এক কঠিন সময়ে স্ট্যালিন তাঁর পূর্ণ মহত্ত্ব নিয়ে আমাদের চোখের সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন- আমরা তাঁকে দেখেছি সমগ্র বিশ্বজুড়ে প্রগতির রাজপথে সগর্বে পদচারণা করতে। তাঁর আপন জন্মভূমি গুর্জির পাহাড়ী পথ তিনি লঙ্ঘন করে চলেছেন, ডন আর ভল্গার মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ রণাঙ্গন তিনি অতিক্রম করছেন, মস্কোর নির্মীয়মান সুবিশাল সড়কে তাঁর দৃপ্ত পদক্ষেপ, জনকোলাহলে পূর্ণ সাংহাইয়ের বাজারে তাঁর উপস্থিতি, ফ্রান্সের পাহাড়ী উপত্যকায় তিনি হাঁটছেন। ব্রাজিলের রণ ভূমিতে তাঁর পদচিহ্ন, রোমের বিশাল প্রাঙ্গনে তাঁর দীর্ঘতম ছায়া, ভারতবর্ষের অসংখ্য গ্রামে তিনি বিচরণ করেছেন- পর্বত-শিখরকে তিনি মাপছেন তাঁর পদচিহ্নে।
স্ট্যালিনের শেষকৃত্যের সময় যখন এসেছে, তখন প্যারিসের এক বেকার যুবক, গোলাপ ফুলের মালায় সজ্জিত তাঁর প্রতিকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে একগুচ্ছ ভায়োলেট ফুল নিবেদন করল তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে— ‘আজ আমি রুটি না কিনে সে পয়সায় ওঁর জন্য ফুল কিনলাম।’ তুরিনের সমস্ত কলকারখানা স্তব্ধ হয়েছিল, সিসিলিয় কৃষিশ্রমিকেরা নিশ্চুপ নিস্তব্ধ দন্ডায়মান ছিল, জেনোয়ার বন্দর শ্রমিকেরা বন্ধ করে দিয়েছিল তাদের সমস্ত কাজকর্ম। সবাই যেন স্ট্যালিনের শবযাত্রার যাত্রী। পুরনো পিকিঙে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা জড়ো হচ্ছিল শহরের সীমানা ছাড়িয়ে বিশাল ময়দানপ্রান্তে, তাদের পরম সুহৃদের জন্য শোক প্রকাশ করতে। আর্জেন্টিনার চারণভূমিতে এক গাড়োয়ান পথ চলতে চলতে ‘শোক’ শব্দটি উচ্চারণ করে থমকে দাঁড়াল আর সেই মুর্হূতে সে ও তার গাড়ীর যাত্রী উভয়ে স্ট্যালিনের জন্য শোক ব্যক্ত করল। কোরিয়ার ভগ্নস্তুপের মধ্যে সেই সব মায়েরা যারা মানুষের দুর্ভাগ্যের সমস্তরকম অভিজ্ঞতা নিজেদের জীবনে সঞ্চয় করেছে, তারা আনতচক্ষে স্ট্যালিনকে স্মরণ করল। পুলিশ, গুপ্তচর আর অত্যাচারীদের ভিড়ের মধ্য থেকে নিউইয়র্কের সৎ ও শুভবুদ্ধির মানুষেরা শোকস্তব্ধচিত্তে বলে উঠল— “বিশ্ব শান্তির বন্ধু চলে গেলেন”।
আমাদের শত্রুরা ভেবেছিল, এই মহান শোকের সময় আমরা একা হয়ে যাব, আমাদের কোনো সমব্যথী থাকবে না। একথা সত্য, আমাদের শোক এতই মর্মান্তিক, যা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। যারা পৃথিবীর প্রতিটি জিনিসকে ডলার-সেন্টে পরিমাপ করে, সেই সব ভ্রষ্টাচারীরা কখনোই এমন একজন মহান মানুষকে হারানোর বেদনা উপলব্ধি করতে পারবে না। কিন্তু এই সংকটময় মুর্হূতে আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম, আমাদের বন্ধুর সংখ্যা কত- আমাদের শোক সারা মানবজাতির শোকে পরিণত হয়েছে।
ব্রাজিলের ক্ষেতমজুর, যে স্বপ্নেও মস্কোর কোনো বাজারের ছবি আঁকতে পারে না, ভাবতে পারে না, সোভিয়েতের গ্রামে কীভাবে লোকে জীবনযাপন করে, কোনো রাশিয়ানকে সে হয়তো জীবনে চোখেই দেখেনি, সে কোনওদিনও বরফাচ্ছাদিত জমি দেখেনি, সে জানেইনা ছুটিতে বিশ্রাম কি জিনিস। বহুশতাব্দীধরে সে উদয়াস্ত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে আসছে, তার জীবনে খুশির মুহূর্ত খুবই দুর্লভ। কিন্তু সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের মতই প্রশস্ত তার হৃদয় এবং সেই হৃদয়ে সেই মানুষটির জন্য ভাবনা সঞ্চিত আছে, যে মানুষটি পৃথিবীর অন্য প্রান্তে বাস করে এবং সকলের কল্যাণ কামনা করে। রোগাপাতলা সেই কৃষ্ণবর্ণের ক্ষেতমজুরটি জানে যে মস্কো নামে এক শহর আছে, যেখানে স্ট্যালিন বাস করেন। এই নাম তাকে নিরন্তর মাথা উঁচ করে বেঁচে থাকার প্রেরণা যুগিয়েছে।
ইতালি ও ফ্রান্সে ফ্যাসিস্ট জল্লাদদের দেওয়া মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত কমিউনিস্টরা, যাঁরা সাহসের সাথে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তাঁরা মৃত্যুর পূর্ব মুর্হূত পর্যন্ত যে চিঠি গোপনে পাঠাতে পেরেছিলেন, সেখানে তাঁদের প্রিয় নামের সাথে আর একটা নামও স্মরণ করেছিলেন- সে নাম হলো স্ট্যালিন। ফাঁসিকাঠে ঝোলানোর এক ঘন্টাআগে, রেবার, গেস্টাপোর চরম অত্যাচারে যে চলৎশক্তিহীন, তিনি স্ট্যালিনের নামে চিঠি লিখেছিলেন। স্ট্যালিনের নাম মুখে নিয়ে গ্যাব্রিয়েল পেরী আর ড্যানিয়েল কামানোভা বীরত্বের সাথে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন। স্ট্যালিনের নাম উচ্চারিত হয়েছিল সেই সব বীরদের কণ্ঠে যাঁরা মহাচীনে লংরুট মার্চে অংশ নিয়েছিলেন, উচ্চারিত হয়েছিল দেশের স্বাধীনতার জন্য শহীদ হওয়া ক্যান্টনের সেই বীরদের কণ্ঠে। স্ট্যালিনের নামই ভিয়েতনামীদের স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রেরণা দেয়। স্ট্যালিনের শিকড় ছিল আমাদের ইতিহাসের গভীরে- আমাদের জন্মভূমির বিশাল প্রান্তরে প্রোথিত। কিন্তু মহীরুহ হয়ে তিনি দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে গিয়েছিলেন।
সেইসব ভয়ংকর দিনগুলি, যখন ফ্যাসিস্টদের হাতে সমগ্র মানবজীবন, সংস্কৃতি সবই প্রায় ধ্বংসের মুখে, তখন স্ট্যালিন মুক্তিফৌজকে রণাঙ্গনে নামালেন, সেই বাহিনীকে নেতৃত্ব দিলেন। পরাধীন দেশের বীর প্রতিরোধকারীদের- লিমুসিন, পিয়েদমন্ত, পোল্যান্ড আর শ্লোভাকিয়ার গেরিলাবাহিনীকে। প্রাগ, অসলো, এথেন্স আর তারানার বীরসন্তানদের তিনিই উদ্দীপ্ত করলেন, যার ফলশ্রুতিতে অচিরেই আমরা জয়লাভ করেছি। ফ্যাসিস্টদের পরাজয়ের পর যখন ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের দরজা উন্মূক্ত হলো, তখন মৃত্যুর মুখ থেকে জীবনের আলোয় ফিরে আসা নারীপুরুষের দল আনন্দাশ্রুভরা চোখে স্ট্যালিনের জয়ধ্বনি করেছিল। সারাবিশ্বের মানুষ স্ট্যালিনের সত্তুরতম জন্মদিনে তাঁর কাছে বহুমূল্যবান উপহার পাঠিয়েছিল। উপহারগুলো বহুমূল্য, তার কারণ সেগুলি যুদ্ধের স্মারক সম্বলিত। যেমন ফ্রান্সের লোকেরা পাঠিয়েছিল একটি কলম, যা ভরা ছিল ব্যালাবিয়েন দুর্গের মাটিতে। যে যুগে ফরাসী দেশপ্রেমিকদের নাৎসীরা গুলি করে হত্যা করত, সেই বীরেরা নিজের দেশের জয়, মানবতার জয়, এবং স্ট্যালিনের জয় কামনা করে মৃত্যুবরণ করেছে।
স্ট্যালিন ছিলেন এক মহান সেনানায়ক। তিনি যুদ্ধকে ঘৃণা করতেন। যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্বন্ধে তিনি ভালোমতো ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি এমন এক বাহিনীর নায়ক ছিলেন, যারা শান্তির জন্য যুদ্ধ করেছে। যিনি স্তালিনগ্রাদের ভগ্নস্তুপে দাঁড়িয়ে শপথ নিয়েছিলেন যে, এই গণহত্যাকারী দস্যুদের বিনাশ না করে আমরা বিশ্রাম নেব না। সকলেই জানে তারা কারা, যারা জনগণের বিজয়কে কলঙ্কিত করেছে, যারা আবার আর একটি যুদ্ধ বাধাবার চক্রান্ত করছে।
আজ এই শোকের দিনে, সারা বিশ্বজুড়ে যারা শান্তির পক্ষে, তাদের রাজনৈতিক চিন্তা যাই হোক না কেন তারা সকলেই স্ট্যালিনের কাছে ঋণ স্বীকার করেন। হ্যাঁ, স্ট্যালিনই সেই ব্যক্তি, যিনি আর একটি যুদ্ধ বাধাবার চক্রান্তকে ব্যর্থ করার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে কোটি কোটি জনগণকে এবং হাজারো শহর নগরকে রক্ষা করেছেন। সেজন্যেই রোমের আলোকিত প্রাঙ্গনে তাঁর প্রতিকৃতি শোভা পায়, আর সেখানে উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা আছে, “স্ট্যালিনই শান্তি”। মিসিসিপি রাজ্যের ছোট্ট এক গ্রামে এক নিগ্রো শ্রমিক আমাকে বলেছিল-“ওরা আমাদের হত্যা করার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যেতে চায়, কিন্তু স্ট্যালিন তা হতে দিচ্ছেন না।” ডেনমার্কের একজন খুব সাধারণ, পাঁচসন্তানের জননী বলেছিলেন- ‘আমার সন্তানদের জন্য আমার কোন ভয় নেই, স্ট্যালিন ওদের রক্ষা করবেন।’ চীনের গ্রামে আমি স্ট্যালিনের ছবি দেখেছি। প্রশ্ন করলে তারা বলেছে- ‘ উনি আমাদের বাড়ি ঘর সব কিছুর রক্ষার্কতা।’
স্ট্যালিন সর্বদা জাতির স্বাধীনতার স্বপক্ষে কথা বলেছেন। আজ সমস্ত জাতিগুলিই একথা উপলব্ধি করতে পারছে যে, স্বাধীনতা ছাড়া প্রতিরক্ষার কথা অর্থহীন। তাই বিশ্বে যে সমস্ত জাতি বা দেশ গোপন বা প্রকাশ্য আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে তাদের দেশে বিদেশী সামরিক ঘাঁটির বিরুদ্ধে, সেই লড়াইয়ে স্ট্যালিন তাদের সহযোদ্ধা।
শান্তির সংগ্রামের এই মহান সেনানায়কের মৃত্যুতে বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের শোকাভিভূত হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু একথাও সত্য যে, স্ট্যালিন মৃত্যুহীন। তিনি কেবল তাঁর আপন কীর্তির মধ্যে জীবিত নেই, জীবিত নেই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশাল শক্তির মধ্যে। তিনি জীবিত রয়েছেন কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে। তাই স্ট্যালিনের হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হলে সারা বিশ্বের শোকসন্তপ্ত মানুষের হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়। সারা পৃথিবীর মানুষকে শান্তি ও সুখী জীবনের লক্ষ্যে স্ট্যালিনই একসূত্রে গেঁথেছেন। তাই সোভিয়েত জনগণের সঙ্গে সারাবিশ্বের প্রগতিশীল জনগণও উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করবে- স্ট্যালিনের মৃত্যু নেই, তিনি মৃত্যুহীন।
(মহান নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষ পদাপর্ণ উপলক্ষে আমরা সাম্যবাদে নভেম্বর বিপ্লব ও মহান মনীষীদের উপর ধারবাহিকভাবে লেখা প্রকাশ করছি। এ সংখ্যায় মহান স্ট্যালিনের উপর বিখ্যাত রুশ সাহিত্যিক ইলিয়া এরেনবুর্গের লেখাটি ছাপা হলো।)