সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে আড়াল করতে চায় গণবিরোধী দুঃশাসন
“এমন নয় যে, তারা সৈনিক ছিলো; যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হয়েছে। তারা ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় নিহত সাধারণ নাগরিকও নয়। তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী বা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সদস্যও নয় যে, রাষ্ট্রীয় শক্তির হাতে নিষ্পেষিত হয়েছে। তারা আমাদের অংশ ছিলো, বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক ছিলো। কিন্তু তাদের খুঁজে খুঁজে, পিটিয়ে ও নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছে। . . . .” ‘ইন্ডিয়া টুডে’ পত্রিকায় এক লেখায় দময়ান্তি দত্ত ও কৌশিক ডেকা মর্মস্পর্শী ভাষায় ভারতের বর্তমান সাম্প্রদায়িকতা ও অসহিষ্ণুতার পরিবেশের বর্ণনা দিয়েছেন (দৈনিক সমকাল ২১ জুলাই ২০১৭)। যে বর্ণনা তারা দিয়েছেন, এ ভাবা যায় না। বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর এটি ক্রমে বেড়েই চলেছে।
২০১৫ সালে উত্তর প্রদেশের দাদরিতে ঘরে গরুর মাংস রেখেছে এই সন্দেহে মোহাম্মদ আখলাক নামে এক ব্যক্তিকে হত্যা করে গো-রক্ষকেরা। এ পর্যন্ত পিটিয়ে মারার অন্তত ৫০টি ঘটনা ঘটেছে ভারতের ১১টি রাজ্যে(সমকাল ২১ জুলাই পৃষ্ঠা ১০)। যারা এর প্রতিবাদ করেছেন, ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতির এই হিংস্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে যারা দাঁড়িয়েছেন, ধর্মকে রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে যুক্ত না করে নিজ নিজ বিশ্বাসের জায়গায় রাখার জন্য যারা সোচ্চার হয়েছেন – তারাও তালিকা থেকে বাদ পড়েননি। তাদেরও হত্যা করা হয়েছে। . . . . . . .
হঠাৎ করে গরু নিয়ে এরকম উত্তেজনা তৈরি করার পেছনে ধর্ম রক্ষার কোন ব্যাপার নেই, একথা ভারতের অনেকেই ধর্মীয় পুঁথি-পুস্তক তুলে ধরে ধরে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন। এর পেছনে অন্য উদ্দেশ্য আছে। ভারত একটা পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র। সে দেশের জনজীবনের সংকট দিন দিন বাড়ছে। মূল্যবৃদ্ধি-বেকারত্বের চাপে সেদেশের জনগণ দিশেহারা। দারিদ্র্য ও ঋণের চাপে কৃষকদের আত্মহত্যা করার ঘটনা দু’চারদিন পরপরই পত্রপত্রিকায় আসে। মিডিয়ায় আসা খবর হিসেব করলেই বোঝা যায় সেদেশের সাধারণ মানুষের পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, অথচ প্রকাশিত খবর তো বাস্তব অবস্থার ছোট একটি অংশের প্রকাশ মাত্র – প্রকৃত পরিস্থিতি আরও খারাপ। বিজেপি সরকার দেশের এইরকম সংকটের মুখে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জনগণকে ‘আচ্ছে দিন’ আনার ভরসা দিয়েছিল। বুর্জোয়া মিডিয়ার প্রবল প্রচারে মানুষও সেটি বিশ্বাস করেছিল। ফলে গত নির্বাচনে বিরাট ব্যবধানে ভোটে বিজয়ী হয় বিজেপি।
কিন্তু ব্যবস্থাই যেখানে সংকটের জন্ম দেয় সেখানে ব্যবস্থাকে বহাল রেখে সংকটের সমাধান কোনোভাবেই সম্ভব হতে পারে না। অল্পদিনেই বিজেপি সম্পর্কে মানুষের মোহমুক্তি ঘটেছে। আর বিজেপিও বুর্জোয়া ব্যবস্থার সংকটকে আড়াল করার জন্য চিরাচরিত অস্ত্র ধর্মকে ব্যবহার করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এ ব্যাপারে আগে থেকেই দক্ষ ছিলেন। তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ২০০৪ সালে সেখানে এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত করেন। হাজার হাজার লোক সে দাঙ্গায় নিহত হয়েছিল। তার নেতৃত্বে বিজেপি এবার তাদের দক্ষতার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটাতে লাগলো।
ফলস্বরূপ তৈরি হলো অসহিষ্ণুতা, অবিশ্বাস, উগ্রতা। মানুষের ঐক্যে ফাটল ধরা শুরু হলো। বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, অনাহার এগুলোতে হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ নেই। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংকট কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। যারা ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না, ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, সব হারিয়ে গ্রাম থেকে শহরে পাড়ি জমাচ্ছেন – তারা কোনো বিশেষ ধর্মের মানুষ নয়। সবাই এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, নারীপুরুষ-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিষময় ফল ভোগ করছেন।
তাই এই অভিনব সমস্যা থেকে মুক্তির রাস্তাও অভিনব, ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ভেদে তা ভিন্ন হতে পারে না। দরকার ঐক্যবদ্ধ লড়াই। শাসকগোষ্ঠী এই ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের শক্তিকে দুর্বল করতে চায়, মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে রাখতে চায়। ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ভেদে এই বিভক্তি সৃষ্টি করলে শ্রমজীবী মানুষ একে অপরকে শত্রু ভেবে পরস্পর লড়ালড়ি করে, নিজেদের শক্তিক্ষয় করে। তাতে শোষণমূলক সমাজব্যবস্থা আড়ালে চলে যায়। তারা বুঝতে পারে না হিন্দুর শত্রু মুসলমান বা মুসলমানের শত্রু হিন্দু নয় – উভয়ের মূল শত্রু পুঁজিবাদ।
মোদী ও তার দল বিজেপির এ হেন কর্মকান্ডের পেছনের উদ্দেশ্যও এই। তবে এবারে এটা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এরকম সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা নিকট অতীতে আর দেখা যায়নি। প্রচন্ড আতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করছে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়। যদিও এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ভারতের গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বসিরহাট, স্বরূপনগরসহ কিছু এলাকায় গুজবকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা চলছিল। সাধারণ মানুষ তা রুখে দেয়। ভারতের বামপন্থী দল এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) এলাকায় এলাকায় সচেতন মানুষকে জড়ো করে শান্তি কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে।
রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের মাধ্যমে ফায়দা লোটার অপচেষ্টা বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী, বুর্জোয়া দলসমূহ এবং মৌলবাদী শক্তিসমূহও করে থাকে। এদেশের সকল শিক্ষিত-সচেতন-গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন মানুষকেও এব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত।