বন্যা অতিক্রান্ত হয়েছে প্রায় এক মাস। প্রচার মাধ্যমগুলোতে এখন এর খুব একটা প্রচার নেই। সরকারও প্রায় নিশ্চুপ। কিন্তু কেমন আছে বন্যাদুর্গত মানুষগুলো? আমরা দেখছি, সরকার ও রাষ্ট্রের হর্তাকর্তাগণ ‘শান্তি’ আর ‘উন্নয়ন’র আওয়াজ তুলছে। কিন্তু এর কতটুকু প্রভাব আছে সেই বন্যাকবলিত মানুষের জীবনে? এই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষেরাই তো আমাদের খাদ্য যোগায়, তাদের শ্রমে-ঘামে ফসলের বাম্পার ফলন হয়। কিন্তু কতই না ভয়াবহ দুর্দশার মধ্যে কাতরাচ্ছে সেই সহায় সম্বলহীন মানুষেরা! প্রায় দেড়শ’র বেশি মানুষের করুণ মৃত্যু আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল — এদেশের প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগে সাধারণ মানুষের নিদারুণ অসহায়ত্ব।
বারবার বন্যা-ঝড়-অতিবৃষ্টি ইত্যাদি দুর্যোগ প্রাকৃতিক কারণেই আসবে। কিন্তু শুধুই কি প্রাকৃতিক ব্যাপার? না কি ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংসের পরিমাণ বৃদ্ধির পিছনে মনুষ্যসৃষ্ট কারণও দায়ী? এ প্রশ্ন আজ ভাবার সময় এসেছে। প্রায় ৫ লাখ হেক্টরের অধিক জমির ফসল বন্যায় ভেসে গেছে। কৃষকেরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে। সেখানকার দৈনন্দিন জীবনে এখন যেসব সংকট নানাভাবে দেখা দিচ্ছে — তা ভাবলে কোনো বিবেকবান মানুষেরই শান্তিতে থাকার কথা নয়। যেকোনো মানুষের চোখে হাজারো করুণ দৃশ্য অপেক্ষা করছে সেখানে।
বন্যার পানি সরে গিয়েছে। কিন্তু এখনও মানুষ ফিরে পায়নি তাদের স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবন। গ্রামগুলোর অধিকাংশ পরিবারের পুরুষেরা কাজের আশায় পাড়ি জমাচ্ছে শহরে। শহরে গিয়েও পড়ছে ভিন্ন এক অনিশ্চিয়তার মধ্যে। কারো কারো ক্ষেত্রে ঋণের বোঝা এতই ভারী যে বাড়িতে ফেরাও কঠিন হয়ে পড়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় শতকরা ৯০ ভাগ মানুষই ঋণগ্রস্ত। চাষের ফসল ঘরে তুলতে না পেরে পুরনো ঋণ শোধ করাও সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্যে তারা আবার নতুন করে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে। দেখা যাচ্ছে যে, একই পরিবার অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছে ঋণী। উপার্জনের সুযোগ খোঁজার আগেই দেখতে পাচ্ছে বাজারে সবকিছুর মূল্য আকাশছোঁয়া। এমনকি চালের মূল্যও নাগালের বাইরে। ফলে খাদ্যের কোনো নিশ্চয়তা না থাকায় লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন।
নামমাত্র ত্রাণের ব্যবস্থা করে সরকার তার দায়িত্ব শেষ করেছে। অথচ মানুষর ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে, মেরামতের টাকাও নেই। বৃদ্ধ ও শিশুদের অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। অনেক বৃদ্ধই বয়ষ্ক ভাতাও পান না। পেলেও যতটুকু অর্থ তা এই মুহূর্তের জন্য একেবারেই অপ্রতুল। তাই ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে তাদের নামতে হচ্ছে রাস্তায়। অর্থের অভাবে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। অনেককে পড়াশুনায় ইস্তফা দিতে হচ্ছে। বাড়ছে শিশুশ্রম। বন্যার এই ভয়াবহতা শিশুমনে বৈকল্য আনতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। অনেক স্কুল-কলেজের শিক্ষাকার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি। প্রায় ৩০ হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেগুলোর দ্রুত সংস্কারের দাবি উঠলেও সরকারের উপর মহল থেকে কোনো উদ্যোগই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সন্তানরা বেতন দিতে অক্ষম, পড়াশুনার উপকরণ সামগ্রীও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাই যৌক্তিক কারণেই সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট দাবি করেছিল — শিক্ষার্থীদের অন্তত একবছরের বেতন মওকুফ ও তাদের শিক্ষা উপরকরণ সরবরাহের। সেই দাবির প্রতিও সরকারের কোনো কর্ণপাত নেই। এমন অবস্থায় শিক্ষাজীবন একটা অনিশ্চিত অবস্থায় পড়েছে। নিরুপায় ও বিভ্রান্ত হয়ে অন্যায় অপকর্মে যুক্ত হয়ে পড়েছে অনেকে। এর বিষময় প্রভাব সমাজজীবনে আরও ভয়াবহ রূপে দেখা দিবে।
বন্যার এই সময়টাতে বহুবার উচ্চারিত হয়েছে কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে বীজ-সার বিতরণ, সুদমুক্ত কৃষিঋণ দান এবং ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান-রাস্তাঘাট-সেতু সংস্কার করার দাবি। কিন্তু এগুলোর কোনোটিই সরকার গুরুত্বের সাথে নেয়নি। বরং দায় এড়িয়ে গিয়ে অন্যান্য রাজনৈতিক ইস্যু নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে। এভাবে মানুষকে অশান্তি ও দুর্ভোগের মধ্যে রেখে মুখে যতই শান্তি ও উন্নয়নের বুলি আওড়ানো হোক না কেন— সাধারণ মানুষের কাছে তার কোনো তাৎপর্য নেই।
সবদিক থেকে সর্বস্বান্ত হওয়া বন্যাকবলিত মানুষের জীবনের কান্না হয়তো সহজে থামবে না। কিন্তু এটাও সত্য যে, এই মানুষরা তাদের অদম্য সংগ্রামের পথেই বেঁচে থাকার উপায় বের করবেন। তথাকথিত জনপ্রতিনিধিরা বসন্তের কোকিল। ভোটের স্বার্থে তারা নানা কিছু বলবে। মানুষকে বারবার প্রতারিত করবে। তাতে সত্যিকারের কোনো পরিবর্তন আসবে না। কেননা ক্ষমতাসীনদের কাছে সাধারণ মানুষ হলো ক্ষমতায় যাবার সিঁড়ি। শাসকদের এই চরিত্র আজ পরিষ্কারভাবে বোঝার সময় এসেছে। তাই বন্যা কেবল জনগণের দুর্দশাই বয়ে আনেনি, শাসকদের চিনিয়ে দিতেও সাহায্য করছে।