গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাত থেকে রপ্তানি আয় হয় ২ হাজার ৫৪৯ কোটি ডলার। যে শ্রমিকেরা সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে, দেশের সমুদয় উনড়বয়নের ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করে তারাই আজ সবচেয়ে অসুবিধায় দিন পার করছে। ২০১৩ সালের পর থেকে গত ৩ বছরে প্রত্যেক শিল্প এলাকায় বাড়ি ভাড়া বেড়েছে, অথচ শ্রমিকের মজুরী বাড়েনি। সরকার বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে কয়েক দফা যার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ শিকার শ্রমিকশ্রেণী। একদিকে তাদের বর্ধিত বিদ্যুৎ এবং গ্যাস এর ব্যবহার মূল্য বিল আকারে প্রত্যক্ষভাবে দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে ওই মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব প্রত্যেক পণ্যের মধ্যে পড়ছে। অথচ শ্রমিকের বেতন এই সময়কালে বাড়েনি। যানবাহনের ভাড়া বেড়েছে কয়েকগুণ, বাস ও রেলভাড়া সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাড়িয়েছে। কিন্তু শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি। এতে করে শ্রমিকের জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এখন শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই।
গার্মেন্টস সেক্টরে বর্তমান নিমড়বতম মজুরি অপর্যাপ্ত
২০১৩ সালে গার্মেন্টস সেক্টরে ন্যূনতম মজুরী ধার্য্য করা হয়েছে ৫৩০০ টাকা (৩০০০ মূল মজুরি + ১২০০ বাসা ভাড়া + চিকিৎসা ২৫০+ যাতায়াত ২০০+ খাদ্যভাতা ৬৫০ = ৫৩০০)। বর্তমান মজুরি যে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল তা মজুরি কাঠামোতে প্রদত্ত বাড়ি ভাড়া দেখলেই বোঝা যায়। ১২০০ টাকা বাড়ি ভাড়া দিয়ে কোন শিল্প অঞ্চলে বাড়ি ভাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। তেমনি চিকিৎসা ভাতা, টিফিন ভাতা এবং মূল বেসিক বেতন সবই বাস্তবের এবং প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। চিকিৎসা ভাতা ২৫০ টাকা মাত্র। যাতায়াত ভাতা ২০০ টাকা মাত্র, সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকায় যাতায়াত করলেও কেবল একজনের কর্মস্থলে আসাযাওয়াতেই ২৬ কর্মদিবসে কমপক্ষে ২৬০ টাকা লাগে। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সরকার গঠিত নূর খান কমিশন জাতীয় ন্যূনতম মজুরী ঘোষণা করেছিল ১৫৫ টাকা। তখন চালের মণ ছিল ৩০ টাকা। পাকিস্তান আমলের একজন শ্রমিক ১৫৫ টাকা ন্যূনতম মজুরীতে পাঁচ মণ চাল কিনতে পারলেও আজকে সে ন্যূনতম মজুরী ৫৩০০ টাকা দিয়ে ৩ মণের বেশি চাল কিনতে পারবে না। আজ স্বাধীনতার ৪০ বছরেও তাহলে কোন্ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন হলো? স্বাধীনতার পূর্বে আদমজী, ইস্পাহানী, লতিফ বাওয়ানীদের কারখানায় শ্রমিকদের থাকার জন্য কলোনী বা ব্যারাক ছিল, স্কুল-হাসপাতাল খেলার মাঠ ছিল। আজ স্বাধীনতার পরে গার্মেন্টস মালিকরা শ্রমিকদের থাকার জায়গা করে দেয়ার দায়িত্ব নিচ্ছেন না।
মজুরি বৃদ্ধি আজ সময়ের দাবি
জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সরকার নতুন পে-স্কেল ঘোষণা করে সরকারি কর্মচারীদের বেতন দ্বিগুণ বাড়িয়েছে। সম্প্রতি বেতন বাড়ানো হয়েছে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী- এমপিদের। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে, শ্রমিকদের জন্য নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষিত হবে না কেন? শ্রমিকরাও তো একই বাজার থেকে কেনা-কাটা করে। সরকার দাবি করছে – দেশের উন্নয়ন হচ্ছে, অচিরেই ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ হতে যাচ্ছে, তাহলে শ্রমিকের অবস্থার উন্নতি হবে না কেন? দেশে জাতীয় আয় বাড়ার পেছনে শ্রমজীবী মানুষের অবদানই তো সবচেয়ে বেশি। শিল্প বাঁচানোর কথা বলে শ্রমিকদের মানবেতর জীবনে ফেলে রাখা হবে তা মেনে নেয়া যায় না। তাই আজ দাবি উঠেছে – শ্রমিকদের মানুষের মত বাঁচার উপযোগী ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ ও ঘোষণা করতে হবে।
গার্মেন্টস শিল্পের আয় বাড়ছে
বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশ। ২০২১ সালে পোশাক রপ্তানি পাঁচ হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা। সব দেশের মোট রপ্তানি আয়ের(৩ হাজার ১২০ কোটি ডলার) প্রায় ৮২ শতাংশ। চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে দেশের মোট পণ্য রপ্তানির ৮১ দশমিক ৬৬ শতাংশ বা ১ হাজার ৩১৩ কোটি ৫৫ লাখ ডলার পোশাক খাত থেকে এসেছে। এই আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেশি। একই সঙ্গে তা গত অর্থবছরের একই সময়ের ১ হাজার ২০২ কোটি ডলারের রপ্তানির চেয়ে ৯ দশমিক ২৬ শতাংশ বেশি। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান দৈনিক প্রথম আলোকে বলেন “…আগামী ছয় মাস পোশাক রপ্তানি ভালো ছাড়া খারাপ হবে না।” একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পোশাকের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। এখানে কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের পোশাকের রপ্তানি আয় ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ১১ দশমিক ৪১ শতাংশ।
বাংলাদেশে মজুরি প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম
সর্বনিম্ন মজুরি এখন ৫ হাজার ৩০০ টাকা। এটি অন্যান্য সকল গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিকারক দেশের চেয়ে অনেক কম। আইএলও-র ‘Minimum wages in the global garment industry : Update for ২০১৫’ প্রতিবেদন অনুসারে – ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারিতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মাসিক সর্বনিম্ন মজুরি শ্রীলংকায় ৬৬- ৮০ ডলার(দক্ষতাভেদে), বাংলাদেশে ৬৮ ডলার, ভারতে ৭৮-১৬৫ ডলার(রাজ্য ও দক্ষতার মান ভেদে), পাকিস্তান ৯৯-১১৯ ডলার, ভিয়েতনামে ১০০-১৪৫ ডলার, কম্বোডিয়া ১২৮ ডলার, ইন্দোনেশিয়া ৯২- ২১৩ ডলার, মালেশিয়া ২২৫-২৫৩ ডলার, চীন ১৬৫-২৯৭ ডলার(প্রদেশভেদে), তুরস্ক ৫১৭ ডলার, মেক্সিকো ১৫১-১৬৩ ডলার। এর মধ্যে কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের সরকার মজুরি বাড়িয়ে ২০১৬ সাল থেকে নির্ধারণ করেছে যথাক্রমে ১৪০ ডলার ও ১০৭-১৫৬ ডলার। পাকিস্তান জুন, ২০১৫ থেকে মজুরি বাড়িয়ে সর্বনিম্ন প্রায় ১২০ ডলার নির্ধারণ করেছে। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভিয়েতনামের সরকার শ্রমিকের জন্য খুবই সস্তায় আবাসন, পরিবহন ও অন্যান্য সুবিধাও দিয়ে থাকে। এই দেশটি এখন বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিযোগী দেশ।
মজুরি বৃদ্ধি কত হওয়া দরকার
১২০০ টাকা বাড়ি ভাড়া দিয়ে কোন শিল্প অঞ্চলে বাড়ি ভাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। বাড়ি ভাড়া যেমন বাস্তবের এবং প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল তেমনি চিকিৎসা ভাতা, টিফিন ভাতা এবং মূল বেসিক বেতন সবই অপ্রতুল।
গার্মেন্টস সেক্টরে চিকিৎসা ভাতা ২৫০ টাকা মাত্র। ডায়াগনস্টিক টেস্ট-ওষুধের মূল্য বাদ, শুধু একবার মাত্র একজন এমবিবিএস ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করলেই কমপক্ষে ৫০০ টাকা লাগে। তাই আমাদের দাবী মাসে ৭০ টাকার ঔষধ ধরে ন্যূনতম চিকিৎসা ভাতা ২৫০ টাকার স্থলে ৫৭০ টাকা করা হোক। যাতায়াত ভাতা অবশ্যই দৈনিক ১৫ টাকার কমে কোনভাবেই হবে না। এই জন্য দৈনিক ৩০ টাকা হলেও ২৬ দিনে ৩০x২৬ = ৭৮০ টাকা দাঁড়ায়। তাই আমরা দাবী করছি মাসে ২০০ টাকার স্থলে ৭৮০ টাকা মাত্র যাতায়াত ভাতা করা হোক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হিসাব করে দেখিয়েছেন দৈনিক ১০ ঘন্টা কাজ করলে (যদিও বাস্তবে ১৪/১৬ ঘন্টা হামেশাই শ্রমিকরা কাজ করে থাকে) একজন পুরুষ শ্রমিকের ৩৩৬৪ কিলোক্যালরি এবং নারী শ্রমিকের ২৪০৬ কিলোক্যালরি তাপ দেহে (যদিও নারীদের মাতৃত্বকালীন সময়ে অনেক বেশী দরকার হয়) প্রয়োজন হয়। সুতরাং নর-নারী নির্বিশেষে গড়ে (৩৩৬৪+২৪০৬/২) ২৮৮৫ কিলোক্যালরি তাপ উৎপাদন সম্বলিত খাদ্য প্রয়োজন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আরও ৮৫ কিলোক্যালরি বাদ দিয়ে ন্যূনতম ২৮০০ কিলোক্যালরি তাপ উৎপাদন করতে পারে শরীরে এমন খাদ্য গ্রহণ করার জন্য খাদ্য খরচ পড়বে ১০৯ টাকা প্রতিদিন। সব কিছু মিলে অবশ্যই একজন শ্রমিকের মূল বেতন ১০হাজার ও মোট বেতন ১৬ হাজার টাকা হওয়া প্রয়োজন। শ্রমিকরা এই ন্যায্য দাবিতেই লড়ছে। কিন্তু সরকার এই দাবির প্রতি কর্ণপাত না করে হামলা হুমকি ভয় গ্রেফতার করে মালিকদের স্বার্থই রক্ষা করছে।