশ। তেমনি একথাও ঠিক যে, শতকোটি অণুজীব, ফাইটোপ্লাঙ্কটন, লতা, গুল্ম, উদ্ভিদ, প্রাণী মিলে বিশাল এই প্রাণসম্ভারে গড়ে ওঠা জীবন-রীতি যেকোন জায়গা থেকেই পৃথক। এই জীবন-রীতি ঠিক যেন ধাপে ধাপে নতুন প্রাণের যুক্ততায় গড়ে ওঠা বিশাল সমীকরণের মতো। যার ক্ষুদ্র একটি অংশও বাদ পড়লে কিংবা বাইরে থেকে হঠাৎ ঢুকে গেলে দুপাশের সাম্যাবস্থা আর থাকবে না। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সেই তুলনায় বিশাল বন-খেকো দানবের মতো। দেশের সাধরণ মানুষ আজ এই দানবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে।

ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে, আলো ফুটছে, প্রাণ জাগছে,…

সারাদেশে সুন্দরবন রক্ষার্থে এমন একটি আন্দোলন চলছে যা আসলেই সৃষ্টিশীল। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গান বাঁধা হচ্ছে, ডকুমেন্টারি তৈরি হচ্ছে, পথ-নাটক করা হচ্ছে, কার্টুন আঁকা হচ্ছে, প্রচারের নিত্য নতুন মাধ্যম আবিষ্কৃত হচ্ছে। পত্রিকার পাতায় দেশের চিন্তাশীল মানুষেরা বিভিন্ন দিক থেকে এই প্রকল্পের বিপক্ষের যুক্তিগুলো তুলে ধরছেন। রামপালের পক্ষেও লিখছেন গুটিকয়েক বুদ্ধিজীবী। যদিও সেখানে আন্দোলনকারীদের ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণের দিকটি প্রধান। আন্দোলনকারীরা সেই আক্রমণকে উপেক্ষা করে ধৈর্য্য ধরে শুধু তাদের যুক্তিটুকু খন্ডন করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। প্রতিবাদের বিভিন্ন নতুন ধরণ যুক্ত হচ্ছে। যেমন, একজন সন্তানসম্ভবা নারী শহীদ মিনারে অবস্থান নিয়েছেন প্লাকার্ড হাতে। তিনি তার অনাগত সন্তানের জন্য সুন্দরবনকে রক্ষা করতে চান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নতুন নতুন পোস্টার তৈরি করে শেয়ার দিচ্ছে কিশোর-তরুণরা। মা তার দুই সন্তানকে নিয়ে চলে আসছেন মাঠের কর্মসূচিতে। ছাত্র সংগঠনগুলো বিভিন্ন ধরনের আয়োজন রাখছে। পাশাপাশি আন্দোলনকারীদের ব্যারিকেড ভাঙ্গা, টিয়ার গ্যাস সহ্য করা, পুলিশের মার খাওয়া থেকে শুরু করে রোডমার্চ, লংমার্চসহ বিভিন্ন কর্মসূচির অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হচ্ছে। আন্দোলনের ঢেউ গিয়ে নাড়া দিচ্ছে প্রবাসেও। প্রবাসী বাঙ্গালিরা সংগঠিত হচ্ছেন। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান জানাচ্ছেন। এমনকি ১৭৭টি ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান সুন্দরবনের ক্ষতি হবে জেনে অর্থ বিনিয়োগে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
কে নেই এই আন্দোলনে? সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-লেখক-শিক্ষক-গায়ক-ছাত্র-বিজ্ঞানী-গবেষকসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ নিয়ে এই আন্দোলন। সরকার প্রযুক্তিগত কিছু শব্দ ব্যবহার করে চেয়েছিলো আন্দোলনের বিপক্ষে কিছু যুক্তি খাড়া করতে। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে সবাই বিশ্বের তথ্যভান্ডার খুঁজে দেখছেন যে আসলে বিষয়টি কী। জানছেন এর পিছনের রাজনীতিটা কী। আবার দিন যত যাচ্ছে, আন্দোলনের উপর আক্রমণও তত বাড়ছে। আর সেই হারেই বাড়ছে সাধারণ তরুণ-যুবকদের অংশগ্রহণ। প্রশ্ন তোলা হয়েছে, টাকা আসছে কোথা থেকে। আন্দোলনকারীরা ফিরে তাকিয়েছে প্রশ্নকারীর দিকে। তবে কি তারা বায়ান্ন দেখে নি, ঊনসত্তর দেখে নি, মুক্তিযুদ্ধ দেখে নি? সেদিন আন্দোলনকারীরা টাকা পেয়েছিলো কোথায়? হাজার হাজার তরুণ-যুবকের শ্রমে-ঘামে গড়ে উঠেছে এই আন্দোলন। তারা জীবন পর্যন্ত বাজি রেখে অংশগ্রহণ করছে। দেশের মানুষের আর্থিক-নৈতিক সহযোগিতা আর আন্দোলনকারীদের পরিশ্রমে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা অত সহজ নয়। সরকার ও সরকারের বুদ্ধিজীবীদের যুক্তিখন্ডন করে আর তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে করতে এগিয়ে চলছে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন।

ভালো নেই দেশের মানুষ

আসলে কেমন আছে দেশের মানুষ? ঈদের ঠিক আগ মুহূর্তে টঙ্গীতে মারা গেলেন ৩৩ জন শ্রমিক। ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন প্রায় ২৬৪ জন। দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদী হামলায় মানুষের জীবনের অনিশ্চয়তাসহ বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত মানুষ। অথচ প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বড় গলায় বললেন যে, বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী আর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই সরকারের আমলেই বিদ্যুতের দাম বেড়েছে আটবার। গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে প্রায় দেড়গুণ। প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই গুম-খুন-হত্যা আর ক্রসফায়ারের গল্প। একটির পর একটি নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। অথচ রাষ্ট্র কোনো একটি ঘটনারও বিচার করছে না। রাষ্ট্র যেখানে নিজেই সন্ত্রাসীর ভূমিকায় অবতীর্ণ, সেখানে অন্য অপরাধীদের বিচার কী হবে তা জনগণ খুব সহজেই বুঝে গিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলন শেষে প্রধানমন্ত্রীর একজন সহযোগী সাংবাদিক বলেছেন যে, আন্দোলনকারীদের সবচেয়ে বড় ধৃষ্টতা এই যে তারা প্রধানমন্ত্রীর দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। প্রধানমন্ত্রীও তাতে সায় দিয়ে বিগলিত হয়ে গেলেন। এর পিছনে আসল যে কথাটি লুকিয়ে থাকে তা হলো সরকার যত জনবিরোধী পদক্ষেপই নিক না কেন, তার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলার অধিকার জনগণের নেই। কারণ তাতে প্রধানমন্ত্রীর দেশপ্রেম নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাবে। ভিন্নমত দমনের এই প্রক্রিয়াটি আরও শক্তিশালী হয় যখন যারা আন্দোলন করছে, তাদের ‘উন্নয়নবিরোধী-স্বাধীনতাবিরোধী’ তকমা এঁটে দেয়া হয়। মাঠের আন্দোলনকে পুলিশ, সরকারি সংগঠন দিয়ে দমন করার চেষ্টা আর ভিন্নচিন্তাকে গায়ের জোরে থামিয়ে দেবার চেষ্টা রাষ্ট্র নিজেই করছে প্রতিমুহূর্তে। জনগণও তাই বিক্ষুব্ধ। কিন্তু দমন-পীড়নের ভয়ে মাঠে নামতে নানা বিবেচনা করছে। এই যে পরিস্থিতি — এর নাম ফ্যাসিবাদ। এর মধ্যেও যারা সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন করছেন তারা আসলে এই ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলা করেই অন্দোলনকে এগিয়ে নিচ্ছেন।

রামপাল চুক্তিতে বাংলাদেশের লাভের থেকে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি

শুরুতে সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিলো যে, দূষণ প্রতিরোধে সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হবে। আন্দোলন শুরু হলে হঠাৎ একলাফে তার জায়গা দখল করলো আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি। প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে, আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি কোনো দূষণ কমানোর প্রযুক্তি নয়। সাব, সুপার, অ্যাডভান্সড ও আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ভাগ করা হয় প্রধানতঃ কয়লা থেকে শক্তিতে রূপান্তরের দক্ষতার উপর। এই টেকনোলজিগুলোর মধ্যকার পার্থক্য নিম্নরূপ-
অর্থাৎ, আলট্রা সুপার টেকনোলজিতে কয়লা ব্যবহারের পরিমাণ যেহেতু কিছুটা কম হবে, দূষণ কিছুটা কমবে। কিন্তু তা পরিমাণে অতি সামান্য।
অথচ সরকার এমনভাবে বলছে যেন ‘সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি’ সকল দূষণের মহৌষধ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই দূষণের মাত্রা সর্বোচ্চ ১০% কমানো সম্ভব। অন্যান্য টেকনোলজি দিয়ে দূষণের পরিমাণ কিছুটা কমানো যেতে পারে, কিন্তু ভারতের এনটিপিসি’র সাথে চুক্তির অসমতা কমানো যাবে কী করে? আমাদের যেসব মন্ত্রী-আমলারা দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে এই চুক্তি করলেন তাদের দুর্নীতি লুটপাট দূর করা যাবে কী করে?
প্রথমত, প্রকল্পের ৭০% অর্থ আসবে ভারতের এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে। এই ঋণের গ্যারান্টার আবার বাংলাদেশ। মানে প্রকল্প চলাকালীন কোনো ধরনের বিপর্যয় দেখা দিলে তা বহন করতে হবে বাংলাদেশকে। আর বাকি ৩০% অর্থ দেবে ভারত ও বাংলাদেশ সমান ১৫% ভাগে। কিন্তু বিদ্যুতের ভাগ হবে সমান সমান। অর্থাৎ, ভারত বিনিয়োগ করবে ১৫%, কিন্তু বিদ্যুৎ পাবে মোট উৎপাদনের ৫০%। আর বাংলাদেশ অনেক বেশি দায়িত্ব নেবার পরও বিদ্যুৎ পাবে ৫০%। এর চেয়ে অসম চুক্তি আর কি হতে পারে?
দ্বিতীয়ত, এই প্রকল্পে প্রতি বছর কয়লা পোড়ানো হবে প্রায় ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন। ফলে হিসেবে প্রতি বছরে বর্জ্য হিসেবে যা যা উৎপাদিত হবে তা হলো:
এই হলো ‘dirtiest fuel on earth’ কয়লা ব্যবহারের ফলাফল। দূষণ রোধে পাওয়ার প্ল্যান্টে বেশ কিছু প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। নিম্নে এই টেকনোলজিগুলোর কার্যকারিতা ও সীমাবদ্ধতাসহ তুলে ধরা হলো-
অথচ, এর প্রত্যেকটি বিষয়ই অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং খোদ আমেরিকাতেই এখনও প্রায় কোনো কারখানাতে সবগুলো প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয় না। Union of Concerned Scientist এর পক্ষ থেকে প্রকাশিত ‘Coal Power: Air Pollution’ এ বিষয়টি এমনই বলা হয়েছে। কয়লা ব্যবহারের কারণ হলো কয়লা বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী। যদি রামপালে দূষণ প্রতিরোধে অনেক মূল্যের প্রযুক্তিই ব্যবহার করতে হয় তাহলে কয়লা ব্যবহারের আর কোনো অর্থ থাকে না। রামপালের ইআইএ রিপোর্টে আমরা দেখতে পাই যে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে যন্ত্রপাতি স্থাপনা খরচ ধরা হয়েছে ১৯৬ কোটি টাকা আর পরিচালনা খরচ হবে ২৯.৪৯ কোটি টাকা। অথচ শুধুমাত্র এফজিডি স্থাপনা খরচ এক হাজার থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা। আর স্থাপনা খরচ বাদ দিলে শুধু পরিচালনা খরচ ৮৩ কোটি থেকে ২০৮ কোটি টাকা। বরাদ্দ না রেখে শুধু এত এত প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিবেশকে সুরক্ষা দেবার কথা ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছু নয়।
তৃতীয়ত, একটি বড় মাত্রার দূষণের সম্ভাবনা রয়ে যাবে কয়লা আনা নেওয়ার সময়। যদি কোনো দুর্ঘটনা নাও ঘটে, তবুও কয়লা আনা নেওয়ার প্রক্রিয়াতে দূষণ ঘটবে। বিশাল এই বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখতে বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন কয়লা লাগবে। এই পরিমাণ কয়লা একবারে আনা স¤ভব নয়। প্রথমে ৮০ হাজার টনের কয়লাবাহী বিশাল জাহাজ থামবে আক্রাম পয়েন্টে। বড় জাহাজ একেবারে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে অতিক্রম করবে হিরণ পয়েন্ট থেকে আক্রাম পয়েন্ট পর্যন্ত। এই রাস্তার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০ কিলোমিটার। এত বড় জাহাজ মংলা বন্দর পর্যন্ত যেতে পারবে না। তাই ১.৫ লাইটেরেজ জাহাজে করে আক্রাম পয়েন্ট থেকে মংলা পর্যন্ত কয়লা আনা হবে। এই রাস্তার দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৭ কিলোমিটার। মংলা থেকে এই কয়লা নিয়ে যাওয়া হবে রামপালে। উল্লেখ্য যে, আক্রাম পয়েন্ট একেবারে সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে। এই বনভূমি পশু-পাখিদের বিচরণক্ষেত্র আর নদীটি মাছদের প্রজননক্ষেত্র। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বড় জাহাজ বছরে ৫৯ দিন এবং লাইটেরেজ করে ২৩৬ দিন যাতায়াত করবে। ফলে পশু-পাখি ও মাছদের জীবন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। প্রতিবার জাহাজ চলাচলের সময় কৃত্রিম ঢেউ তৈরি হবে।
জাহাজ থেকে দূষিত পানিসহ বর্জ্য নিঃসরিত হবে। বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে কয়লা লোড-আনলোডের সময় গুড়া কয়লার ধোঁয়া তেরি হবে এবং মাটি-পানি ও বায়ু দূষণ ঘটাবে। অতিরিক্ত শব্দ তৈরি হবে। রাতে জাহাজ চলাচলে সার্চলাইটের আলো নিশাচর প্রাণীদের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। এমনকি ইআইএ রিপোর্টেও এই দূষণের কথা স্বীকার করা হয়েছে। (সূত্র: প্রস্তাবিত রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবেশ সমীক্ষা; Impact of Coal Transportation, Transhipment and Handling, page 293-294)
শুধু তাই নয়, বড় জাহাজ চলাচলের জন্য নাব্যতা ধরে রাখতে প্রতি বছর ড্রেজিং-এর ব্যবস্থা করতে হবে। ফলে পলি মাটি উত্তোলনের পর বিপুল পরিমাণ মাটি জমা হবে। শব্দ দূষণ ও স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশ ব্যাহত হবে।
চতুর্থত, সুন্দরবন একটি প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ। সিডর, আইলা প্রভৃতিতে সুন্দরবন আমাদেরকে রক্ষা করেছে। এরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবন না থাকলে ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেত ৫-১০ গুণ।
পঞ্চমত, যে উৎপাদিত বিদ্যুৎ তা কিনতে হবে প্রতি ইউনিট ৮ টাকা ৮৫ পয়সায়। অথচ জাতীয় প্রতিষ্ঠান পিডিবি’র নিকট কেনা যাবে ৫ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৬ টাকা ৫০ পয়সায়। তাহলে এত দামে বিদ্যুৎ ভারতের কাছ থেকে কেনার প্রয়োজন কী? খরচ বাড়লে বিদ্যুতের দাম আরও বাড়তে পারে বলে উল্লেখ আছে।
ছোটবেলায় আমরা অংক করতাম, কোনো জিনিসের উৎপাদন খরচ ১০০ টাকা, জিনিসটির বিক্রয়মূল্য ৫৫ টাকা। লাভ কত? প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ এগুলোর তাৎপর্য বুঝতে পারা জ্ঞানের প্রশ্ন, দূরদর্শিতার প্রশ্ন। কিন্তু, সাধারণ লাভ ক্ষতির হিসাবও কী সরকার এলোমেলো করে ফেলেছে?
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষাক্ত ধোঁয়া এভাবেই দূষিত করবে সুন্দরবনকে
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষাক্ত ধোঁয়া এভাবেই দূষিত করবে সুন্দরবনকে

মহাপ্রাণ সুন্দরবনের গুরুত্ব বোঝার সক্ষমতা সরকারের নেই

সুন্দরবন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন। ১৯০৩ সালের হিসেব অনুযায়ী, এখানে আছে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ। নানা ধরনের প্রাণীর মধ্যে আছে লোনা পানির কুমির, গাঙ্গেয় আর ইরাবতী নামের ডলফিন। বনভূমিতে আছে প্রায় ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩২০ প্রজাতির আবাসিক ও অতিথি পাখি, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী আর ৪০০ প্রজাতির মাছ। লোনা আর স্বাদু পানির মিলনস্থল মাছের অন্যতম প্রজনন ক্ষেত্র। আরও আছে আমাদের জানার বাইরের লতা-গুল্ম আর অণুজীব। সব মিলিয়েই সুন্দরবন এক বিশাল প্রাণের সম্ভার। শুধুমাত্র এই সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাব দিয়ে মহাপ্রাণ সুন্দরবনকে বোঝা অসম্ভব। এত বিশাল প্রাণসমষ্টি নিয়ে গঠিত সুন্দরবন এক অবিছিন্ন প্রাণসত্তা। বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই জানেন যে, বনের একটি একক পরিবর্তিত হলে সমগ্র বাস্তুতন্ত্রে তার প্রভাব পড়ে।
বহু যুক্তি সরকার করছে। যেমন, উন্নয়নের জন্য একটু আধটু দূষণ হবেই। এই যে মানুষ গাড়ি, ফ্রিজ, টেলিভিশন ব্যবহার করছে। এগুলোতে কি দূষণ হচ্ছে না? তাহলে কি এগুলো বন্ধ করে দিতে বলেন? কিংবা কয়লা যদি কাভার্ড বার্জে ঢেকে আনা হয় তাহলে সমস্যা কোথায়? কিংবা, ১৪ কিলোমিটার দূরে শব্দ যাবে কিভাবে?
মানুষ আর অন্য প্রাণীদের বসতি এক ব্যাপার নয়। মানুষের চেয়ে পশুপাখিরা প্রকৃতির প্রতি অনেক বেশি সংবেদনশীল। হঠাৎ কিছু গাছ কেটে ফেললে কিংবা কোনো একটি ক্ষুদ্র প্রজাতি প্রাণিজগত থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেলে মানুষের তাৎক্ষণিক কিছু যায় আসে না। কিন্তু পশু-পাখির আসে। আর যেকোনো লোকালয়ের দূষণ আর সুন্দরবনের পাশে বিদ্যুৎকেন্দ্র করা এক ব্যাপার নয়। সুন্দরবন কোনো সাধারণ বনও নয়। এটি হলো বিশেষ ধরনের জলাবন। সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে জালের মতো ছড়িয়ে আছে নদী থেকে আসা খাল। এখানকার উদ্ভিদ-মাছ-জীবজন্তু সমুদ্রের জোয়ার ভাটা, লোনা পানি আর স্বাদু পানির নিয়মচক্রের সাথে মানিয়ে বেড়ে উঠেছে। এটি মানুষ তৈরি করে নি। এটি গড়ে উঠতে সময় নিয়েছে প্রায় দুই লাখ বছর। সুন্দরবনের এই বিশেষত্বের কথা সরকার বাহাদুর ভাবলে এ ধরনের হাস্যকর প্রশ্ন করতে পারতেন কি?

সরকার নাকি প্রয়োজনে আরেকটি সুন্দরবন তৈরি করবে, তবুও রামপালের বিকল্প খুঁজবে না

প্রধানমন্ত্রী তার প্রেস কনফারেন্সে হুমকি দিয়েছেন যে, বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করলে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিবেন। নূন্যতম গণতান্ত্রিক চিন্তা বহিঃপ্রকাশের সৌজন্যও তিনি দেখালেন না। সরকার থেকে বারবার একথাই বলা হচ্ছে যে, বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে, সরকার নিজেই চায় না দেশের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হোক। চাইলে তারা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গ্যাসভিত্তিক বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে, পুরাতন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে আধুনিকায়ন করে কম্বাইন্ড সাইকেলে পরিণত করে বর্তমানে যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ রয়েছে তা দিয়েই সস্তায় গোটা দেশের বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান করতো। বর্তমানে ২০-২৫% সক্ষমতায় ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার করে যে ৪০০০-৪৫০০ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে, আধুনিকায়ন করা হলে একই পরিমাণ গ্যাস থেকে ৮০০০-৯০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সস্তায় ইউনিট প্রতি দেড় থেকে দুই টাকা খরচে উৎপাদন করা যেতো। সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই এই লক্ষ্যে উদ্যোগ নিলে ২০১১ সালের মধ্যেই বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করতে পারতো। জরুরি উদ্যোগে ৬ মাসে পুরাতন বিদ্যুৎকেন্দ্র মেরামত ও আধুনিকায়ন এবং দেড়-দুই বছরে নতুন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হলে কুইক রেন্টালের চেয়ে অনেক কুইক এবং অনেক সস্তায় বিদ্যুৎ সংকটের স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব হতো। বিদ্যুৎ সংকটের সমাধানের লক্ষ্যে এই বিকল্প প্রস্তাবগুলো দেশের বামপন্থী দল ও দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী, জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বহু আগে থেকেই দিয়ে আসছেন।
কিন্তু বিদ্যুৎ খাত নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা অন্যান্য সেবামূলক খাতের মতো ব্যবসায়ীদের হাতে মুনাফার জন্য ছেড়ে দেওয়া। তাই সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে তারা সংস্কার না করে রেন্টাল-কুইক রেন্টালের নামে দেশি-বিদেশি কোম্পানির হাতে দিয়ে দিচ্ছে। বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সামিট, ওরিয়েন্টাল, দেশ, অটবি, এগ্রিকোসহ দেশি-বিদেশি কোম্পানির জন্য বিদ্যুৎ খাতকে লাভজনক করেছে আর দেশবাসীর ওপর বোঝা বাড়িয়েছে। বেশি দামেও যেন মানুষ বিদ্যুৎ কেনে তাই বিদ্যুৎ সমস্যাকে জিইয়ে রাখছে। বিদ্যুৎ খাতকে নিয়ে সরকার লুটপাটের যে পরিকল্পনা করেছে রামপাল তারই একটি অংশমাত্র।
জ্বালানি সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে জাতীয় সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বাপেক্স, পেট্রোবাংলা, জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ, ব্যুরো অব মিনারেল ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলোকে পঙ্গু করার চক্রান্ত বন্ধ করতে হবে। এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে যা তেল-গ্যাস-কয়লা সম্পদ অনুসন্ধান, উত্তোলন এবং তার কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করবে। হাতের কাছে থাকা এসব সমাধানের পাশাপাশি আশু এবং দীর্ঘমেয়াদী কিছু বিকল্প নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। সারা বিশ্ব এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। কারণ তেল, গ্যাস, কয়লা এসব প্রাকৃতিক সম্পদ সবই একদিন ফুরিয়ে যাবে। তাই এখন থেকেই এমন জ্বালানির সন্ধান করা দরকার, যার উৎস প্রাকৃতিকভাবে অফুরন্ত। সেই দিক থেকে দেখলে বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রয়োজনের দ্বিগুণ পরিমাণ উৎপাদন করতে পারবে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ কৌশল বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের অভিসন্দর্ভ থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশে বায়ু থেকে ৫০০০ মেগাওয়াট, সূর্যের আলো থেকে ৫০০০ মেগাওয়াট, বায়োমাস (মানুষের বর্জ্য) থেকে ১০,০০০ মেগাওয়াট, নদীর প্রাকৃতিক স্রোত থেকে ১০,০০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন, আর্থিক সমর্থনদান এবং প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন।

বড়পুকুরিয়া ও দেশের বাইরের বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভুল তথ্য দিয়েছেন

সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেশের দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ার কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছবি দেখিয়েছেন। অক্সফোর্ড এর Didcot, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ভিয়েতনামের কুয়াঙ নিন ও তাইওয়ানের তাইচু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা বলেছেন। বিদ্যুৎকেন্দ্রের রঙিন ছবি দেখিয়ে তার পাশে সবুজ গাছ দেখিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, “কই,সবুজ তো আছে।”
প্রথম কথা হলো,সবুজ আর বন এক কথা নয়। আর যেকোন বন আর সুন্দরবন এক কথা নয়। পৃথিবীর কোথাও সুন্দরবনের মতো সংবেদনশীল জলাবনের পাশে কয়লা বিদ্যুতের উদাহরণ নেই। আমাদের বড় পুকুরিয়াতে কয়লা খনির কয়লা দিয়েই বিদ্যুৎ তৈরি হয়। পরিবহন সংক্রান্ত কোনো দূষণ সেখানে নেই। তারপরও কয়লার দূষণের মাত্রা নিয়ে এলাকার মানুষ শঙ্কিত। সেখানকার পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ বাড়ছে, কৃষি জমি কয়লা দূষণে কালো হয়ে গেছে। ফসল ও মাছে বিষক্রিয়া দেখা দিচ্ছে।
আর দেশের বাইরের যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ছবি তিনি দেখিয়েছেন তা সবই বহু আগে নির্মিত। একসময় পুরো পৃথিবীতেই কয়লা বিদ্যুতের প্রাধান্য ছিল। পরে কয়লা সস্তা হওয়া সত্ত্বেও ধীরে ধীরে সব দেশ কয়লা থেকে সরে আসছে। এর মধ্যে Didcot বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০১৩ সালের মার্চ মাসে যুক্তরাজ্য বন্ধ করে দিয়েছে দূষণের কারণে। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনা করে আমেরিকান ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি। ২০১৪ সালে পানি দূষণের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে এই কোম্পানি জরিমানা দেয়। তারা একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিতে ও দুটিতে দূষণ কমানোর অঙ্গিকার করে। ছবি দেখানো বাকি কেন্দ্রগুলোর ইতিহাস প্রায় একই রকম। এক বেইজিং শহরেই তিনটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা হয়েছে। আগামী বছর চতুর্থটি বন্ধ করা হবে। দূষণ ঠেকাতে চীনে প্রায় ২৫টি এলাকায় কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারতও কয়লা বিদ্যুৎ থেকে সরে আসছে।
পৃথিবীর যেখানেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে সেখানেই পরিবেশ দূষণ সংক্রান্ত ভয়াবহ সমস্যা আছে। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কি সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিখবো নাকি সুন্দরবনকে হারিয়ে তারপর বুঝবো।

বুঝতে হবে পেছনের রাজনীতি, বুঝতে হবে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক

শুধু রামপালে সুন্দরবনবিনাশী বিদ্যুৎ প্রকল্প নয়, সমুদ্রের দু’টি গ্যাস ব্লক ভারতীয় কোম্পানিকে ইজারা দেয়া, তিস্তা-ব্রহ্মপুত্রসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হবার পরও প্রতিবাদ না করা, দেশের অভ্যন্তরে নামমাত্র শুল্কে নৌবন্দর ও রাস্তা ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়া, সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যাসহ দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যার সমাধানে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করা-এমন অসংখ্য বিষয় দেখে বোঝা যায় ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের নীতি কতটা নতজানু। এই অবস্থান যে কেবল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের, তা নয়, বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় আসা সকল সরকারই ভারতের ব্যাপারে এমন নতজানু মনোভাব দেখিয়েছে। কিন্তু কেন এই আনুগত্য? কারণ শাসক দলগুলো লুটপাট আর গদি দখল নিয়েই ব্যস্ত। তাদের সকল নীতি-পরিকল্পনা দেশের পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থের অনুকূলেই প্রণীত। জনগণের ভবিষ্যৎ কোন তিমিরে গিয়ে পড়বে তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। এমন গণবিরোধী শক্তিগুলোর ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকার জন্য দেশের মধ্যে পুঁজিপতিদের সমর্থন এবং দেশের বাইরে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর অনুগ্রহ-আনুকূল্য বড় প্রয়োজন। ভারত এ অঞ্চলের মহা শক্তিধর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। ফলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি-জামাত সকলেই ভারতের সাথে সম্পর্কিত থাকতে চায়। এই সময় সেই প্রয়োজন আরও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কেননা বর্তমান সরকার জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়াই দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেছে। তারা মনে করছে, ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে ভারত সরকারের অনুগ্রহের কোনো বিকল্প তাদের কাছে নেই। তাই হাজার যুক্তির পরও তারা রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে এমন একগুঁয়ে মনোভাব প্রদর্শন করছে। এখানে আরেকটি কথাও স্মরণ রাখা প্রয়োজন, ভারতের শাসকগোষ্ঠী এবং ভারতের জনগণ এক নয়। ভারতের জনগণও এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধিতা করছে। কেননা সুন্দরবন ধ্বংস হলে তা ওই দেশের জনগণের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনবে। ভারত সরকার তাদের দেশে এনটিপিসি কোম্পানির মাধ্যমে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে চেয়েছিলো। কিন্তু কয়েকটি রাজ্যে জনগণের আন্দোলনের কারণে প্রকল্প বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। তাই বাংলাদেশ-ভারতের সংগ্রামী জনতার স্বার্থ এক সুরে গাঁথা।

ছাত্র-যুব শক্তিই একমাত্র ভরসা মহাপ্রাণ সুন্দরবন বাঁচানোর আন্দোলনে শামিল হোন

3-copy
সরকার উন্নয়ন বলে চারিদিকে রব তুলছে। শহরে, নগরে, মহাসড়কের পাশ ঘেঁষে বিশাল বিলবোর্ডে উন্নয়নের ঢাক-ঢোল বাজছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু উন্নয়নের সুফল কারা ভোগ করছে, জনগণের স্বার্থ কতটুকু-এ প্রশ্ন যেন তোলাই যাবে না। সরকার প্রচার করছে, আন্দোলনকারীরা দেশের উন্নয়ন চায় না। এ দেশের মানুষ অভিজ্ঞতা দিয়ে জানে, অতীতের সব সরকারই উন্নয়নের জিগির তুলে দেশের সর্বনাশ করেছে। দেশের শিল্প কল-কারখানা বন্ধ করে, দেশের প্রাকৃতিক গ্যাস বিদেশীদের হাতে তুলে দিয়েছে। এ সরকারও তার ব্যতিক্রম নয়। একথা ঠিক যে, দেশে মহাসড়কের পরিসর বাড়ছে, বিরাট বিরাট ফ্লাই-ওভার হচ্ছে, সেতু হচ্ছে, ব্যয়বহুল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে, চোখ ধাঁধানো বহুতল মার্কেটে ছেয়ে যাচ্ছে দেশ। কিন্তু তারপরও আপামর শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব হচ্ছে কতটুকু? প্রতি বছর নতুন নতুন খাতে ট্যাক্সের বোঝা বাড়ছে। সীমিত আয়ের মানুষের ব্যয়ের বোঝা বাড়িয়ে দিয়ে জীবনের নিরাপত্তা ও পরিবেশ নষ্ট করার নাম উন্নয়ন নয়। নদী, বন, জলাভূমি ধ্বংস করাকে উন্নয়ন বলা যায় না। স্বাধীনতার পর থেকে এ ধরনের তথাকথিত উন্নয়নে একদল দেশী-বিদেশী লুটেরারা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। কিন্তু জনগণের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটে নি। একদিন এদেশে আদমজী পাটকল ছিল পৃথিবীখ্যাত শিল্প-কারখানা। শিল্প উন্নয়নের নামে বিএনপি-জামাত সরকার বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ-এর পরামর্শে সেটা বন্ধ করেছে। বেকার হয়েছে শ্রমিক, নিঃস্ব হয়েছে পাটচাষী। সর্ববৃহৎ পাটকল এখন শুধুই স্মৃতি। এবার বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে মহাজোট সরকার। সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে হয়তো কয়েক দশক পরে সুন্দরবনও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ইতিহাসে পরিণত হবে। ভবিষ্যতের কাছে তখন আমরা কী জবাব দিব?
তরুণ-যুবকেরা যাতে আন্দোলনে যুক্ত না হয় সে জন্য চলছে নানা অপপ্রচার। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচার করছে- ‘একটি ছেলে কিছুই না জেনে শুধুমাত্র হুজুগে রামপালবিরোধী কর্মসূচিতে যাচ্ছে।’ এভাবে একদিকে এই আন্দোলনের বড় শক্তি ছাত্র-তরুণদের তারা হেয় করেছে। অন্যদিকে দলীয় সংগঠন ও পুলিশি আক্রমণ চালিয়ে ভয়-ভীতির মাধ্যমে আন্দোলনের শক্তিকে বাধাগ্রস্ত করছে। কিন্তু, দিন যত যাচ্ছে আরও বেশি ছাত্র-তরুণেরা যুক্তি, নৈতিকতা এবং সৃজনশীলতার জোরে বাসযোগ্য বাংলাদেশ নির্মাণের দায়িত্ববোধ থেকে এ আন্দোলনে শামিল হচ্ছে। আন্দোলনের তরফ থেকে সরকারকে বিতর্কে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে, গণভোট আয়োজন করে জনমত যাচাইয়েরও প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু সরকার তার সিদ্ধান্তে অনড়।
তাই লড়াইটা যদি শুধু যুক্তির হতো তাহলে এ প্রশ্নের মীমাংসা বহু আগেই হয়ে যেতো। সম্প্রতি জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউনেসকোও বাংলাদেশ সরকারকে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের সুপারিশ করেছে। কিন্তু সরকার কোনো যুক্তি শুনতে নারাজ। তবুও আমাদের যুক্তির লড়াই চালিয়ে যেতে হবে জনগণকে আরও সচেতন করার প্রয়োজনে। আর তার পাশাপাশি বজায় রাখতে হবে মাঠের লড়াই। সম্প্রতি শ্রীলংকার সরকার এনটিপিসির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি বাতিল করেছে আন্দোলনের মুখে। অতীতের ফুলবাড়ি আন্দোলন, গ্যাস ব্লক ইজারা দেবার আন্দোলন, বন্দর রক্ষার আন্দোলন আমাদের সামনে শিক্ষা রেখে গেছে যে কীভাবে দেশের জাতীয় সম্পদকে দেশী-বিদেশী আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা করতে হয়। তাই, প্রয়োজন সক্রিয় অংশগ্রহণের, প্রয়োজন সাহসের সাথে মাঠের লড়াইকে আরও শক্তিশালী করা। এই মাঠের শক্তিই শেষ অবধি ফয়সালা করবে কী হবে সুন্দরবন তথা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।
তথ্যসূত্র :
১. বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প আছে সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নাই — তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি
২. বাসদ ( মাকর্সবাদী) কর্তৃক প্রকাশিত সাম্যবাদ (বুলেটিন)
৩. ইআইএ রির্পোট
RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments