Saturday, November 23, 2024
Homeফিচারমহাজোট সরকারের ৩ বছর — উন্নয়নের শোরগোলে চাপা পড়ছে মানুষের আর্তনাদ

মহাজোট সরকারের ৩ বছর — উন্নয়নের শোরগোলে চাপা পড়ছে মানুষের আর্তনাদ

1483550732

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের এক কৃষক পিতার ছেলে তারেক ২০১৪ সালে মাস্টার্স পাশ করেছিলেন। বহু কষ্ট স্বীকার ও অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই অভাবী পরিবারের ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে প্রম শ্রেণীতে মাস্টার্স পাশ করেন। পাশ করার পর দুই বছর দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। কোথাও কোন চাকরি পাননি। বাবা আক্ষেপ করে ছেলেকে বলেছিলেন, “তাহলে পড়ালেখা না করে আমার সাথে মাঠে কাজ করলে পারতিস।”

এ বছরের মে মাসে আজিজ আত্মহত্যা করেন।

জানুয়ারি মাসে আত্মহত্যা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স পাশ করা মানিকগঞ্জের ঘিওরের মেয়ে সুক্তি। প্রাণপণ চাকরির চেষ্টা করছিলেন তিনিও। একটা চাকরি ছাড়া তো টিকে থাকাও যায় না। তার উপর তিনি একজন মেয়ে। জীবন সংগ্রাম তার জন্য অন্যদের চেয়ে আরও একধাপ বেশি কঠিন। কিন্তু আর লড়তে পারলেন না সুক্তি।

দেশের বহুল প্রচারিত একটি প্রথম সারির দৈনিকে এই ঘটনাগুলো উঠে এসেছে। সেই রিপোর্ট দেখলেই আমাদের দেশের ভয়াবহ  উন্নয়নের চিত্র বোঝা যাবে। দেশের স্নাতক ডিগ্রিধারির প্রায় অর্ধেকেরই (৪৭ শতাংশ) কোন কাজ নেই। সর্বাধিক বেকারত্বের দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১২ তম।

এ এক অর্জনই বটে। এরকম বহু অর্জন নিয়ে গত ৫ জানুয়ারি মহাজোট সরকার ৩ বছর পূর্ণ করেছে। একটি অবৈধ, অগণতান্ত্রিক, ভোটারদের অংশগ্রহণবিহীন নির্বাচন করে, দেশের মধ্যে চরম ফ্যাসিবাদী শাসন জারি করে ৩ বছর ধরে একতরফাভাবে দেশ চালানোর জন্য তারা গোটা পুঁজিবাদী বিশ্বে বাহবা পেতেই পারেন। কিন্তু সারাদেশের মানুষ নিদারুণ অবস্থায় মুক্তির রাস্তা খুঁজছে। কেউই ভাল নেই। আজিজ বা সুক্তির কথা পত্রিকায় আসলেও অনেক নাম প্রতিদিন মুছে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে, যাদের কথা পত্রিকার পাতায় আসছে না। কিংবা আত্মহত্যা না করলেও করুণ পরিস্থিতিতে জীবন কাটাচ্ছেন দেশের অনেক সাধারণ মানুষ যাদের মরা কিংবা বেঁচে থাকার মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষ আজ সংকটজনক অবস্থার মধ্যে আছেন রাস্তাঘাট-ব্রিজ-কালভার্ট আর নদীর উপর বড় সেতু বানানোটাকেই যারা উন্নয়ন মনে করেন, সেরকম পরিত্যাজ্য বিজ্ঞ লোক ব্যতীত আর সবাই এই সময়ের প্রতিটি দিনকে হাতে গুণতে পারবেন। শুধু গত দুই বছরেই বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ অন্যান্য সেবাখাতগুলোর মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ৬৮%। ২০১০ সালের তুলনায় ২০১১ সালে ঢাকা শহরে বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ। গত দশ বছরে বেড়েছে সাড়ে চার গুণ। গরীব-নিম্নবিত্ত মানুষ যারা ঢাকা শহরে সামান্য কাজ করে কোনরকমে পরিবার প্রতিপালন করেন, তাদের জীবন টেনে নেয়াই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এ চিত্র বিভিন্ন মাত্রায় দেশের সবগুলো জেলায়। জেলা শহরগুলো সাধারণত উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিক্ষার্থীরা শহরে এসে ভীড় জমায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য। শহরাঞ্চলে বাড়িভাড়া বৃদ্ধি ও জীবন যাপনের ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাবে শিক্ষা ব্যয় বেড়েগেছে অনেকগুণ। আবার সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ কয় বছরে ব্যাপকহারে বেতন ও অন্যান্য ফি বৃদ্ধি করা হয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তো করা হচ্ছেই। শিক্ষাখাত প্রায় পুরোপুরি বেসরকারিকরণ হচ্ছে, কিছু ক্ষেত্রে পিপিপি (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) এর মাধ্যমে চলছে।

untitled-20_37817

কৃষক তার ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। এ সরকারের আমলে কোন বছরই কৃষক তার ফসলের ন্যায্য দাম উঠাতে পারেনি। ব্র্যাকের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, দেশে প্রায় ৫০ শতাংশ মাঝারি মানের ও ৩৯ শতাংশ প্রান্তিক কৃষক রয়েছেন। প্রচলিত ভর্তুকি ব্যবস্থায় মাঝারি ও ক্ষুদ্র কৃষকরা অবহেলিত ও বঞ্চিত থাকেন, কেননা ভর্তুকি বন্টনে বর্তমানে যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় তাতে বড় বড় কৃষকরা এবং সার-কীটনাশক ব্যবসায়ীরা লাভবান হন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকরা এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এই মাঝারি ও ক্ষুদ্র কৃষকরা তখন বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নেয়। পরপর কয়েক বছর চাষের ক্ষতি হলে এই কৃষকরা আর টিকে থাকতে পারেন না। ২০১০ সাল থেকে হিসাব করা হলেও দেখানো যাবে যে, মহাজোট সরকারের এ কয় বছরে কত ব্যাপক সংখ্যক কৃষক ঘরবাড়ি সব বিক্রি করে শহরে এসেছে।

এদেশে শ্রমিকরা কি অবস্থায় আছে তা বলে বুঝানোর দরকার নেই। বর্তমান সরকারের সময়ে তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছে প্রায় দেড়শত শ্রমিক। রানা প্লাজা ধ্বসে নিহত হয়েছে প্রায় ১২০০ এর অধিক শ্রমিক। শত শত লোক পঙ্গু হয়ে গেছে। কারো বিচার হয়নি। শ্রমিকরা থেকে থেকেই বিক্ষোভ করছে একটা মানসম্মত ন্যূনতম মজুরির জন্য। কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। অমানুষিক পরিশ্রম ও অত্যধিক নিম্ন মজুরির বিনিময়ে দেশের সবচেয়ে বড় শিল্পখাত, গার্মেন্টস্ খাত চলছে। বিশ্ব বাজারে পোশাক রপ্তানীতে একবার চীনকেও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ, আর সেটা হয়েছেঅত্যধিক নিম্ন মজুরি সুবিধার কারণে। দেশের সর্বোচ্চ সংখ্যক -প্রায় ৪০ লক্ষ শ্রমিক এই খাতে যুক্ত। এই ডিসেম্বরে আশুলিয়ার উইন্ডি গার্মেন্টসে মজুরীর বিষয় নিয়ে ১১ ডিসেম্বর থেকে গার্মেন্টস্ শ্রমিকদের আন্দোলন শুরু হয়। ২০১৩ সালে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরী ৫৩০০ টাকা নির্ধারণের পর ৩ বছর পার হয়ে গেল। এখনো সারা দেশের অনেক কারখানায় মজুরী বোর্ড ঘোষিত এই ন্যূনতম মজুরী কার্যকর করা হয়নি। এই বিষয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলো বারবার সরকার ও মালিক পক্ষকে অবহিত করলেও তাদের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। আশুলিয়ার উইন্ডি গার্মেন্টসেও শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরী ৫৩০০ টাকা না দিয়ে ৩৮০০ টাকা, সর্বোচ্চ ৪২০০ টাকা দেয়া হতো। এই অবস্থায় শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। শ্রমিকরা মজুরি বাড়ানোর দাবি করেছিলো। পাশাপাশি বাৎসরিক ছুটির টাকা প্রদানের দাবি করেছিল কয়েকটি কারখানার শ্রমিক। কারখানাগুলোতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বিরুদ্ধেও শ্রমিকদের ক্ষোভ ছিল। এবার আশুলিয়ার শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণ মিছিল-সমাবেশে তাদের দাবি উত্থাপন করেছিলো- সর্বনিম্ন বেতন ৫ হাজার ৩০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ১৬ হাজার টাকা করা, কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, দুপুরে খাবার ও যাতায়াত ভাতা বৃদ্ধি, ছুটির দিনে ওভার টাইম বিল দ্বিগুণ করা, যখন তখন শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করা, কর্মক্ষেত্রে মৃত্যু হলে চাকরির বয়স পর্যন্ত আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ, তাজরীনসহ সব কারখানায় দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা, শিল্পাঞ্চলে সরকারি স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ এবং নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।

অথচ এসকল দাবির একটিও না মেনে মালিকদের সংগঠন ‘বিজিএমইএ’ আশুলিয়ার ৫৯টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিলো এবং শ্রমিকদের জানিয়ে দিলো যে, কারখানা বন্ধ থাকাকালীন সময়ের বেতন-ভাতা তারা পাবে না। আমরা দেখেছি, কারখানা বন্ধ রাখলে তার যে ক্ষতি হয় তা মালিকরা সরকারের কাছ থেকে আদায় করে নেন। পূর্বেও বিএনপি-জামাতের অবরোধের সময়ে হওয়া আর্থিক ক্ষতি বিভিন্নভাবে মালিকরা সরকারের কাছ থেকে আদায় করেছেন। প্রথম আলোর ২০১৫ সালের করা একটা রিপোর্ট বলছে, গত পাঁচ বছরে মালিকেরা সরকার থেকে নগদ সাহায্য পেয়েছে প্রায় চার হাজার ২১৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট বলছে, ২০১৩ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো সবমিলিয়ে মোট ১১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে গার্মেন্টস শিল্পকে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংক একাই ঋণ দিয়েছে ৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের রিপোর্ট বলছে, ২০০৮ এর পরে ২৭০টি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির ঋণ মওকুফ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর রাষ্ট্রীয় ৮ ব্যাংকের মোট খেলাপী ঋণের ১৬.৭০শতাংশ আটকে আছে গার্মেন্টস মালিকদের কাছে। অথচ স্বাভাবিক সাধারণ কতগুলো দাবিকে সামনে আনতেই এই শ্রমিকদের উপর কি রূপ নৃশংস আচরণ করলো মালিকপক্ষ ও তাদের পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থা? শুধু কারখানা বন্ধ নয়, শ্রমিকদের থাকার জায়গাগুলোতে পুলিশ ও মালিকদের পোষা গুণ্ডাদেরকে লেলিয়ে দেয়া হলো। শ্রমিক নেতাদের বিনা নোটিশে গ্রেফতার করা হলো।

এই চিত্র সবগুলো ক্ষেত্রে। স্বাস্থ্যসহ অন্য যে কোন ক্ষেত্রের দিকে তাকালেই এই ভয়ঙ্কর চিত্র চোখে পড়বে।

এসবের মধ্যেই এই সরকার বারবার ঘোষণা করে যাচ্ছে – দেশে উন্নয়ন হচ্ছে। গণতন্ত্র একবারেই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু উন্নয়ন করতে গেলে কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়! স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যে এই দেশে এখন নেই- এ কথা অস্বীকার করার উপায় সরকারেরও নেই। তাই তারা এবারে অন্যরকম গণতন্ত্রের শ্লোগান তুলেছেন। এর নাম ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’। সরকারি প্রতিষ্ঠানে, রাস্তায়, দেয়ালে দেয়ালে বিলবোর্ড দিয়ে এই শ্লোগান এখন ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে।

ফ্যাসীবাদ যে কোন ধরনের নগ্ন একনায়কত্ব, এমনকি মিলিটারি ডিকটেটরশীপ বা সামরিক একনায়কত্ব থেকেও অনেক বেশি মারাত্মক
আওয়ামী লীগ সরকার যে ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসন চালাচ্ছে, তা এই দেশের মানুষের কাছে নতুন হলেও বিশ্বের ইতিহাসে এসব জিনিস নতুন নয়। বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা চরম সংকটের মধ্যে পড়ে ফ্যাসিবাদের জন্ম দিয়েছে। আওয়ামী লীগ এমন এক সময়ে এদেশে ক্ষমতায় এসেছে যখন পুঁজিবাদী অর্থনীতির সংকট বাংলাদেশে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিলো, ছোট-মাঝারি পুঁজিপতি-মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়- এদের মধ্যে নতুন আশাপূরণ তো হয়ই নি, বরং পুরনো জীবনযাত্রার মধ্যেও যতটুকু নিরাপত্তাবোধ ছিলো তাও ধ্বসে গিয়েছিলো। দ্বিদলীয় শাসনব্যবস্থায় পরস্পর সংঘাতময় রাজনীতির কারণে নিয়মতান্ত্রিক সরকার পরিবর্তনও সম্ভব হচ্ছিলো না। বড় দু’দলের উপরেই মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলো। দেশের রাজনীতি সব সময়েই একটা অনিশ্চয়তা-সংঘাত-সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো। এসকল প্রেক্ষিতে সমস্যা মীমাংসা করতে না পারার কারণে সেনাসমর্থিত যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিলো সেও মানুষের কাছে ক্রমশ অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো।

একই সময়ে বিশ্বপুঁজিবাদ সংকটে পড়ে তার কল-কারখানাগুলোকে তুলনামূলক সস্তা শ্রমের দেশগুলোতে স্থানান্তরিত করছে। আউটসোর্সিং বাংলাদেশে নতুন একটা সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। দেশের পুঁজিপতিরা চাইছিলো এই সস্তা শ্রম কাজে লাগাতে। কর্পোরেটদের সাথে মিলে কোলাবোরেশনে ব্যবসা করতে। এজন্য তাদের নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক স্থিতাবস্থার দরকার ছিলো। দরকার ছিলো সবকিছুর উপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের। বিরোধী দলকে একচেটিয়া দমন ও সকল ক্ষেত্রে বিগ বিজনেস হাউজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও দ্বিতীয় দফায় আওয়ামী লীগকে নিয়ে আসা দরকার ছিলো। এ প্রক্রিয়ায় জনগণের সম্মতি ব্যতিরেকে, অথচ প্রচলিত আইনসম্মত ব্যবস্থায় (বাস্তবে তা ন্যায়সঙ্গত নয়, আইনের মূল চেতনার সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়) পুনরায় ৫ বছরের জন্য সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। সামরিক একনায়কত্ব একটা রূপে হয়, তাকে বোঝা যায়, কিন্তু এ ধরনের শাসন জনগণকে পুরোপুরি বিভ্রান্ত করে। যেহেতু প্রকাশ্যেই গণতান্ত্রিক রীতিনীতির লঙ্ঘন হয়েছে, তাই শেখ হাসিনা প্রথমে বলেন যে, নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময় চলে আসার কারণে সংবিধান রক্ষা করার জন্য নির্বাচন করা হচ্ছে। পরবর্তীতে সকল দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু ক্রমেই সেই অবস্থান থেকে তারা সরে এলেন। কারণ বিএনপি-জামাত কোনরকম আন্দোলনের শক্তি হিসেবে মানুষের সামনে আসতে পারেনি। জনগণের সমস্যা-সংকট নিয়ে এই দুই দল কখনই রাস্তায় নামেনি। উপরন্তু ক্ষমতায় থাকাকালে তারাও সেই পুঁজিপতি-শিল্পপতিদের স্বার্থরক্ষা করেই চলেছে। তারাও তাদেরই শ্রেণীস্বার্থরক্ষাকারী দল। এখন দেশের বড় বিজনেস হাউসগুলো তাদেরকে চাইছে না। চাইছে আওয়ামী লীগকে। কারণ আওয়ামী লীগকে দিয়ে একইসাথে প্রগতিশীলতা ও ধর্মের ঝাণ্ডা বহন করানো যায়। জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলে মানুষকে উত্তেজিত করা যায়। কি ধর্মান্ধ, কি ধর্মবিরোধী সবার মধ্যেই একটা উগ্রতা সৃষ্টি করে গোটা দেশে যুক্তি-তর্ক করার পরিবেশকেই মেরে দেয়া যায়। এই অবস্থা যে কোন দেশে ফ্যাসিবাদ গড়ে তোলার পূর্বশর্ত। ফলে বিএনপি-জামায়াত কোন প্রকার প্রতিরোধের শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারলো না। আবার তাদের র‌্যাঙ্ক ও ফাইল এমনভাবে প্যাটার্ন যে, ক্ষমতা দখলের আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনরকম গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই তাদের আগ্রহ নেই, আকাঙ্খা নেই, চেষ্টাও নেই। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ সরকারের ভয়াবহ আক্রমণে তাদের শত শত নেতা-কর্মী গ্রেফতার, গুম, খুন হয়ে যাওয়ায় এবং বিরাট সংখ্যক নেতা-কর্মীদের নামে একাধিক করে মামলা থাকায় তারা একভাবে সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করলো। আর দেশের বাম গণতান্ত্রিক শক্তি, যারা দেশে সত্যিকার অর্থেই শোষিত সাধারণ মানুষের আন্দোলন গড়ে তুলতে পারতো। কিন্তু তাদের শক্তিহীনতা, গণবিচ্ছিন্নতা ও অনেক বামপন্থী দলের সঠিক রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি এ আন্দোলন গড়ে উঠতে দিলো না।

কিন্তু মানুষের ক্ষুব্ধতা তাই বলে কমেনি। এবার আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদের চিরাচরিত অস্ত্র, যা দুনিয়ার সকল ফ্যাসিস্ট সরকারই ব্যবহার করেছেন বা করেন, তা ব্যবহার করা শুরু করলো। তা হলো উন্নয়নের গালভরা কথা। আর এজন্য শ্লোগানটাও তারা নির্ধারণ করলো চমৎকার- “উন্নয়নের গণতন্ত্র”!

উন্নয়নের প্রচারটা জনগণের ভালভাবে বোঝা দরকার
দেশে বিরাট উন্নয়ন হচ্ছে এমন খবর প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকায় পাওয়া যাচ্ছে। মেগা প্রকল্পগুলোর ছবি ও সংবাদ জনগণের কাছে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। কিছু তথ্যও প্রদর্শিত হচ্ছে, যেমন পুঁজিবাদী বিশ্বের চরম সংকটের এ সময়েও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে। বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে। এসবকে উন্নয়ন বলে ধরেন এমন কিছু লোকও এদেশে আছেন। দেশের এক বিরাট সংখ্যক বুদ্ধিজীবী এগুলোকে ফলাও প্রচার করে মানুষের সামনে এমনভাবে আনছেন, যাতে তাদের বিভ্রান্তি বৃদ্ধি পায়। রাজনীতিবিমুখ এক বড় সংখ্যার মানুষ এর দ্বারা বিভ্রান্তও হচ্ছেন। বুর্জোয়া গণতন্ত্রে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, দুর্নীতি-লুটপাট-রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন-বিচারহীনতা এসব থাকবেই- এটা অনেকেই মনে করেন। দু’দলের বিগত সময়ের কর্মকাণ্ডে, এমনকি গোটা বিশ্বে বুর্জোয়া রাজনীতির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে যে কোন সচেতন-শিক্ষিত লোকই এই সিদ্ধান্তে আসবেন। কিন্তু এর বিরুদ্ধে সঠিক সংগ্রাম পরিচালনা করার রাজনৈতিক শক্তি যথেষ্ট শক্তিশালী না হওয়ার কারণে এটাকেই মানতে হবে এরকম একটি অসহায় মননও কিছু মানুষের গড়ে উঠেছে। সেক্ষেত্রে মন্দের ভালো; লুট করলেও তো তারা কিছু দিচ্ছে কিংবা একহাতে দেশটাকে সামলাচ্ছে না হলে জঙ্গিরা টিকতে দিত না – ইত্যাদি কথাও এই বিভ্রান্তির মধ্য থেকে বেরিয়ে আসছে, যা বাস্তবে, তারা বুঝুন আর নাই বুঝুন, ফ্যাসিবাদী শাসনকেই স্থায়িত্ব দিতে সাহায্য করছে।

দেশে কি কোন কাজের ক্ষেত্রই তৈরি হয়নি? কোন উন্নয়নই কি দেশের হয়নি? কিছু লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে এটা ঠিক, এটা ফলাও করে দেখানোও হচ্ছে, কিন্তু পাশাপাশি এও দেখা উচিত যে কত লোক কর্মসংস্থান থেকে উচ্ছেদ হচ্ছেন। তবেই দেশের আসল চিত্র বেরিয়ে আসবে। পাঠকরা আলোচনার শুরুতে দেয়া পরিসংখ্যান থেকেই তা কিছুটা বুঝতে পেরেছেন। আবার এই যে নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বলে প্রচার করা হচ্ছে, এই কাজের ক্ষেত্রটা কী? দেশে প্রচুর বড় বড় প্রজেক্ট নেয়া হয়েছে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য। স্যামসাং থেকে শুরু করে বড় বড় কর্পোরেটরা সস্তা শ্রম, সস্তা কাঁচামাল, সস্তায় গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি পাচ্ছে বলে এখানে তাদের ফ্যাক্টরি শিফট করছে। তাদের জন্য ‘স্পেশাল ইকনোমিক জোন’ তৈরি করা হচ্ছে। ভারত, চীন, জাপান আলাদা আলাদাভাবে বিরাট জায়গা বরাদ্দ পেয়েছে। এসব অবকাঠামো তৈরির জন্য আবার এসব জায়গার সাথে মূল সড়ক-রেল-নৌপথের যোগাযোগের জন্য রাস্তা-ব্রিজ ইত্যাদি তৈরি করা দরকার। এসকল কাজে কিছু লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। আর কিছু শিক্ষিত লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে কর্পোরেটদের টেকনিক্যাল অফিসে দক্ষতা বিক্রি করার জন্য। একটা দেশের সামগ্রিক পরিকল্পনা, সম্পদ ব্যবস্থাপনা, শিল্পায়ন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে একটা জনগোষ্ঠীকে উন্নত থেকে উন্নততর করার অংশ হিসেবে এই উন্নয়ন নয়, কর্পোরেটদের একটা ক্রাইসিসকে ট্যাকল করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা সবচেয়ে সস্তা দামে দিতে পারার কারণেই কিছু মানুষের গতি হচ্ছে। কর্পোরেটরা আর কোথাও আরও সস্তায় এই দক্ষতা পেলে এই বাজারের দিকে তাকাবেও না। তখন সংকট আরও ঘনীভূত হবে।

এই দক্ষতা তৈরির জন্য ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর শ্লোগান তোলা হলো। পাঠ্যক্রমে আই.সি.টি (ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি) যুক্ত করা হলো। প্রধানমন্ত্রীর পুত্র দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাবার ব্রত নিয়ে এই আই.সি.টি শিক্ষা প্রসারের জন্য প্রচার শুরু করলেন। মানুষের মধ্যে ধারণা এলো প্রযুক্তিতে এগিয়ে না গেলে আমাদের দেশের উন্নতি কিছুতেই হতে পারে না। এই প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়া মানে উচ্চশিক্ষিত দক্ষ প্রযুক্তিবিদ তৈরি নয়, যে বাজারটা বাংলাদেশে এই সময়ে এসেছে, তার প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু টেকনোলজিস্ট তৈরি করা।

ফলে এই সব উন্নয়ন এবং ডিজিটালাইজেশন আসলে কিছু শ্লোগান এবং সকল দেশের সকল ফ্যাসিবাদী সরকারকেই এই সকল চমক লাগানো কথাবার্তা বলতে হয় জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য।

কর্মসংস্থানের আরেকটা ক্ষেত্রও তৈরি হয়েছে দেশে। দেশের ক্রমবর্ধমান বেকার সংখ্যা যখন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, তখন পয়সা দিয়ে যুবকদের পার্টির স্বেচ্ছাসেবক বানানো শুরু হলো। তারা দরকার হলে পার্টির হয়ে লাঠালাঠি করবে। রাষ্ট্রিয় প্রশাসনের সাথে একটা প্যারালাল প্রশাসন ব্যবস্থা পার্টি নিজে চালু করলো। সকল সরকারি অফিসে, স্কুলে ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে তারা একাধারে নিয়ন্ত্রক ও মিডলম্যান। তাদেরকে না ধরলে কোন কাজ হয় না। এ যুগের অন্যতম মার্কসবাদী চিন্তানায়ক ও দার্শনিক কমরেড শিবদাস ঘোষ সংকটগ্রস্থ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের এই বৈশিষ্ট্যকে ঠিক ঠিকভাবে ধরে বলেছিলেন, “ . . . তারা (পুঁজিপতিরা) দেখলো বেকারদের মধ্যে শিক্ষাসংস্কৃতি থাকলে তার থেকেই বিক্ষুব্ধ হয়ে বিপ্লবের চিন্তা জন্ম নিতে পারে। তাই শিক্ষা-সংস্কৃতির যেটা নীতি-নৈতিকতার বুনিয়াদ, সেটাকে তারা মেরে দিতে চাইলো, অপরদিকে বেকারদের একটা অংশকে পয়সা দিয়ে কিনে নিয়ে অসৎ পথে পরিচালিত করলো। . . . অর্থাৎ পার্টিগুলো এখন হয়েছে এক ধরনের এম্পয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ।”

সকল রকম মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর আক্রমণ চলছে
দেশে প্রতিদিন গড়ে ৯টি খুনের ঘটনা ঘটছে। প্রতিমাসে ধর্ষিত হচ্ছেন ৪০ জন নারী। গত তিন বছরে আইন-শৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ৩১২ জন গুম হয়েছেন। শুধু ২০১৫ সালেই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৯৮টি। এর মধ্যে ক্রসফায়ার করে মারা হয়েছে ৭০ জনকে। পুলিশ প্রশাসন নিজেই বড় বড় খুনের সাথে জড়িত। নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের মামলায় সরকারের এলিট ফোর্স র‌্যাব জড়িত বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রতিদিন পুলিশের বিরুদ্ধে গড়ে ৩৮টি অভিযোগ পুলিশ সদর দপ্তরের সিকিউরিটি সেলে এসে জমা হচ্ছে।

সংবাদপত্রের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিদিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। যে খসড়া সম্প্রচার নীতিমালা সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়েছে তা চূড়ান্তভাবে অগণতান্ত্রিক। আইসিটি এ্যাক্টের ৫৭ ধারায় একের পর এক গ্রেফতার চলছে। এই ধারাটিই ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। উপরন্তু এই ধারার অধীনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কেউ মন্তব্য করলে তাকে জেলে ঢোকানো হচ্ছে। অথচ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংবাদমাধ্যমের কাজই হচ্ছে সরকারের সমালোচনা করা।

একই সাথে আরেকটি আইনের খসড়া চলছে- ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকরণ আইন’।  এও চূড়ান্তরূপে গণবিরোধী। দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখার ওপরে এরকম একটি আইন করা বাস্তবে শাসক দল কর্তৃক লিখিত ইতিহাসকেই একতরফা সুরক্ষা দেয়ার জন্য।

একটা ফ্যাসিবাদী সাংস্কৃতিক মনন গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে
সব জায়গায়
প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়, দেয়ালে লিখনে, বিলবোর্ডে এখন এমনকি প্রাথমিক ক্লাসের পাঠ্যবইয়ের পেছনেও প্রধানমন্ত্রীর প্রচারণা, প্রশস্তি তুলে ধরা হচ্ছে। একটা উগ্র সাংস্কৃতিক মনন গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে গোটা জাতির মধ্যে। রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হলেন জাতির নেতা। স্বাভাবিকভাবেই তিনি রাষ্ট্রের সেই একমাত্র দলেরও নেতা। তিনি সমস্ত নিয়ম-কানুন-নীতি-পদ্ধতি ঠিক করেন। তার ইচ্ছাতেই সবকিছু নির্ধারিত হয়। তার মানে এই নয় যে, জনগণের ইচ্ছার উর্ধ্বে তার ইচ্ছা। তিনি হলেন জনগণের ইচ্ছার রূপকার। তিনি জানেন, সবচেয়ে ভাল জানেন এবং সবার চেয়ে বেশি জানেন কি করতে হবে, কোন লক্ষ্যে জাতিকে নিয়ে যেতে হবে। তাই তার স্তুতি, প্রশস্তি, তার হাতকে শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক দল-মিডিয়া-বিচার-আদালত-প্রশাসন যা কিছুই হোক, থাকবে। এর বিপরীত কোন চিন্তা, যুক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন যে কোন কিছুকেই প্রশাসনের নির্মম আঘাতের মুখে পড়তে হবে।

এরকম অবস্থায় দেশের মধ্যে একধরনের যুক্তিহীন, তর্কহীন, জবাবদিহিতাহীন পরিবেশ তৈরি হয় যা সকল রকমের গোড়ামি ও সাম্প্রদায়িক মানসিকতাকে উস্কে দেয়। দেশের মধ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সকল রকমভাবেই মার খায়। এই অবস্থা একটা দেশ ও জাতির জন্য খুবই দুর্যোগের।এ অবস্থা দেশের বামপন্থী দলসমূহ তথা সকল স্তরের গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা ধারণকারী লোকেদের এর বিরুদ্ধে এগিয়ে আসা দরকার।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments