(নভেম্বর বিপ্লব জারশাসিত রাশিয়ার অত্যাচারিত মানুষকে কীভাবে মুক্তির সন্ধান দিয়েছিল, রুশ দেশে শিক্ষকতা করার সুবাদে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে তা তুলে ধরেছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির গ্র্যাজুয়েট ও ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক প্যাট স্লোন। ১৯৩১ থেকে ১৯৩৭ সালের মধ্যে তিন দফায় রাশিয়ায় গিয়ে তিনি থেকেছেন। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীদের প্রচার করা নানা ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে ১৯৩৮ সালে তিনি ‘রাশিয়া উইদাউট ইলুউশন’ বইটি লেখেন। ১৯৪৫ সালে সেটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয় ‘বিপ্লবোত্তর রাশিয়া’ নামে। ব্রিটিশ বুর্জোয়া গণতন্ত্রের তুলনায় সমাজতন্ত্রের যে শ্রেষ্ঠত্ব প্যাট স্লোন দেখিয়েছেন, এবং সমাজতন্ত্রের অধীনে রুশ জনগণের সর্বাঙ্গীন অগ্রগতির যে বিবরণ তিনি দিয়েছেন তার সামান্য অংশ আমরা গণদাবী থেকে সংগ্রহ করে প্রকাশ করছি। বর্তমানে কমিউনিস্ট ও স্ট্যালিন বিরোধী মিথ্যা প্রচারের মুখোশ খুলতে রচনাংশটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা আশা করি।)
সোভিয়েত স্বাধীনতার মূল কথা
১৯৩৫ সালে রয় হাওয়ার্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে স্ট্যালিন নানা কথার মধ্যে স্বাধীনতা প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত মন্তব্য করেছিলেনঃ
“একজন অভুক্ত চাকরিহীন বেকার যে কী ধরনের ব্যক্তি স্বাধীনতা উপভোগ করার আশা করে তা আমি ভেবে পাই না। শোষণ যেখানে লোপ পেয়েছে, যেখানে একের উপর অন্যের পীড়নের প্রশ্ন নেই, যেখানে নেই দারিদ্র ও বেকারত্বের প্রশ্ন, যেখানে কোনও লোক আগামীকাল রুটি, ঘর বা কাজ হারাবার ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত নয়, সেখানেই প্রকৃত স্বাধীনতা হতে পারে। শুধু সে সমাজেই প্রকৃত ব্যক্তি স্বাধীনতা সম্ভব।”
উপরোক্ত কথাগুলিই হচ্ছে সোভিয়েট স্বাধীনতার মূল কথা।…….
সমস্ত মজুর শ্রেণির কারখানা পরিচালনার দাবি ও কৃষকের জমির স্বত্ব দাবির ফলেই এই সোভিয়েট রাষ্ট্রের পত্তন সম্ভব হয়েছে। এবং এই নতুন পদ্ধতির আওতায় কারখানা পরিচালনায় শ্রমিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে ও গ্রাম্য শাসনব্যবস্থায় কৃষকদের প্রত্যক্ষ অংশ নেওয়ার ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি সম্ভবপর হয়েছে। শ্রমিক শ্রেণি দেখতে পাচ্ছে যে তাদের স্বাধীনতার দাবির মধ্য দিয়ে তারা এমন একটি সামাজিক ব্যবস্থার সৃষ্টি করতে পেরেছে যাতে কি অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে, কি শিক্ষা ও মানসিক উন্নতির ক্ষেত্রে তারা স্বপ্নাতীত সুখ বা আনন্দের অধিকারী হতে পেরেছে।…..
রাশিয়ার পুর্বতন শাসনকর্তাদের কাছে এই অভিনব সামাজিক পদ্ধতি একেবারেই অবাঞ্ছনীয় ছিল।…..
সোভিয়েট ইউনিয়নে দেখেছি যে অর্থনীতি, ইতিহাস ও দর্শন প্রভৃতি বিষয়কে বিজ্ঞান হিসাবেই শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে । উদ্দেশ্য হল ছাত্রদের চিন্তার খোরাক জোগানো এবং বিরুদ্ধ মতামতের এলোমেলো চিন্তা থেকে রেহাই দেওয়া। কারণ এসব তত্ত্ব পুঁজিবাদকে মুল ভিত্তি বলে ধরে নিয়েছে। এছাড়া ছাত্রদের কাছে অর্থনীতি ও মানব ইতিহাসের চিন্তাধারা মুল চিত্রকে প্রকটিত করে। মানুষের ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক বোধের সৃষ্টি করাও হল এর অন্যতম লক্ষ্য। কেমব্রিজে অর্থনীতিতে হাত পাকিয়ে ও উত্তর ওয়েলসে দু’বছর ধরে সে সব শিক্ষা দিয়ে আমি স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি যে, মস্কোয় প্রকৃতপক্ষে বর্তমান বিশ্ব-সমস্যাকে বিশ্লেষণ ও উপলব্ধি করার উপযোগী পাঠ্যবিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। সেখানে আরও দেখতে পাই যে, যে সব বই অবলম্বন করে এই উপযোগী শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে, আমাদের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় সেগুলোর কোনও উল্লেখ নেই।…..
ব্রিটেনে একজন মার্কসপন্থীর অর্থনীতির অধ্যাপক হওয়ার মতোই মস্কোয় একজন মার্কসবিরোধীর অর্থনীতির অধ্যাপক হওয়ার একটা কঠিন ব্যাপার। তেমন জার্মানি ও ভারতবর্ষে দুটি পদ্ধতিই পাশাপাশি নিজস্ব নীতি বজায় রেখে কাজ করছে, এটাও একটা অভাবনীয় ব্যাপার। যদি আমরা সোভিয়েটের অর্থনীতিকে বৈজ্ঞানিক ও আমাদেরটা অবৈজ্ঞানিক বলে মেনে নিই তবে স্বীকার করতে হবে যে সোভিয়েটে অর্থনীতি বৈজ্ঞানিক পন্থায় পরিচালিত হওয়ার পূর্ণ সুযোগ পায়। সে জায়গায় এদেশের মানসিক চিন্তাবৃত্তিগুলো অবৈজ্ঞানিক সুড়ঙ্গ পথে হাঁপিয়ে মরে। সত্যকে খুঁজে নেওয়ার স্বাধীনতা ইংল্যান্ড থেকে সোভিয়েটে ঢের বেশি।…..
কাজেই এটা স্বাধীনতা বনাম স্বাধীনতা দমনের প্রশ্ন নয়। এ হচ্ছে বিভিন্ন রকমের স্বাধীনতার মধ্যে থেকে একরকম স্বাধীনতা বেছে নেওয়ার প্রশ্ন। আমার মতোই যদি আপনারা মার্শেলের ও মার্কসের অর্থনীতির আপেক্ষিক তুলনায় সক্ষম হয়ে থাকেন এবং এই ধারণায় এসে থাকেন যে মার্কসের অর্থনীতিই হচ্ছে একমাত্র বৈজ্ঞানিক এবং ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির অ্যাডাম স্মিথ ও রিকার্ডোর যুগ থেকে ভুল বা অবৈজ্ঞানিক পথে পাক খেয়ে নিজের চারপাশে একটা পৌরাণিক কাহিনী সৃষ্টি করেছে – তবে নিজেদের শিক্ষাপদ্ধতিকে নিন্দা ও সোভিয়েট শিক্ষাপদ্ধতিকে প্রশংসা করতে বাধ্য হবেন। আবার কেউ যদি মনে করে যে আমাদের অর্থনীতিবিদদের মতামতসমূহ বৈজ্ঞানিক, মার্কসবাদীর মতামত অবৈজ্ঞানিক, তবে এখানকার পদ্ধতিই আপনি পছন্দ করবেন। কিন্তু যে যাই ভাবুন, কেউ যেন কল্পনাও না করেন যে কোনও মার্কসপন্থীর অবাধে ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির সর্বোচ্চ পদ অধিকার করার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। সেটা সোভিয়েটেও নেই। কারণ আজ পর্যন্ত এরূপ স্বাধীনতা কোথাও দেখা যায়নি।…..
মার্কসীয় চিন্তাধারাই একমাত্র খাঁটি বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা, এই মত প্রসারের ফলে যদি জনমতের চাপে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমান প্রশ্নে তাদের মতামত বদলাতে বাধ্য হয় এবং উচ্চপদে মার্কসপন্থীরা উন্নীত হয় তাহলে মার্কসবিরোধীদের সরিয়ে সে জায়গায় মার্কসপন্থীদের নিয়োগ করলে সোভিয়েটের মতো এখানেও একই ধরনের অভিযোগ চলতে থাকবে। তারা তখন স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত বলেই অভিযোগ করতে থাকবে। আমি সোভিয়েটে একবার ইতিহাসের ক্লাসে উপস্থিত ছিলাম। তাকে আমি এক কথায় বলতে পারি অপূর্ব। অথচ সেই ক্লাসের বক্তা একজন খেতাবধারী অধ্যাপক নন একজন সাধারণ শিক্ষক মাত্র। তাঁর বলার কৃতিত্ব তাঁর ব্যক্তিত্বের ফলে নয়, সেটা হচ্ছে মানুষের চিন্তাধারার ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ পদ্ধতির গুণ। কৃতিত্বপূর্ণ উপায়ে মানুষের চিন্তাধারার ইতিহাস প্রকাশের স্বাধীনতা উপভোগকারী সোভিয়েট যুবকদের আমি ঈর্ষা করি। আমাদের ছাত্রেরা এই স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত। কারণ মার্কসীয় অর্থনীতিবিদদের মতো মার্কসীয় দার্শনিকেরাও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অপাংক্তেয়। ইতিহাসের বেলায়ও এটা পুরোপুরি প্রযোজ্য।…..
সময়ে সময়ে আমাকে লেখকরা জিজ্ঞাসা করেন যে, “ধরুণ, আমি যদি আজ সোভিয়েটে বাস করে কোনও বই লিখি এবং যে কোনও কারণে হোক সেটা যদি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না পায় তবে আমি সেটা প্রকাশ করতে পারব কি?” স্পষ্টই উত্তর দিয়ে থাকি — “না”। কারণ আজকে সোভিয়েট রাশিয়ায় বই প্রকাশের দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের, ট্রেড ইউনিয়নের, কমিউনিস্ট পার্টির ও অন্যান্য গণপ্রতিষ্ঠানের। সোভিয়েট জাতি গড়ে তোলার জন্য এসব সংঘ সম্মিলিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যেহেতু এসব প্রকাশনালয় হচ্ছে গণপ্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিগত নয়, কাজেই তারা ব্যক্তিগত মুনাফার খাতিরে নয় জনস্বার্থের ভিত্তিতেই এসব বইয়ের বিচার করে, বিবেচনা করে। কাজেই তারা জনস্বার্থের উপযোগী বইই শুধু ছাপায়, অন্য বই নয়। শেক্সপিয়ার ও টলস্টয়ের বই হাজারে হাজারে ছাপানো হয় তবে সস্তা দরের চটকদার বই আদৌ ছাপানো হয় না। সবাই স্বীকার করবে যে, এ হচ্ছে সোভিয়েট পদ্ধতির অন্যতম সুবিধা। এতে নিশ্চয়ই কেউ অমত করবে না। লেনিন ও স্ট্যালিনের লেখা বই লক্ষ লক্ষ সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়। তাই বলে হিটলার বা ট্রটস্কিও লেখা মোটেই ছাপানো হয় না। রাজনৈতিক মতবাদ অনুসারে এটা অনেকেই ভালো বা খারাপ বলবে।….
ধনতন্ত্রের আওতায় প্রকাশনালয় চলে মুনাফার খাতিরে। প্রকাশকদের সেখানে জীবনের দৃষ্টিভঙ্গির চাইতে বই কাটতির দিকেই প্রবল ঝোঁক। ফলে সোভিয়েটের মতো সমাজসেবার প্রেরণা নিয়ে সেখানে প্রকাশনালয় পরিচালিত হয় না। কাজেই মুনাফালোভী প্রকাশকের কতৃত্ব, না জাতির সংস্কৃতির মান উন্নতকারী জনপ্রতিনিধিদের কতৃত্ব, এই দুটির এশটিকে বেছে নিতে হবে।….
অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে, ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বা পুঁজিবাদের যখনই কোনও সংকট দেখা যায় তখনই এমনকী ব্যক্তিগত প্রকাশনালয়গুলি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এসে পড়ে। যদি আমরা ব্রিটেনের কুৎসা প্রচার আইন, দেব নিন্দা আইন, সরকারি গুপ্ত আইন অথবা সরকারি অনুমতি ব্যতীত প্রকাশিতব্য নয়- এ ধরনের আইনের কথা ধরি তবে দেখতে পাওয়া যাবে যে আমাদের স্বাধীনতার ক্ষেত্রও যথেষ্ট সীমাবদ্ধ। জরুরি অবস্থায় স্বাধীনতার তো কোনও কথাই আসে না। যদি আমরা চল্লিশ কোটি লোকের দেশ ভারতবর্ষের কথা ধরি তবে দেখতে পাব, ব্রিটিশ আইনের দৌলতে বহু বামপন্থী প্রকাশনালয়ের বই ভারতবর্ষে পাঠানো নিষিদ্ধ। ব্রিটিশ স্বাধীনতা সমগ্রভাবেও সোভিয়েট স্বাধীনতার চেয়ে মোটেই প্রশস্ত নয়। শিক্ষা সংক্রান্ত স্বাধীনতার কথা যা আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি সে সম্বন্ধেও এই একই কথা খাটে। কে এই স্বাধীনতা নির্ধারণ করবে এবং কাদের স্বার্থের খাতিরে করবে? উভয় ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা রাষ্ট্রের বিশেষ উদ্দেশ্য অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত। প্রকৃত স্বাধীনতাকামীর প্রশ্ন হবে, একটি পরাধীন দেশে বা যুদ্ধরত দেশে শেষ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা প্রত্যেক লোককে স্বাধীন নাগরিক হিসাবে উন্নত হবার বেশি সুযোগ দেবে- সমাজতন্ত্র না পুঁজিবাদ? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর সোভিয়েটে বর্তমানে যে জরুরি অবস্থা, যুদ্ধাবস্থা চলছে এটাও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে যার জন্য সোভিয়েটকে কতক ব্যবস্থা নিজের হাতে নিতে হয়েছে।…..
ধর্মের স্বাধীনতা
এদেশে একটা প্রচলিত বিশ্বাস আছে যে, সোভিয়েটে ধর্মের স্বাধীনতা নেই। কোনও সত্য নেই এ কথার পিছনে। অবশ্য এটা ঠিক যে অন্যান্য দেশের গির্জার তুলনায় রাশিয়ার গির্জাগুলো কিছুটা আর্থিক দুরবস্থা ভোগ করে। কারণ তারা এখন জমি বা মুলধনের মুনাফা ভোগ করতে পারে না। বর্তমানে বস্তির ভাড়া থেকে বঞ্চিত হলে ইংল্যান্ডের গির্জাগুলোও নিঃসন্দেহে দারুণ দুরবস্থায় পড়বে। সোভিয়েট রাষ্ট্রের বক্তব্য হল, কেন আমরা দলে দলে ছেলেমেয়েদের যথেচ্ছ ক্যাথলিক, ব্যাপটিস্ট বা গোঁড়া রাশিয়ান হতে দেব? আমরা ধর্ম সম্বন্ধে নিরীশ্বরবাদী। আমরা এদের কাউকে আমল দিই না। তাই পারিবারিক গন্ডির বাইরে এসব ছেলেমেয়েকে ধর্মবুদ্ধি প্রণোদিত করা নিষিদ্ধ। এ সব ছেলেমেয়েরা কিছুটা প্রাপ্তবয়স্ক হলেই, তারা ইচ্ছা করলে গির্জায় যাতায়াত করতে পারে। কিন্তু নিজেদের বিচার-বুদ্ধি পরিণত না হওয়া পর্যন্ত এদের মধ্যে ধর্মের আবেগ ঢুকিয়ে দেওয়ার আমাদের কী অধিকার আছে?…..
ধর্ম বিশ্বাস যদি স্বর্গীয় অনুপ্রেরণা থেকে আসে তবে সোভিয়েটে তা জীবন্ত হয়ে ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ ধর্মপ্রাণ যুবক যুবতী ইচ্ছা করলে যে কোনও গির্জায় গিয়ে তাদের আধ্যাত্মিক আশার তৃপ্তিসাধন করতে পারে। কিন্তু এটা যদি নেহাৎই মানবিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান বা পদ্ধতি অপরিণত ও অবচেতন যুব মনের উপর আধিপত্য করে বেতার ও পত্রিকা প্রচারের দ্বারা এটাকে জীবিত রাখতে চায়, তাহলে সোভিয়েট রাশিয়ায় এটার বাঁচবার কোনও আশাই নেই।
রাজনৈতিক স্বাধীনতা
সোভিয়েট রাষ্ট্রে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল। রাশিয়ায় যাবার আগেও আমি তা জানতাম। একদলীয় নায়কত্ব কী করে গণতান্ত্রিক হতে পারে এটা জানবার জন্য আমি অত্যন্ত উৎসুক ছিলাম। সোভিয়েটে থাকাকালে প্রথম বছরে অন্যান্য যে কোনও বিষয়ের চেয়ে একদলীয় পদ্ধতি সম্বন্ধেই আমি বেশি আলোচনা করেছি। আমি প্রশ্ন করতাম, “একটি মাত্র রাজনৈতিক দল নিয়ে কী করে আপনারা গণতন্ত্র রক্ষা করেত পারেন?” উত্তর পেতাম, “আমাদের একটা দলের চেয়ে বেশি দলের দরকার কী? আমাদের দল হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণির দল আর আমাদের রাষ্ট্রও হচ্ছে শ্রমিক রাষ্ট্র। আমাদের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে বিপর্যস্ত করার জন্য আমরা বহু পুঁজিবাদী দলের অস্তিত্ব কামনা করিনা।” আমি বললাম, বেশ, মেনে নিলাম।“কিন্তু কর্মীদের মধ্যে মতানৈক্য হলে কী করেন? বিভিন্ন শ্রমিক গোষ্ঠীর বিভিন্ন মত থাকতে পারে এবং সে সব মত প্রকাশের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।” “আমাদের দলের ভেতরেই অনৈক্যের মীমাংসা সম্ভব। ওই সমস্ত বিষয়ের মীমাংসার জন্য সোভিয়েট রাষ্ট্রে কোনও ভিন্ন রাজনৈতিক দল সৃষ্টির প্রয়োজন হয় না।”…. খুশি হলাম না।
সোভিয়েটে একদলীয় শাসন পদ্ধতি সম্বন্ধে এই যে একটা বিরাট গোলমেলে ধারণা, এটা হচ্ছে অনেকটা সেই দল সম্বন্ধে ভুল বোধের ফল। এটি আদৌ একটা পার্লামেন্টারি পার্টি নয়। আমি নিজেও আস্তে আস্তে দলের কার্যাবলি ও সাধারণের এর প্রতি আচরণ দেখে এটা বুঝতে পারি। ১৯৩৩ সালের হেমন্তকালে দল থেকে অবাঞ্ছিতদের সরিয়ে দেওয়ার সময়ে এর ভাল অভিব্যক্তি হয়েছে। আমি তখন ওখানে ছিলাম। সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিস্ট পার্টি হল “শ্রমিক শ্রেণির সংঘবদ্ধ অগ্রবাহিনী”, মানে সমগ্র শ্রমিক গোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিদের প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ যারা সমাজিক উন্নতির সাধারণ কর্মপন্থা পরিকল্পনার দায়িত্ব ও নেতৃত্ব নেওয়ার যোগ্য তাদেরই মিলিত সংঘ। কোনও প্রতিষ্ঠানই এই দাবি সঠিকভাবে পূরণ করেত পারে না, যদি না কাজের ভিতর দিয়ে জনসাধারণের মতের কষ্টিপাথরে যাচাই হয়। এই পদ্ধতির ফলে প্রত্যেক বছর দলের সকল সভ্য যে এলাকায় কাজ করে সেই এলাকার জনসাধারণের কাছে তাদের কাজের হিসাব নিকাশ দেয়, দেয় তাদের রাজনৈতিক ইতিহাস এবং তাদের বর্তমান কাজের খতিয়ান এবং সব শেষে প্রমাণ করে শ্রমিক শ্রেণির ‘সংঘবদ্ধ অগ্রবাহিনী’-র সভ্য হবার দাবির যৌক্তিকতা।
এ ধরনের সভায় জনসাধারণের প্রবেশাধিকার থাকে। যে কেউ ইচ্ছা করলে সম্ভাব্য দলচ্যুত সভ্যের পক্ষে বা বিপক্ষে নানা রকম প্রশ্ন ছাড়া কিছু আলোচনাও করতে পারে। এরূপে কোনও কমিউনিস্ট কর্মী তার কাজের গুরুত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার কথা ঘোষণা করলেও আলোচনা এবং প্রশ্নের ভিতর দিয়ে তার দাবির অযৌক্তিকতা প্রমাণ হয়ে যাওয়া কিছুই অস্বাভাবিক নয়। মানে তার কাজের ভিতর এমন গলদ থেকে যেতে পারে যেটা দলের সুনামের পক্ষে হানিকর বা পারিবারিক বা ব্যক্তিগত জীবনে তার আচরণ এত আপত্তিকর যে সে জনসাধারণের শ্রদ্ধা অর্জনে অক্ষম। এ ধরনের অভিযোগ খন্ডনের পক্ষে যথেষ্ট যুক্তির অভাব হলেই তাকে দল থেকে বহিস্কৃত করা হয়।…..
এ ধরনের একটি সভায় আমি উপস্থিত ছিলাম। সেখানে একজন দলচ্যুত সভ্যের বিরুদ্ধে দর্শকদের সামনে লালফৌজের একজন সৈনিক কতকগুলি উত্তেজনাপূর্ণ প্রশ্নের অবতরণা করল। এই কমিউনিস্ট কর্মী ১৯১৭ থেকে দলের সভ্য। কিন্তু লাল ফৌজের সেই সৈনিকটি তাকে বলশেভিক থাকাকালেই শ্বেত রাশিয়ানদের পক্ষে লড়বার অভিযোগে অভিযুক্ত করল। এই সৈনিকটি এ ব্যাপারের জন্যই বিশেষ করে তৈরী হয়ে এসেছিল। স্পষ্টতই এই ধরনের প্রশ্ন সেখানে সমাধান হওয়ার নয় এবং অভিযোগকারীকে সমস্ত তথ্য লিখে ‘নির্দিষ্ট কমিশনের’ কাছে পাঠাবার জন্য বলা হয়। একটা বিশেষ তদন্তের জন্য এটা স্থগিত রাখা হয়। অন্যান্য ব্যাপারে নারী পুরুষ যেই হোক না কেন, উচ্ছৃংখল জীবন যাপন করলে, তার নৈতিক চরিত্র সম্বন্ধে নানা প্রশ্নের অবতারণা করা হয়ে থাকে। অন্য দেশের মতো সোভিয়েটে এ ব্যাপারে জনমতের মাপকাঠি রয়েছে এবং সেখানে জনমত কমিউনিস্টদের থেকে আদর্শ জীবন যাপনের দাবি রাখে। পরিশেষে কর্মস্থলে তার আচরণ, দায়িত্বহীনতা, অধিনস্থদের প্রতি কর্তৃত্বের ভাব, অলসতা, এ ধরনের সমস্ত প্রশ্নই সেখানেই আলোচিত হয়। ১৯৩৩ সালে রাজনৈতিক কার্যাবলিতে কপটাচরণের উপর অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়। দল থেকে অবাঞ্ছিতদের সরিয়ে দেওয়ার সময়ে যে সব কমিউনিস্ট তার পূর্বতন কার্যাবলী অকপটে ব্যক্ত করেছে, এমনকি বিপ্লবের সময়ে তার বিরুদ্ধ মনোভাবেরও প্রকাশ করতে দ্বিধা করেনি, তাদের বিরুদ্ধে আমি কোন সমালোচনা শুনিনি। যতক্ষণ সে একটানা অকৃত্রিমভাবে তার পূর্বাপর ইতিহাস বলে গেছে ততক্ষণ তার বিরুদ্ধে একটিও প্রশ্ন ওঠেনি। যখনই কেউ গোঁজামিল দেওয়ার চেষ্টা করেছে বা কিছু লুকাবার ভান করেছে, তখনই দর্শকবৃন্দ ও উক্ত কমিশন তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছে। সোভিয়েটে রাজনৈতিক কপটতা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুতর দুর্নাম। কারো পূর্বতন কার্যাবলী সম্বন্ধে ভুল সংবাদ দেওয়া মানে এদেশের চাকরিপ্রার্থীর জন্য মিথ্যা সার্টিফিকেট দেওয়ার মতোই নিন্দনীয়। দুঃখের বিষয় যে আমাদের দেশের বহু কপট রাজনীতিবিদের সোভিয়েটের এই জনপ্রিয় যাচাই-ব্যবস্থার মতো ব্যবস্থায় পরীক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনাই নেই।…
সোভিয়েট নাগরিকদের শুধু আমি উৎসাহভরে “আমাদের দল” ও “আমাদের সরকার” বলতে শুনিনি, অত্যন্ত গর্ব এবং আনন্দের সঙ্গে বার বার “আমাদের স্ট্যালিন” বলতেও শুনেছি। পাশ্চাত্য নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রের ধারায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের কাছে এসব স্থূল বলে মনে হবে। আমি স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি যে, এর সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে আমার বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল।…
এমন কোন প্রমাণ নেই যে, স্ট্যালিন লোকের শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরুপ নেহেরুর চাইতে বেশি আখ্যায় ভূষিত হন। লিঁও ফুচেট ওয়ানগার অন্যান্য বিষয়ের মতো স্ট্যালিনের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করেছিলেন। তিনি লিখেছেন “এভাবে প্রশংসায় ভূষিত হওয়া স্ট্যালিন অত্যন্ত অপছন্দ করেন, মাঝে মাঝে এ নিয়ে হাসি তামাসাও করেন।” স্ট্যালিনের একটা বক্তৃতা আমার মনে আছে যাতে যারা কাজ করার বদলে নেতাদের কাছে এরূপ অভিনন্দনপত্র ও আনুগত্য প্রকাশ করার জন্য বাগ্র, তিনি তাদের দস্তুরমত কশাঘাত করেন।…
আজকে ব্রিটেনে, সারা দেশব্যাপী বেশি সংখ্যক জনসাধারণের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে পারে এরূপ কোনও রাজনৈতিক বা ট্রেড ইউনিয়ন নেতা নেই। কাজেই কোনও নেতাকে শ্রদ্ধা না করে তাকে করতে হবে সমালোচনা, তার নীতি অনুসরণ না করে করতে হবে বাধা সৃষ্টি, এ হচ্ছে এখনকার সাধারণ মনোভাব। এ অবস্থার সঙ্গে আমরা এতখানি অভ্যস্ত হয়েছি যে এটাকে আমরা গণতান্ত্রিক ভাব বলেই অভিহিত করি। আসলে এটা হচ্ছে গণতন্ত্রের অসুস্থ মনোভাবের লক্ষণ। যে গণতন্ত্রে সাধারণ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জনসাধারণের সংঘর্ষ বর্তমান, সেখানে গণতন্ত্রের অঙ্গচ্ছেদই হয়ে থাকে।
যখন কোনও গণতান্ত্রিক দেশে একটা প্রগতিশীল শক্তি ঐক্যের কথা বলে তখন তার মানে হচ্ছে এই : একটা সর্বজনীন প্রচেষ্টায় জনসাধারণ ও নেতাদের সম্মিলিত ঐক্য। আজকে এই সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় নেতাদের বেশি জনপ্রিয় হতে হলে তাদেরকে জনসাধারণকেও তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। যদি স্যার ওয়াল্টার সিট্রাইন ও নেভিল চেম্বারলেন বলেন, “নেতা আসে, নেতা যায়, কিন্তু জনসাধারণ শ্বাশত”, তখন অবশ্যই তাঁরা শ্রেষ্ঠ গণতান্ত্রিক বলে পরিচিত হবেন। আজকের তুলনায় জনসাধারণ তাঁদের এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্য শ্রদ্ধা জানাবে। কিন্তু ‘গণতান্ত্রিক’ সিট্রাইন ও চেম্বারলেন কেউই এই শব্দগুলি গঠন করেন নি, এর গঠনকর্তা হলেন স্বয়ং ‘একাধিপতি’ স্ট্যালিন। …
স্ট্যালিনের মতো ইউরোপের কোনও সমসাময়িক রাজনৈতিক নেতাই জনসাধারণ যে ইতিহাসের সৃষ্টিকর্তা এটা উপলব্ধিই করেন নি। কাজেই ইউরোপের সমসাময়িক কোনও রাজনৈতিক নেতা জনসাধারণের শ্রদ্ধা অর্জন করতে সমর্থ হননি। আমরা প্রায়ই লোকদের মধ্যে সোভিয়েতে স্ট্যালিনের প্রশংসা প্রসঙ্গে আলোচনা শুনতে পাই। একতরফা সমালোচনারও অন্ত নেই। আজকের সোভিয়েতের জনসাধারণ যদি তাদের নেতার গুণগান করার জন্য অভিযুক্ত হয় তবে সে নেতারও জনসাধারণের প্রশংসা করার জন্য অভিযুক্ত হওয়া উচিত। এই পারস্পরিক প্রশংসা হচ্ছে প্রকৃত গণতান্ত্রিক। ফ্যাসিস্ট নেতারা বা আমাদের ব্রিটিশ গণতান্ত্রিক নেতারা কেউ আমাদের “শুধু জনসাধারণ শ্বাশত” এ কথা বলেন না। স্ট্যালিন এটা উপলব্ধি করেছেন এবং কথায়ও সেটা প্রকাশ করেছেন । সে কারণেই স্ট্যালিন দেশবরেণ্য। …
সোভিয়েট রাশিয়া থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে আসার পর আমাকে একটি প্রশ্ন বহুবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছে : “ব্রিটিশ নাগরিকরা যেমন হাইড পার্কে মিলিত হয় চেম্বারলেনের বিরুদ্ধে প্রচারমূলক কাজ চালাতে পারে, সোভিয়েট নাগরিকরা কোনও পার্কে গিয়ে স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে সেরূপ কিছু বলতে পারে কি?” ব্রিটিশ গণতান্ত্রিকদের কাছে এ হচ্ছে গোড়ার কথা। আমার উত্তর হচ্ছে, সোভিয়েটে কোনও নাগরিক পার্কে গিয়ে স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে কিছু বললে জনসাধারণ তাকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাধ্য করবে।…
সাম্যবাদী নয় অথচ সমাজতান্ত্রিক, এরকম লোক সব সময়ে অভিযোগ করে থাকেন যে, সোভিয়েটে আজ কমিউনিস্ট দলের স্বৈরতন্ত্র চলছে। ওরা শুধু যে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে তা নয়, সমস্ত ট্রেড ইউনিয়ন ও লোকপ্রিয় সংঘগুলোতেও তারা আধিপত্য করে। কী করে তারা অন্যান্য সংঘগুলোর উপর আধিপত্য করে? তারা দলের সভ্যদের জন্য অফিস সংক্রান্ত নির্বাচনে বেশি সমর্থন লাভ করে। এতে তারা এতখানি সাফল্য লাভ করে যে, বিভিন্ন দলের পরিচালক সমিতিতে পার্টি সভ্যই থাকে বেশি। এতে অনিষ্টকর বা অগণতান্ত্রিক কিছুই নেই। আজ ব্রিটেনে যদি এরূপ একটি লোকপ্রিয় রাজনৈতিক দল থাকে যেখানে শ্রমিকশ্রেণির প্রতিনিধিত্ব ক্ষমতা আছে তবে আজ সোভিয়েট রাশিয়ায় যে অবস্থা বিদ্যমান এই দেশেও আমরা সেরূপ একটা অবস্থায় পৌঁছতে পারব। তখন আমরা দেখতে পাব যে, এই দলই শাসন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করবে। এবং জনসাধারণ তাদের অনুসৃত নীতি থেকে উপকৃত হওয়ার ফলে এই দলের সভ্যদের করবে সমর্থন। শুধু স্থানীয় বা জাতীয় নির্বাচনে নয়- ট্রেড ইউনিয়ন, সমবায় সমিতি এবং অন্যান্য সমস্ত গণতান্ত্রিক সংঘেও। কার্যত আমরা দেখতে পাব যে যদি জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি নিয়ে একটি প্রকৃত জনগণের দল গড়ে ওঠে তা হলে জনসাধারণ প্রত্যেক গণতান্ত্রিক সংঘের নির্বাচনে সেই দলের সভ্যদেরই সমর্থন করবে, কারণ তারা তখন জানতে পারবে যে এ অবস্থায় দলের সভ্যই ঐক্য ও আকাক্সক্ষার একমাত্র প্রতীক। এ ধরনের দল আমাদের পার্লামেন্টারি দল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোতে শ্রেষ্ঠ নাগরিকরা থাকবে এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। সোভিয়েটে দলে বিশুদ্ধকরণের যে প্রক্রিয়া তাতে শুধুমাত্র শ্রেষ্ঠ নাগরিকরাই দলে থাকতে পারেন। আমাদের এখানে তেমন যাচাই করার কোনও ব্যবস্থা নেই। এখানে দলের সভ্যরা ইচ্ছা করলে অর্থের জোরে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারে।…
১৯৩১ অবধি সোভিয়েটে বাস করে আমার এ ধারণা হয়েছে যে, যদি ব্রিটেনে জনসাধারণের স্বার্থরক্ষাকারী গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয় তবে সে দল উত্তরোত্তর বাড়তে থাকবেই। সেটিই হবে দেশে একমাত্র অগ্রগামী শক্তি, সেটি হবে জনগণের সংগঠিত অগ্রবাহিনী এবং সেই দলের নেতারা তাদের কাজ ও নীতির জন্য সাধারণ শ্রেণির লোকের সমর্থন পাবে। আজকে সোভিয়েট রাষ্ট্রের কমিউনিস্ট দল ও তার নেতারা- স্ট্যালিন, মলোটভ, কালিনিন, ভরোশিলভ, কাগানোভিচ যেরূপ পেয়ে থাকেন, তাঁরাও ঠিক সেরূপ সমর্থন পাবেন।…
সোভিয়েটে সাধারণ নরনারী দৈনন্দিন যে সব সমস্যার সম্মুখীন হয় স্ট্যালিনের বক্তৃতা হচ্ছে তারই একটা জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি। স্ট্যালিন স্বর্গ থেকে এ সব বক্তৃতার বিষয়বস্তুর প্রেরণা পান না, পান সারা দেশব্যাপী অজস্র প্রস্তাব, স্থানীয় সমস্যার মীমাংসা, সুপারিশ, পত্রিকায় প্রকাশিত চিঠি, দলের নেতৃবৃন্দ ও সোভিয়েট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরিত অভিযোগ থেকে। স্থানীয় সমস্যা, সুপারিশ ইত্যাদি সম্বন্ধে প্রচুর খবরাখবর সংগ্রহ না করে সোভিয়েট কেন্দ্রীয় দল বা সরকার কোনও মীমাংসায় উপস্থিত হয় না।
কয়েকটি লোক আমাদের বিশ্বাস না করিয়ে ছাড়বে না যে, স্ট্যালিন নিজেই সোভিয়েট নীতির সমস্ত বিষয়ের মীমাংসা করে থাকেন। নেতা হিসাবে স্ট্যালিনের একটা অত্যাশ্চর্য গুণ এই যে নেতৃত্ব দেওয়ার সময়ে তিনি এমন নীতি বলে দেন যা সমস্ত জনসাধারণের হিতকর হয়। স্ট্যালিন নিজেও এটা বহু বার বলেছেন যে, সাধারণ মজুর শ্রেণির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ব্যতীত কেন্দ্রীয় সমিতির উপদেশ তেমন কোনও কাজে আসে না। কাজেই স্ট্যালিন যখনই কোনও ব্যাপারে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তখনই জোর গলায় বলেছেন যে তাঁর বক্তব্য সমস্ত জাতির মনের কথার প্রকাশ ছাড়া কিছুই নয়।…
১৯৩৮ সালে যখন আমি সোভিয়েট ইউনিয়নে আমার কাজে যোগ দিলাম তখন কারও মনে সন্দেহের অবকাশ ছিল না যে, সোভিয়েটের বহু পদস্থ ব্যক্তিদের দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করার অপরাধে গুলি করে মারা হবে।…
পাঠকরা জিজ্ঞাসা করতে পারেন যে তাঁদের প্রতি ওই অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের কারণ কী? কী কারণে তাঁদের বর্তমান নেতৃস্থানীয়দের তুলনায় দায়িত্বজ্ঞানহীন ও অবিশ্বস্ত বলে মনে করা হত? এর উত্তর মিলবে অতীত গৃহ-ইতিহাসে এবং সোভিয়েট বিপ্লবের ইতিহাসে। এই ইতিহাস সম্বন্ধে ব্রিটিশরা অত্যন্ত অল্পই জানে এবং সোভিয়েট এলাকায় যাওয়ার পরই এর প্রকৃত ইতিহাস জানা যায়। ইংল্যান্ড থেকে দেখে মনে হয়েছিল যে লেনিন ও ট্রটস্কি, কামেনেভ ও জিনোভিয়েভ হলেন রুশ বিপ্লবের নেতা। যাঁরা বক্তৃতামঞ্চে দেখা দিতেন বা বড় বড় রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টো ও ইস্তাহার লিখতেন আমরা একমাত্র তাঁদেরই বিষয় জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু সেই বড় বড় নেতাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব এবং তার সংগ্রাম ও সমাধান সম্বন্ধে কিছু জানতে পারিনি।
১৯১৭ সালে প্রবাসী বলশেভিকরা লেনিনের সঙ্গে রাশিয়ায় ফিরে এলেন। ট্রটস্কিও ফিরলেন তাঁদের সঙ্গে। বলশেভিকদের বিরুদ্ধে তিনি তাঁর বৈপ্লবিক কর্মপন্থা জনসাধারণের কাছে উপস্থিত করলেন। এবং মাত্র ১৯১৭ সালের জুলাই মাসে যখন দেশব্যাপী বলশেভিকদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে তখন তিনি এসে যোগ দিলেন সেই পার্টিতে।…
১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসে উদ্ভব হল গুরুতর পরিস্থিতি। বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি পেট্রোগ্রাডে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটির সভ্য কামেনেভ ও জিনোভিয়েভ সে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গেলেন এবং পরাজিত হওয়ার পর সংবাদপত্রে সে সম্বন্ধে ফলাও করে জাহির করলেন। ফলে বিদ্রোহের গোপন সিদ্ধান্ত পর্যন্ত জানাজানি হয়ে গেল। এঁদের সঙ্গে পূর্বেকার সম্বন্ধ থাকা সত্ত্বেও লেনিন এঁদের তীব্র সমালোচনা করলেন এবং পার্টি থেকে এঁদের বহিস্কার দাবি করলেন। তিনি বললেন- “কামেনেভ ও জিনোভিয়েভ তাঁদের মতো অন্যান্য ভ্রান্ত ও বিপথগামী ব্যক্তিদের একত্র করে দল গঠন করুন। এবং সে দলে কোনও শ্রমিক যোগ দেবে না।” এর কিছু পরেই তিনি একটি চিঠিতে এ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন যে- “শ্রমিকদের পার্টির স্বাস্থ্যরক্ষার একমাত্র পথ হল তার মধ্যে যে বারোজন মেরুদন্ডহীন বুদ্ধিজীবী রয়েছেন তাঁদের বের করে দেওয়া, বিপ্লবীদের সংগঠিত করা এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি পূর্ণ করে বিপ্লবী মজুরদের হাতে হাত দিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়া।” ১৯১৭ সালে পার্টি যখন বাস্তব ও গুরুতর কাজের সম্মুখীন এবং কেন্দ্রীয় কমিটি শুধু বে-আইনি ইস্তাহার প্রকাশ ও পাঠানোতেই আবদ্ধ, লেনিন তখন নেতৃত্বের মধ্যকার বারোজন মেরুদন্ডহীন বুদ্ধিজীবীদের বহিস্কারের কথা বললেন।
নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিপ্লব সম্বন্ধে কয়েকজনের নিজেদের পৃথক পৃথক নীতি ছিল যার সঙ্গে পার্টি নীতির আদৌ কোনও যোগ ছিল না। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, ট্রটস্কি বলশেভিকদের সঙ্গে যোগ দেওয়া সত্ত্বেও তাঁর নিজের পুরনো নীতিতেই বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মতে শুধুমাত্র রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা অসম্ভব, কেন না তার জনসংখ্যার অধিকাংশ হল কৃষক এবং কৃষকরা সর্বদা প্রতিবিপ্লবী শক্তি। একমাত্র সমগ্র ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হলে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা সম্ভব। বলশেভিকদের ‘ডেমোক্রেটিক সেন্ট্রালিজম’ নীতির, যে নীতির ফলে পার্টির বিভিন্ন কমিটির নির্দেশ সমস্ত পার্টি সভ্যদের অবশ্য পালনীয়, ট্রটস্কি বরাবর তার বিরোধী ছিলেন। বিপ্লবের দশ বছর পূর্বে তাঁর ‘আওয়ার পলিটিক্যাল টাস্কস’ বইয়ে ট্রটস্কি বলশেভিক পার্টি সম্বন্ধে লিখেছিলেন, “কোথায় যেন উঁচুতে, খুব উঁচুতে কেউ একজনকে কোথায় আটক করে রাখছে, তার পদচ্যুতি ঘটাচ্ছে, তার শ্বাসরোধ করছে। আবার কেউ একজন এসে নিজের ব্যক্তিত্ব প্রচার করছে। এবং তারই ফলে কমিটির চুড়ায় পতাকা উড়ছে বিজয়গর্বে। পতাকায় লেখা- গোঁড়ামি, কেন্দ্রীয় নির্দেশ, রাজনৈতিক সংগ্রাম”। জারের শাসন সম্বন্ধেও এর চেয়ে কড়া সমালোচনা করা যেতে পারত না। কিন্তু আজও ট্রটস্কির কলম থেকে এই ধরণের নিন্দাবাদ সমান স্রোতে বেরিয়ে আসছে- লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিক পার্টির বিরুদ্ধে নয়- স্ট্যালিনের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।
১৯১৮ সালে তাঁর বৈপ্লবিক নীতির ভিত্তিতে ট্রটস্কি জার্মানির সঙ্গে শান্তি স্থাপনের বিরোধিতা করেন। বুখারিন, রাডেক এবং আরও কয়েকজন লেনিন ও স্ট্যালিনের বিরোধিতা করে ট্রটস্কিদের দিকে গেলেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা একটি ‘বামপন্থী কমিউনিস্ট দল’ খাড়া করলেন। বললেন, লেনিন হচ্ছেন দক্ষিণপন্থী এবং অবশেষে সোস্যাল রেভোলিউশনারিদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে বলপূর্বক নিজেদের দলীয় শাসন কায়েম করবার জন্য সচেষ্ট হলেন। যদি ১৯১৯ সালে কামেনেভ ও জিনোভিয়েভ তাঁদের ইচ্ছানুরূপ অগ্রসর হতে পারতেন তাহলে আজ আর সোভিয়েট শাসনের কোনও অস্তিত্বই থাকত না। যদি ১৯১৮ সালে ট্রটস্কি এবং বুখারিন তাঁদের নিজেদের পথে কাজ করতে পারতেন তাহলে সোভিয়েট গণতন্ত্র সাম্রাজ্যবাদী জার্মানির সামরিক শাসনের নিচে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যেত। এসব পুরনো কথা তুলে নোংরা কাঁথা ধোবার ইচ্ছা আমার নেই, তবে দু’কারণে আমি এ কথার পুনরাবৃত্তি করছি। প্রথমত, কী কারণে সোভিয়েটের নাগরিকদের কাছে এইসব নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা অবিশ্বস্ত বলে প্রতিপন্ন হলেন। দ্বিতীয়ত, এইসব ব্যক্তিরাই সোভিয়েট বিপ্লবের নেতা এই মর্মে আমাদের সংবাদপত্রে যে সব খবর বেরিয়েছে তা যে মিথ্যা তা প্রমাণ করার জন্য। তাঁরা মাঝে মাঝে ভাল কাজ করেছেন সন্দেহ নেই, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাঁদের নীতি কাজে লাগালে দেশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হত।