আব্দুল মোমিন মারা গেলেন। সাথে মারা গেল তার নয় বছরের কন্যা সানজিদা আর তার স্ত্রী লুবনা বেগম। কোনো এক সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে তারা আর ঘরে ফেরেননি। তাদের লাশ পাওয়া গেছে বাড়ির কাছাকাছি একটি জমির মধ্যে। বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন তারা তিনজনে।
ঘটনার কারণ হিসেবে তার প্রতিবেশীরা চরম দারিদ্র্যের কথাই বলেছেন। সদ্য মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় গৌরবে মাথা উঁকি দেয়া একটি দেশের মুন্সিগঞ্জ নামক জেলায় আব্দুল মোমিন বাস করতেন। জীবন ধারণের জন্য করতেন মাছের ব্যবসা। কিন্তু ভালো চলছিল না তার। ভালো চলছে না তার মতো অনেকেরই। প্রচুর লোকসান গুণে সংসার চালানোর জন্য শেষ পর্যন্ত ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছেন এবং সেখানেও বিপর্যস্ত হয়ে বারবার তাগাদা খেয়ে দিশেহারা হয়েছেন। অন্তিম দিশা তিনি পেয়ে গেলেন।
মারা যাওয়ার সময় আব্দুল মোমিন হয়তো জানতেন না তার দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটছে। জিডিপি বৃদ্ধির হার এখন ৭.১%। মাথাপিছু আয় এখন বছরে এক লক্ষ আঠার হাজার ছয়শত পয়শট্টি টাকা। মাসে প্রায় দশ হাজার টাকা। কাগজে কলমে সবাই প্রতিমাসে এই টাকা আয় করে। দেশে শিল্পায়ন হচ্ছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে। এতসব তথ্য জানলে হয়তো তিনি সুখে মরতে পারতেন!
কিন্তু মরতে তাকে হতোই। কারণ আরেকটা পরিসংখ্যানও তাকে শুনতে হতো। সম্পদ বৃদ্ধির সাথে সাথে ধনী-গরীব বৈষম্য বাড়ছে ব্যাপকভাবে। গিনি কো-এফিসিয়েন্ট দিয়ে একটি দেশের ধনী-গরীবের বৈষম্যের মাত্রা বোঝা যায়। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের এই সূচক ছিল ০.৩১, ২০১৬ সালে এসে হলো ০.৩৯। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এএফও) এর প্রতিবেদনে বৈষম্যের হার বৃদ্ধিতে গোটা এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। এই কারণে মাথাপিছু আয়ের হিসেবে আব্দুল কাদিরের টাকাটা তার পকেটে আসেনি। তার টাকাটা অন্য কারও সম্পদ বৃদ্ধি করেছে।
`Freedom of choice’ বা পছন্দের স্বাধীনতার কথা আমরা অহরহ শুনতে পাই। দারিদ্র্য কেউই পছন্দ করে না। কিন্তু দারিদ্র্যকে তার মেনে নিতে হয়। মেনে নিতে হয় কারণ এই ব্যবস্থার কাছে সে অসহায়, যদি না ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সে লড়াই করে। আব্দুল মোমিনের মতো লক্ষ কোটি লোক আছেন এই দেশে। তারা কেউই দারিদ্র্যকে পছন্দ করে আনেননি। বরং চরম দারিদ্র্য তাদের উপর চেপে বসেছে এবং একসময় একেবারে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
এমন হয় কেন? কারণ এই সমাজব্যবস্থাটা পুঁজিবাদী। গুটিকয়েক পুঁজিপতিদের সর্বোচ্চ মুনাফা লোটার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত এখানে। দিনশেষে এখানে জিডিপি’র হিসেব শোনানো হয়। কিন্তু তা কার পকেটে ঢুকে, সেকথা গোপন থাকে। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক দিনরাত খেটে যে পণ্য তৈরি করে তার মূল্যের বেশিরভাগটাই ঢোকে মালিকশ্রেণির পকেটে। শুধু শ্রম দেয়ার জন্য বেঁচে থাকতে যতটুকু দরকার, ততটুকুই পায় শ্রমিকরা। কখনও তাও পায় না। সারাদেশে লক্ষ লক্ষ বেকার। তারা সামান্য কিছু টাকা পেলেই নিজের শ্রম বিক্রি করবে, কিন্তু তাও সে পাচ্ছে না। ছোট ব্যবসায়ীরা উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে বাজার থেকে। গরীব কৃষক জমি বিক্রি করে দিয়ে বিছানা পাতছে ঢাকার রাস্তায়। এ চিত্র তো অহরহ। কাদিরের পরিবারের তিনজনই আত্মহত্যা করেছিল, তাই ব্যাপারটা খবর হয়েছে। হাজার হাজার প্রাণ প্রতিদিন নিরবে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে – সে খবর এত কোলাহল পেরিয়ে আসে না।
এই ব্যবস্থার নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে অনেক আগেই সর্বহারার মহান নেতা ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস বলেছিলেন, “ . . . একজন ব্যক্তি যখন একথা জেনেই অপরকে আঘাত করে যে, তার আঘাত মৃত্যুর কারণ হবে, তখন তার কাজকে আমরা বলি হত্যা। সমাজ যখন হাজার হাজার মানুষকে জীবনের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো থেকে বঞ্চিত করে, বাঁচার অযোগ্য অবস্থার মধ্যে তাদের রেখে দেয়- আইনের বেড়ি পড়িয়ে নিশ্চিত মৃত্যু পর্যন্ত ওই অবস্থায় থাকতেই তাদের বাধ্য করে, সহস্র জীবনের ধ্বংস অনিবার্য জেনেও সমাজ যখন ওই অবস্থাই চলতে দেয়; তখন একজন হত্যাকারীর মতোই সমাজের এই কাজটিও মানবহত্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। . . . . ”
একটা জীবন খুব ছোট কোন কথা নয়। অনেক স্বপ্ন, অনেক সাধের এ জীবন। মানুষ এ জীবন পায় মাত্র একটিবার। এইভাবে পরাজিত হয়ে নিজেকে হত্যা করতে কেউই চায় না। হয়তো কত স্বপ্ন নিয়ে আব্দুল মোমিন তার জীবন শুরু করেছিল। কিন্তু হল না কিছুই। আমাদের কাছে এই মৃত্যু একটা খবর মাত্র, কিন্তু তার কাছে . . . ‘একটা গোটা জীবন।’