Saturday, November 23, 2024
Homeফিচারসিলিন্ডার ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি

সিলিন্ডার ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি

বামপন্থীদলগুলোর হরতাল-জ্বালানি মন্ত্রণালয় ঘেরাওয়ে নজিরবিহীন পুলিশি হামলা

Bam_and_CPB
মাসখানেক আগে গত জানুয়ারিতে তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি আহুত হরতালে পুলিশি তান্ডবের দগদগে স্মৃতি জনমানুষের মন থেকে মুছে না যেতেই আবারও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পুলিশের হামলা-নির্যাতন প্রত্যক্ষ করলো দেশবাসী। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা ও সিপিবি-বাসদ আহুত হরতালের সমর্থনে প্রগতিশীল ছাত্র জোট ঢাকার শাহবাগে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সমাবেশ করছিল। কিন্তু গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী সরকারের এই প্রতিবাদটুকুও সহ্য হয়নি। তাই পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে হামলা করে নেতা-কর্মীদের আহত করলো, গ্রেফতার করলো ১১জন নেতা-কর্মীকে। এদিকে এই মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ১৫ মার্চ গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার জ্বালানি মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচিতেও পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ ও হামলা করেছে। হামলায় আহত হয়েছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুদ রানা, অনিমেষ রায়, শরিফুল ইসলাম, সজীব চৌহান, খোকন মোহন্তসহ বিভিন্ন বামপন্থীদলের ১৬ জন নেতা-কর্মী। একদিকে কয়েকমাস আগে বিইআরসি’র গণশুনানিতে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব অযৌক্তিক প্রমাণিত হলেও হঠাৎ করে স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা অন্যদিকে মূল্যবৃদ্ধির ফলে সংক্ষুব্ধ জনতার মনের আকুতিকে উচ্চকিত করছে যে প্রতিবাদী কন্ঠগুলো তাদের উপর নির্মম দমন-পীড়ন – এই হল বর্তমান সরকারের গণতন্ত্রের নমুনা! একটা সরকার যদি গণতান্ত্রিক হয় তাহলে তো তার জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা উচিত। এই যে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি- এতে কি জনগণের সায় আছে? সমস্ত মহল থেকেই তো এই অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ এসেছে। তাহলে কেন এই মূল্যবৃদ্ধি? কার স্বার্থে?

আবাসিকে এক বার্নার চুলায় গ্যাসের দাম ৬০০টাকা থেকে বাড়িয়ে মার্চে ৭৫০ ও জুনে ৯০০টাকা এবং দুই বার্নার চুলায় গ্যাসের দাম মার্চে ৬৫০ থেকে বাড়িয়ে মার্চে ৮৫০ টাকা ও জুনে ৯৫০ টাকা করা হলে ভোক্তা জনগণ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুধু আবাসিকের গ্যাস নয়, শিল্প, সার, বিদ্যুৎ বাণিজ্যিক, চা-বাগান, সিএনজি প্রভৃতি খাতেও গ্যাসের মূল্য বাড়ানো হয়েছে। ফলে গ্যাসের উপর নির্ভরশীল উৎপাদিত পণ্যের মূল্য সরাসরি বাড়বে। আবার উৎপাদিত পণ্য পরিবহনেরও খরচ বৃদ্ধির কারণে আরেকদফা পণ্যের মূল্য বাড়বে। পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিসহ বাড়ি ভাড়া, গাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির ফলে সাধারণ জনগণ তথা নিম্ন-মধ্য আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাবে। অন্যদিকে প্রকৃত মজুরি না বাড়ায় এই সমস্ত সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠবে। ফলে এই কথা পরিষ্কার যে এই মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ জনগণের কোনো স্বার্থ নেই।

সরকারের তরফ থেকে যুক্তি করা হয় বেশি দাম দিয়ে কিনে কম দামে তাদেরকে গ্যাস বিক্রি করতে হয়। ফলে কতদিন আর ভর্তুকি দিয়ে চালাবে সরকার? এই যুক্তিও ধোপে টেকে না। কারণ গত কয়েক বছরে এইখাত থেকে সরকার লাভ করছে। পেট্রোবাংলার অধিভুক্ত কোম্পানিগুলো থেকে সরকার প্রায় ৬০০০ কোটি টাকা কর-লভ্যাংশ-রয়্যালটি বাবদ পেয়েছে গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে। এরপরও পেট্রোবাংলার নীট মুনাফা ১২৬৯ কোটি টাকার বেশি। রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য এই খাতে আরো নতুন করে শুল্কারোপ করছে। ফলে এই অবস্থায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। আবার যে গ্যাস সরকারকে কিনতে হয়, তাতে বেশি দাম দিতে হয় কেনো? পেট্রোবাংলা প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাস বাপেক্স-এর কাছ থেকে কেনে ২৫ টাকায়, আর বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে কেনে গড়ে ২৫০ টাকায়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে যে গ্যাস ২৫ টাকা খরচ করে কেনা সম্ভব সেই গ্যাস তাহলে বেশি দাম দিয়ে কেনো বিদেশি কোম্পানি থেকে কিনতে হচ্ছে? বাপেক্সকে গ্যাসকূপ না দিয়ে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে লিজ দিচ্ছে তো সরকারই। জনগণের স্বার্থ ক্ষুন্ন করে বিদেশি কোম্পানিকে লিজ দিয়ে তাদের থেকে অতিরিক্ত দামে গ্যাস ক্রয় করে সরকার একবার জনগণকে ঠকাচ্ছে আবার সেই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করে আরেকবার জনগণের পকেট কাটছে।

অথচ জনগণকে ন্যায্য গ্যাসটুকুও দেওয়া হচ্ছে না। ঢাকা শহরে বেশিরভাগ এলাকায় বাসাবাড়িতে দীর্ঘদিন ধরেই গ্যাসের চাপ কম। ফলে রান্নার কাজে বিঘ্ন ঘটছে। তাই গ্যাসের চাপ না থাকায় পাইপলাইনের গ্যাসের উপর অতিষ্ঠ হয়ে সাধারণ মানুষ সিলিন্ডারের দিকে ঝুঁকছে। প্রকৃতপক্ষে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবসায়ীরাও এটা চায়। এদেশে ৪৮টি প্রতিষ্ঠান এই খাতের ব্যবসার সাথে যুক্ত। বাজারের নিয়ন্ত্রণ বসুন্ধরা গ্রুপের হাতে। প্রতিষ্ঠানগুলো মিলে ‘এলপিজি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছে। এর চেয়ারম্যানও বসুন্ধরা গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমান। তিনি আবার প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারিখাত উন্নয়ন বিষয়ক উপদেষ্টাও বটে। ফলে একথা কারো বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়, তিনি কি ধরনের উপদেশ দিচ্ছেন আর কি ধরনের উন্নয়ন করছেন! এই উন্নয়নের মূল কথা হলো সরকার সেবাখাত থেকে ভর্তুকি দিন দিন উঠিয়ে দিবে। ভর্তুকি উঠিয়ে দিয়ে বৈষম্য কমিয়ে সরকার সরকারিখাত আর বেসরকারিখাতের মধ্যে সমতা বিধান করবে। এই সমতা বিধানের অর্থ হলো সরকার সেবাখাতসমূহ সম্পূর্ণভাবে বাজারের উপর ছেড়ে দেবে। ব্যবসায়ীরা হিসাব কষে দেখেছে আগামী ৫/১০ বছরে বাংলাদেশে ২ মিলিয়ন মেট্রিকটন এলপিজি ব্যবহৃত হবে। বিশাল এই বাজার দেখে ব্যবসায়ীদের চোখ লোভে চকচক করছে। কিন্তু তাদের এই বাজার ধরার ক্ষেত্রে বাধা পাইপলাইনে গ্যাসের ব্যবহার। তাই পাইপলাইনের গ্যাসের উপর নির্ভরশীলতা কাটাতেই গ্যাসের কৃত্রিম সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি করে এলপিজি’র বাজার তৈরি করা হচ্ছে। ফলে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় সরকারের এই সিদ্ধান্ত এলপিজি গ্যাসের ব্যবসায়ীদের স্বার্থই রক্ষা করবে। দুর্দশা বাড়বে জনজীবনে।

 সাম্যবাদ মার্চ ২০১৭

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments