১৮ মে ২০১৭ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কনভেনশন। উচ্চশিক্ষায় ৫ গুণ বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাবনা বাতিল, শিক্ষা গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি, পিপিপি-হেক্যাপ প্রকল্প বাতিল, ডাকসুসহ সকল প্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ইউজিসির ২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্র বাতিলের দাবীতে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের আহ্বানে অনুষ্ঠিত হয় এই কনভেনশন। এ দিন সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় কনভেনশন উদ্বোধন করেন তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি নাঈমা খালেদ মনিকার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক স্নেহাদ্রি চক্রবর্তী রিন্টুর সঞ্চালনায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বাসদ (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় কার্য পরিচালনা কমিটির সদস্য সাইফুজ্জামান সাকন ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগত প্রতিনিধিবৃন্দ।
কনভেনশনের আলোচনা পর্ব বিকাল ৩ টায় টিএসসি অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নাঈমা খালেদ মনিকার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক স্নেহাদ্রি চক্রবর্ত্তী রিন্টুর পরিচালনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন দৈনিক নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রনেতা আ ক ম জহিরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তানজীমউদ্দীন খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা, সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, লেখক রাখাল রাহা। কনভেনশন ঘোষণা পাঠ করেন সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুদ রানা।
কনভেনশনরে ঘোষণায় বলা হয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর থেকেই এদেশের শিল্প, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা সবকিছুই পরিচালিত হয়েছে কোনো না কোনো নীতির ভিত্তিতে, সুনির্দিষ্ট শ্রেণিস্বার্থের ভিত্তিতে। এই ব্যবস্থায় কোনো কিছু চলছে মানেই হলো তার মধ্যে একটা নীতি কার্যকর আছে। তা সে লিখিত হোক, আর না হোক। তা সে প্রকাশিত হোক, আর না হোক। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা- কোনটিই এর ব্যতিক্রম নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরিচালনা করার জন্য তেমনই একটি নীতিগত পরিকল্পনার নাম ‘উচ্চশিক্ষার কৌশলপত্র : ২০০৬-২০২৬ (Strategic Plan for Higher Education: 2006-2026)’ । সরকার ২০০৬ সালে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে এই মহাপরিকল্পনাটি হাজির করে। ব্যাপারটি এমন নয় যে, এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। বরং এই কৌশলপত্রের মাধ্যমে সরকার অতীতের সাথে সঙ্গতি রেখে সুনির্দিষ্টভাবে এবং দীর্ঘমেয়াদী একটি পরিকল্পনা তুলে ধরেছে। এখন পর্যন্ত এই পরিকল্পনা অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হচ্ছে। এর ফলাফলে গত ১০ বছরে বদলে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কিছু। শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব কিংবা শিক্ষার মর্মবস্তু — সবই পাল্টে গেছে এবং পাল্টাচ্ছে ক্রমাগত। আমাদের সংগঠন কৌশলপত্র প্রকাশের পরপরই এর বিরোধিতা করে, ছাত্রসমাজের সামনে এ সম্পর্কিত বক্তব্য তুলে ধরে এবং নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আজ অবধি এই আন্দোলন পরিচালনা করছে।
কৌশলপত্র বাস্তবায়নের ফলে গত ১০ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লক্ষ্যণীয় কিছু পরিবর্তন সূচিত হয়েছে — নানা খাতে ফি বেড়েছে অবিশ্বাস্যভাবে; প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেড়েছে নিজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা; বাণিজ্যিক স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনা ভাড়া দেয়া হচ্ছে; প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যিক নাইট কোর্স, উইকেন্ড কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স চালু করা হয়েছে; চাকুরি বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ছাত্র সংখ্যা, পাঠের বিষয়বস্তু এবং সিলেবাস পরিবর্তিত হয়েছে; মানবিক ও প্রকৃতি বিজ্ঞানের বিষয়গুলো অবহেলিত হয়েছে, বেড়েছে প্রযুক্তি ও ব্যবসা শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়সমূহ, আমব্রেলা এ্যাক্ট ও প্রস্তাবিত উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসনের লেশটুকুও নস্যাৎ করা হয়েছে; ছাত্র রাজনীতির উপর বেড়েছে নানা রকমের বিধি নিষেধ; গবেষণায় বরাদ্দ নেমে এসেছে প্রায় শুণ্যের কোঠায়; উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্প বা হেক্যাপের নামে বিশ্বব্যাংকের ঋণ নেয়া হচ্ছে; বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ ক্রমাগত নিম্নগামী হয়েছে, বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, কোম্পানির নামে স্থাপনাগুলো নির্মিত হচ্ছে; তথাকথিত `Self Assessment’ এর মাধ্যমে উচ্চশিক্ষাকে ব্যবসায়ীদের প্রয়োজন মতো এবং তাদের চাহিদা অনুযায়ী ঢেলে সাজানোর চেষ্টা চলছে ইত্যাদি।
আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষার এই পরিস্থিতি বিশ্বব্যাপী শিক্ষাসংকটের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। পৃথিবী জুড়েই পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর কাছে শিক্ষাক্ষেত্র এখন অন্যতম লাভজনক বিনিয়োগের খাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকের পর থেকে শিক্ষাবাণিজ্যের এই ধারা তীব্রতর হয়েছে। গ্যাটস চুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ সেবাখাতগুলোকে বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানি, সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠান শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ করছে, তাই তাদের উপযোগী বাজারমুখি বিষয়বস্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হচ্ছে। ইউজিসি’র ২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্র বিশ্বব্যাপী শিক্ষাব্যবসা পরিকল্পনারই একটি অংশ।
শিক্ষা বাণিজ্যের এই করাল থাবা সর্বজনের শিক্ষার অধিকারকে চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাই এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কনভেনশনের আয়োজন করেছি। আমাদের সীমিত সামর্থ্যে সারাদেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শিক্ষাবিদদের কাছে পুস্তিকা-ফোল্ডারের মাধ্যমে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরেছি এবং তাদের মতামত সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর যে চূড়ান্ত আক্রমণ নেমে এসেছে সেই বিবেচনায় আমাদের এই প্রচেষ্টা সীমিত। দেশব্যাপী ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে উচ্চশিক্ষা ধ্বংসের এই মহাপরিকল্পনাকে কোনোভাবেই ঠেকানো সম্ভব নয় বলে আমরা মনে করি।
এই কনভেনশন থেকে ইউজিসি’র ২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্র বাতিলের দাবিতে দীর্ঘমেয়াদী, ধারাবাহিক তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করে ঘোষণায় বলা হয়, আগামী বাজেটে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি মেডিকেল কলেজে ৫ গুণ বেতন বৃদ্ধির যে ঘোষণা অর্থমন্ত্রী দিয়েছেন তা রুখে দিতে দেশের আপামর ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের পক্ষ থেকে সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন, শিক্ষক-শিক্ষাবিদ-পেশাজীবীদের সাথে মত বিনিময়-আলোচনার প্রক্রিয়া পরিচালিত করে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উচ্চশিক্ষা রক্ষা ও বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণবিরোধী একটা প্ল্যাটফরম নির্মাণের যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণে সংকল্প ব্যক্ত করা হয়। দেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-জেলা-বিভাগ এবং কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা-মতবিনিময় করে সমাবেশ, ঘেরাও, ছাত্র ধর্মঘটসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে উচ্চশিক্ষার উপর সর্বগ্রাসী আক্রমণ প্রতিহত করার কর্মসূচী নেয়া হবে বলে কনভেনশনের ঘোষণায় বলা হয়।
কনভেনশনের ঘোষণায় সবাইকে এই লড়াইয়ে শামিল হবার আহ্বান জানানো হয়। কনভেনশনের ঘোষণায় আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলা হয়, ইউজিসি’র কৌশলপত্রের পরিকল্পনা যদি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়, তবে বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘পাবলিক’ চরিত্র বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। দেশের সিংহভাগ মানুষের শিক্ষার অধিকার মারাত্মকভাবে সংকুচিত হবে। তাই কৌশলপত্র বাতিলের লড়াই আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইও। এই আন্দোলনকে সাংগঠনিক সীমার মধ্যে গন্ডীবদ্ধ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। শিক্ষার অধিকার রক্ষা ও সমাজ প্রগতির প্রয়োজনই আমাদের কাছে বড়। তাই যারাই দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান সংকটের গভীরতা অনুভব করেন, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে অবস্থান ব্যক্ত করেন তারাই এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হবেন বলে কনভেশন থেকে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়।
কনভেনশনে ১৫ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের নামঃ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যাগর, বুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে।