Saturday, November 23, 2024
Homeফিচারভয়াবহ বন্যা — অথচ সরকার নির্বিকার!

ভয়াবহ বন্যা — অথচ সরকার নির্বিকার!

flood copy

ভয়াবহ বন্যায় এবারের ঈদের আনন্দ ঘুচে গেছে দেশের মানুষের। এবারের বন্যায় প্রায় সাড়ে ৫ হাজারের মতো গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ৭৫ লক্ষ মানুষ ছিল পানিবন্দী, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাড়ে ছয় লক্ষ হেক্টর জমির ফসল। প্রায় দেড়শত মানুষ মারা গেছে এ বন্যায়।

বন্যা কবলিত এলাকার মানুষ তাদের বাসস্থান হারিয়েছে, গৃহপালিত গবাদিপশু হারিয়েছে, হারিয়েছে বেঁচে থাকার অবলম্বন একটুকু ফসলি জমি। বন্যাদুর্গত মানুষ তাদের বাসস্থানের সাথে হারিয়েছে সারা বছরের সঞ্চিত খাদ্য, ঋণ পরিশোধের জন্য জমানো টাকা, গবাদি পশু, পুকুরের মাছ। অসংখ্য পরিবার বাঁচাতে পারেনি তাদের বয়স্ক এবং শিশু সদস্যটিকে। বন্যা শুরু হবার পরপরই ওই বন্যা কবলিত এলাকার প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ বাড়িঘর হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছে কখনও রেললাইনের উপর, কখনও কোনো উঁচু টিলায় অথবা কখনও খোলা আকাশের নীচে কলার ভেলায় দিনাতিপাত করেছে।

বরিশালে ত্রাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে
বরিশালে ত্রাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে

বন্যার পানি এখন নামতে শুরু করেছে। কিন্তু এতে কি সমস্যার সমাধান হবে? বাস্তবে মানুষের সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করবে। কারণ, বন্যায় আক্রান্ত পরিবারগুলো সর্বস্বান্ত হয়েছে। বাড়িঘর হারানো কৃষকেরা এখন ঘরবাড়ি ঠিক করবে কীভাবে, পরবর্তী চাষের প্রস্তুতি কীভাবে নেবে আবার ইতিমধ্যেই যে ঋণ তাদের আছে এনজিওগুলোর কাছে তার শোধই বা কি করে দেবে — এই ভয়ঙ্কর সঙ্কটে তারা পড়েছে। এই সঙ্কটের সমাধান না করতে পেরে একটা বড় সংখ্যার কৃষক গ্রামে যতটুকু জমি ছিল তা বিক্রি করে কাজের আশায় শহরে পাড়ি জমাবে। এরা সংখ্যায় এক-দু’জন নয়, লক্ষ লক্ষ। দলে দলে শহরে আসা এই লোকেদের জন্য শহরে কোন কাজ নেই। ফলে একদিকে শ্রম সস্তা হবে, অপরদিকে সামাজিক জীবনে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে ভীষণভাবে।

স্কুল ছাত্ররাও ত্রাণ তৎপরতায় পিছিয়ে নেই
স্কুল ছাত্ররাও ত্রাণ তৎপরতায় পিছিয়ে নেই

এর সামাজিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী। একটা বিরাট সংখ্যক কর্মক্ষম লোক বেকার হয়ে যাওয়া, ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে ঝরে পড়া, এক একটা জনপদ ধরে ধরে লোকেরা ঘর ছেড়ে রাস্তায় নামা — এটা শুধু ওই মানুষগুলোর বিষয় আর থাকেনা শেষ পর্যন্ত। ওই এলাকার অর্থনীতির উপরও তার প্রভাব পড়ে। ছোট ও মধ্য ব্যবসায়ীদের একটা অংশ উচ্ছেদ হবে। কাজ হারাবে ওইসব ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত থাকা কর্মচারি, দিনমজুরেরা। সব মিলিয়ে এক জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকবেনা।

আবার বন্যার পানি নামার সময় নানা রকম পানিবাহিত রোগ মহামারি আকারে দেখা দেবে, অথচ এই অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য কোনো উদ্যোগ-আয়োজন সরকারের পক্ষ থেকে নেই। ভেঙে পড়া স্কুলঘর, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণে কোনো ত্বরিত পদক্ষেপ সরকারের পক্ষ থেকে লক্ষ করা যাচ্ছে না। একেবারেই মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে বন্যায় আক্রান্ত মানুষেরা।

দেশে যখন এমন এক পরিস্থিতি তখন দেশের সরকার ব্যস্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে। ব্যস্ত প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের পাল্টা বক্তব্য তৈরিতে। কীভাবে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমে আসবে, কীভাবে সমস্ত দুর্গত মানুষদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া যাবে, বন্যা পরবর্তী মহামারি কীভাবে মোকাবেলা করা যাবে, মানবিক সংকটটা কীভাবে আটকানো যায় — এসব নিয়ে সরকারের কোনো ব্যস্ততা লক্ষ করা যায়নি। পত্রপত্রিকায় আমরা বন্যার সময়ে দেখেছি, ঐ এলাকার মানুষের কী দুর্ভোগ! ত্রাণ না পাওয়ায় তাদের কান্না আমরা গণমাধ্যমগুলোতে দেখেছি। বন্যা আক্রান্ত ৭০ লক্ষ মানুষের মধ্যে মাত্র ২৫ লক্ষ সরকারি ত্রাণের আওতায় এসেছে। তাহলে বাকি ৪৫ লক্ষ মানুষ কীভাবে বাঁচবে, তা নিয়ে সরকারের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আমরা এও দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী যখন উত্তরবঙ্গে বন্যা পরিস্থিতি দেখতে গেলেন, সেখানে ত্রাণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেবার ঘোষণা দিলেন। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটেনি। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য যত ফলাও করে গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, তার সামান্য পরিমাণ কার্যকারিতাও দুর্গত জনগণ উপলব্ধি করেনি। বরং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপিদের মুখে শোনা গেছে — ‘দেশে কোনো বন্যা নেই।’ বাস্তবিকপক্ষে সরকারিভাবে বরাদ্দ ছিল নিতান্ত স্বল্প এবং যতটুকু বরাদ্দ ছিল তার বেশিরভাগই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের পকেটে গেছে। ঠিক একই রকম লুটপাট আমরা দেখেছি বন্যাকবলিত হাওর অঞ্চল নিয়েও।

মানুষের এমন অবর্ণনীয় কষ্টের পরও সরকার এত নির্লিপ্ত কেন? কারণ শত শত মানুষের কান্নার শব্দ, বাঁচার আকুতি সরকারের কানে পৌঁছায় না। ইতিপূর্বে শুকনো মৌসুমে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশ ভারতের যেসকল আন্তর্জাতিক নদী রয়েছে সেগুলোতে বাঁধ দিয়ে ভারত সরকার কীভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আর এখন বর্ষাকালে যখন গঙ্গা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রে ধারণ ক্ষমতার বেশি পরিমাণ পানি প্রবাহিত হচ্ছে তখন ভারত সরকার সমস্ত বাঁধ খুলে দিয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। কোনো সরকারই সাম্রাজ্যবাদী ভারতের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে দাঁড়ায়নি, নিজেদের ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে যায়নি।

ত্রাণের দাবীতে গাইবান্ধায় মিছিল
ত্রাণের দাবীতে গাইবান্ধায় মিছিল

আমরা জানি, বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও, মনুষ্যসৃষ্ট অনেক কারণই বন্যাকে প্রভাবিত করে। বন্যা তখনই হয় যখন দেশের নদীগুলোর পানি ধারণ ক্ষমতার থেকে নদীগুলোতে প্রবাহিত পানির পরিমাণ বেশি হয়ে যায়। উজানে বৃষ্টির পরিমাণ যদি বেশি হয় অতিরিক্ত পানি যদি প্রায় প্রতিনিয়ত নদীগুলো দিয়ে নামে তাহলে সরকারের উচিৎ নদীগুলো খনন করা। আমরা দেখি বিভিন্ন নদীতে সেতু হয়, যোগাযোগব্যবস্থা গতিশীল রাখতে সেতু প্রয়োজনীয় কিন্তু সেতু নদীর স্বাভাবিক স্রোতধারায় বাধা সৃষ্টি করে। যার ফলে সেতুর নীচে চর পরতে দেখা যায়। দেশের প্রায় সমস্ত বড় বড় নদীতেই এভাবে সৃষ্টি হচ্ছে পলির পাহাড়। কিন্তু কোথাও কোনো নদী খননের উদ্যোগ নেই, কদাচিৎ কোনো নদীতে যদি খনন কাজ চলেও সেই খননকৃত পলি ফেলে রাখা হয় নদীর পাড়ে, যা পুনরায় নদীতেই ফিরে আসে। এভাবেই বাজে উন্নয়নের ভাঙ্গা ঢোল আর নদীখেকো ব্যবসায়ীরা নদী ভরাট করে গড়ে তুলে শিল্প কারখানা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের অধিকাংশ ছোট ও মাঝারি নদীর মৃত্যু হয়েছে নদী শাসনের ফলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব নদী শাসিত হয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগে। নদী বিশেষজ্ঞদের ভাষায় উজান থেকে নেমে আসা পলির কারণে পদ্মা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্রের মতো বড় ও প্রধান নদীগুলোর তলদেশ প্রতি তিন বছরে এক ফুট করে ভরাট হচ্ছে। তাদের আশঙ্কা খনন না করা হলে ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান প্রবাহমান নদীগুলো প্রায় স্রোতহীন মৃত খালে পরিণত হবে। কাজেই এভাবে চলতে থাকলে পাহাড়ে সামান্যবৃষ্টি হলেই বাংলাদেশে বন্যা দেখা দেবে তা প্রায় নিশ্চিত। বাস্তবিকপক্ষে বাংলাদেশের পালাμমে ক্ষমতায় আসা দলগুলো কী এ বিষয়টা জানেন না?

যখনই কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার প্রশ্ন আসে, তখনই সরকার বিভিন্ন অজুহাত দাঁড় করায়। সরকার বলে দুর্যোগ পূর্বাভাসের পর্যাপ্ত প্রযুক্তি তাদের কাছে নেই, তাই তারা ঠিকঠাক পূর্বাভাস দিতে পারে না। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও দুর্যোগ পূর্বাভাসের উনড়বত প্রযুক্তি থাকে না, অথচ এই ৪৬ বছরেই কত যুদ্ধ বিমান বিনা প্রয়োজনেই কেনা হয়েছে।

গত জুলাই থেকে আগস্ট থেকে যে বন্যা শুরু হলো, সরকারকে বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা এই ভবিতব্য বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছিল গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসেই। কিন্তু এই ৫-৬ মাসেও সরকার পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে পারেনি, পর্যাপ্ত খাবারের মজুদ রাখেনি। গবাদিপশুগুলোকে সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করেনি।

সদ্যজাত শিশু ও গর্ভবতী নারীদেরকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা ৫-৬ মাস সময়েও সরকার করতে পারেনি। বন্যা চলাকালীন সময়েও আমরা দেখেছি সরকারের উদাসীনতা। সারা উত্তরবঙ্গ যখন বন্যায় ভাসছে, যখন ঘর-বাড়ি ডুবে গেছে, সমস্ত সহায় সম্বল হারিয়ে অনাহারে পেটের ক্ষুধায় হাহাকার করছে সমস্ত উত্তরবঙ্গের মানুষ, তখনো সরকার বুঝতে পারেনি বন্যা হয়েছে কী হয়নি! এই হচ্ছে সরকারের অবস্থা।

এই পরিস্থিতিতে আমাদের দাবি হলো – বন্যায় আক্রান্ত এলাকার কৃষকদের সকল প্রকার কৃষিঋণ মওকুফ করতে হবে। এনজিও’র ঋণ মওকুফ করতে হবে। তারা যাতে সর্বস্বান্ত হওয়া এই কৃষকদের উপর কোনো চাপ প্রয়োগ না করতে পারে তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। কৃষকদের বিনামূল্যে বীজ সরবরাহ করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো জরুরি ভিত্তিতে মেরামত করতে হবে। ছাত্রদের বেতন ও অন্যান্য ফি আগামী এক বছরের জন্য মওকুফ করে দিতে হবে। বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করতে হবে। বন্যাকবলিত এলাকায় উপযুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। একেবারে ভেতরের এলাকাগুলোতেও মেডিকেল টিম পাঠাতে হবে। বন্যা পরবর্তী মহামারি প্রতিরোধ করতে হবে।

এই একবিংশ শতাব্দীতে, যখন বড় বড় বাঁধ দিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের থেকেও নিচু এলাকাগুলোতে পরিকল্পিত শহর গড়ে তোলা হচ্ছে, সেসময়ে এদেশের মানুষের বারবার ভাগ্যের উপর নিজেদের সমর্পন করার মতো ব্যর্থতা আর কিছুই হতে পারে না।

সাম্যবাদ সেপ্টেম্বর ২০১৭

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments