Saturday, November 23, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - অক্টোবর ২০১৭লাস ভেগাসে হামলা — মারণাস্ত্র ব্যবসার মরণব্যাধিতে আক্রান্ত আমেরিকা

লাস ভেগাসে হামলা — মারণাস্ত্র ব্যবসার মরণব্যাধিতে আক্রান্ত আমেরিকা

las vegas

সম্প্রতি আমেরিকার  নেভাদা অঙ্গরাজ্যের লাস ভেগাস শহরে এক বন্দুকধারীর গুলিতে ৫৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫ শতাধিক। আমেরিকার মতো দেশ, যেখানে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা খাতে প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়, সেরকম একটি দেশে হামলার ঘটনা গোটা বিশ্বের মানুষের বিস্ময় উদ্রেক করেছে।  হাজার হাজার মানুষ সেদিন কর্মব্যস্ততার মধ্যে একটু ফুরসত পেয়ে একত্রিত হয়েছিল আনন্দোৎসবে। কিন্তু বন্দুকধারীর হামলায় মুহুর্তের মধ্যেই এটা পরিণত হয় শোকোৎসবে। প্রাণভয়ে মানুষ দিগি¦দিক ছুটছে। স্বজন হারানোর বেদনায় — হাহাকারে লাস  ভেগাসের আলোকোজ্জ্বল আকাশে নেমে আসে অন্ধকারের ছায়া, বাতাস হয়ে ওঠে ভারী, বিষণ্ণ। ঠাণ্ডা মাথায় একজন মানুষের পক্ষে কী করে সম্ভব এমন নারকীয় হত্যাকান্ড!

হামলাকারী স্টিফেন প্যাডক সম্পর্কে আমেরিকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও বলছে, তার মনোবিকার ছিল। এর আগে গত বছরও অরল্যান্ডোতে ঠিক একই রকমভাবে এক বন্দুকধারীর হামলায় নিহত হয়েছিল ৪৮ জন সাধারণ মানুষ। এবারে লাস ভেগাসে হামলাসহ গত এক বছরের মধ্যে এটি ২৭৩তম ও এক মাসের মধ্যে ২৯তম হামলার ঘটনা। ‘গান ভায়োলেন্স আর্কাইভ ড্যাটাবেসে’র তথ্যানুসারে ২০০১-১৪ সালের মধ্যে আমেরিকায় সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণ হারিয়েছে ৩ হাজার ৪১২ জন (নাইন-ইলেভেনের হামলাসহ)। আর একই সময়ে বন্দুকধারীদের আক্রমণ ও আত্মহত্যায় জীবন বিনাশ হয়েছে ৪ লক্ষ ৪৪ হাজার ৯৫ জন মানুষের। ‘হার্ভাড স্কুল অব পাবলিক হেলথ’স কন্ট্রোল রিসার্চ সেন্টারের মতে, অস্ত্রের সহজলভ্যতাই আমেরিকার খুন বেশি হওয়ার প্রধান কারণ।

আমেরিকান সংবিধানে নাগরিকদের জন্য অস্ত্রের অবাধ প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। এবং একে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এই অধিকার ভোগ করার ফলে সারা দুনিয়ায় বেসামরিক মানুষের কাছে যে পরিমাণ অস্ত্র আছে তার অর্ধেকের বেশি এখন আমেরিকার মানুষের হাতে। অর্থাৎ আমেরিকার প্রতি ১০০ জন নাগরিকের মধ্যে ৮৮ জনের কাছেই মারণাস্ত্র আছে। মারণাস্ত্রের এই বিপুল বিস্তার আজ আমেরিকার সমাজের মরণ ডেকে আনছে। শিশুদের স্কুল কিংবা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, উৎসবে-কনসার্টে কিংবা স্টেশনের মতো জনবহুল স্থানগুলোতে হামলার ঘটনা ঘটছে নিয়ত। প্রশ্ন হলো, কেন কথিত স্বর্গরাজ্যে দিন দিন উন্মাদ ও অস্ত্রধারীদের হাতে সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে পড়ছে? আর কেনই বা সমাজে এরকম মানুষের সংখ্যা বাড়ছে?

এর কারণ বুঝতে হলে আমাদের একটু তাকাতে হবে আমেরিকার সমাজের ভেতরের দিকে। আমেরিকার আলো ঝলমলে যে শহরগুলোর চিত্র আমরা দেখি, এ হচ্ছে একটি ছবি। আছে আরেকটি ছবিও। যেখানে বহু মানুষের জীবনে আলোর রেখা পৌঁছে না। রয়েছে প্রচ- দারিদ্র্য, বেকারত্বের গ্লানি, ঋণের পাহাড়। আজ আমেরিকায় আর্থিক বৈষম্য প্রকট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই বৈষম্যের ফলশ্রুতিতেই দানা বেঁধেছিল অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন। শ্লোগান উঠেছিল ৯৯ শতাংশ বনাম ১ শতাংশ। একদিকে আর্থিক বৈষম্য, শোষণ-নিপীড়ন, শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ বিভিন্ন বর্ণের মানুষের মধ্যে বিভেদ অন্যদিকে পুঁজিবাদী সমাজের ভোগ-জৌলুসের আকর্ষণ – এই দুই মিলে আমেরিকার সমাজে প্রচন্ড সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করছে। সংকট থেকে মুক্তির রাস্তা না পেয়ে মানুষ হয়ে পড়ছে আরো আত্মকেন্দ্রিক। মানবিক মূলবোধের চূড়ান্ত অবনমন ঘটছে। নৈরাশ্যের আধার চারদিক থেকে মানুষকে ঘিরে ধরেছে – জীবনের সামনে কোনো নূতন আশা নেই, বেঁচে থাকার মহত্তর কোনো মানে নেই। ফলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে ড্রাগসে আসক্তি, বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষ, সংখ্যায় যা ২ ২লাখ ৩৯ হাজার ৭৫১ জন, তারা কারাবন্দী।

এই সামাজিক পরিস্থিতিই আজ আমেরিকায় এমন নৃশংস মানুষের জন্ম দিচ্ছে। ফলে এরকম একটি পরিস্থিতিতে আগ্নেয়াস্ত্রের বিক্রিতে-ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করাই হতো স্বাভাবিক। আমেরিকার বিবেকবান শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা এই দাবিতে বহুদিন থেকে সোচ্চার। কিন্তু সেরকম কোনো পদক্ষেপ মার্কিন শাসকরা নিচ্ছে না কেন? বরং অস্ত্রই মানুষকে নিরাপত্তা দেবে, প্রত্যেক স্বাধীন মানুষের এটি অধিকার — নিরাপত্তা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা সম্পর্কে এই রকম ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে দিয়ে অস্ত্রের বাজারকে আরও প্রসারিত করা হচ্ছে। সেই কারণেই আমেরিকান অস্ত্রব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন’ বিগত মার্কিন নির্বাচনে জোটবদ্ধ হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছিল। এই অস্ত্রব্যবসায়ীরা চায় না আমেরিকান অস্ত্র আইন সংশোধিত হোক। কেননা  আর্থিক মন্দায় ভুগতে থাকা সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার পুঁজিপতিরা অস্ত্রব্যবসাকেই করে তাদের পাখির চোখ। আর তাদের ব্যবসার স্বার্থেই প্রণীত হয় আমেরিকার যাবতীয় অভ্যন্তরীণ আইন ও পররাষ্ট্রনীতি। তাই ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’র নামে অস্ত্রের বাজারকে চাঙা রাখতে তথা আমেরিকান অর্থনীতি সচল রাখতে গোটা দুনিয়ায় স্থানীয় ও আঞ্চলিকভাবে খন্ড খন্ড যুদ্ধ লাগিয়ে রেখেছে। মিথ্যে অজুহাতে আফগানিস্থান, ইরাক, লিবিয়াসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে। আর সেই ধ্বংসস্তুপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো জন্ম লাভ করছে আইএসসহ বিভিন্ন জঙ্গিসংগঠন। যারা বেঁচে থাকার রসদ অর্থাৎ অস্ত্র পাচ্ছে খোদ আমেরিকার কাছ থেকে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে প্রাকৃতিক সম্পদ, তেল দখল করে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ তার অন্তিম শ্বাস গ্রহণ করছে। আর নিজ দেশে মুনাফার লোভে যে অস্ত্রকে তারা মানুষের হাতে ‘অধিকার’ হিসেবে তুলে দিয়েছে তা-ই আজ আমেরিকার সমাজের স্তরে স্তরে মরণব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। মনুষ্যত্ববিনাশী এই সর্বনাশের স্রোতকে রুখবে সেই সাধ্য কি পুঁজিবাদী সমাজের আছে?

সাম্যবাদ অক্টোবর ২০১৭

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments