সব পর্যায়ে আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ চলছে। জানা গেছে, সব কয়টি বিতরণ কোম্পানি খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে। কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সব ধরনের কাগজপত্র পেলে জুনের মধ্যে গণশুনানি করে নতুন মূল্যহার ঘোষণা হতে পারে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, বিইআরসি এবং পিডিবি সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট) বিদ্যুতের গড়ে খুচরা মূল্য ৬ টাকা ৭৩ পয়সা গত বৃহস্পতিবার ভোক্তা পর্যায়ে খুচরা মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে পিডিবি। ডিমান্ড চার্জ ও সার্ভিস চার্জ বৃদ্ধিসহ প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম অন্ততঃ ৭ টাকা ৭১ পয়সা নির্ধারণ করতে চায় সংস্থাটি অর্থাৎ প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য ১৪.৫৬ শতাংশ বা ৯৮ পয়সা বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
দাম বাড়ানোর যুক্তি নেই, বরং কমানোর সুযোগ আছে
গ্যাসের পর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সরকারি সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের প্রাইসটা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদ্যুতের দামও আমরা অ্যাডজাস্ট করতে চাই। অথচ, গত ফেব্রুয়ারিতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সময় বিইআরসির এক মূল্যায়নেই বলা হয়েছে তেলের দাম কমায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় কমেছে ৩৪ পয়সা। আর বিদ্যুৎ উৎপাদনে দুই ধাপে গ্যাসের মূল্য বাড়বে ১২.০৬ শতাংশ। এর ফলে প্রতি ইউনিটে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে ৩৪ পয়সা। অর্থাৎ সার্বিকভাবে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়ে পড়বে না। গ্যাসের দাম বাড়ায় যে খরচ বাড়বে, তেলের দাম কমায় তা মিটে যাবে। আর আন্তর্জাতিক বাজার বিবেচনায় নিলে তেলের দাম আরো কমানোর সুযোগ সরকারের হাতে রয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে অধিকাংশ বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো লভ্যাংশে রয়েছে। ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির বার্ষিক আয়-ব্যয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ছাড়া বাকি চারটি কোম্পানিই লাভজনক অবস্থানে রয়েছে। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়াকে দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, পরিস্থিতি আদৌ তা নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে যে দামে জ্বালানি তেল বিক্রি হচ্ছে, তাকে বিবেচনায় নিলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বাড়ার কোনো কারণ নেই। ফলে ‘লোকসান’ বা উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে গিয়ে ‘ভর্তুকি’ দেওয়ারও কোনো কারণ নেই। বলা যায়, জ্বালানি তেল বিক্রির ক্ষেত্রে সরকার বিপিসির মাধ্যমে অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য মাত্রায় মুনাফা করার যে নীতি নিয়েছে, তাকেই এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা হচ্ছে।
বিদ্যুৎখাত ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেয়ার পরিণামে বার বার মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে
পিডিবির সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ১৫টি বেসরকারি কেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় দাম ১১ টাকা ৬৭ পয়সা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাম সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেডের বিদ্যুতের, ইউনিট প্রতি ২০ টাকা ৪০ পয়সা। এ কেন্দ্র থেকেই গত অর্থবছর সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ কিনেছে পিডিবি। বারাকা, ডিজিটাল পাওয়ার ও সিনহা পিপল এনার্জিসহ আরো কয়েকটি বেসরকারি কেন্দ্র থেকে ৭ থেকে সাড়ে ৭ টাকায় বিদ্যুৎ কেনার সুযোগ থাকলেও সেখান থেকে কেনা হয়েছে তুলনামূলক কম। যদিও স্বাভাবিক যুক্তি অনুযায়ী সাশ্রয়ী কেন্দ্র থেকে বেশি বিদ্যুৎ কেনার কথা। ২০১০ সালের ১ মার্চ থেকে ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকার পাইকারি পর্যায়ে ছয়বার ও গ্রাহক পর্যায়ে সাতবার দাম বাড়িয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে এ সময় জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ কমেছে। বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ১৫ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। দেশে মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০৭টিতে। নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র যোগ হয়েছে ৭৪টি। এর মধ্যে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র তথা আইপিপি ২৮টি। ২০১০-১১ অর্থবছরে বেসরকারি কেন্দ্র থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনা শুরু হয়। ওই অর্থবছরই লোকসানে পড়ে পিডিবি। অর্থবছরটিতে পিডিবির লোকসান হয় ৬২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। পরবর্তীতে লোকসানের পরিমাণ বাড়তে থাকে। সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরেও প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লোকসান করে পিডিবি। গত ছয় বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থা লোকসান গুনেছে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
সামগ্রিকভাবে সরকারের ভুল নীতি ও বেসরকারি মালিকদের মুনাফাবান্ধব/স্বার্থরক্ষার নীতি জনগণকে বার বার দুর্ভোগে নিপতিত করেছে। কারণ জনগণের দরকার তো ভোটে। তখন আশ্বাসে ভোলানো যাবে। আর ভোটের টাকা জোগাবে তো পুঁজিপতি/ব্যবসায়ীরা। ফলে দেশের স্বার্থ তো রক্ষা করতেই হবে! এখন আমরা আমাদের স্বার্থ কিভাবে রক্ষা করবো, তা আমাদের ভাবতে হবে।