সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়নের বীজ রাষ্ট্র ও সমাজকাঠামোর মধ্যেই নিহিত
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে একটা বিখ্যাত গান ছিল, ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খৃষ্টান, বাংলার মুসলমান/আমরা সবাই বাঙালী’। কেমন দেশ আমাদের সংগ্রামী পূর্বসূরীরা চেয়েছিলেন এ গানে তা ফুটে উঠেছে। কিন্তু ৪৫ বছর পর যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা বা সমাজ চিত্র আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান, তাতে এ ভাবনা অস্বাভাবিক নয়— বাংলাদেশ এখন বিশেষ এক সম্প্রদায়ের দেশ, অন্যরা এখানে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক! ধর্ম ভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রেও প্রায় সমস্ত অংশের মানুষ যেমন নিপীড়িত ছিল; সবচেয়ে বেশি অত্যাচারের শিকার হয়েছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। এদের একটা বড় অংশই ’৪৭ এ অনেক ব্যাথা নিয়ে দেশ ছেড়ে গিয়েছিল। পিতৃভূমিকে ভালোবেসে যারা থেকে গিয়েছিল, ২৩ বছরের পাকিস্তান রাষ্ট্রে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। অধিকার বঞ্চিত মানুষের লড়াই গড়ে উঠলে পাকিস্তানীরা বার বার সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিয়েছে। ধর্মীয় বিভাজনের সংকীর্ণ চিন্তায় আবদ্ধ করে শোষণমূলক রাষ্ট্রের স্বরূপ মানুষের কাছে আড়াল করেছে । এজন্য ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করেছে। এমনকি দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টাও করেছে, লাগিয়েছেও। হিন্দুর সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি ঘোষণা করে ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ করা হয়েছিল।
দীর্ঘ সংগ্রামের পরম্পরায় গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষাগুলো মূর্ত হয়ে উঠেছিল। কথা ছিল এমন রাষ্ট্র হবে, যেখানে ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে কোনো প্রকার বৈষম্য থাকবেনা,সকল প্রকার শোষণের অবসান ঘটবে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার হবে না; রাষ্ট্র হবে ধর্ম নিরপেক্ষ। কিন্তু বিশ্ব পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের ক্ষয়ের এ যুগে পুঁজিপতি শ্রেণীর বিদ্যমান রাষ্ট্রের কাছে এ চাওয়া কেবলই সোনার পাথর বাটি— ৪৫ বছরে কি এটা হাড়ে হাড়ে বোঝা হয়নি?
রামু থেকে নাসির নগর— সব ঘটনার প্রকৃতি ও লক্ষ্য একই
গত নভেম্বরে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নাসির নগরে হিন্দু জনগোষ্ঠীর মন্দির, বাড়ি-ঘরে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে ফেসবুকে একটি ছদ্ম আইডির মাধ্যমে দেয়া পোস্টকে কেন্দ্র করে। জনৈক রসরাজ দাসের নামে এ ফেসবুক আইডিতে ইসলাম ধর্মের অবমাননা করা হয়েছে— এরকম অপপ্রচার করে হামলার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। ইউএনও, এমপি-মন্ত্রী সহ স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ এ ঘটনায় সরাসরি ইন্ধন দিয়েছেন, কেউ প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়েছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ ওঝা সেজে পরবর্তীতে ছুটে গেছেন। কিন্তু ঘটনার হোতাদের কাউকেই বিচারের আওতায় আনা হয়নি।
কক্সবাজারের রামুতে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জনৈক উত্তম কুমার বড়ুয়ার ফেসবুক থেকে কুরআন অবমাননার অভিযোগে ১২ টি বৌদ্ধ বিহার ও মন্দির এবং বৌদ্ধদের চল্লিশটি বাড়িতে আগুন দেয়া ও লুটপাটের ঘটনা সংঘটিত হয় স্থানীয় উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি, মৎসজীবী লীগের সভাপতিসহ স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী সরকারি দলের লোকজন দ্বারা। বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরাও তাতে যোগ দিয়েছিল। ৩০ সেপ্টেম্বর পটিয়ায় বৌদ্ধ ও হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে ও মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটে।
পাবনার সাথিয়ায় স্থানীয় ক্ষমতাধরদের চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে ফেসবুকে ছদ্ম আইডি তে মহানবীকে কটুক্তি করার অজুহাত তুলে জনৈক রাজীবকে বলির পাঠা বানিয়ে যখন তান্ডব চলছিল,স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অদূরেই ছিলেন। থানা ছিল ৫ মিনিট দূরত্বে। অথচ ঘর-বাড়ি পোড়ানোর দেড় ঘণ্টা পর পুলিশের দেখা মেলে। এ ঘটনার সঙ্গেও স্থানীয় আওয়ামী প্রভাবশালীরা যুক্ত ছিল।
যশোরের মালো পাড়ায় (২০১৪ সালের জানুয়ারিতে) হামলা হয় মূলত আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর হেরে যাওয়ার প্রতিশোধ হিসেবে।
উপরের প্রত্যেকটি ঘটনায় দেখা যায়, সরকারের স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের স্বার্থজনিত বিরোধ, চাঁদাবাজি, হিন্দু জনগোষ্ঠীর বাড়ি-ঘর দখল, আতঙ্ক তৈরী করে জায়গা ছেড়ে দিতে বাধ্য করা ইত্যাদি নানা মনোবৃত্তি কাজ করেছে। অন্তত ৩টি ঘটনায় কাজে লাগানো হয়েছে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে ঘটনাগুলোর সাথে জড়িত কারোরই বিচার করা হয়নি। এভাবেই বার বার সাম্প্রদায়িক হামলার প্রেক্ষাপট তৈরী হয়েছে আর আতঙ্কে-নিরাপত্তাহীনতায় দেশ ছেড়ে যাচ্ছে হিন্দু জনগোষ্ঠী। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী দেশে হিন্দু জনসংখ্যা ১০ লাখ কমেছে। অধ্যাপক আবুল বারাকাত গবেষণা করে দেখিয়েছেন, বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনরাই হিন্দু জনগোষ্ঠীর জমি-সম্পদ দখল করেছে। পত্রিকায় একজন খুব আক্ষেপ করে বলেছেন, সরকার/আওয়ামী লীগ মনে করে দেশে থাকলে ভোট আমার, চলে গেলে জমি আমার।
কেবল ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী নয়,
অব্যাহত নিপীড়নের শিকার সমতল-পাহাড়ের আদিবাসীরাও
গোবিন্দগঞ্জের বন্ধ চিনিকলের জমি যা পাকিস্তান আমলে সাঁওতালদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছিল, তা ফেরত দেবার দাবি তুলে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চলছিল। এর মধ্যেই সাঁওতালদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ৪ জনকে হত্যা করা হয়। এতেই শেষ হয়নি, পরবর্তীতে তাদের আড়াই হাজার ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। প্রশাসনের সহযোগিতায় স্থানীয় এম.পি চেয়ারম্যানসহ আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এর বিরুদ্ধে সারা দেশে প্রবল ধিক্কার উঠলেও দোষীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। পাহাড়ে প্রায় প্রতিদিনই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। পাহাড়ীদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে, বাঙ্গালী-পাহাড়ী বিরোধ জিইয়ে রেখে ও ইন্ধন যুগিয়ে রাষ্ট্র এ ভয়ঙ্কর আক্রমণ চালাচ্ছে।
রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোর মধ্যেই সাম্প্রদায়িকতার বীজ নিহিত আছে
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে যে দেশ সৃষ্টি করলো, মাত্র ৪৫ বছরে সে দেশে জনগণের মধ্যে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার এমন মানসিকতা তৈরী হলো কেমন করে? কারাই বা করলো? আমরা জানি অর্থনীতি হলো সমাজের ভিত্তি । এর পরিপূরকভাবে রাজনীতি ও সংস্কৃতি গড়ে উঠে। যে বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রের অবসান চেয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, স্বাধীনতার পর তার কোনো হেরফের হয়নি। শাসন কাঠামোতে গণতান্ত্রিকতা ক্রমাগত সংকুচিত হয়েছে। আকাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার পরিপূরক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার সংগ্রাম পরিহার করে শাসক দলগুলো জনগণকে ক্রমাগত বিভক্ত করে ভোটের রাজনীতির স্বার্থ হাসিল করেছে। শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে বৈষম্যমূলক বিভিন্ন ধারা এবং বাণিজ্যিকীকরণের নীতির ফলাফলে সমাজবিচ্ছিন্ন, আত্মকেন্দ্রিক, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, যুক্তিহীন মনন তৈরী হয়েছে। সামরিক স্বৈরশাসকেরা তাদের গণবিরোধী রাজনীতিকে আড়াল করতে মুসলিম ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়েছে। কেউ ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পথ উন্মুক্ত করেছে, কেউবা ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বানিয়েছে। পরবর্তী শাসকরা ক্ষমতার স্বার্থে এর সুবিধা নিয়েছে। জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে কেউ শরীক, কেউবা তাদের সাথে কৌশলগত ঐক্য করেছে। এভাবে রাষ্ট্র ও সমাজ অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধ বিনষ্ট হয়েছে।
দুর্নীতি-লুটপাটের বিদ্যমান ব্যবস্থায়, স্তরে স্তরে এমন একটি জবরদস্তির সংস্কৃতি দাঁড়িয়েছে, যার শিকার হচ্ছে সমাজের দুর্বল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। এটি যেমন একটি দিক, পাশাপাশি জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা ও দাবি তুলে ধরে যথার্থ সংগ্রামী রাজনৈতিক ধারার অনুপস্থিতিও বড় ব্যাপার। বদ্ধ জলাশয়ে শ্যাওলা জন্মানোর মতই এরকম প্রেক্ষাপটে সমাজের মধ্যে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও গোঁড়ামির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগে জনগণের মধ্যে ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়গত বিভেদ উস্কে দিয়ে নির্বিচার লুট ও দখলবাজীর রাজত্ব কায়েম করছে।
কিছু বিভ্রান্তিকর চিন্তা
নাসিরনগরে ঘটনার পর সারা দেশে প্রতিবাদ হচ্ছে, সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের লোকজনের প্রত্যক্ষ ভূমিকা স্পষ্ট হওয়ার পরও কেউ কেউ জামায়াতী অনুপ্রবেশকারীরা করেছে— এরকম ব্যাখ্যা দিয়ে তাদের সংশ্লিষ্টতাকে আড়াল করতে চাইছেন। কেউ ’৭২ এর সংবিধানে ফিরলেই সমাধান— এরকম পথ্য হাজির করেছেন। ৪৫ বছরের শোষণ-বঞ্চনার ভিত্তির উপর শাসকদের গণবিরোধী ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার যে পরিবেশ সৃষ্টি হলো, তার বিরুদ্ধে পাল্টা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগ্রাম না করে কতগুলো শব্দমালা সংবিধানে জুড়ে দিলে অথবা সংবিধান অক্ষত থাকলেই কি এ অবস্থার অবসান হবে? অথবা বাংলাদেশ ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ— এ জাতীয় উচ্চারণও কার্যত মিষ্টি কথায় ক্ষত সারানোর মত ব্যাপার।
উত্তরণের পথ কি?
হিন্দু, বৌদ্ধ, সাঁওতাল- যেই হোক, ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয় তার গৌণ পরিচয়। আসল পরিচয় সে এদেশেরই মানুষ। কিন্তু দেশের হিন্দু বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এ পরিচয়ে নিজেদের ভাবতে পারছেন কি? শঙ্কা-নিরাপত্তাহীনতায়-অপমানে নিজের অস্তিত্বই অনুভব করতে পারছেন না। যারা এত নিপীড়ন সত্ত্বেও বিএনপি-জামায়াত থেকে আওয়ামীলীগকে মন্দের ভাল হিসেবে নির্ভরযোগ্য মনে করছেন, তারা চরিত্রগতভাবে কতটুকু তফাৎ খুঁজে পাচ্ছেন? এভাবে ৪৫ বছর তো পার হলো! আজ হামলা কেবল হিন্দুদের ওপর নয়, অন্য ধর্মীয় জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়— শিয়া, সাঁওতাল, পাহাড়ী কেউ কি আক্রমণের বাইরে আছেন? প্রতিদিনই কত অবর্ণনীয় নির্যাতনের মুখোমুখি হচ্ছেন এদেশের নারীরা। মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণীর কর্তৃত্বে থাকা এ রাষ্ট্রে/সমাজে দুর্বল, অসংগঠিত, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পদে পদেই আক্রমণের শিকার। ক্ষমতাশালী ক্ষুদ্র গোষ্ঠী কর্তৃক জায়গা-জমি দখল, নদী দখল, খাস জমি দখল, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট কি না হচ্ছে। কিন্তু নিপীড়িতের পক্ষে দাঁড়ায় কে? খেয়াল করলে দেখা যাবে নাসিরনগর বা সাঁওতাল পল্লীতে ক্ষমতাশালীরা আক্রমণ করেছে কিন্তু নিপীড়িত মানুষদের আশ্রয় দিয়েছে, বাঁচানোর চেষ্টা করেছে সাধারণ মানুষ। প্রতিরোধের শক্তি নিহিত এখানেই। কেবল হিন্দু জনগোষ্ঠীর বা নিজ নিজ সম্প্রদায়ের ঐক্য সাধনের মধ্য দিয়ে এর সমাধান হবে না। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের পথপরিক্রমায় বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের পথেই কেবল এর অবসান হতে পারে।