সারাদিনের কাজ শেষে যারা সেদিন হন্তদন্ত হয়ে ছুটছিলেন বাসার উদ্দেশ্যে — কেউ পায়ে হেঁটে, কেউবা চঞ্চল দৃষ্টিতে বাসের জন্য অপেক্ষমাণ। হঠাৎ সবাই যেন পাথরের মূর্তির মতো দাড়িয়ে যায় — বিস্মিত দৃষ্টিতে অপলক চেয়ে দেখে চোখের সামনে মিছিল নয়, যেন চলমান রক্ত সমুদ্র। চলছে তো চলছেই যেন আর শেষই হবে না। জনৈক দু’জন পথচারী যেতে যেতে মন্তব্য করলেন, ‘বামপন্থীদের এতো বড় মিছিল! বিশ্বাসই হতে চায় না।’ প্রত্যুত্তরে আরেকজন বললো, ‘সবাই মিলেছে বলেই সম্ভব হয়েছে। এই শক্তি নিয়ে যদি জনগণের সংকট নিরসনের দাবিতে আন্দোলন করতো!’ এমনি বিস্ময় আর প্রত্যাশার জন্ম দিয়ে গত ৭ নভেম্বর পালিত হলো রুশ বিপ্লবের শততম বার্ষিকী। ‘অক্টোবর বিপ্লব শততম বার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটি’ আহুত কর্মসূচির এদিন ছিল সমাপনী সমাবেশ ও লালপতাকা মিছিল। নদী যেমন মোহনায় মিলিত হয় তেমনি বামপন্থী চিন্তায়-আদর্শে বিশ্বাসী মানুষের মোহনা ছিল সেদিন শহীদ মিনার। ফলে কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরুর পূর্বেই সমাবেশস্থল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উৎসুক মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। এরপর ধীরে ধীরে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বামপন্থীদলগুলোর মিছিল আসতে থাকে। কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে শহীদ মিনারের আঙিনা। বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ, শ্রমিক-কৃষক, শিক্ষার্থী — কে আসেনি এই কাফেলায়?
এদেশে আজ মরে মরে বেঁচে আছে মানুষ। প্রতিদিন কত লাঞ্ছনা-অপমান সয়ে সয়ে ধুঁকে ধুঁকে জীবনের পথ চলছে। সংকটের আবর্তে নিমজ্জিত। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। পারিবারিক বন্ধন ভাঙার উপক্রম হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর বন্ধনে নেই স্নেহ-প্রীতির ছোঁয়া। স্বামী স্ত্রীকে খুন করছে, স্ত্রী ভাড়াটে খুনি দিয়ে হত্যা করছে স্বামীকে। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ-হত্যা তো নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। যুবক-তরুণ ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা নেই, কাজের নিশ্চয়তা নেই। ফলে অপরাধমূলক কর্মকান্ডে তাদের যুক্ততা বাড়ছে। পরিবারে ভালবাসা নেই, রাষ্ট্রে সম্মান নেই, যোগ্যতার কদর নেই। এই অবস্থা থেকে মুক্তির কথা অনুসৃত হলো মহাসমাবেশে আসা বক্তাদের মুখ থেকে।
বক্তরা তাদের কথায় স্মরণ করলেন ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর (পুরনো ক্যালেন্ডারে ২৫ অক্টোবর) ঘটে যাওয়া মহান নভেম্বর বিপ্লবের কথা। যে বিপ্লব মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার বুকে সংগঠিত হয়েছিল। নতুন সমাজ, নতুন সভ্যতার গোড়াপত্তন ঘটেছিল। তাই দেখে আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলেছিলেন, “চিরকালই মানুষের সভ্যতায় একদল অখ্যাত লোক থাকে তাদেরই সংখ্যা বেশি, তারাই বাহন; তাদের মানুষ হবার সময় নেই; দেশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত। সবচেয়ে কম খেয়ে কম পরে কম শিখে বাকি সকলের পরিচর্যা করে; সকলের চেয়ে বেশি তাদের পরিশ্রম, সকলের চেয়ে বেশি তাদের অসম্মান। কথায় কথায় তারা উপোসে মরে, উপরওয়ালাদের লাথি-ঝাঁটা খেয়ে মরে জীবন যাত্রার জন্য যত কিছু সুযোগ সুবিধে সব কিছুর থেকেই তারা বঞ্চিত।…রাশিয়ায় একেবারে গোড়া ঘেঁষে এই সমস্যার সমাধান করবার চেষ্টা চলছে।” বাস্তবিকই এই নতুন সমাজে ‘সভ্যতার পাজর থেকে ব্যক্তিস্বার্থের বীজ’ উপরে ফেলার মাধ্যমে সমাজের সমস্ত মানুষের কল্যাণের চিন্তাকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। মানবিক বিকাশের সমস্ত রাস্তা অবারিত করা হয়েছিল। দাসত্ব থেকে নারীকে মুক্তি দিয়ে বিশ্বলোকের সামনে মানুষ হিসেবে পরিচিত হবার সুযোগ করে দিয়েছিল। সবার জন্য শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কাজ-বাসস্থানসহ মৌলিক অধিকার পূরণের নিশ্চয়তা বিধান করেছিল। এক কথায় শতাব্দী থেকে শতাব্দী মানুষের উপর মানুষের যে শোষণ-নিপীড়ন-সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ-যুদ্ধ-হত্যা-ধ্বংসযজ্ঞ – সেই কলুষ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের মানুষকে মুক্ত করেছিল নভেম্বর বিপ্লব। একই সাথে দুনিয়াজোড়া যারা এই মুক্তিসংগ্রামে নিয়োজিত – তাদেরও পথ দেখিয়েছিল। নভেম্বর বিপ্লবের সেই চেতনাকে ধারণ করেই এদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বেগবান করার লক্ষ্যে উদ্যাপিত হলো শততম বার্ষিকী।
ঘড়ির কাঁটায় বেলা তিনটা বাজার আগেই কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মহাসমাবেশের কাজ শুরু হয়। ‘অক্টোবর বিপ্লব শততম বার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটি’র ব্যানারে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক। সূচনা বক্তব্য রাখেন উদযাপন কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বক্তব্য রাখেন তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বাসদ(মার্কসবাদী)-র সাধারণ সম্পাদক মুবিনুল হায়দার চৌধুরী, সিপিবি’র সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন নান্নু, বিপ্লবী ওয়াকার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, জাতীয় গণফ্রন্টের টিপু বিশ্বাস, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক হামিদুল হক, গণমুক্তি আন্দোলনের নাসিরউদ্দিন আহমেদ নাসু, গরীব মুক্তি আন্দোলনের শামসুজ্জামান মিলন, বাসদ(মাহবুব)-র শওকত হোসেন। বক্তব্য শেষে নগরীর রাজপথে উত্তাল ঢেউ তুলে বিশাল লালপতাকা মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। দৃপ্ত পদক্ষেপ, শাণিত শ্লোগানে এদেশের বুকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন হাজার হাজার শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-পেশাজীবী ব্যক্তিবর্গ।