২২ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ডিসেম্বর গ্যাসের দামবৃদ্ধির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রচারাভিযান
গ্যাসের দামবৃদ্ধির সরকারি প্রস্তাবনার প্রতিবাদে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা আন্দোলনের কর্মসূচী দিয়েছে। ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬ তোপখানা রোডের নির্মল সেন মিলনায়তনে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা আহুত এক সংবাদ সম্মেলন থেকে ঘোষণা করা হয়, অবিলম্বে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত থেকে সরকার সরে না আসলে আগামী ২২ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ডিসেম্বর গ্যাসের দাম বৃদ্ধির এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রচারাভিযান চালানো হবে। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন অঞ্চল ও এলাকায় পদযাত্রা, প্রচারপত্র বিলি, গণসংযোগ কর্মসূচিও চলবে। ২৮ ডিসেম্বর আমরা জ্বালানি মন্ত্রণালয় অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে যাওয়া হবে। সেখান থেকে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষিত হবে। মৌর্চার সমন্বয়ক ও গণসংহতি আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য ফিরোজ আহমেদ সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। সংবাদ সন্মেলনে সাংবাকিদের প্রশ্নের উত্তর দেন বাসদ (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় নেতা কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড সাইফুল হক, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন নান্নু, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহবায়ক হামিদুল হক প্রমুখ।
উল্লেখ্য, সব ধরনের গ্যাসের দাম আবারও বাড়ছে, এই মর্মে একাধিক জাতীয় দৈনিকে খবর এসেছে। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, আবাসিক খাতে দুই চুলার ক্ষেত্রে দাম বাড়বে সর্বোচ্চ ১২২ দশমিক ২২ শতাংশ পর্যন্ত। দাম বাড়ানোর এই প্রস্তাবের অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এই সংবাদও জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। এখন এই প্রস্তাব এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে জমা দেয়া হবে এবং কমিশন আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেবে। অথচ গণশুনানীতে অংশগ্রহণকারী সকলের কাছেই এটি বারবারই পরিষ্কার যে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কোন যৌক্তিক কারণ নেই। একদিকে কোম্পানি ও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিলো যে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়াতে হবে এবং অন্যান্য খরচাদি সমন্বয় করতে হবে। অন্যদিকে কোম্পানির প্রদত্ত কাগজ-পত্র থেকে পরিস্কার যে বর্ধিত বেতন ‘সিষ্টেম গেইন’ থেকে পরিশোধ করার পরও সেবার মান বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করা যাবে। কিন্তু তারপরও দেখা যাচ্ছে সরকার দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বেপরোয়া।
সংবাদ সম্মেলনে পঠিত লিখিত বক্তব্যের পূর্ণ বিবরণ-
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার ডাকে আজকের এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হবার জন্য আপনাদের সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতি এবং প্রাত্যহিক জনজীবনে অত্যন্ত বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, এমন একটি বিষয়ে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার বক্তব্য এবং কর্মসূচি ঘোষণার জন্যই আমরা আজকের এই সংবাদ সম্মেলন আহবান করেছি।
প্রিয় বন্ধুরা,
আপনারা নিশ্চয়ই ইতিমধ্যেই অবগত আছেন যে, সব খাতে গ্যাসের দাম আবারও বাড়ছে, এই মর্মে একাধিক জাতীয় দৈনিকে খবর এসেছে। দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুযায়ী, আবাসিক খাতে দুই চুলার গ্যাসের জন্য বর্তমান দাম ৬৫০ থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করা হচ্ছে। বৃদ্ধির হার ৫৪.৬১ শতাংশ। আর এক চুলার গ্রাহকদের ক্ষেত্রে বর্তমান দাম ৬০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা করা হবে। এ ক্ষেত্রে দাম বাড়ার হার ৩৩.৩৩। সিএনজির দাম প্রতি ঘনমিটার ৩৫ থেকে বেড়ে ৪৩-৪৫ টাকা, গৃহস্থালিতে মিটারভিত্তিক গ্যাসের দাম ৭ থেকে বেড়ে ৯-১০ টাকা এবং শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত ক্যাপটিভ বিদ্যুতের জন্য প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৮ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১০ টাকা হতে পারে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার কারখানা, শিল্প, বাণিজ্যিক, চা-বাগান প্রভৃতি সব ক্ষেত্রেই গ্যাসের দাম গড়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ছে।
এই প্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা মনে করে,
১. বিদেশী কোম্পানি তথা আইওসির গ্যাস শুল্ক-ভ্যাট মুক্ত। অথচ সে গ্যাস শুল্ক-ভ্যাটযুক্ত গণ্য করে পেট্রোবাংলা গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করে। বিইআরসির গণশুনানিতে এ প্রস্তাব অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
২. উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে অনেকেরই চাহিদার তুলনায় রাজস্ব উদ্বৃত্ত বিদ্যমান। যে ক’টি কোম্পানির রাজস্ব ঘাটতি রয়েছে, তা এখন পর্যন্ত সামান্য। সে ঘাটতি সমন্বয়ে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি সঠিক ও যৌক্তিক নয়।
৩. আমদানিকৃত এলএনজির বাজার সৃষ্টির জন্য গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা দরকার, এই বক্তব্যও আমরা শুনতে পাচ্ছি। আমদানির আগেই এই সমন্বেয়র উদ্যোগকে বরং বলা যেতে পারে ভোক্তা ও উৎপাদকদের কিছুটা আগাম পকেট কেটে নেয়া। অন্যদিকে, এলপিজির আমদানি ব্যয় যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। ২০০৯ সালে বিইআরসি সিলিন্ডারপ্রতি এলপিজির দামহার ১ হাজার ৫০ থেকে প্রথমে ৮৫০ টাকা ও পরে ৭০০ টাকা নির্ধারণ করে। এ দামহার বলবত থাকলেও বাজারভেদে তা এখন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা। দামহার যথাযথ মাত্রায় যৌক্তিক করা হলে তা বিক্রি হতে পারে ৪৫০ টাকায়। অথচ সে দামহার যথার্থ যৌক্তিক না করে ব্যক্তিখাতকে এলপিজি আমদানির সুযোগ দেয়া হচ্ছে এবং সিলিন্ডারপ্রতি ৩০০ টাকা ভর্তুকির কথাও বলা হচ্ছে। এলপিজিকে এভাবে প্রতিযোগিতাহীন বাজারে উচ্চ মুনাফার সুযোগ দেয়া রাষ্ট্রের আদর্শের পরিপন্থী।
৪. গণশুনানিতে বিশেষজ্ঞদের উপস্থাপিত তথ্য থেকে দেখা যয়, গ্যাস উন্নয়ন তহবিল তথা জিডিএফে ভোক্তারা জমা দেন বছরে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। সুদসহ এ ফান্ডে এরই মধ্যে জমা হয়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। সরবরাহকৃত গ্যাসে দেশীয় কোম্পানির গ্যাসের অংশ যেন বৃদ্ধি পায় এবং সরবরাহ ব্যয় যেন তাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে উদ্দেশ্যে এ ফান্ড গঠিত হয়েছিল। এ ফান্ড গঠনকালে সরবরাহকৃত গ্যাসে অংশ ছিল দেশীয় কোম্পানির ৫২ শতাংশ এবং আইওসির ৪৮ শতাংশ। এত প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সত্ত্বেও এখন দেশীয় কোম্পানির গ্যাসের অংশ ৪০ শতাংশ, আইওসির ৬০ শতাংশ। আবার পেট্রোবাংলা এ ফান্ডের আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে এফডিআর রেখে সুদ পাচ্ছে। এই অর্থের একটি বিরাট অংশ সরকার ইতিমধ্যেই অন্যন্য নানান খাতে খরচ করেছে। অথচ গ্যাসখাতের উন্নয়নে তাদের মনোযোগ ও ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না।
৫. গ্যাসখাতে বিপুল দুর্নীতির বোঝাও জনগণকেই টানতে হচ্ছে। পেট্রোবাংলার বিরুদ্ধে আইওসির গ্যাস ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটির ২৮.১.২০১৫ তারিখের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যয় উসুল, কম্প্রেসর স্থাপন ও পরিচালনা, গ্যাসের দাম পরিশোধে ডিসকাউন্ট সুবিধা না নেয়া এবং যন্ত্রপাতি আমদানি — এসব ব্যাপারে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে পেট্রোবাংলা অভিযুক্ত। ওই প্রতিবেদনে আইএমইডির সূত্রে তিতাস গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানির বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এবং বলা হয়েছে, ত্রুটিপূর্ণ মিটার ও মিটার টেম্পারিং, গ্যাস অপচয় এবং অবৈধ সংযোগের কারণে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে সরকারী ক্ষমতাধররা চোরাই সংযোগ সাধারণ গ্রহকের বাড়িতে পৌছে দিয়ে জনগণের কোটি কোটি টাকা চুরি করছে, এর সাথেও সরকারের প্রত্যক্ষ মদদ রয়েছে।
আমরা পরিস্কার বলতে চাই,
ক. গ্যাসের দামের এই বিপুল বৃদ্ধি সাধারণ নাগরিকদের দৈনন্দিন ব্যয় বৃদ্ধি করবে। পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পাবার ফলে সঙ্কট ঘনীভূত হবে। বাড়বে খাদ্যশস্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল পণ্যের দাম।
খ. অন্যদিকে গ্যাস একটি অত্যাবশ্যকীয় ও কৌশলগত পণ্য। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এই ধরনের কৌশলগত জ্বালানির মূল্য কম রেখে, এ থেকে মুনাফা বা কর না নিয়ে সরকার চেষ্টা করে শিল্পোৎপাদনের খরচ কমিয়ে রাখতে। এতে দেশের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়, জনগণের জীবনমান বৃদ্ধি পায়, বিদেশের সাথে প্রতিযোগিতার সামর্থ্য বৃদ্ধি পায়। সরকারের আয়ের উৎস থাকে আয়কর। অন্যদিকে বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাই, সরকার আয়কর থেকে সামান্যই আয় করেন, বরং জনগণের ওপর ভ্যাট, খাজনা, শুল্ক ইত্যাদি বাড়িয়ে, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি এসবের দাম বাড়িয়ে আয় করার চেষ্টা করছে।
ইতিমধ্যে ঢাকা ওয়াসা চার মাসের মাথায় আবারও পানির দাম বাড়য়েছে। ওয়াসার পানির দাম বছরে সাধারণত ৫ শতাংশ হারে বাড়ে। কিন্তু এ বছর দুই দফায় বাড়ানোর কারণে মোট দাম বাড়ল আবাসিকে ২২ শতাংশ এবং শিল্প ও বাণিজ্যিকে ১৮ শতাংশ। অন্যদিকে আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে পুনরায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে বলে পত্রিকায় খবর এসেছে।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুরা,
গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা সরকারের এই গণবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে অতীতের মতই ধারাবাহিকভাবে সক্রিয় আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। এই সংবাদ সম্মেলন থেকে আমরা সেই আন্দোলনের প্রাথমিক কর্মসূচি ঘোষণা করতে চাই।
ইতিমধ্যেই গত ১১ ডিসেম্বর গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিরুদ্ধে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি।
আগামী ২০ ডিসেম্বর থেকে ২৭ ডিসেম্বর গ্যাসের দাম বৃদ্ধির এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রচারাভিযান চালাবো। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন অঞ্চল ও এলাকায় পদযাত্রা, প্রচারপত্র বিলি, সমাবেশ, গণসংযোগ কর্মসূচি চলবে। ২৮ ডিসেম্বর আমরা জ্বালানি মন্ত্রণালয় অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে যাবো। সেখান থেকে আমাদের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষিত হবে।
প্রিয় বন্ধুরা,
অপরাপর গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিকেও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির এই তৎপরতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে আমরা যৌথ সংগ্রাম পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা ইতিমধ্যেই একদিকে ‘চার বাম দল’ এবং অপরদিকে ‘সিপিবি-বাসদ’ এই দুটি জোটের সাথে এই বিষয়ে সমন্বিত জোরদার কর্মসূচি গ্রহণের জন্য আলোচনা শুরু করেছে। আমরা আশা করি, সরকারের এই গণবিরোধী তৎপরতা প্রতিরোধে জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক শক্তিগুলোর একটা জোরদার আন্দোলন সামনে অগ্রসর হবে।
গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার আহবানে এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হবার জন্য আপনাদের সকলকে আবারো ধন্যবাদ জানাই। আপনাদের মাধ্যমে এই সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য এবং কর্মসূচিসমূহ জনগণের কাছে পৌছে যাবে এই কামনা রেখে আজকের সংবাদ সম্মেলন এখানেই শেষ করছি।