মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নতুন করে সেনা অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় তারা পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। এবারের ঘটনার সূত্রপাত হয় গত ৯ অক্টোবর ২০১৬ মংডু এলাকায় ৩টি সীমান্ত চৌকিতে সশস্ত্র হামলায় ৯ পুলিশ সদস্য খুন ও অস্ত্র লুটের ঘটনার মধ্য দিয়ে। মিয়ানমার সরকার এ হামলার জন্য দায়ী করেছে রোহিঙ্গা মুসলিম জঙ্গীগোষ্ঠীকে। ঘটনার পর থেকে সন্দেহভাজন জঙ্গীদের ধরার জন্য সেনাবাহিনী ও পুলিশ রোহিঙ্গা এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে। তল্লাশির নামে শত শত বাড়ীঘরে আগুন দেয়া হয়েছে, অন্তত ৩০ হাজার রোহিঙ্গা গৃহহারা হয়েছে, নিহত হয়েছে শতাধিক। সর্বশেষ ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিতওয়েতে রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উভয়পক্ষে দেড় শতাধিক নিহত হয়েছিল, প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার রোহিঙ্গাকে ঘরবাড়ি ও জমি থেকে উচ্ছেদ করে আশ্রয় শিবিরে রাখা হয়েছে। সেবার ঘটনার সূত্রপাত হয় একজন বার্মিজ নারীকে গণধর্ষণ ও খুনের পর। রাখাইনরা এজন্য রোহিঙ্গাদের দায়ী করে এবং উত্তেজিত জনতা বাস থেকে নামিয়ে ১০ জন রোহিঙ্গা মুসলিমকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এর প্রতিক্রিয়ায় দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা বেধে যায়। ওই ঘটনার পর রোহিঙ্গাদের ওপর আরো বেশি রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন নেমে আসে। তখনও হাজারে হাজারে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। এর আগে ১৯৭৮, ১৯৯১ সালে বড় আকারে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে লাখে লাখে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
‘রাষ্ট্রহীন’ নিপীড়িত এই রোহিঙ্গাদের দুর্দশার যেন শেষ নেই। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বাঙালী অভিবাসী মনে করে। সে কারণে তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। ১৯৮২ সালে প্রণীত সেখানকার নাগরিকত্ব আইন অনুসারে বার্মা ভূ-খন্ডে ঐতিহাসিকভাবে বসবাসরত ১৩৫টি নৃ-গোষ্ঠীর তালিকায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নাম রাখা হয়নি। নাগরিকত্ব না থাকার কারণে তারা ভোটাধিকার, জমির বৈধ মালিকানা, সরকারি চাকরি-স্বাস্থ্যসেবা-শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এমনকি ভ্রমণ-বিয়ে-সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রেও সরকারি অনুমোদন নিতে হয়। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা বর্তমানে আনুমানিক ৮-১০ লাখ। বাংলাদেশে দুটি শরণার্থী শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা আছে ৩২ হাজার জন, এর বাইরে অবৈধভাবে বসবাস করছে অন্তত ৫ লাখ। আরো কয়েক লাখ রোহিঙ্গা সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। কক্সবাজার অঞ্চলে মাফিয়া গডফাদাররা ইয়াবাসহ মাদক, অস্ত্র চোরাচালান ও নানা অপরাধমূলক কাজে হতদরিদ্র রোহিঙ্গাদের অনেককে ব্যবহার করে। স্থানীয় প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াত নেতারা এদের অবৈধভাবে ভোটার বানিয়ে নির্বাচনী রাজনীতিতে কাজে লাগায়। বিভিন্ন ইসলামিক এনজিও রোহিঙ্গাদের সহযোগিতার নামে মৌলবাদী রাজনীতির প্রসার ও জঙ্গীবাদী কর্মকান্ডে যুক্ত করতে তৎপর আছে।
আজকে যখন নতুন করে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিতে আসছে তখন প্রশ্ন উঠেছে — ঘনবসতিপূর্ণ ও সীমিত সম্পদের বাংলাদেশ এদের দায়িত্ব কতটুকু নিতে পারবে? আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের সমস্যা সেখানেই সমাধানের জন্য চাপ না দিয়ে বাংলাদেশকে কেন সীমান্ত খুলে দিতে বলছে? আসলে অসহায় মানুষ প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় প্রার্থনা করলে আশ্রয় দেব কি দেব না তা বিবেচনার বিষয় হতে পারে না, কষ্ট হলেও তাদের আশ্রয় দেয়া আমাদের মানবিক দায়িত্ব। ১৯৭১ সালে এক কোটি বাঙালী ভারতে আশ্রয় না পেলে কি পরিণতি হতো? প্রশ্ন হচ্ছে — কি প্রক্রিয়ায় আশ্রয় দেয়া হবে, কতদিনের জন্য এবং কীভাবে দ্বিপাক্ষিক-আঞ্চলিক কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে ও আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করে মিয়ানমার সরকারকে বাধ্য করা যায় রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে, তাদের অধিকার-নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। তাছাড়া সরকার যতই বাধা দিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ করা বাস্তবে সম্ভব নয়, ফলে না চাইলেও বাংলাদেশকে চাপ নিতে হচ্ছে। বরং জাতিসংঘকে যুক্ত করে ঘোষণা দিয়ে নির্দিষ্ট আশ্রয়শিবিরে সাময়িক আশ্রয় দেয়া হলে ও আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন-তথ্যভান্ডার করা থাকলে তা মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করার জন্য সহায়ক হতে পারে। পাশের ঘরে আগুন লাগলে নির্বিকার থাকা চলে না। দ্রুত এই মানবিক সংকট সমাধান করা না গেলে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নকে পুঁজি করে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক উস্কানি সৃষ্টির অপচেষ্টা কিংবা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের আশংকা বাড়বে।