বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)’র উদ্যোগে ‘শতবর্ষে নভেম্বর বিপ্লব: বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও কমিউনিস্টদের কর্তব্য’ শীর্ষক আলোচনা সভা ১০ এপ্রিল’ ১৭ বিকেল ৪টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটের সেমিনার হলে অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)’র কেন্দ্রীয় কার্য পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরি। প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারতের সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার (কমিউনিস্ট) এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ।
সভাপতির বক্তব্যে কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরি বলেন, রুশ বিপ্লবের শতবর্ষ পালন করছি আমরা এমন এক সময়ে যখন প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ভারত সফর করতে গেছেন। কিন্তু তিনি কিছুই আদায় করতে পারেননি। নিরাপত্তা সহযোগিতা, অস্ত্র ক্রয়, লাইন অব ক্রেডিট ঋণ, পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়ন-ডিজেল ও বিদ্যুৎ আমদানি-কানেকটিভিটি বৃদ্ধি-মহাকাশ সহযোগিতা-সাইবার নিরাপত্তাসহ প্রায় সব সমঝোতার মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর ভারতের সামরিক, বাণিজ্যিক ও ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য বাড়বে। পক্ষান্তরে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা, অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনা, গঙ্গা ব্যারেজসহ বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আশ্বাস ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়নি। অনির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে ভারতের শাসকগোষ্ঠীর সমর্থন নিশ্চিত করতে নতজানু নীতি অনুসরণ করে চলেছে। সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থে ভারতের শাসকগোষ্ঠীর সাথে বাংলাদেশের শাসকদের বন্ধুত্বে জনগণের কোন স্বার্থ নেই – তা আরেকবার প্রমাণিত হল। আজকের এ আলোচনা সভায় ভারতের এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) এর সাধারণ সম্পাদক এসেছেন। আমরা যেমন ভারতকে একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ মনে করি, এসইউসিআই (কমিউনিস্ট)ও তেমনি তাকে একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ বলে মনে করে। তারাও দক্ষিণ এশিয়া, মিয়ানমার, মালদ্বীপসহ বিভিন্ন দেশে ভারতের সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরোধী।
প্রধান আলোচকের বক্তব্যে কমরেড প্রভাস ঘোষ বলেন, এক দুঃখজনক সময়ে আমরা নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপন করছি। মানবসভ্যতায় নতুন এক দ্বার উন্মোচন করেছিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। শ্রমিকদের সবেতন ছুটি উদযাপন, বিনামূল্যে শিক্ষা, চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণ বিরাট ত্যাগ স্বীকার করে ফ্যাসিবাদকে রুখে দিয়েছিলো। সেদিন সারা বিশ্বে ছিলো কমিউনিজমের জয় জয়কার। বারট্রান্ড রাসেল, রমা রঁল্যা, আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ সকল মনীষী একে স্বাগত জানিয়েছেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল গানটি প্রথম বাংলায় লিখেছিলেন। কিন্তু এই বিরাট সভ্যতার পতন হলো কেনো? কারণ সমাজতন্ত্র হচ্ছে পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে পৌঁছাবার মধ্যবর্তী স্তর। ক্ষুদ্র পুঁজিকে কেন্দ্র করে, মানুষের ব্যক্তিগত অভ্যাসকে কেন্দ্র করে পুঁজিবাদে ফিরে সম্ভাবনা সব সময়েই থাকে। সোভিয়েতকে প্রতিনিয়ত সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর আক্রমণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিরাট ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলা করতে হয়েছে। দেশের ভেতরে প্রতিবিপ্লবীদের চক্রান্ত মোকাবেলা করতে হয়েছে। একদিকে এই সকল বিরোধাত্মক পরিস্থিতি, অন্যদিকে চেতনার নিম্নমান, মার্কসবাদী রাজনীতি চর্চার ঘাটতি সোভিয়েতের পতন ঘটিয়েছে।
বর্তমানে বিশ্বে শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অস্তিত্ব নেই। বিশ্বের অবস্থা এখন কী? ভারতে সরকার সরকারি দপ্তরের কাজ কন্ট্রাকটরকে দিয়ে দিচ্ছে। বাধ্য হয়ে শ্রমিকরা নামমাত্র মজুরিতে নিজের শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। দরিদ্র কৃষক আত্মহত্যা করছে। দরিদ্র মানুষ অভাবের তাড়নায় নিজের সন্তানকে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। মেয়েদের বিক্রি করে দিচ্ছে পরিবারগুলো কিছু টাকার বিনিময়ে। এদের বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। শুধু ভারত নয় – সব দেশেরই এক অবস্থা। এই সংকটের জন্ম দিয়েছে পুঁজিবাদ।
এই পুঁজিবাদ দেশে দেশে যুদ্ধ লাগিয়ে রেখেছে। জাতিগত, সম্প্রদায়গত, ধর্মগত দাঙ্গা প্রবল রূপ নিয়েছে। পুঁজিবাদ যে শত্রু এই চিন্তার বদলে তাদের মধ্যে বিপরীত ধর্ম, জাতি ও সম্প্রদায়কে প্রধান শত্রু হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। ভারতে বিজেপি-আরএসএসের মাধ্যমে অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতি ভয়াবহ ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এসব এখন সারা বিশ্বে ঘটছে। ঘটাচ্ছে পুঁজিবাদ।
ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রি না বাঁচলে পুঁজিবাদী অর্থনীতি বাঁচবে না। তাই যুদ্ধ তার চাই। একটা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে এখন বিশ্বে দুুটি অর্থনৈতিক-সামরিক জোটের। এর একটি হচ্ছে আমেরিকা-ভারত-অস্ট্রেলিয়া-জাপান-ইসরায়েলকে কেন্দ্র করে; সেটাতে তারা নেপাল, বাংলাদেশসহ এই এলাকার অন্যান্য দেশসমূহকে যুক্ত করতে চায়। আর একটি হচ্ছে রাশিয়া ও চীনকে কেন্দ্র করে।
ভারত একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে তার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন সব সময়েই আছে। বাংলাদেশে তিস্তার পানি তারা দিচ্ছে না, যত চুক্তি তারা স্বাক্ষর করছে তার প্রায় সবই অসম। সবই ভারতের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থে।
পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান নেই, মানবজাতির মুক্তি নেই। কিন্তু পুঁজিবাদ এখন সমাজে মানুষ বলে কিছু রাখছে না। তাই এই সময়ে কমিউনিস্টদের কাজ খুবই কষ্টসাধ্য। এ সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে গণআন্দোলন গড়ে তোলা, ব্যাপক মানুষকে পুঁজিবাদের আগ্রাসন সম্পর্কে সচেতন করে তোলা ও পুঁজিবাদবিরোধী ব্যাপক গণআন্দোলন দেশে দেশে গড়ে তোলা – মানবসভ্যতাকে রক্ষার জন্য কমিউনিস্টদের যথার্থ ভূমিকা পালন করতে হবে।