Saturday, November 23, 2024
Homeফিচারশতবর্ষে অক্টোবর বিপ্লব — সৌমেন বসু

শতবর্ষে অক্টোবর বিপ্লব — সৌমেন বসু

Lenin_na_tribuneইউরোপের শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছিল এক ধরনের নতুন মানুষ। গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া এই মানুষগুলোর সম্পদ-সম্পত্তি বলতে কিছুই ছিল না। ছিল শুধু শ্রমের ক্ষমতা। আর এই শ্রমের ক্ষমতা বিক্রি করেই তাদেরকে জীবন ধারণ করতে হত। তাদের এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিত কলকারখানার মালিকরা। উদয়াস্ত পরিশ্রম করার পর শ্রান্ত-অবসন্ন কালিঝুলি মাখা এই মানুষগুলো গিয়ে ভিড় করত ভাটিখানায়। ভিড় করত পতিতালয়ে। এইভাবে জীবন চলত একই লয়ে—ক্লেদাক্ত, ঘৃণ্য, অসহনীয়।

কলকারখানার সাথে যুক্ত এই মানুষগুলোকে তখনকার দিনের ইউরোপের অধিকাংশ মানবতাবাদীরা দেখতেন করুণার চোখে। এদেরকে তাঁরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্লেদ বলে মনে করতেন। ভাবতেন কীভাবে সমাজজীবন থেকে এইসব ক্লেদাক্ত মানুষদের দূর করে সমাজকে কালিমামুক্ত করা যায়, সমাজকে সুস্থ-সুন্দর-স্বাভাবিক করা যায়।

কিন্তু সর্বোন্নত উৎপাদন যন্ত্রের সাথে যুক্ত এই কালিঝুলিমাখা মানুষগুলোর মধ্যেই কার্ল মার্কস অনাগত নতুন সভ্যতা-স্রষ্টাদের দেখতে পেয়েছিলেন। সমাজবিকাশের নিয়মের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বমূলক বিচারধারা প্রয়োগ করে তিনি দেখালেন এই শ্রমিকশ্রেণীর হাতেই রয়েছে নতুন সভ্যতা সৃষ্টির চাবিকাঠি। এদেরকে যতই অজ্ঞ, অশিক্ষিত, ইন্দ্রিয়পরায়ণ বলে মনে হোক—সেটা এদের সত্যিকার পরিচয় নয়। এ তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া পুঁজিবাদের অভিশাপ মাত্র। এই শ্রমিকশ্রেণী সংগ্রামের গতিপথে একদিন উঠে দাঁড়াবে। নিজেকে সর্বোন্নত জ্ঞানের আধারে বিকশিত করবে। রাজনৈতিক চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে শ্রেণীসংগ্রামের হাতিয়ার গড়ে তুলবে। উন্নত রুচি-সংস্কৃতির দ্বারা নিজের সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটাবে। পুঁজিবাদকে ধ্বংস করে সমাজতন্ত্র কায়েম করবে।

মার্কস-এঙ্গেলস আরো বললেন, সমাজতন্ত্র কোনো ব্যক্তিমানুষের শুভ ইচ্ছার ফল নয়। কোনো কল্পনাপ্রসূত চিন্তাও নয়। সমাজতন্ত্র সমাজবিকাশের নিয়মের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সৃষ্টি নির্ভর করে না। আমরা সমাজ বিকাশের ধারাকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে অনুধাবন করতে পারি, তার যথার্থ চরিত্র বুঝে তার বিকাশ ত্বরান্বিত করতে পারি এবং সমাজের বিপ্লবী রূপান্তর ঘটানোর ক্ষেত্রে নিজেদের যোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারি। বিজ্ঞানসম্মত, ইতিহাসসম্মত বিশ্লেষণের মাধ্যমে মার্কস দেখালেন, সভ্যতার অগ্রগতির পথে পুঁজিবাদ আজ প্রধান বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। ফলে তাকে বিপ্লবের আঘাতে অপসারিত করতে হবে। আর এই বিপ্লবের অপ্রতিরোধ্য শক্তিকে পুঁজিবাদ নিজের অভ্যন্তরেই সৃষ্টি করেছে। এই শক্তিই হলো শ্রমিকশ্রেণী। পুঁজিবাদের শোষণ অত্যাচারের হাত থেকে মানব সভ্যতাকে রক্ষা করে তার অপ্রতিহত বিকাশের দুয়ারকে খুলে দেওয়ার দায়িত্ব আজ শ্রমিকশ্রেণীর কাঁধে বর্তেছে। ইতিহাস-নির্ধারিত এই দায়িত্ব শ্রমিকশ্রেণীকে পালন করতেই হবে। মার্কস আরও দেখালেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মূল সমস্যা হলো, এখানে উৎপাদনের চরিত্রটা সামাজিক, কিন্তু মালিকানা ব্যক্তিগত। এই সমস্যার বিজ্ঞানসম্মত সমাধান হল উৎপাদন যন্ত্রের উপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এই সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পুঁজিপতিশ্রেণী হচ্ছে প্রবল বাধা। তাদের এই বাধাকে অতিক্রম করার জন্য চাই এমন একটা সামাজিক শক্তি যা পুঁজিপতিদের সমস্ত বাধাকে চূর্ণ করে সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। মার্কস বললেন, শ্রমিকশ্রেণীই হলো সেই শক্তি যার নেতৃত্বে অন্য সমস্ত শ্রমজীবী জনগণ সংগঠিত হবে এবং পুঁজিবাদকে ধ্বংস করে কায়েম করবে সমাজতন্ত্র।

কিন্তু পুঁজিবাদ তার বিকাশের সর্বোচ্চ স্তরে অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী স্তরে পৌঁছে আজ মুমূর্ষু, সমাজ-অগ্রগতির ক্ষেত্রে চরম প্রতিবন্ধক। এই নতুন পরিস্থিতিতে মার্কসের শিক্ষাকে আরও বিকশিত ও সমৃদ্ধ করে রাশিয়ার মাটিতে প্রয়োগ করেছিলেন কমরেড লেনিন। রাশিয়ার বুকে ঘটেছিল বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, ইতিহাসে যা অক্টোবর বিপ্লব হিসেবে খ্যাত।

রাশিয়ায় মার্কসবাদের প্রতিষ্ঠা

অক্টোবর বিপ্লব হঠাৎ ঘটে-যাওয়া ঘটনা নয়। এই বিপ্লবের জন্য রাশিয়ার মার্কসবাদী চিন্তানায়কদেরকে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। বহু বিপ্লববিরোধী ভ্রান্ত চিন্তার স্বরূপ উন্মোচন করে শ্রমিকশ্রেণীর এগিয়ে চলার পথকে আলোকিত করতে হয়েছে। মতাদর্শগত দৃঢ়ভিত্তির ওপর তাদের প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে। উন্নত মতাদর্শে বলীয়ান শ্রমিকশ্রেণী ও অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষ বিপ্লবের পথকে মসৃণ করতে অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। জেল, কারাদন্ড, নির্বাসন, ফাঁসির মঞ্চ—কোনো কিছুই সংগ্রামের পথ থেকে তাঁদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারে নি।

রাশিয়ায় মার্কসবাদের চিন্তা প্রথম নিয়ে আসেন প্লেখানভ। প্রথম দিকে প্লেখানভ নারদনিকবাদী চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। জারের অত্যাচারে তিনি দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং বিদেশে মার্কসবাদের সংস্পর্শে এসে তিনি নারদনিক চিন্তা পরিত্যাগ করে মার্কসবাদকে মুক্তির দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৮৮৩ সালে জেনেভা শহরে তিনি ‘শ্রমিক মুক্তি সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করেন।

‘শ্রমিক মুক্তি সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করার পর প্লেখানভ রাশিয়ার মাটিতে মার্কসবাদী চিন্তার প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু এই কাজে প্রধান বাধা ছিল সেখানে নারদনিক চিন্তার প্রবল প্রভাব। তখনকার দিনে রাশিয়ার প্রগতিশীল শ্রমিক ও বিপ্লবী তরুণদের মধ্যে এই চিন্তার খুবই প্রভাব ছিল। নারদনিকরা মনে করতেন, ১. কৃষকরাই হল বিপ্লবের প্রধান শক্তি। একমাত্র কৃষক বিদ্রোহের দ্বারাই জারতন্ত্রকে উচ্ছেদ করা যাবে। ২. রাশিয়ায় পুঁজিবাদ একটা আকস্মিক বিষয়। সেখানে এর কোনো বিকাশ ঘটবে না এবং তাই সর্বহারাশ্রেণীরও সেখানে বিকাশের কোনো সম্ভাবনা নেই। ৩. বিপ্লবে শ্রমিকশ্রেণী নেতৃত্বকারী শ্রেণী নয়, ফলে তাঁরা শ্রমিকশ্রেণীকে বাদ দিয়েই সমাজতন্ত্রের চিন্তা করতেন। আর এই সমাজতন্ত্রের ভিত্তি ও ভ্রূণ ছিল কৃষক পঞ্চায়েত (কমিউন)। ৪. তাঁরা মনে করতেন, শ্রেণী সংগ্রামের ফলে ইতিহাস সৃষ্টি হয় না, ইতিহাস সৃষ্টি করে কয়েকজন বীর। জনগণ এই বীরদের অনুসরণ করে মাত্র। [এই ধারণাই ব্যক্তিগত সন্ত্রাসবাদের বুনিয়াদ। এই কারণেই নারদনিকরা কৃষকদের মধ্যে বিপ্লবী প্রচারের কাজ ত্যাগ করে ব্যক্তিগত সন্ত্রাসবাদের দিকে চলে যায়।]

নারদনিকদের এই বিজ্ঞানবিরোধী চিন্তার বিরুদ্ধে কলম ধরলেন প্লেখানভ। তিনি বললেন, রুশদেশে পুঁজিবাদের আবির্ভাব ও বিকাশ ঐতিহাসিক সত্য। কোনো শক্তিই একে অস্বীকার করতে পারবে না। বিপ্লবীদের কাজ হলো, এই সহজ সত্যকে স্বীকার করে পুঁজিবাদের বিকাশের ফলে যে নতুন বিপ্লবী শ্রেণীর জন্ম হয়েছে তাদের শ্রেণী চেতনার ভিত্তিতে উদ্বুদ্ধ করা, শ্রমিকশ্রেণীর দল গঠনে সাহায্য করা। প্লেখানভ আরও বললেন, সংখ্যায় শ্রমিকশ্রেণী এখনও কম, একথা ঠিক। কিন্তু তারাই প্রধান বিপ্লবী শক্তি, সর্বোন্নত উৎপাদন যন্ত্রের সাথে যুক্ত থাকার জন্য এই শ্রমিকশ্রেণীই ভবিষ্যতের স্রষ্টা।

নারদনিকদের বিরুদ্ধে প্লেখানভের এই সংগ্রামের ফলে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী মহলে তাদের প্রভাব অনেকটাই কমে গিয়েছিল। এরপর নারদনিকদের তত্ত্বগতভাবে উৎপাটন করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন লেনিন।

লেনিনের জন্ম ১৮৭০ সালে। ১৮৮৭ সালে তিনি কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু বিপ্লবী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অপরাধে তিনি গ্রেপ্তার ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হন। ১৮৯৩ সালে তিনি সেন্ট পিটার্সবুর্গ যান। ১৮৯৫ সালে লেনিন সেন্ট পিটার্সবুর্গের সমস্ত শ্রমিকচক্রকে একটা সংগঠনে একত্রিত করেন। এই সংগঠনের নাম ছিল ‘শ্রমিকশ্রেণীর মুক্তি সংগ্রাম সংঘ’।

লেনিনের পরিচালনায় ‘শ্রমিকশ্রেণীর মুক্তি সংগ্রাম সংঘ’ শ্রমিকদের পরিচালিত অর্থনৈতিক দাবী আদায়ের সংগ্রামের সঙ্গে জার-শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামকে এক সূত্রে গ্রথিত করেছিল। রাশিয়াতে এই সংগঠনই প্রথম শ্রমিক আন্দোলনের সাথে সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যের ঐক্য সাধনের সূচনা করেছিল।

নারদনিকদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত হেনেছিলেন লেনিন। ১৮৯৪ সালে লেনিন লিখেছিলেন, ‘জনগণের বন্ধুরা কী ধরনের এবং তারা কীভাবে সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে লড়াই করে।’ এই বইতে লেনিন নারদনিকদের দুর্বলতা উদ্ঘাটন করেন। তিনি দেখান, বহু আগেই নারদনিকরা সংগ্রামের পথ ত্যাগ করে জার সরকারের সাথে আপসের পথ গ্রহণ করেছে। তারা এখন ধনী কৃষকদের কৃষি ব্যবস্থার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কুলাকদের বন্ধু। লেনিন লিখলেন, ‘ওরা মনে করে, জার সরকারের কাছে বেশ ভদ্রভাবে বিনীত হয়ে আবেদন জানাতে পারলেই সরকার সব ঠিক করে দেবে।’

তখনও যে সমস্ত নারদনিকরা রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ অসম্ভব বলে মনে করতেন তাদের ধারণাকে নস্যাৎ করে দিল লেনিনের দি ডেভেলপমেন্ট অব ক্যাপিটালিজম ইন রাশিয়া বইটি। এই বইতে রাশিয়ার অর্থনীতির পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করে লেনিন রাশিয়ার শ্রেণীকাঠামোর বিশ্লেষণ করেন এবং দেখান রাশিয়ার কৃষিতে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেছে এবং শ্রমিক শ্রেণী ক্রমাগত নেতৃত্বকারী ভূমিকা গ্রহণ করছে।

অর্থনীতিবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম

রাশিয়ায় কলকারখানা যত বিকশিত হচ্ছিল, শ্রমিকশ্রেণীর সংখ্যা ও শক্তি তত বৃদ্ধি পাচ্ছিল, মালিকদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামও তত শক্তিশালী হচ্ছিল। বড় বড় শহরে শ্রমিকরা মালিকদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছিল, তারা ধর্মঘট করছিল, একসাথে কাজ বন্ধ করে দিচ্ছিল। তারা দাবী জানাচ্ছিল মজুরী বৃদ্ধির, দাবী জানাচ্ছিল কাজের সময় আট ঘণ্টা বেঁধে দেওয়ার, কাজের পরিবেশ উন্নত করার, তাদের সন্তানদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সুবন্দোবস্তের, বাসোপযোগী বাসস্থানের।

কিন্তু এই শ্রমিকদের সংগ্রাম সুস্পষ্টভাবে দুটো ধারায় বিভক্ত হয়ে গেল। একদিকে ছিলেন অর্থনীতিবাদীরা, অন্যদিকে ছিল লেনিনের নেতৃত্বে যথার্থ মার্কসবাদীরা। অর্থনীতিবাদীরা মনে করতেন, শ্রমিকরা শুধু অর্থনৈতিক দাবীদাওয়া নিয়ে লড়াই করবে, তাদের লড়াই হবে শুধু তাদের নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে। তাদের লক্ষ্য হবে শুধু নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার মানোন্নয়ন; রাজনৈতিক সংগ্রাম শ্রমিকের কাজ নয়, রাজনৈতিক সংগ্রাম উদারনৈতিক বুর্জোয়াদের কাজ। শ্রমিকরা এই উদারনৈতিক বুর্জোয়াদের সমর্থন করবে। ১৮৯৯ সালে অর্থনীতিবাদীরা একটা ইস্তাহার প্রকাশ করলেন। তাতে বলা হল, সর্বহারাদের রাজনৈতিক পার্টি গঠন ও শ্রমিকশ্রেণীর আলাদা রাজনৈতিক দাবী উত্থাপন করাটা অপ্রয়োজনীয়।

অর্থনীতিবাদীদের এইসব বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করলেন লেনিন। তিনি বললেন, অর্থনৈতিক দাবী দাওয়ার ঘেরাটোপের মধ্যে শ্রমিক আন্দোলনকে আটকে ফেলার অর্থ হল তাদের মজুরী দাসত্বের জীবনকে চূড়ান্ত বলে মনে করা। তিনি আরও বললেন, মার্কসবাদীরা তাঁদের বিপ্লবী সংগ্রামের মধ্যে সংস্কারের সংগ্রামকেও অঙ্গীভূত করে। কিন্তু সংস্কারের সংগ্রাম সবসময়ই অপ্রধান; তা মূল রাজনৈতিক সংগ্রামের পরিপূরক মাত্র। তাই শ্রমিক আন্দোলনের মূল কেন্দ্রবিন্দু হবে সর্বহারার রাজনৈতিক মুক্তি আন্দোলন। এবং তার জন্য দরকার শ্রমিকশ্রেণীর যথার্থ শ্রেণীচেতনা। এই যথার্থ শ্রেণীচেতনা, অর্থাৎ যথার্থ রাজনৈতিক চেতনা বলতে কী বোঝায়? লেনিন বললেন, “শ্রমিকদের শ্রেণীচেতনা যথার্থ রাজনৈতিক চেতনা হতে পারে না, যদি সমাজে যে শ্রেণীই আক্রান্ত হোক, সব ধরনের আক্রমণ, স্বৈরাচার, নির্যাতন, হিংসা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য শ্রমিকশ্রেণী শিক্ষিত না হয়। শ্রমিকশ্রেণীর চেতনা যথার্থ রাজনৈতিক চেতনা হতে পারে না, যদি শ্রমিকরা সুনির্দিষ্ট ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করে, বিশেষ করে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করে;…যদি তারা সমস্ত শ্রেণী, গোষ্ঠী ও জনগণের সমস্ত অংশের জীবনধারার বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করতে না পারে, বস্তুবাদী বিশ্লেষণকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে না পারে।” (রচনাবলী, রুশ সংস্করণ, পঞ্চম খন্ড, পৃ ৪১২)

কিন্তু এই যথার্থ শ্রেণীচেতনা, রাজনৈতিক চেতনা কি শ্রমিকশ্রেণীর অর্থনৈতিক দাবীদাওয়া নিয়ে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আপনাআপনি গড়ে উঠবে? এর উত্তরে লেনিন বললেন, “শ্রমিকদের মধ্যে রাজনৈতিক শ্রেণীচেতনা একমাত্র বাইরে থেকে আসতে পারে। এর অর্থ হলো, আসতে পারে একমাত্র অর্থনৈতিক সংগ্রামের বাইরে থেকে, শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্কের বাইরে থেকে। একমাত্র সমস্ত শ্রেণীর মধ্যে সম্পর্কের ভিতর দিয়েই এই জ্ঞান অর্জন করা যেতে পারে।…শ্রমিকদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা দেওয়ার জন্য সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের (তখন কমিউনিস্টদের সোস্যাল ডেমোক্র্যাট বলা হত) অবশ্যই জনগণের সমস্ত শ্রেণীর মধ্যে যেতে হবে, সমস্ত ক্ষেত্রেই তাদের অগ্রগামী বাহিনীকে পাঠাতে হবে।” (ঐ, পৃ ৪২২) এইভাবে লেনিন শ্রমিক আন্দোলনে রাজনৈতিক চেতনার যথার্থ গুরুত্ব এবং তার উৎস সম্পর্কে যথার্থ বিশ্লেষণ রেখে শ্রমিক আন্দোলনকে অর্থনীতিবাদীদের প্রভাব থেকে মুক্ত করেছিলেন শুধু নয়, সমগ্র বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণীর সামনে মূল্যবান শিক্ষা তুলে ধরেছিলেন।
অর্থনীতিবাদীরা শ্রমিক আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ততার তত্ত্ব প্রচার করছিলেন। তাঁরা বলছিলেন, শ্রমিকদের চিন্তাকে সমাজতান্ত্রিক চেতনার স্তরে উন্নীত করা সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের অর্থাৎ কমিউনিস্টদের উচিত নয়। বরঞ্চ সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের উচিত, সাধারণ মানুষের স্তরে নিজেদের নামিয়ে আনা। শ্রমিক আন্দোলনের মধ্য থেকে যতদিন না শ্রমিকশ্রেণী আপনাআপনি সমাজতান্ত্রিক চেতনার স্তরে পৌঁছায়, ততদিন সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের অপেক্ষা করা উচিত। এই চিন্তাকে সজোরে আঘাত করলেন লেনিন। তিনি বললেন, স্বতঃস্ফূর্ততার তত্ত্বের জয়গান গাওয়ার অর্থ হল চেতনার গুরুত্বকে হেয় করা, শ্রমিকশ্রেণীকে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের লেজুড়ে পরিণত করা, তাদের সুবিধাবাদের পঙ্কে নিমজ্জিত করা।

লেনিন আরও বললেন, “বিপ্লবী নীতি না থাকলে বিপ্লবী আন্দোলন সম্ভব নয়।…যে পার্টি সবচেয়ে অগ্রগামী নীতি দ্বারা পরিচালিত কেবল সেই পার্টিই পারে অগ্রণী সংগ্রামী বাহিনীর ভূমিকা পালন করতে।” (রচনাবলী, পঞ্চম খন্ড, পৃ ১৬৩-৬৪) অর্থনীতিবাদীদের প্রভাব থেকে শ্রমিক আন্দোলনকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে লেনিনের এই সংগ্রামের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

রুশ সোস্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস, ১৯০৩

১৮৯৮ সালে সেন্ট পিটার্সবুর্গ, মস্কো, কিয়েভ-এর সংগ্রামী সংঘগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। এই উদ্দেশ্যে তারা ১৮৯৮ সালের মার্চ মাসে মিনস্ক শহরে প্রথম কংগ্রেস আহ্বান করে। লেনিন থাকতে পারেন নি—তিনি তখন সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে ছিলেন। ১৯০০ সালের প্রথম দিকে লেনিন সাইবেরিয়া থেকে ফিরে এলেন। লেনিন স্থির করলেন, রাশিয়ার বুকে যে সমস্ত ছোট ছোট মার্কসবাদী পাঠচক্র আছে তাদের মধ্যে চিন্তার বিভ্রান্তি দূর করে ঐক্যবদ্ধ রূপ দেওয়ার জন্য একটা গোপন সংবাদপত্র প্রকাশ করা দরকার। কিন্তু এই সংবাদপত্র প্রকাশ করতে হবে বিদেশ থেকে—যাতে জারের গুপ্তচর বাহিনী পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ করে দিতে না পারে। বিদেশে প্লেখানভ, অক্সেলরড ও জাসুলিচের সাথে আলোচনা করার পর ইস্ক্রা প্রকাশ করার ব্যবস্থা করলেন লেনিন। ১৯০০ সালের ডিসেম্বর মাসে ইস্ক্রার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হলো।

রুশ বিপ্লবের ইতিহাসে ইস্ক্রার প্রকাশ একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব সম্পর্কে লেনিন লিখলেন, “আমাদের মতে রাশিয়ার উপযোগী রাজনৈতিক সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করাই হবে আমাদের কাজের সূচনা, আমাদের কাঙ্ক্ষিত সংগঠন সৃষ্টির প্রথম ধাপ, সর্বোপরি এই সংবাদপত্রই হবে প্রধান সূত্র — যা অবলম্বন করে আমরা আমাদের সংগঠনকে বৃদ্ধি করতে পারব।…জনগণের ব্যাপকতম অংশের মধ্যে রাজনীতি ও সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আগ্রহ জেগেছে। একখানা সংবাদপত্র না থাকলে এর প্রচার ও আন্দোলন পরিচালনা করা সম্ভব নয়।” (রচনাবলী, চতুর্থ খন্ড, পৃ ১১০) পার্টির রাজনৈতিক, মতাদর্শগত, সংগঠনগত সংহতির পথ প্রস্তুত করে দিতে ইস্ক্রা বাস্তবে সারা রাশিয়ায় রাজনৈতিক সংবাদপত্রের ভূমিকাই পালন করেছিল।

বিদেশে এবং গোপনে রুশ সোস্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন বসল ১৯০৩ সালের ৩০ জুলাই। প্রথমে ব্রাসেলসে অধিবেশন বসলেও পরে পুলিশের চাপে কংগ্রেসের অধিবেশন লন্ডনে স্থানান্তরিত করা হয়।
শ্রমিকশ্রেণীর পার্টির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে লেনিনের মত ছিল — পার্টিকে হতে হবে শ্রমিকশ্রেণীর অগ্রণী বাহিনী। পুঁজিবাদের উচ্ছেদ ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাই হবে পার্টির চূড়ান্ত লক্ষ্য। পার্টির কাঠামো ও গঠন সম্পর্কে লেনিন লিখলেন, “আমি জোর দিয়ে বলছি : ১.ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য যদি নেতাদের কোনো স্থিতিশীল সংগঠন না থাকে তাহলে কোনো বিপ্লবী আন্দোলনই স্থায়ী হয় না। ২. জনগণ যতই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অধিক সংখ্যায় সংগ্রামের দিকে আকৃষ্ট হয়…ততই এই ধরনের সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা বেশী বেশী করে দেখা দেয়। ৩. যারা বিপ্লবকেই জীবনের একমাত্র কাজ বলে মেনে নিয়েছে প্রধানত তারাই এই সংগঠনে থাকবে। ৪. একটা স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমরা এই সংগঠনের সভ্যসংখ্যা যত বেশী পেশাদার বিপ্লবী এবং যারা বিপ্লবী কাজকর্মে পুলিশকে প্রতিহত করতে অভ্যস্ত ও কৌশলী, তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারি, ততই রাজনৈতিক পুলিশের পক্ষে এই সংগঠন ধ্বংস করা দুঃসাধ্য হবে।” (রচনাবলী, চতুর্থ খন্ড, পৃ ৪৫৬)

২৬টি সংগঠনের মোট ৪৩ জন প্রতিনিধি দ্বিতীয় কংগ্রেসে অংশগ্রহণ করেন। কংগ্রেসের কর্মসূচী গ্রহণের প্রশ্নে প্রতিনিধিদের মধ্যে গুরুতর মতপার্থক্য ছিল। অনেক আলাপ-আলোচনা তর্ক-বিতর্কের পর পার্টির কর্মসূচীতে ‘সর্বহারা একনায়কত্ব’ ধারণাটি স্থান পেল। আসল সংগ্রাম কিন্তু শুরু হলো পার্টির নিয়মকানুন সংক্রান্ত খসড়া প্রস্তাবের আলোচনায়। কে পার্টির সভ্য হতে পারবে, পার্টি সংগঠনের প্রকৃতি কেমন হবে — এই নিয়ে শুরু হয়ে গেল জোরদার বিতর্ক। লেনিন বললেন, পার্টির কর্মসূচী যে মেনে চলবে, পার্টিকে যে অর্থ দিয়ে সাহায্য করবে এবং পার্টির কোনও না কোনও সংগঠনের সাথে যুক্ত থেকে কাজ করবে, সে-ই পার্টির সভ্য হতে পারবে। লেনিনের এই মতকে সমর্থন করলেন প্লেখানভ। অন্যদিকে মার্তভ বললেন, কর্মসূচী মেনে চলা ও অর্থ সাহায্য করাটাই আবশ্যিক বিষয়। কিন্তু সবাইকে পার্টির কোনও না কোনও সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকতে হবে — এই শর্ত থাকা উচিত নয়।

লেনিনের মতে সর্বহারাশ্রেণীর পার্টিকে হতে হবে ‘দুর্ভেদ্য দুর্গ’-এর মত। সংগঠনে যে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। কাউকে সদস্যপদ পেতে গেলে কোনও না কোনও সংগঠনের মধ্য দিয়ে তাকে আসতে হবে। পার্টির আদর্শ ও শৃঙ্খলা তাকে মেনে চলতে হবে। কিন্তু মার্তভ এমন সব ব্যক্তিদের জন্য পার্টির দরজা খুলে দিতে চেয়েছিলেন, যারা বিপ্লবের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন হলেও অস্থিরমতি, যারা পার্টির অধীনে কোনো না কোনো সংগঠনে যোগ দিতে চায় না, পার্টির শৃঙ্খলাও মানতে চায় না, পার্টির কাজে যেসব দুঃখ-কষ্ট ও বিপদের সম্ভাবনা আছে তা তারা সহ্য করতে রাজি নয়।

যাই হোক, লেনিন ও লেনিনের অনুগামীদের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও কিন্তু দ্বিতীয় কংগ্রেস তাঁদের প্রস্তাব অনুমোদন করল না। মার্তভের প্রস্তাব গৃহীত হল। কিন্তু পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের প্রশ্নে লেনিন জয়লাভ করলেন। মার্তভের দল চেষ্টা করেছিল, যাতে অস্থিরমতি ও সুবিধাবাদীরা কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচিত হয়। এই বিষয়ে কংগ্রেসের অধিকাংশ সদস্যই লেনিনের মতকে সমর্থন করেন। যে সমস্ত সদস্য লেনিনকে সমর্থন করেছিলেন, এই সময় থেকে তাদের বলশেভিক বলা হত। (কথাটির অর্থ সংখ্যাগুরু) বিরোধীদের বলা হতো মেনশেভিক (অর্থাৎ, সংখ্যালঘু)।

এখানে আর একটা কথাও বলা দরকার। এই কংগ্রেসে প্লেখানভ নানা প্রশ্নে লেনিনের মতকে সমর্থন করলেও তাঁর এই সমর্থন ছিল ক্ষণস্থায়ী। চিন্তার নানা বিভ্রান্তির জন্য তিনি অতি দ্রুত মেনশেভিকদের দলে চলে গিয়েছিলেন।

প্রথম রুশ বিপ্লব (১৯০৫)

১৯০৪ সালে জানুয়ারী মাসে শুরু হয় রুশ-জাপান যুদ্ধ। জারতন্ত্র যে কতদূর জীর্ণ হয়ে পড়েছিল তা জারসৈন্যের বারবার পরাজয়ে বোঝা গেল। জারতন্ত্রের প্রতি জনগণের ক্ষোভ ও ঘৃণা ক্রমাগতই বাড়ছিল। জার সরকার যুদ্ধকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল বিপ্লবকে রোধ করার জন্য। কিন্তু ঘটলো ঠিক বিপরীত। যুদ্ধের ফলে জারের প্রতি ঘৃণায় যেন ফেটে পড়ল সমগ্র রাশিয়া। রাশিয়া জুড়ে শ্রমিক ধর্মঘট যেন বারুদের মতো ফেটে পড়তে লাগল।

বলশেভিকদের বাকু কমিটির নেতৃত্বে ১৯০৪ সালে বাকু শহরে শ্রমিকদের এক বিশাল ও সংগঠিত ধর্মঘট হয়। তৈলখনি শ্রমিকদের এই ধর্মঘট বিজয়ী হয়। বাকু ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে ট্রান্স-ককেশিয়া ও সারা রুশদেশে বিপ্লবী জাগরণের সূচনা হয়েছিল। স্ট্যালিন লিখেছিলেন, “সারা রুশদেশ জুড়ে জানুয়ারী ও ফেব্রুয়ারী মাসে যে গৌরবময় সংগ্রাম চলেছিল, বাকু ধর্মঘট হল তারই পূর্বসংকেত।”

১৯০৫ সালের ৩ জানুয়ারী সেন্ট পিটার্সবুর্গের সবচেয়ে বড় কারখানা পুটিলভে ধর্মঘট শুরু হয়। এই ধর্মঘট চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেন্ট পিটার্সবুর্গের অন্যান্য কারখানাও তাতে যোগ দেয়। এই ধর্মঘটকে ভেতর থেকে ভেঙে দেওয়ার জন্য জার সরকার গাপন নামে একজন পাদ্রীকে ব্যবহার করে। অনেক আগে থেকে এই পাদ্রী জার সরকারের একজন গুপ্ত অনুচর হিসেবে কাজ করছিল। জার সরকারের গোপন সাহায্য নিয়ে পাদ্রী গাপন ‘রুশ কারখানা শ্রমিক সভা’ নামে একটা সংগঠন তৈরী করে। সেন্ট পিটার্সবুর্গের সর্বত্র এই সংগঠনের শাখা ছিল। ধর্মঘট আরম্ভ হওয়ার পর গাপন শ্রমিকদের এক অধিবেশনে তার বিশ্বাসঘাতক পরিকল্পনা পেশ করে। পরিকল্পনাটা ছিল এইরকম : ৯ জানুয়ারী শ্রমিকরা এক জায়গায় মিলিত হয়ে গির্জার পতাকা ও জারের ছবি নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করে শীতকালীন প্রাসাদে যাবে এবং তাদের দাবীদাওয়া সম্বলিত স্মারকলিপি সম্রাটের কাছে পেশ করবে। সম্রাট তাদের কথা শুনবেন এবং দাবীদাওয়া পূরণ করবেন। বলশেভিকদের প্রভাবে দাবীদাওয়ার তালিকার মধ্যে সংবিধান পরিষদ আহ্বান, আইনের চোখে সবার সমান অধিকার, রাষ্ট্র থেকে ধর্মপ্রতিষ্ঠানকে পৃথক করা, যুদ্ধের অবসান, আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্দিষ্ট করা, কৃষকদের হাতে জমি দেওয়া প্রভৃতি দাবী যুক্ত হয়।
বলশেভিকরা শ্রমিকদের বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন, জারের কাছে আবেদন-নিবেদনে কোনো লাভ হবে না। বলশেভিকরা একথাও শ্রমিকদের বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন যে তাদের ওপর গুলিও চলতে পারে। কিন্তু শীতপ্রাসাদ অভিমুখে মিছিল যাওয়ার পরিকল্পনা তারা বন্ধ করতে পারেন নি। কারণ শ্রমিকদের একটা বড় অংশ তখনও বিশ্বাস করত, জার সরকার তাদের সাহায্য করবে। এই মিছিলের বিরোধী হলেও বলশেভিক পার্টি শ্রমিকদের সাথে মিছিলে থাকার সিদ্ধান্তই গ্রহণ করল।

১৯০৫ সালের ৯ জানুয়ারী সকালে পাদ্রী গাপনের নেতৃত্বে মিছিল শুরু হলো। শ্রমিকরা সপরিবারে জারের ছবি ও গির্জার পতাকা নিয়ে ধর্মসঙ্গীত গাইতে গাইতে এগিয়ে চলল। মিছিলে ছিল ১ লক্ষ ৪০ হাজারেরও বেশী মানুষ।

জার সরকার মিছিলকে অভ্যর্থনা জানাল গুলি চালিয়ে। ১ হাজার শ্রমিক প্রাণ হারাল। ২ হাজার আহত হলো। শ্রমিকদের রক্তে পিটার্সবুর্গের রাজপথ রক্তাক্ত হলো। অনেক বলশেভিক কর্মীও নিহত হলো। বুকের রক্ত দিয়ে তারা শ্রমিকদের পাদ্রী গাপনের প্রভাব থেকে মুক্ত করল। ইতিহাসে ৯ জানুয়ারী খ্যাত হলো রক্তাক্ত রবিবার বলে।

৯ জানুয়ারীর পর থেকেই ধর্মঘটসহ শ্রমিকদের বিপ্লবী সংগ্রাম আরও তীব্রতর হলো এবং তা রাজনৈতিক রূপ ধারণ করল। এই সমস্ত ধর্মঘট সমগ্র দেশকে আলোড়িত করল এবং তার উত্তাপ গিয়ে গ্রামাঞ্চলেও লাগল। বিদ্রোহে যোগ দিল কৃষকরাও। কৃষকরা ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করল, প্রাসাদ ও খামারবাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দিল। জমিদারেরা ভয়ে শহরে পালিয়ে এল। জার সরকার কৃষকদের ওপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালালো। কিন্তু কৃষক বিদ্রোহ থামানো গেল না।
১৯০৫ সালের জুন মাসে কৃষ্ণ সাগরে যুদ্ধজাহাজ পোটেমকিন বিদ্রোহ ঘোষণা করল। লেনিন এই বিদ্রোহের প্রতি খুবই গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, এই আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করা এবং শ্রমিক, কৃষক ও স্থানীয় সেনাদলের আন্দোলনের সাথে সংযোগ স্থাপন করা বলশেভিকদের একান্ত কর্তব্য। লেনিন বললেন, শ্রমিকদের ব্যাপক রাজনৈতিক ধর্মঘট ও মিছিল, কৃষক আন্দোলনের প্রসার, জনগণের সাথে পুলিশ ও সৈন্যদলের সশস্ত্র সংঘর্ষ এবং সবশেষে পোটেমকিন যুদ্ধজাহাজে বিদ্রোহ প্রমাণ করছে জনগণের সশস্ত্র অভ্যুত্থান ক্রমেই পরিপক্ক হয়ে উঠছে।

রাশিয়ার এই প্রথম বিপ্লবের (১৯০৫) চরিত্রটি ছিল বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক। প্রশ্ন উঠল, এই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সর্বহারাশ্রেণীর ভূমিকা কী হবে? তারা কি বুর্জোয়াদের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে তাদের সাহায্যকারীতে পরিণত হবে, নাকি নিজেরাই এগিয়ে এসে বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবে? এই প্রশ্নে সমস্ত বিভ্রান্তির অবসান ঘটিয়ে লেনিন বললেন : “মার্কসবাদ সর্বহারা শ্রেণীকে এই শিক্ষা দেয় যে, সে বুর্জোয়া বিপ্লব থেকে দূরে থাকতে পারে না, বিপ্লব সম্পর্কে উদাসীন থাকতে পারে না; বিপ্লবের নেতৃত্ব বুর্জোয়াদের হাতে ছেড়ে দিতে পারে না। মার্কসবাদ বরং এই শিক্ষাই দেয় যে, সে যেন একান্ত উদ্দীপনা সহকারে প্রকৃত সর্বহারা গণতন্ত্রের জন্য বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে। সে যেন বিপ্লবকে তার যথার্থ পরিণতিতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অত্যন্ত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সংগ্রাম করে।” (রচনাবলী, প্রথম খন্ড, পৃ ৩৬৯)

লেনিন আরও বললেন, “বুর্জোয়া গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলো যদি সংস্কারের মারফত না হয়ে বিপ্লবের মারফত হয়, তাহলে শ্রমিকশ্রেণীরই সুবিধা বেশী। কারণ সংস্কারের পথ হলো মন্দগতির পথ, দীর্ঘসূত্রতার পথ, জাতির শরীরের বিভিন্ন পচা অংশ তিলে তিলে ক্ষয় হওয়ার যন্ত্রণাদায়ক পথ। শ্রমিক আর কৃষকরাই সবচেয়ে আগে আর সবচেয়ে বেশী এই পচন পদ্ধতির জন্য যন্ত্রণা পেয়ে থাকে।…পচা, দূষিত অংশগুলো সোজাসুজি বাদ দেওয়ার রাস্তা, রাজতন্ত্র ও তার আনুষঙ্গিক জঘন্য, ঘৃণ্য, পূতিগন্ধময় ও সংক্রামক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সবচেয়ে কম আমল দেওয়া এবং তাদের স্বার্থের দিকে নজর না দেওয়ার পথ হলো বিপ্লবের পথ।” (ঐ, পৃ ৩৬৮-৬৯)

তাই লেনিন বললেন, “এই কারণেই সর্বহারাশ্রেণী সকলের আগে দাঁড়িয়ে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে।”
অক্টোবরের রাজনৈতিক ধর্মঘট সারা রাশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল। প্রায় দশ লক্ষ কারখানা শ্রমিক এই সাধারণ রাজনৈতিক ধর্মঘটে যোগ দিল, দেশের সমগ্র জনজীবন স্তব্ধ হয়ে গেল, সরকার হয়ে পড়ল পঙ্গু।

এই সময় রাশিয়ার বুকে ঘটল একটা অনন্যসাধারণ ঘটনা। জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আগুনে শ্রমিকদের বিপ্লবী সৃজনী প্রতিভার ফল হিসেবে শক্তিশালী সংগ্রামের একটা নতুন হাতিয়ার গড়ে উঠল। সংগ্রামের এই নতুন হাতিয়ারের নাম — শ্রমিক প্রতিনিধিদের সোভিয়েত।

সমস্ত কারখানা থেকে প্রতিনিধি নিয়ে গড়ে উঠল শ্রমিক প্রতিনিধিদের এই সোভিয়েত। এ ছিল শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক সংগঠনের এমন একটা রূপ যা পৃথিবীতে আগে কখনও দেখা যায় নি। জনগণের নিজস্ব সৃজনীশক্তির নতুন বিপ্লবী রূপ হলো এই সোভিয়েত। জারতন্ত্রের সমস্ত আইনকানুন ও হুকুম অগ্রাহ্য করে বিপ্লবী জনগণই এই সব সোভিয়েত প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই সোভিয়েতগুলোই ছিল জনগণের বিপ্লবী সংগ্রাম পরিচালনার রাজনৈতিক হাতিয়ার। এই সোভিয়েতগুলোর রাজনৈতিক তাৎপর্য বুঝতে বলশেভিকদের ভুল হয় নি। এই সোভিয়েতগুলোই ছিল জনগণের রাজনৈতিক শক্তির ভ্রূণ।

১৯০৫ সালের ২৬ অক্টোবর সেন্ট পিটার্সবুর্গে সমস্ত কারখানার শ্রমিক প্রতিনিধিদের সোভিয়েত গঠিত হলো। ওই রাতেই বসল সোভিয়েতের প্রথম অধিবেশন। সেন্ট পিটার্সবুর্গের পর মস্কোতে শ্রমিক প্রতিনিধিদের সোভিয়েত গঠিত হয়।

এই সোভিয়েতগুলোর কর্তৃত্বে কিন্তু ছিল মেনশেভিকরা। তাদের ভ্রান্ত পরিকল্পনার ফলে প্রথম রুশ বিপ্লবে সোভিয়েতগুলো যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারত, তা পারে নি।

১৯০৫ সালের নভেম্বর মাসে লেনিন রাশিয়ায় ফিরে এলেন। সশস্ত্র বিপ্লবের আয়োজনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করলেন। ট্রান্স-ককেশিয়াতে কমরেড স্ট্যালিন পূর্ণোদ্যমে বিপ্লবের প্রস্তুতির কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ডিসেম্বর মাসে ফিনল্যান্ডের টামারফর্স-এ বলশেভিকদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এখানেই লেনিনের সাথে স্ট্যালিনের প্রথম সাক্ষাৎ।

১৯০৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মস্কোয় রাজনৈতিক ধর্মঘট শুরু হলো। কিন্তু এই ধর্মঘটকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া গেল না। সেন্ট পিটার্সবুর্গ থেকেও যথেষ্ট সমর্থন পাওয়া গেল না। তাই শুরুতেই এই ধর্মঘটের সফল হওয়ার সম্ভাবনা কমে গেল।
২২ ডিসেম্বর মস্কোতে শুরু হলো ব্যারিকেড লড়াই। নয় দিন ধরে কয়েক হাজার শ্রমিক বীর বিক্রমে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু শ্রমিকদের সংখ্যার চেয়ে জারের সৈন্যসংখ্যা ছিল অনেক বেশী। মস্কো বলশেভিক কমিটির সমস্ত নেতারা গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন। তাই সশস্ত্র বিদ্রোহ ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের সাথে সম্পর্কহীন অভ্যুত্থানে পরিণত হলো। অঞ্চলগুলো প্রধানত আত্মরক্ষামূলক লড়াই চালিয়েছিল। এটাই ছিল মস্কো বিদ্রোহের প্রধান দুর্বলতা এবং তার পরাজয়ের অন্যতম কারণ। লেনিন বললেন, “আরও দৃঢ়ভাবে, আরও উৎসাহ নিয়ে এবং আক্রমণাত্মক উপায়ে আমাদের অস্ত্রধারণ করা উচিত ছিল। আমাদের উচিত ছিল, জনসাধারণকে বুঝিয়ে দেওয়া, কেবল শান্তিপূর্ণ ধর্মঘটে নিজেদের আবদ্ধ রাখা অসম্ভব এবং নির্ভীক, নির্মম, সশস্ত্র সংগ্রাম অপরিহার্য।” (রচনাবলী, প্রথম খন্ড, পৃ ৪৪৬)

১৯০৫ সালের ডিসেম্বরের বিদ্রোহ হলো এই বিপ্লবের চরম পর্যায়। জারের স্বৈরতন্ত্র বিপ্লবকে দমন করল। তারপর বিপ্লবী তেজে ভাটা পড়তে শুরু করল। বিপ্লবের প্রবাহ প্রশমিত হলো।

কেন প্রথম রুশ বিপ্লবের পরাজয় ঘটল? এর কারণ হলো :
বিপ্লবের সময়ে শ্রমিক-কৃষকের স্থায়ী মৈত্রীর অভাব। কৃষকদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনারও অভাব ছিল। বিপ্লবী বলশেভিকদের তুলনায় তাদের আস্থা বেশী ছিল সোস্যালিস্ট রেভ্যুলিউশনারীদের প্রতি। লেনিন লিখেছেন, “কৃষকদের কাজ অত্যন্ত বিচ্ছিন্ন ও অসংবদ্ধ ছিল এবং যথেষ্ট পরিমাণে আক্রমণাত্মক ছিল না। বিপ্লবের পরাজয়ের এটাই অন্যতম মূল কারণ।” (রচনাবলী, ঊনবিংশ খন্ড, পৃ ৩৫৪)

জারের সেনাদলের একটা অংশ বিদ্রোহকে সমর্থন করলেও অধিকাংশ সৈন্য ধর্মঘট এবং শ্রমিক অভ্যুত্থান দমনের কাজে জারকেই সাহায্য করেছিল।

শ্রমিকরা বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করেছিল, তারা সোভিয়েতও গঠন করেছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে সংহতির অভাব ছিল।

রুশ সোস্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির মধ্যে ছিল ঐক্যের অভাব। বলশেভিকরা বিপ্লবী কর্মসূচী ও দৃঢ়তা নিয়ে সংগ্রাম করলেও মেনশেভিকরা ছিল আপসমুখী। ওদিকে আবার শ্রমিক সোভিয়েতগুলোতেও মেনশেভিকদের প্রভাবই ছিল বেশী। এই বিভক্তি শ্রমিকদের মধ্যে বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছিল। তাই শ্রমিকশ্রেণী বিপ্লবের প্রকৃত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে নি।

১৯০৫ সালের বিপ্লব পরাজিত হওয়ার পর শুরু হলো স্তলিপিন প্রতিক্রিয়ার যুগ। স্তলিপিন ছিলেন জার সরকারের মন্ত্রী। তাঁর উদ্যোগে সর্বত্র শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগঠনগুলো ধ্বংস করা হলো। কারাগার, দুর্গ ও নির্বাসনের জায়গাগুলো বিপ্লবী নেতা ও কর্মীতে ভরে গেল। অসংখ্য বিপ্লবীর ফাঁসি হলো। আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রমিক ও কৃষকরা যে সমস্ত অধিকার আদায় করেছিল, তা সব কেড়ে নেওয়া হলো। নতুন নতুন দমনমূলক আইন প্রণয়ন করা হলো।

বিপ্লবের পরাজয়ের ফলে স্তলিপিন প্রতিক্রিয়াই একমাত্র বিষয় ছিল না। বিপ্লবী বাহিনীর মধ্যেও ভাঙন ও অধঃপতন শুরু হয়ে গেল। বিপ্লব যখন উত্তাল গতিতে অগ্রসর হচ্ছিল তখন যারা বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দিয়েছিল, তাদের মধ্যে অনেকেই পার্টি ছেড়ে চলে গেল। কেউ কেউ আবার প্রকাশ্যে বিপ্লবের শত্রু শিবিরে যোগ দিল। কেউবা জারতন্ত্রের সাথে শান্তিতে ঘর করতে শুরু করল।

বলশেভিকদের বিরুদ্ধে এইসময় মেনশেভিকরা আঘাত হানতে শুরু করে ভিন্ন কায়দায়। মেনশেভিকরা বিশ্বাস করত না, বিপ্লবের প্রবাহের আবার জোয়ার আনা সম্ভব। তারা মনে করত, পরাজয়ই চূড়ান্ত, রাশিয়ার বিপ্লবী শক্তি আর কোনো দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। তাই তারা বিপ্লবী কর্মসূচী পরিত্যাগ করার কথা বলল, সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবী পার্টিকে বিলুপ্ত করার দাবীও জানাল। ইতিহাসে এরা তাই বিলোপবাদী হিসেবে পরিচিত।

সুবিধাবাদী ভাবধারার আবির্ভাবের সময় থেকেই লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা এই বিলোপবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম পরিচালনা করেন। লেনিন বলেছিলেন, এই বিলোপবাদীরা হলো, পার্টির মধ্যে লিবারাল বুর্জোয়াদের দালাল।

পার্টির এই দুর্দিনে জনসাধারণের সাথে জীবন্ত সম্পর্ক রাখার প্রয়োজনে বলশেভিকরা তাদের কর্মকৌশলের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে এল। বলশেভিকরা ট্রেড ইউনিয়ন, অসহায়-আতুর কল্যাণ সমিতি, শ্রমিকদের সমবায় সমিতি, ক্লাব, শিক্ষাসমিতি প্রভৃতি আইনসম্মত প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করল। এইভাবে জনসাধারণের সাথে মিশে বলশেভিকরা জার সরকারের ভ্রান্ত নীতির মুখোশ খুলে দিত, শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করত এবং চেষ্টা করত কৃষকদের সর্বহারা শ্রেণীর পক্ষে টেনে আনতে। এই ক্ষেত্রে তারা রাষ্ট্রীয় নির্বাচিত প্রতিনিধি সভা ‘ডুমা’কেও কাজে লাগানোর চেষ্টা করত। পার্টির বেআইনী সংগঠনকে অটুট রেখে আইনসম্মত সংগঠনকে ব্যবহার করার দ্বৈত নীতি গ্রহণের ফলে বলশেভিকরা আবার নতুন করে শক্তি সঞ্চয়ের পথে এগিয়ে যেতে পারল।

বিপ্লবের পরাজয়ের ফলে প্রতিক্রিয়া আর একটা ভিন্ন রূপেও আত্মপ্রকাশ করল। এই আক্রমণ এল দর্শনগতভাবে মার্কসবাদকে আক্রমণের মধ্যে দিয়ে। এই আক্রমণকারীদের মধ্যে ছিলেন বগদানভ, লুনাচারস্কি, য়ুশকেভিচ, ভ্যালেন্টিনভ প্রমুখ তথাকথিত মার্কসবাদীরা। এরা মার্কসবাদের দার্শনিক ভিত্তির ওপর, অর্থাৎ দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূল নীতির ওপর আক্রমণ চালালেন। নিজেদেরকে এঁরা মার্কসবাদী বলে দাবী করতেন। বলতেন, সীমাবদ্ধতা থেকে মার্কসবাদকে মুক্ত করে তাঁরা একে আরও উন্নত করতে চান, যুগোপযোগী করতে চান। এই কপটতার বিপদ হলো, এর ফলে দলের সাধারণ সদস্যদের বিভ্রান্ত হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা ছিল। তাই এঁদের প্রতিটি বক্তব্যের যথাযথ জবাব দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল মার্কসবাদী ছদ্মবেশের আড়ালে এদের ভাববাদী চিন্তাকে উন্মোচন করা, এদের বিপ্লববিরোধী চরিত্রকে প্রকাশ করে দেওয়া। এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন লেনিন। ১৯০৯ সালে প্রকাশিত হলো তাঁর বই মেটেরিয়ালিজম অ্যান্ড এম্পিরিও-ক্রিটিসিজম। এই বইতে লেনিন দেখালেন : ১. দর্শনের ক্ষেত্রে আধুনিক সংশোধনবাদীদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, চাতুর্যের সাথে মার্কসবাদকে প্রত্যাখ্যান করা, মার্কসবাদের ছদ্মবেশে বস্তুবাদ-বিরোধী নীতি প্রচার করা। ২. রাশিয়ার মাখপন্থীরা (বগদানভ, বাজারভ ইত্যাদি) ভাববাদের জালে জড়িয়ে পড়েছে, বস্তুবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ৩. এম্পিরিও-ক্রিটিসিস্টদের শ্রেণীভূমিকা হলো তারা সাধারণভাবে বস্তুবাদের বিরুদ্ধে এবং বিশেষভাবে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের বিরুদ্ধে। রুশ বিপ্লবের ইতিহাসে লেনিনের এই বইয়ের ভূমিকা অপরিসীম। স্তলিপিন প্রতিক্রিয়ার যুগে একদল নানা বর্ণের সংশোধনবাদী ও দলত্যাগীদের সম্মিলিত আক্রমণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি মার্কসবাদের প্রাণসত্তা ও মর্মবস্তুকে রক্ষা করেছিলেন।

ট্রটস্কিবাদের বিরুদ্ধে বলশেভিকদের সংগ্রাম

পার্টির এই দুর্দিনে যখন বলশেভিকরা দৃঢ়তার সাথে বিলোপবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছিল তখন ট্রটস্কি সমর্থন করলেন মেনশেভিক বিলোপবাদীদের। এইসময় লেনিন তাঁর নামকরণ করে ‘জুডাস ট্রটস্কি’। লেনিন তখন লিখেছিলেন, “ট্রটস্কি এক জঘন্য আত্মসর্বস্ব উপদলীয় চক্রীর মতো ব্যবহার করছেন… মুখে পার্টির প্রতি আনুগত্য জানালেও আসলে তিনি যে কোনো উপদলীয় চক্রীর চেয়ে খারাপ কাজ করছেন।”

এর পরে ১৯১২ সালে ট্রটস্কি সমস্ত বলশেভিক বিরোধী সংগঠন ও উপদলকে একত্রিত করেন। বিলোপবাদীদের পক্ষে থাকলেও ট্রটস্কির বিলোপবাদ ছিল ধূর্ত প্রকৃতির। প্রকাশ্যে বলতেন, তিনি বলশেভিক ও মেনশেভিকদের মধ্যে মিটমাটের চেষ্টা করছেন — তিনি নিরপেক্ষ। লেনিন বলতেন, খোলাখুলি বিলোপবাদীদের চেয়েও ট্রটস্কি ঘৃণার পাত্র, কারণ শ্রমিকদের ধাপ্পা দেওয়ার ক্ষমতা তার বেশী। স্ট্যালিন এঁদের সম্পর্কে লিখেছিলেন, “মধ্যপন্থা একটা রাজনৈতিক ধারা। এই মতবাদ আপসের মতবাদ। একটা দলের মধ্যে সর্বহারার স্বার্থকে পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীস্বার্থের বশবর্তী করার মতবাদ। লেনিনবাদের দৃষ্টিতে এই মতবাদ একেবারেই বাতিলযোগ্য।” (লেনিনবাদের সমস্যা)

বলশেভিকদের আলাদা মার্কসবাদী পার্টি গঠন

স্তলিপিন প্রতিক্রিয়ার যুগে মেনশেভিকরা যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তারপরেও তাদের সাথে আর এক পার্টিতে থাকার উপায় ছিল না। ফলে দরকার হলো, মেনশেভিকদের সাথে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সমস্ত বলশেভিক মতাবলম্বীদের একটি পার্টির অভ্যন্তরে সংহত করা। এই উদ্দেশ্যে ১৯১২ সালের জানুয়ারী মাসে প্রাগে ষষ্ঠ নিখিল-রুশ পার্টি কনফারেন্সের অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে পার্টি থেকে মেনশেভিকদের বিতাড়ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং বলশেভিকরা আলাদা পার্টি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

প্রাগ কনফারেন্সের গুরুত্ব সম্পর্কে স্ট্যালিন বলছেন, “আমাদের পার্টির ইতিহাসে এই কনফারেন্সের গুরুত্ব খুবই বেশী, কারণ এখানে বলশেভিক ও মেনশেভিকদের মধ্যে সীমারেখা টানা হয় এবং সারা দেশের বলশেভিক সংগঠনগুলিকে একত্রে মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধ বলশেভিক পার্টি গঠন করা হয়।” (সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির পঞ্চদশতম কংগ্রেসের আক্ষরিক বিবরণী, পৃ ৩৬১-৬২)

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, এই প্রাগ কনফারেন্সে স্ট্যালিন উপস্থিত থাকতে পারেন নি। তিনি তখন নির্বাসনে। কিন্তু এই কংগ্রেসেই স্ট্যালিন সর্বপ্রথম দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। রাশিয়ার অভ্যন্তরে দলের কাজকর্ম পরিচালনার জন্য একটা ব্যুরোও গঠিত হয়েছিল। এই ব্যুরোর দায়িত্ব লেনিন অর্পণ করেছিলেন স্ট্যালিনের ওপর।

প্রথম সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধ ও ফেব্রুয়ারী বিপ্লব

স্তলিপিন প্রতিক্রিয়ার যুগে লেনিন ও বলশেভিক পার্টি এইভাবে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রাণসত্তাকে রক্ষা করলেন এবং মার্কসবাদের শ্রেষ্ঠত্বকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনকে সঠিক দিশা দেখালেন। লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টির এই নীতিনিষ্ঠ ভূমিকার জন্য ধীরে ধীরে শ্রমিক আন্দোলনে আবার প্রাণসঞ্চার ঘটলো এবং ১৯১২ সালে আবার সমগ্র রাশিয়া জুড়ে শ্রমিক আন্দোলনের প্রবাহ ছড়িয়ে পড়ল। ১৯১২ সালের ৪ এপ্রিল সাইবেরিয়ার লেনা স্বর্ণখনিতে ধর্মঘটের সময় জার সরকার পাঁচ’শরও বেশী শ্রমিকদের গুলি করে হত্যা ও আহত করে। একদল নিরস্ত্র শ্রমিক যখন শান্তভাবে খনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার জন্য যাচ্ছিল, তখন তাদের ওপর গুলি চালানোর ঘটনায় সমগ্র দেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। লেনায় গুলি চালানোর জবাবে সেন্ট পিটার্সবুর্গ, মস্কো এবং অন্যান্য শিল্পকেন্দ্র ও অঞ্চলের সর্বহারাশ্রেণী ব্যাপক ধর্মঘট, মিছিল ও সভাসমিতি শুরু করল। এই বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল সেন্ট পিটার্সবুর্গের বীর সর্বহারার দল। ১৯১৪ সালের প্রথম দিকে ধর্মঘটি শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়াল ১৫ লক্ষ। এইভাবে ১৯১২-১৪ সালের ধর্মঘট আন্দোলনের ব্যাপ্তি দেশে যে অবস্থার সৃষ্টি করেছিল তা ১৯০৫ সালে বিপ্লব শুরু হওয়ার সময়ের অনুরূপ।

এই শ্রমিক আন্দোলনকে আদর্শগতভাবে পথ দেখানোর জন্য ১৯১২ সালের ৫ মে প্রকাশিত হলো পার্টির মুখপত্র প্রাভদা। বলশেভিক পার্টির বেআইনী কেন্দ্রগুলোর চারদিকে প্রাভদা আইনী সংগঠনগুলোকে সংহত করেছিল এবং একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে, বিপ্লবের উদ্যোগের দিকে, শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনকে পরিচালিত করেছিল। পরবর্তীকালে স্ট্যালিন বলেছিলেন, “১৯১২ সালের প্রাভদা হলো ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিজয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন।”

এইসময় ডুমার নির্বাচনেও বলশেভিকরা খুবই গুরুত্ব দিয়ে অংশগ্রহণ করে। ১৯১২ সালে জার সরকার চতুর্থ ডুমার জন্য নির্বাচনের নির্দেশ দেয়। দেশব্যাপী আইন বাঁচিয়ে বলশেভিক পার্টির বিপ্লবী কাজ চালাবার প্রধান কেন্দ্র ছিল ডুমার বলশেভিক গ্রুপ ও প্রাভদা। এইভাবে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা বেআইনী ও আইনী— এই দুই ধরনের সংগঠনকে একসূত্রে গ্রথিত করে বিপ্লবের গতিপ্রবাহে জোয়ার সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল।

ইউরোপে এইসময়ে অত্যন্ত গুরুতর একটি ঘটনা ঘটে। তা হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪)। একদিকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া অন্যদিকে জার্মানী, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরী। ১ আগস্ট জার্মানী যুদ্ধ ঘোষণা করল রাশিয়ার বিরুদ্ধে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই বলশেভিকরা বুঝতে পেরেছিল যে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। যুদ্ধ বাধলে দেশে দেশে সমাজতন্ত্রীরা কী ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করবে, সে সম্পর্কেও লেনিন আন্তর্জাতিক সোস্যালিস্ট কংগ্রেসে মার্কসবাদী লাইন উপস্থাপন করেন। লেনিন দেখান, পুঁজিবাদ তার বিকাশের সর্বোচ্চ ও সর্বশেষ স্তরে — সাম্রাজ্যবাদের স্তরে, উপনীত হয়েছে। এই স্তরে ব্যাংকপুঁজির ও শিল্পপুঁজির মিলনের মধ্য দিয়ে লগ্নিপুঁজির জন্ম হয়েছে। এই লগ্নিপুঁজির দরকার নিত্যনতুন বাজার এবং কাঁচামালের উৎস। বিভিন্ন দেশের লগ্নিপুঁজি নিজেদের মধ্যে বিশ্ব বাজার ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিতে মরিয়া। কিন্তু এদের বিকাশ ঘটে অসমভাবে। আজ যে সামনে, কাল সে পিছনে চলে যায়। ফলে দুনিয়াকে আবার নতুন করে ভাগ করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এই প্রয়োজন থেকেই শুরু হয় ১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সব সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রই এই বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী।

লেনিন বারবার দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের নেতাদের দোদুল্যমান মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের কংগ্রেসে ঠিক হয় পার্লামেন্টের নির্বাচিত সোস্যালিস্টরা নিজ নিজ দেশের যুদ্ধ-ঋণের বিরুদ্ধে ভোট দেবে। ১৯১২ সালের বলকান যুদ্ধের সময় বেস্ল শহরে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের বিশ্ব কংগ্রেসে ঘোষণা করা হয়, পুঁজিপতিদের মুনাফা বৃদ্ধির জন্য এক দেশের শ্রমিকের পক্ষে অন্য দেশের শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করা চরম অপরাধ। তাই দেশে দেশে শ্রমিকশ্রেণী এই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের শরিক হতে পারে না।

কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হলো, এই সব প্রস্তাব কাজে পরিণত করার সময় এল, তখন দেখা গেল দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের নেতারা বিশ্বাসঘাতক, তারা সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাস মাত্র। ১৯১৪ সালের ৪ আগস্ট জার্মান সোস্যাল ডেমোক্র্যাটরা পার্লামেন্টে যুদ্ধ ঋণকে মঞ্জুর করল, জার্মানীর যুদ্ধসম্ভার বৃদ্ধির পক্ষে তারা ভোট দিল। ফ্রান্স, ব্রিটেন, বেলজিয়াম ও অন্যান্য দেশের সোস্যালিস্টদের একটা বড় অংশ যুদ্ধের প্রতি সমর্থন জানাল। এরা শ্রমিকশ্রেণীর চোখে ধুলো দিয়ে তাদের মনে সংকীর্ণ জাতীয়তার বিষ ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজে সাম্রাজ্যবাদীদের সাহায্য করল। ‘পিতৃভূমি রক্ষা’র নামে এইসব বেঈমান সোস্যালিস্টরা ফরাসী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে জার্মান শ্রমিককে, জার্মান শ্রমিকের বিরুদ্ধে ইংরেজ ও ফরাসী শ্রমিকদের লেলিয়ে দিল।

একমাত্র বলশেভিক পার্টিই বিনা দ্বিধায় বিপ্লবী তেজে যুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকতাবাদের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিল। আন্তর্জাতিকতাবাদের ধারণাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে লেনিন বললেন : একটা দেশের শ্রমিকশ্রেণী যদি তার নিজের দেশের সাম্রাজ্যবাদীদের পররাজ্য গ্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করে, তাহলে সেই দেশের শ্রমিকশ্রেণী মুক্তি অর্জন করতে পারবে না। লেনিন বললেন, আত্মসমালোচনার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের দলগুলো ভীত, তারা নিজেদের ভুলকে গোপন করে, ভালমানুষীর ভান করে, বিপ্লবী বাক্যবিন্যাসের দ্বারা নিজেদের ভুলত্রুটিকে জনগণের সামনে আড়াল করে। লেনিন বললেন, এইসব অভ্যাস সজীব চিন্তাকে ভোঁতা করে দেয় এবং নিজের ভুল থেকে বিপ্লবী শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে না।

আত্মসমালোচনা প্রসঙ্গে এইসময় লেনিন লিখলেন, “একটা রাজনৈতিক দল তার শ্রেণী ও মেহনতী জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালনে কতটা আন্তরিক এবং এই দায়িত্ব সে বাস্তবে কেমনভাবে পালন করে তা বিচারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও সুনিশ্চিত পন্থা হলো, নিজের ভুলের প্রতি সেই দলের মনোভাব কী তা বোঝা। খোলাখুলি ভুল স্বীকার করা, ভুলের কারণ নির্ধারণ করা, কী পরিস্থিতিতে এই ভুল হল তার ব্যাখ্যা করা এবং এই ভুল শোধরানোর পন্থাপদ্ধতি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করা — এই হলো একটা নিষ্ঠাবান পার্টির মাপকাঠি। এইভাবেই পার্টির দায়িত্ব পালন করা উচিত, এইভাবেই শ্রেণী ও জনগণকে শিক্ষিত করা উচিত।” (রচনাবলী, খন্ড ২৫, পৃ ২০০) এই সময়ে লেনিন তাঁর বই সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর রচনা করেন (১৯১৬)। সাম্রাজ্যবাদী যুগের চরিত্র অনুযায়ী বিপ্লবের রণনীতি নির্ধারণের প্রশ্নে লেনিন দেখালেন, বর্তমানে এক জায়গায় বা কয়েকটা জায়গায় সাম্রাজ্যবাদী ফ্রন্টে ভাঙন ধরানো সর্বহারা শ্রেণীর পক্ষে সম্ভব। প্রথমে কয়েকটা দেশে, বা এমনকী একটা দেশেও সমাজতন্ত্রের বিজয় সম্ভব। পুঁজিবাদের অসম বিকাশের জন্য একই সময়ে সবদেশে সমাজতন্ত্রের বিজয় অসম্ভব। বিপ্লব সম্পর্কে লেনিনের এই নতুন ও পূর্ণাঙ্গ মতবাদকে পরবর্তীকালে স্ট্যালিন তাঁর লেনিনবাদের ভিত্তি বইতে যেভাবে বর্ণনা করেছেন, তা হলো এই : “আগে সর্বহারা বিপ্লবকে একান্তভাবে একটা বিশেষ দেশের অভ্যন্তরীণ বিকাশের পরিণতি বলে মনে করা হত। এখন এই দৃষ্টিভঙ্গি আর যথেষ্ট নয়। এখন সর্বহারা বিপ্লবকে প্রধানত সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের পরিণতি হিসেবে দেখতে হবে, কোনো একটা দেশে বিশ্বসাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খল ছিন্ন হওয়ার ফল হিসেবে দেখতে হবে। […] ‘বিপ্লব কোথায় শুরু হবে? কোথায়, কোন দেশে পুঁজিবাদী ফ্রন্টকে সবচেয়ে আগে ছিন্ন করা যাবে?’ এই প্রশ্নের উত্তরে আগে সাধারণভাবে বলা হত, যেখানে শিল্প উন্নত, যেখানে শ্রমিকশ্রেণী সংখ্যাগরিষ্ঠ, যে দেশ অধিকতর সংস্কৃতি সম্পন্ন, যেখানে অধিকতর গণতন্ত্র আছে— আগে এই প্রশ্নের উত্তর সাধারণত এইভাবেই দেওয়া হত।

“[…] এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে লেনিনবাদী বিপ্লবের তত্ত্ব দেখালো যে, না, যেখানে শিল্প অধিকতর বিকশিত সেখানেই বিপ্লব হবে এমন নয়। সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খল যেখানে সবচেয়ে দুর্বল, সেখানেই পুঁজির ফ্রন্টকে ছিন্ন করে দেওয়া যাবে। কারণ বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী ফ্রন্টের শৃঙ্খলের দুর্বলতার গ্রন্থিকে ছিন্ন করার পরিণতিতেই ঘটবে সর্বহারার বিপ্লব। তা ছাড়া হয়তো দেখা যাবে, যে দেশ বিপ্লব শুরু করেছে, পুঁজির ফ্রন্টে ভাঙন ধরিয়েছে, সেই দেশ পুঁজিবাদী অর্থে কম বিকশিত। অথচ পুঁজিবাদী অর্থে অধিকতর বিকশিত দেশ পুঁজিবাদের কাঠামোর মধ্যেই রয়ে গেছে।”

ইতিমধ্যে যুদ্ধে কেটে গিয়েছিল তিন বছর। জার বাহিনী বারবার পরাজিত হচ্ছিল। জার্মান গোলন্দাজদের গোলায় জার বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে লাগল। জার বাহিনীর না ছিল গোলা, না ছিল কামান-বন্দুক। ১৯১৬ সালের মধ্যে জার্মানরা সমগ্র পোল্যান্ড এবং বালটিক অঞ্চলের খানিকটা দখল করে নিল।

যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজয়ের পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও তীব্র আকার ধারণ করছিল। ১৯১৭ সালের জানুয়ারী ও ফেব্রুয়ারী মাসে খাদ্যদ্রব্য, কাঁচামাল ও জ্বালানী সরবরাহের অব্যবস্থা একেবারে চরমে গিয়ে ওঠে। পেট্রোগ্রাদ ও মস্কোতে খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কারখানাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যেতে লাগল, বেকার সমস্যা অত্যন্ত তীব্র হলো। বিশেষ করে শ্রমিকদের অবস্থা হয়ে পড়ল অসহনীয়। ফলে জার সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমিক, কৃষক, সেনাবাহিনী ও বুদ্ধিজীবীদের ঘৃণা ও ক্রোধ সমস্ত সীমা অতিক্রম করে গেল। এই অসহনীয় পরিস্থিতির হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার একটাই উপায় রইল জনগণের সামনে — তা হলো জারতন্ত্রের উচ্ছেদ। জনগণ তাদের বিপ্লবী কর্তব্য সম্পাদনে এগিয়ে এল।

১৯১৭ সালের ৯ জানুয়ারী ধর্মঘট শুরু হয় পেট্রোগ্রাদ, মস্কো, বাকু ও নিজনি নভগারডে। ১৮ ফেব্রুয়ারী ধর্মঘট শুরু হলো পুটিলভ কারখানায়। ২২ ফেব্রুয়ারী অধিকাংশ বড় বড় কারখানায় শ্রমিকরা ধর্মঘট শুরু করল। ২৩ ফেব্রুয়ারী ছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সেদিন পেট্রোগ্রাদ বলশেভিক কমিটির ডাকে নারী শ্রমিকরা রাস্তায় বেরিয়ে এসে অনাহার, যুদ্ধ ও জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করল। সারা শহরে ধর্মঘট করে পেট্রোগ্রাদের শ্রমিকরা নারী শ্রমিকদের এই বিক্ষোভকে সমর্থন করল। এই রাজনৈতিক ধর্মঘট ক্রমে জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক রাজনৈতিক বিক্ষোভে পরিণত হলো। ২৬ ফেব্রুয়ারী রাজনৈতিক ধর্মঘট ও বিক্ষোভ অভ্যুত্থানের আকার ধারণ করল। শ্রমিকরা পুলিশ ও সৈন্যদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে নিজেরা অস্ত্র ধারণ করতে শুরু করল। ২৭ ফেব্রুয়ারী পেট্রোগ্রাদে সৈনিকরা শ্রমিকদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করল এবং বিদ্রোহী জনগণের পাশে এসে দাঁড়াল। বিপ্লবের পক্ষে সৈনিকদের নিয়ে আসার ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিদ্রোহী শ্রমিক ও সৈনিকরা জারের মন্ত্রী ও সেনাপতিদের গ্রেপ্তার করতে শুরু করে এবং জেল থেকে বিপ্লবীদের মুক্ত করে দেয়। পেট্রোগ্রাদে বিপ্লবের এই বিজয় সংবাদ অন্যান্য শহরে ও যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ল এবং সর্বত্র শ্রমিক ও সৈনিকরা জারের কর্মচারীদের পদচ্যুত করল। এইভাবে ফেব্রুয়ারী মাসে রাশিয়াতে স্বৈরতান্ত্রিক জার-এর শাসনের অবসান ঘটল। ১৯০৫ সালে ব্যর্থ হয়ে যাওয়া বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব জয়যুক্ত হলো।

বিপ্লব আরম্ভ হওয়ার প্রথম কয়েকদিনেই সোভিয়েতগুলোর অভ্যুদয় ঘটে। বিজয়ী বিপ্লবের অবলম্বন ছিল শ্রমিক ও সৈনিকদের সোভিয়েতগুলো। ১৯০৫ সালের বিপ্লব প্রমাণ করেছিল, সোভিয়েতগুলো হলো সশস্ত্র অভ্যুত্থানের হাতিয়ার এবং সেই সাথে নতুন রাষ্ট্রশক্তির ভ্রূণ। তফাৎ ছিল এইখানে যে, ১৯০৫ সালে গঠিত হয়েছিল কেবল শ্রমিক প্রতিনিধিদের সোভিয়েত, আর ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে গঠিত হয়েছিল শ্রমিক ও সৈনিক প্রতিনিধিদের সোভিয়েত।

বলশেভিকরা যখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে সংগ্রাম করছিল, মেনশেভিক ও সোস্যালিস্ট রেভ্যুলিউশনারীরা তখন ব্যস্ত ছিল বিভিন্ন সোভিয়েতে তাদের সংখ্যাধিক্য সৃষ্টির কাজে। অধিকাংশ বলশেভিক নেতা ছিলেন জেলে বা নির্বাসনে। লেনিন ছিলেন বিদেশে এবং স্ট্যালিন ও স্ভের্দলভ ছিলেন সাইবেরিয়ায়, নির্বাসনে। ফলে মেনশেভিকরা সোভিয়েতগুলোতে সহজেই প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে তারা চতুর্থ স্টেট ডুমার লিবারাল বুর্জোয়া সদস্যদের সাথে এক গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং রাশিয়ায় একটা নতুন সরকার গঠন করে। এর নেতৃত্বে ছিলেন প্রিন্স লভোভ। আর ছিলেন মিলিউকভ, গুচকভ, কেরেনস্কি। এইভাবে সোভিয়েতের কার্যনির্বাহক সমিতির সোস্যালিস্ট ও মেনশেভিক নেতারা বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে ক্ষমতা সমর্পণ করল।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিজয়ী শ্রমিক ও কৃষকরা স্বেচ্ছায় বুর্জোয়াদের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা সমর্পণ করল কেন?

এই প্রশ্নের উত্তরে লেনিন দেখিয়েছেন, “বিপুল এক পেটিবুর্জোয়া ঢেউ এসে সব কিছু ডুবিয়ে দেয়, শুধু সংখ্যার দিক দিয়ে নয়, মতবাদের দিক দিয়েও শ্রেণীসচেতন সর্বহারাকে আবির্ভূত করে, অর্থাৎ পেটিবুর্জোয়া রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা শ্রমিকদের বহুলাংশে প্রভাবিত ও কলুষিত করে।” (রচনাবলী, দ্বিতীয় খন্ড, পৃ ২৯)

লেনিন আরও দেখালেন, এর আর একটা কারণ হলো যুদ্ধের সময় সর্বহারা শ্রেণীর গঠনের পরিবর্তন হয়েছিল এবং বিপ্লবের শুরুতে সর্বহারা শ্রেণীর সংগঠন ও শ্রেণীচেতনা যথেষ্ট ছিল না। নিয়মিত শ্রমিকদের মধ্যে শতকরা চল্লিশজন সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়। নতুন শ্রমিক হিসেবে তাদের জায়গা ক্ষুদে মালিক ও দোকানদাররা এসে দখল করে। এদের কাছে সর্বহারা মানসিকতাটা ছিল একেবারেই অজানা। শ্রমিকদের ভিতর এই পেটিবুর্জোয়া অংশ মেনশেভিক ও সোস্যালিস্ট রেভ্যুলিউশনারীদের জমিকে শক্তিশালী করার উপাদান হিসেবে কাজ করেছিল।

এই কারণে রাজনীতিতে অভিজ্ঞ বহুলোক এই পেটিবুর্জোয়া আবহের শিকারে পরিণত হল এবং বিপ্লবের প্রাথমিক সাফল্যে আপসপন্থী পার্টিগুলোর খপ্পরে গিয়ে পড়ল। বুর্জোয়া রাষ্ট্রশক্তি সোভিয়েতের কাজে বাধা দেবে না, এই সরল বিশ্বাসে তারা বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে রাষ্ট্রশক্তি সমর্পণ করে দিতে রাজি হলো।

এই বুর্জোয়া সরকারের পাশাপাশি রইলো আর একটা শক্তি — শ্রমিক, কৃষক ও সৈনিক প্রতিনিধিদের সোভিয়েত। ফলে দেখা দিল দুটো শক্তির এক অদ্ভুত সমাবেশ। অস্থায়ী সরকার ছিল বুর্জোয়া একনায়কত্বের প্রতিনিধি; আর শ্রমিক, কৃষক ও সৈনিকদের সোভিয়েত ছিল সর্বহারা শ্রেণী ও কৃষক সম্প্রদায়ের একনায়কত্বের প্রতিনিধি। রাশিয়ার বুকে দেখা দিয়েছিল — ‘দ্বৈত ক্ষমতা’।

বলশেভিকদের ভূমিকা

১৯১৭ সালের ১৬ এপ্রিল লেনিন পেট্রোগ্রাদে এসে পৌঁছলেন। ফিনল্যান্ড রেল স্টেশনে হাজার হাজার শ্রমিক, সৈনিক, নাবিক তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য সমবেত হয়েছিল। একটা সাঁজোয়া গাড়ীর ওপর দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর বক্তৃতায় জনগণকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করার আহ্বান জানান। ‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’— এই কথা বলে তিনি তাঁর বক্তৃতা শেষ করেছিলেন।

কিন্তু ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের পরে রাশিয়ার সর্বহারা শ্রেণীর কর্তব্য কী হবে, এ নিয়ে বলশেভিক পার্টির মধ্যেই নানা বিভ্রান্তি ছিল। মার্কসবাদের পুরনো ধারণা অনুযায়ী অনেকেই মনে করতেন (যারা নিজেদের পুরানো বলশেভিক বলতেন), সর্বহারা শ্রেণীর এখন কাজ হবে বুর্জোয়া বিপ্লবকে সংহত করা এবং বুর্জোয়া বিপ্লবের সমস্ত কর্তব্য সম্পাদন হলে তবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য সংগ্রাম করা। এই ভ্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে লেনিন বললেন, ‘আমাদের তত্ত্ব কোনো আপ্তবাক্য নয়, বরং তা কর্মের পথনির্দেশক’। (রচনাবলী, খন্ড ২৪, পৃ ৪৩) জারতন্ত্রের উচ্ছেদের পর রাশিয়ার পরিস্থিতি ও রাশিয়ার বিপ্লবের স্তর বিশ্লেষণ করে লেনিন দেখালেন, “তাহলে প্রথম স্তরটি কী? সেটি হলো বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে আসার আগে রাষ্ট্রক্ষমতা একটা পুরানো শ্রেণীর হাতে ছিল, সেই শ্রেণী ছিল সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামী অভিজাত শ্রেণী, যার মাথায় ছিলেন নিকোলাস রোমানভ। বিপ্লবের পরে রাষ্ট্রক্ষমতা একটা ভিন্ন শ্রেণী, একটা নতুন শ্রেণী, অর্থাৎ বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে এসেছে। এক শ্রেণীর হাত থেকে অন্য শ্রেণীর হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা চলে যাওয়াই হলো বিপ্লব; বিপ্লব শব্দটির কঠোর বৈজ্ঞানিক ও বাস্তব রাজনৈতিক এই উভয় অর্থেই, কোনো বিপ্লবের প্রথম, প্রধান ও মৌলিক লক্ষণ হলো রাষ্ট্র-ক্ষমতার এই পরিবর্তন। এই অর্থেই ও এই পরিমাণেই, রাশিয়ার বুর্জোয়া অথবা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পূর্ণ হয়েছে” (ঐ, পৃ-৪৪) রাশিয়ার বিপ্লবের দ্বিতীয় স্তরটির চরিত্র কী ছিল? লেনিন বললেন, “গ্রামীণ ধনী, কুলাক, মুনাফাখোরসহ পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক, গরীব কৃষক, অর্ধ-সর্বহারা ও সমস্ত শোষিতদের নিয়ে এবং ততটুকু পরিমাণে বিপ্লব সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব।” (রচনাবলী, খন্ড ২৮, পৃ ৩০০) লেনিনের এই বক্তব্যের অর্থ কী? অর্থ হলো, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কাজ যদি প্রায়-সবটুকুই অপূরিত থাকে কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা যদি চলে যায় বুর্জোয়াদের হাতে, তাহলেও বিপ্লবের স্তর হবে পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক। লেনিন বললেন, পুঁজিবাদের এই সাম্রাজ্যবাদী স্তরে বুর্জোয়ারা আর গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সমস্ত কর্তব্য সম্পাদন করতে পারে না। বুর্জোয়ারা আজ গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ঝান্ডা ফেলে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সর্বহারা শ্রেণীকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে বুর্জোয়াদের অসমাপ্ত কাজকে সম্পূর্ণ করতে হবে। এটাই হলো তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব। বলশেভিক পার্টির মধ্যে সেদিন যে চিন্তাগত বিভ্রান্তি ছিল, এইভাবে লেনিন তা দূর করেছিলেন। এই সময় লেনিন আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন। তিনি পার্টির নাম পরিবর্তন করে ‘সোস্যাল ডেমোক্রেটিক’-এর পরিবর্তে ‘কমিউনিস্ট পার্টি রাখতে বললেন। তিনি বললেন, ‘আমরা অবশ্যই আমাদের কমিউনিস্ট পার্টি বলব।’ (রচনাবলী, খন্ড ২৪, পৃ ৮৪) কেন তিনি এই নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব দিলেন? কারণ, তিনি বললেন, “সোস্যাল ডেমোক্রেটিক নামটা বিভ্রান্তিকর। বর্তমানে সোস্যাল ডেমোক্রেটিক সংগঠনের পরিচিত নেতারা যখন সমাজতন্ত্রকে পরিত্যাগ করেছে, পিতৃভূমি রক্ষার নামে সাম্রাজ্যবাদী দস্যুদের দস্যুবৃত্তিকে সমর্থন করছে, নিজেদের পুঁজিবাদের সেবাদাসে পরিণত করেছে, তখন বলশেভিকদের নামের পাশে ‘সোস্যাল ডেমোক্রেটিক’ কথাটা থাকলে জনগণ বিভ্রান্ত হবে, বিপথে পরিচালিত হবে এবং এইসব নেতাদের দ্বারা প্রতারিত হবে।” (রচনাবলী, খন্ড ২৪, পৃ ৮৭)। লেনিনের এই প্রস্তাব বলশেভিক সম্মেলনে গৃহীত হয়।

লেনিন বললেন, ‘সর্বহারা বিপ্লব যদি সর্বহারার ক্ষমতাকে সংহত করার মূল কর্তব্য সম্পাদন করতে চায়…তাহলে এই বিপ্লবকে সর্বহারার সাথে মেহনতী ও শোষিত মানুষের একটা স্থায়ী মৈত্রী গড়ে তুলতে হবে। গড়ে তুলতে হবে কারণ তারা মেহনতী ও শোষিত জনগণ।’ এই প্রসঙ্গে সোভিয়েতের ভূমিকা বর্ণনা করে পরবর্তীকালে লেনিন বলেছিলেন, ‘বিপুল অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লব যদি ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের গোড়ার দিকে সোভিয়েতের জন্ম দিতে না পারত, তাহলে কোনোমতেই তারা অক্টোবরে ক্ষমতা দখল করতে পারত না। কারণ, সাফল্য পুরোপুরি নির্ভর করে লক্ষ লক্ষ মানুষের আন্দোলনের বিদ্যমান সংগঠনের ওপর। এই বিদ্যমান সংগঠন হলো সোভিয়েত। এর ফলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল চমকপ্রদ সাফল্য, অপেক্ষা করছিল নিরবচ্ছিন্ন জয়দৃপ্ত অভিযান। এই ধরনের অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছিল। রাজনৈতিক ক্ষমতার নতুন রূপ হাতের কাছে তৈরী ছিল। আমাদের যা করতে হয়েছিল, তা হলো কতগুলো ডিক্রি জারি করে বিপ্লবের প্রথম কয় মাসে ভ্রূণাবস্থায় যা ছিল সেই সোভিয়েতের ক্ষমতাকে একটা আইনসঙ্গত স্বীকৃতি দেওয়া, রুশ রাষ্ট্র যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেÑসেই রুশ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করা।” (রচনাবলী, দ্বাদশ খন্ড, পৃ ৩১৫)

১৯১৭ সালে জুলাই বিক্ষোভের ওপর গুলি চলার পর লেনিন আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, বুর্জোয়ারা শ্রমিক-কৃষকের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে লেনিন লিখলেন, “অভিজ্ঞতা শিখিয়েছে গৃহযুদ্ধ হলো শ্রেণীসংগ্রামের সবচেয়ে তীব্র রূপ। এই সময়ে একের পর এক অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সংঘর্ষ ঘটতেই থাকে। এই সংঘর্ষ এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, তা এক শ্রেণীর বিরুদ্ধে অপর শ্রেণীর বিরোধ ও সংঘর্ষে রূপান্তরিত হয়।” (রচনাবলী, খন্ড ২১, পৃ ২৩১)

১৯১৭ সালের আগস্টের শেষ দিক। যুদ্ধক্ষেত্রে কর্দমাক্ত ট্রেঞ্চের মধ্যে বসে লক্ষ লক্ষ সৈনিক প্রভিশনাল গভর্নমেন্টকে অভিশাপ দিচ্ছিল আর বিষণœ চিত্তে নিজেদের জিজ্ঞাসা করছিল, আর-একটা শীতও কি এই অবস্থার মধ্যে কাটাতে হবে? গ্রামাঞ্চলে রাতের আকাশ-বিধ্বংসী অগ্নিকান্ডে আলোকিত হয়ে উঠছিল। শোনা যাচ্ছিল ভয়ঙ্কর সব শব্দ, বিপদ-সঙ্কেত। বুর্জোয়া প্রভিশনাল গভর্নমেন্টের কাছ থেকে জমি পাওয়ার সমস্ত আশা হারিয়ে ফেলেছে শ্রমজীবী কৃষকরা। তারা অভিজাতদের ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দিচ্ছে, জমি দখল করছে। শহরে ক্রমবর্ধমান বেগে ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের মত নিরন্তর আছড়ে পড়ছে ধর্মঘট। নতুন বিপ্লব এগিয়ে আসছে। লেনিন এই বিপ্লবের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এই বিপ্লবের সম্ভাবনা লেনিন আগেই দেখতে পেয়েছিলেন।

অভ্যুত্থানকে কীভাবে জয়যুক্ত করতে হবে, এই প্রশ্নে লেনিন লিখলেন, “সফল হতে গেলে অভ্যুত্থানকে ষড়যন্ত্রের উপর ভিত্তি করলে চলবে না। একটা দলের উপর নির্ভর করলে চলবে না। তাকে নির্ভর করতে হবে অগ্রগামী শ্রেণীর উপর। এই হলো প্রথম কথা। অভ্যুত্থানের ভিত্তি হতে হবে জনগণের বিপ্লবী উত্থান। এই হলো দ্বিতীয় কথা। অভ্যুত্থানকে অবশ্যই বিপ্লবের সন্ধিক্ষণকে ভিত্তি করে গড়ে তুলতে হবে। এইসময় জনগণের অগ্রগামী অংশের উদ্যোগ সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যায়। শত্রুপক্ষ সবচেয়ে দোলাচলে ভুগতে থাকে। বিপ্লবের দুর্বল বন্ধুরাও দোদুল্যমান হয়ে পড়ে।” (ঐ, পৃ ২২৪)। অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে কমরেড লেনিন আরও লিখলেন, “অভ্যুত্থানকে মার্কসবাদী পদ্ধতিতে অর্থাৎ একটা শিল্পকর্মের মতো পরিচালনা করতে হবে। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে অভ্যুত্থানের শক্তিকে পরিচালনার জন্য একটা কেন্দ্র সংগঠিত করতে হবে, ঐ শক্তিকে নানা জায়গায় ভাগ করে দিতে হবে।…” (ঐ, পৃ ২২৯)

তখন দেশের মধ্যে শক্তির ভারসাম্যের পরিবর্তন হতে শুরু করেছিল। পেট্রোগ্রাদ ও মস্কোÑএই দুই রাজধানীতেই বলশেভিকরা সোভিয়েতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। হেলসিংফোর্সেও সোভিয়েতের ক্ষমতা চলে এল বলশেভিকদের হাতে। পেট্রোগ্রাদের উপকণ্ঠে যেসব ছোট ছোট শহর ছিল, সেখানে বলশেভিকরা ছিল আরও সক্রিয়। ক্রনস্টার্ড, ইউবিয়েভ ও রেভালের সোভিয়েত সংগ্রামী আওয়াজ তুলল, ‘সোভিয়েতের হাতে সমস্ত ক্ষমতা দাও।’

এই পরিস্থিতিতে লেনিন জোরের সাথে বললেন, ‘দেশে আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। দুটো রাজধানীতেই সোভিয়েত আমাদের দখলে।…এমন সেøাগান আমাদের তুলতে হবে যাতে শ্রমজীবী জনগণের পূর্ণ সমর্থন আমরা নিশ্চিত করতে পারি।’
সোভিয়েতের রাজনৈতিক গুরুত্ব বর্ণনা করে ১৯১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লেনিন লিখলেন, “সোভিয়েত হল এক নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র। প্রথমত, সোভিয়েত শ্রমিক আর কৃষককে সশস্ত্র বাহিনীর যোগান দেয়। পুরানো চিরাচরিত সেনাবাহিনীর মতো এই বাহিনী জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে জনগণের সাথে যুক্ত।…বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে এই বাহিনীর কোনো বিকল্প হয় না। দ্বিতীয়ত, এই যন্ত্র মানুষের সাথে, জনগণের সংখ্যাগুরু অংশের সাথে এক বন্ধন তৈরী করে। এই বন্ধন অত্যন্ত অন্তরঙ্গ, অত্যন্ত দৃঢ়। সহজে একে ভাঙা যায় না। অত্যন্ত দ্রুত একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, আবার নতুন করে তৈরী করা যায়।…তৃতীয়ত, এই যন্ত্রের অংশ যারা, জনগণ তাদের নির্বাচিত করতে পারে আবার চাইলে…তাদের পদ থেকে সরিয়েও দিতে পারে। চতুর্থত, একেবারে ভিন্নধর্মী নানা পেশার মানুষের মধ্যে এই যন্ত্র অত্যন্ত নিকট সম্পর্ক তৈরী করে। ফলে আমলাতন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই এর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময়, সবচেয়ে গভীর সংস্কার করা যায়। পঞ্চমত, এখান থেকে অগ্রগামী বাহিনীর এক ধরনের সংগঠন পাওয়া যায়। অগ্রগামী বাহিনী হলো শ্রমিক আর কৃষকের অর্থাৎ নিপীড়িত শ্রেণীর সবচেয়ে রাজনীতি-সচেতন, সবচেয়ে প্রাণবন্ত, সবচেয়ে প্রগতিশীল অংশ। এইভাবে এক রাষ্ট্রযন্ত্র গঠিত হয়।…এই যন্ত্রের মাধ্যমে ঐ শ্রেণীর অগ্রগামী বাহিনী ঐ শ্রেণীর বিশাল জনতার বাকী অংশকে উন্নত করতে পারে, প্রশিক্ষণ দিতে পারে, নেতৃত্ব দিতে পারে।” (ঐ, খন্ড ২১, পৃ ২৫৮-৫৯)

জোরের সাথে লেনিন বললেন, ‘অভ্যুত্থানে বলশেভিকদের বিজয় সুনিশ্চিত। আমরা হঠাৎ আঘাত করতে পারি (যদি সোভিয়েতের কংগ্রেসের জন্য অপেক্ষা করি)। আঘাত করতে পারি পেট্রোগ্রাদ, মস্কো ও বাল্টিক নৌবহর — এই তিন কেন্দ্র থেকে।…পেট্রোগ্রাদে আমাদের হাজার হাজার সশস্ত্র শ্রমিক ও সৈন্য আছে। এরা এখনই উইনটার প্যালেস, সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তর, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, সমস্ত বড় বড় ছাপাখানা দখল করে নিতে পারে। এখান থেকে কেউ আমাদের দখলচ্যুত করতে পারবে না। সেনাবাহিনীর মধ্যে আমরা এমন জোর কদমে প্রচার চালাতে পারব যে, আমাদের শান্তির সরকার, কৃষকদের জন্য জমির সরকারকে কেউ প্রতিরোধ করতে পারবে না।” (ঐ)

ইতিমধ্যে ঘটনা দ্রুত বিকশিত হচ্ছিল। ২১ অক্টোবর লেনিন গোপনে ফিরে এলেন পেট্রোগ্রাদে। এসেই তিনি কমরেড স্ট্যালিন ও কমরেড স্বের্দলভের সাথে আলোচনায় বসলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আসন্ন সংগ্রামের প্রস্তুতির খবর জেনে নিলেন।

২৩ অক্টোবর বসল কেন্দ্রীয় কমিটির ঐতিহাসিক অধিবেশন। কেন্দ্রীয় কমিটির মোট বারো জন্য সদস্য সভায় উপস্থিত ছিলেন। জুলাইয়ের ঘটনার পর লেনিন এই প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় উপস্থিত হলেন। লেনিন তাঁর মতামত একটা সংক্ষিপ্ত প্রস্তাব আকারে উত্থাপন করলেন, ‘…সশস্ত্র অভ্যুত্থান অবশ্যম্ভাবী এবং তা সম্পূর্ণ পরিণত হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটি এই লক্ষ্যে পরিচালিত হতে সমস্ত সংগঠনকে নির্দেশ দিচ্ছে এবং এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে সমস্ত ব্যবহারিক প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের নির্দেশ দিচ্ছে।’ (ঐ, খ- ২১, পৃ ১০৭)

লেনিনের এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন কামেনেভ ও জিনোভিয়েভ। তারা যুক্তি দেখালেন, ‘আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে নয়। শ্রমিক শ্রেণী সক্রিয় সমর্থন দেবে না, দেশে আমরা সংখ্যাগুরু নই, এখন রক্ষণাত্মক অবস্থান গ্রহণ করাই শ্রেয়, বামপন্থী সোস্যালিস্ট রেভ্যুলিউশনারীদের নিয়ে কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে আমরা একটা ব্লক গঠন করতে পারি এবং সেখান থেকেই আমরা আমাদের নীতি কার্যকর করতে পারব।’ এভাবে কামেনেভ এবং জিনোভিয়েভ বিপ্লবী অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করে বুর্জোয়া সংবিধান সভার পক্ষে ওকালতি করলেন।

কেন্দ্রীয় কমিটির কেউ ওঁদের সমর্থন করলেন না। লেনিনের প্রস্তাব সমগ্র বলশেভিক পার্টির কাছে নির্দেশের মত চলে গেল।
কেন্দ্রীয় কমিটির এই সভায় লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি সেদিন আর একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেছিল। অভ্যুত্থান পরিচালনার জন্য একটা ‘পার্টি সেন্টার’ তৈরী হলো। এই পার্টি সেন্টারের নেতৃত্বে ছিলেন স্ট্যালিন।

কেন্দ্রীয় কমিটিতে পরাজিত হয়ে কামেনেভ ও জিনোভিয়েভ এমন পথ গ্রহণ করলেন যা বলশেভিক পার্টির ইতিহাসে আগে কখনও ঘটে নি। মেনশেভিক পার্টির পত্রিকায় ওঁরা ১ অক্টোবর বিপ্লবী অভ্যুত্থানের গোপন খবর ফাঁস করে দিলেন।

মেনশেভিকদের পত্রিকা নভোয়া ঝিঝন যখন লেনিনের হাতে এল, তখন তাঁর মনে হলো, কেউ যেন তাকে সজোরে আঘাত করেছে। কিন্তু এই বিশ্বাসঘাতকতার পরও বিপ্লবের বিজয়ে লেনিন সুনিশ্চিত ছিলেন। পার্টি কর্মীদের উদ্দেশে এক চিঠিতে তিনি লিখলেন, “খুবই দুঃখময়, সামনে কঠিন কর্তব্য, ভয়ঙ্কর বিশ্বাসঘাতকতা। কিন্তু এসব সত্ত্বেও আমাদের কাজ আমরা করবই। শ্রমিকেরা এগিয়ে যাবে, কৃষকরা বিদ্রোহ করবে, সীমান্তে চূড়ান্ত অধৈর্য সেনারা তাদের কাজ করে যাবে। আমাদের বাহিনীকে আমরা সংহত করব — সর্বহারার জয় সুনিশ্চিত।”

বিপ্লবের প্রস্তুতি যখন জোর কদমে চলছে, তখন প্রথম আঘাত হানল কেরেনস্কি সরকার। ৬ নভেম্বর একদল প্রতিবিপ্লবী সেনা এসে বলশেভিক পার্টির মুখপত্র রাবোচি পুত ছাপা বন্ধ করার হুকুম দিল। হুকুম মানতে অস্বীকার করল শ্রমিকরা। হাজার হাজার শ্রমিক এসে ঘিরে ফেলল প্রতিবিপ্লবী কাদেত সেনাদের। স্ট্যালিনের নির্দেশে দুটো সাঁজোয়া গাড়ী এসে কাদেত সেনাদের তাড়িয়ে দিল।

এই হামলার খবর পেয়েই লেনিন একটা নির্দেশ লিখে ফেললেন। তাতে বললেন, “কমরেডস, ৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় আমি চিঠি লিখছি। অবস্থা চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে গেছে। এটা পরিষ্কার, অভ্যুত্থানের বিলম্ব হলে তা চরম সর্বনাশের কারণ হতে পারে। প্রত্যয়ের সমগ্র শক্তি দিয়ে আমি কমরেডদের বোঝাতে চাইছি, সবকিছু এখন সুতোর ওপর ঝুলছে।…যেকোন মূল্যে আজ সন্ধ্যায় আজ রাতেই সরকারকে গ্রেপ্তার করুন, কাদেতদের নিরস্ত্র করুন…আর দেরী করবেন না, দেরী করলে আমরা সব হারাব…দেরী করলে সর্বনাশ হবে।” (দি হিস্ট্রি অব দি সিভিল ওয়ার ইন দি ইউ এস এস আর, দ্বিতীয় খন্ড, পৃ ২৪০) লেনিন যখন এই চিঠি লিখছেন, তখন স্ট্যালিন তাঁর কাছে এক বার্তাবাহক পাঠালেন, চিঠিতে লেনিনকে স্মলনিতে যাওয়ার আমন্ত্রণ ছিল। স্মলনিতে যাওয়ার জন্য লেনিন দ্রুত তৈরী হয়ে নিলেন। টুপিটা মাথায় পরে একটা বড় রুমালে মুখ ঢেকে রাতের অন্ধকারে পদব্রজে লেনিন চললেন স্মলনির দিকে।

লেনিনের আসার খবর পেয়েই কয়েকজন কমরেডকে সাথে নিয়ে স্ট্যালিন এসে উপস্থিত হলেন। এই মুহূর্ত থেকেই লেনিন সরাসরি বিপ্লবী অভ্যুত্থান পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। বিপ্লবের সেই দিনগুলোতে স্মলনিই হয়ে উঠল তাঁর বাসস্থান। এই স্মলনিতে বসেই লেনিন শীত প্রাসাদ দখলের চূড়ান্ত পরিকল্পনা রচনা করেছিলেন।

নির্দেশ পেয়েই সবাই নেমে এল রাস্তায়। সারি বেঁধে গিয়ে দাঁড়াল সেই জায়গায় যেখানে তাদের অস্ত্র দেওয়া হবে। রাইফেল আর গ্রেনেডে সজ্জিত হয়ে শ্রমিকবাহিনী চলল তাদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করতে। শ্রমিক মহল্লাগুলো জেগে উঠল। বোঝা গেল, এই শুভ মুহূর্তের জন্যই তারা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছিল।

পেট্রোগ্রাদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো দখলের কাজ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সুশৃঙ্খলভাবে চলতে থাকল। রাত একটা পঁচিশে দখল করা হলো জেনারেল পোস্ট অফিস, আর রাত দুটোয় বাল্টিক রেল স্টেশন। একটু পরে দখলে এল টেলিগ্রাফ অফিস। এরপরই দখলে চলে এল বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং শহরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। রাত তিনটার সময়ে ঘেরাও করা হলো শীত প্রাসাদ। প্রভিশনাল গভর্নমেন্টের দু’জন মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে স্মলনিতে নিয়ে আসা হলো। কেন্দ্রীয় টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখলের নির্দেশ এল ভোর চারটার সময়। সেটি দখলের পর শীত প্রাসাদের সাথে সমস্ত টেলিযোগাযোগ ছিন্ন করে দেওয়া হলো।

সকালের দিকে শীত প্রাসাদের দিকে যাওয়ার সমস্ত রাস্তা দখলে চলে এল বিপ্লবী বাহিনীর। সকাল ৮টার মধ্যে বিপ্লবী ওয়ারশ স্টেশনের পুরো দখল নিয়ে নিল। ৭ নভেম্বর সকালেই রাজধানীর সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলো দখলে চলে এল।

কিন্তু তখনও পর্যন্ত শীত প্রাসাদ বিপ্লবীদের দখলে আসে নি। বিপ্লবী সামরিক কমিটি ঠিক করল এবার চূড়ান্ত আঘাত হানতে হবে। রাত ৯টার সময়ে চূড়ান্ত নির্দেশ দেওয়া হল। অরোরা জাহাজ থেকে গোলাবর্ষণ শুরু হলো, সাথে সাথে গর্জে উঠল অসংখ্য রাইফেল। প্রতিবিপ্লবীদের মনোবল একেবারে ভেঙে গেল। বিপ্লবী বাহিনী ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ঢুকে পড়ল শীত প্রাসাদে, রাত দুটোর সময়ে পতন ঘটল বুর্জোয়া প্রভিশনাল গভর্নমেন্টের শেষ দুর্গ শীত প্রাসাদের।

শীত প্রাসাদের পতনের সাথে সাথে প্রভিশনাল গভর্নমেন্টের ক্ষমতা লোপ পেল। পেট্রোগ্রাদে বিজয়ী হলো সর্বহারা বিপ্লব। দুনিয়ার এই প্রথম মানবজাতি প্রবেশ করল নতুন এক সমাজে — সমাজতান্ত্রিক সমাজে। সফল হলো সর্বহারা বিপ্লবীদের স্বপ্ন।

পরদিন, ৮ নভেম্বর, নতুন সমাজতান্ত্রিক সরকার, সোভিয়েতের দ্বিতীয় কংগ্রেসে দুটো ডিক্রি পেশ করল। একটা হলো শান্তির ডিক্রি, অন্যটা হলো ভূমি ডিক্রি। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে এসে যুদ্ধদীর্ণ দেশে শান্তি স্থাপনের কাজ শুরু করল নতুন বলশেভিক সরকার। আর সাথে সাথে ভুস্বামীদের হাত থেকে জমি কেড়ে নিয়ে কৃষকদের হাতে জমি তুলে দেওয়ার কাজও শুরু করা হলো। লেনিন বললেন, কৃষকদের হাত থেকে জমি কেড়ে নেওয়ার স্পর্ধা আর কেউ দেখাতে পারবে না।

পেট্রোগ্রাদে বিপ্লব জয়যুক্ত হলেও সব জায়গায় কিন্তু তখনও ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে এসে যায় নি। আরও কয়েকদিন ধরে মস্কোর পথে পথে ভয়ঙ্কর সশস্ত্র সংগ্রাম চলল। ক্ষমতা যাতে মস্কো সোভিয়েতের হাতে না যায়, সেজন্য মেনশেভিক ও সোস্যালিস্ট রেভ্যুলিউশনারী পার্টি শ্বেতরক্ষী ও কাদেতদের সাথে মিলিত হয়ে শ্রমিক ও সৈনিকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে দিল। ফলে মস্কোতে সোভিয়েত শাসন কায়েম করতে আরও কয়েকদিন লেগেছিল।

বিপ্লবের বিজয়ের পর প্রথম কয়েকদিনের মধ্যেই পেট্রোগ্রাদ ও অন্যান্য কয়েকটি অঞ্চলে সোভিয়েত শক্তিকে উৎখাত করার চেষ্টা হয়। কেরেনেস্কির উদ্যোগে সেনাপতি ক্রাসনভ বিদ্রোহ করে। ১৩ নভেম্বর পুলকোভা পাহাড়ের কাছে ক্রাসনভ পরাজিত হয়। সৈন্যবাহিনীর সদর দপ্তরে প্রধান সেনাপতি দুখোনিনও বিদ্রোহের চেষ্টা করে। শেষপর্যন্ত সোভিয়েত সরকার জেনারেল দুখোনিনকে বরখাস্ত করে। প্রতিবিপ্লবের সদর দপ্তর ভেঙ্গে দেওয়া হয়। এইভাবে প্রতিবিপ্লবের নানা বিচ্ছিন্ন চেষ্টাকে পরাজিত করা হয়। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব জয়যুক্ত হয়।

রাশিয়াতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব জয়যুক্ত হতে পারল কেন? কারণ, লেনিনেরই শিক্ষা যে, মার্কসবাদের প্রাণসত্তা হলো বিশেষ পরিস্থিতির বিশেষ মূল্যায়ন, যেটা লেনিন নিজেই রাশিয়ার ক্ষেত্রে সঠিকভাবে করতে পেরেছিলেন। মার্কসবাদী বিচারের ভিত্তিতে লেনিন দেখতে পেয়েছিলেন, সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহেই ব্যস্ত — তারা ঐক্যবদ্ধভাবে রুশ বিপ্লবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না; এখানে শ্রমিকশ্রেণীর যথার্থ দলের নেতৃত্বে শ্রমিক-সৈনিকের সোভিয়েত গড়ে উঠেছে এবং তা ক্রমাগত প্রাধান্য বিস্তার করছে; এখানে পুঁজি ও শ্রমের মধ্যে আপসকামী দল ও শক্তিগুলো ক্রমাগত জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে; রাশিয়ার প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রযন্ত্র তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ছে এবং বলশেভিক পার্টি সেনাবাহিনী সমেত জনগণের চাহিদাকে যথাযথভাবে ধরতে পেরে শান্তি-জমি-রুটির সঠিক স্লোগান জনগণের সামনে উপস্থিত করেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল, রুশ জনগণের অসীম বীরত্ব ও আত্মত্যাগের শক্তি, বলশেভিক নেতা-কর্মীদের বিপ্লবী তেজ ও অদম্য মনোবল, বিপুল সংখ্যক শ্রমিক-কৃষকের সাথে সজীব সংযোগ গড়ে তোলা ও তাদের বিপ্লবী শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রবল উদ্যম। এইসব মিলিয়ে সেদিন রাশিয়ার বুকে এই নতুন ও যুগান্তকারী ঘটনা ঘটতে পেরেছিল।

অক্টোবর বিপ্লব জয়যুক্ত হতে পারল কেন — এই প্রসঙ্গে কমরেড স্ট্যালিন বলেছেন : “প্রথমত রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সামগ্রিকভাবে অক্টোবর বিপ্লবকে সমর্থন করেছিল। দ্বিতীয়ত, গরীব কৃষক ও সৈন্যরা জমি ও যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তির জন্য আকুল হয়েছিল, তাদের বেশীরভাগ অংশই বিপ্লবকে সমর্থন করেছিল। তৃতীয়ত, বিপ্লবের নেতৃত্বে, বিপ্লব পরিচালনার দায়িত্বে ছিল বলশেভিক পার্টির মতো বিশ্বস্ত পার্টি, নানা অগ্নি পরীক্ষায় পার হয়ে আসা একটা পার্টি। বহু অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ছিল এই পার্টি। বছরের পর বছর ধরে এই পার্টি অর্জন করেছিল নিজের লৌহকঠিন শৃঙ্খলা। কিন্তু তার শক্তি শুধু এখানেই নয়। খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষের সাথে ব্যাপক যোগাযোগও তার শক্তির উৎস। চতুর্থত, অক্টোবর বিপ্লবের শত্রুরা ছিল অপেক্ষাকৃত দুর্বল। রুশ বুর্জোয়াশ্রেণীর তেমন একটা শক্তি ছিল না। কৃষক বিদ্রোহের ফলে ভূস্বামীশ্রেণীর মনোবল ঠেকেছিল শূন্যের কোঠায়। মেনশেভিক ও সোস্যালিস্ট রেভ্যুলিউশনারীদের মতো আপসকামী পার্টিদের যুদ্ধের ফলে মানুষকে দেবার মতো আর কিছুই ছিল না। পঞ্চমত, রাশিয়ার নবীন রাষ্ট্রের বিশাল বিস্তৃতিকে বিপ্লব কাজে লাগিয়েছিল।…ষষ্ঠত, বিপ্লবের হাতে ছিল প্রচুর পরিমাণ খাদ্য, জ্বালানী এবং কাঁচামাল। দেশের ভিতর থেকে পাওয়া এই রসদ প্রতিবিপ্লবের বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রচুর কাজে এসেছিল।…এই পরিস্থিতির ফলে অক্টোবর বিপ্লব তুলনামূলকভাবে সহজ হয়। বিপ্লব বিজয়ী হয়।” (রচনাবলী, ইংরেজী সংস্করণ, মস্কো, ১৯৫৩, ষষ্ঠ খন্ড, পৃ ৩৭৫-৭৬)

এই বিপ্লব ও লেনিনের শিক্ষার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) দলের প্রতিষ্ঠাতা শিবদাস ঘোষ বলেছেন, “আপনারা মনে রাখবেন, লেনিনবাদ হচ্ছে এই যুগে দেশকাল ভেদে যে পার্থক্য, সেই পার্থক্যকে সামনে রেখে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার অধীন প্রত্যেকটি দেশের বিপ্লবের প্রক্রিয়াকে অনুধাবন করবার একটি বিচার পদ্ধতি, দেখবার একটি দৃষ্টিভঙ্গি। এযুগে প্রত্যেকটি দেশের বিপ্লবের মূল নীতি কী হবে, তা লেনিনবাদ তুলে ধরেছে। তাই লেনিনবাদকে বলা হয়, এই যুগের, অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগের মার্কসবাদ। একথার মানে হলো, বর্তমান যুগে যখন পুঁজিবাদ ক্ষয়িষ্ণু-মরণোন্মুখ, যখন সে তার বিকাশের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দিয়ে চরম প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে গেছে, দেশে দেশে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে গলা টিপে মারছে, তখন সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার অধীন পুঁজিবাদী এবং ঔপনিবেশিক ও আধা-ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে বিপ্লবের প্রক্রিয়াকে অনুধাবন করবার এবং সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করবার মূল নীতিগুলো তুলে ধরেছে লেনিনবাদ।”

এই লেনিনবাদকে হাতিয়ার করেই, বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে রাশিয়ায় শ্রমিকশ্রেণী বিপ্লব করেছে। অক্টোবর বিপ্লবের চরিত্র জাতীয় ছিল না, তার চরিত্র আন্তর্জাতিক। অক্টোবর বিপ্লব এযুগের সকল দেশের সামনেই বিপ্লবের একটা পরিপ্রেক্ষিত ও মূল নীতিকে তুলে ধরেছে। অক্টোবর বিপ্লব দেখিয়ে দিয়েছে, শ্রমিকশ্রেণী বিপ্লব করতে পারে। এই বিপ্লব নিঃসংশয়ে প্রমাণ করেছে যে, বিশ্বপুঁজিবাদী বিপ্লবের যুগ খতম হয়ে গিয়ে বিশ্বপুঁজিবাদ ক্ষয়িষ্ণু ধ্বংসোন্মুখ, প্রগতিবিরোধী হয়ে পড়েছে, জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধী, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের বিরোধী হয়ে পড়েছে। তাই সমাজপ্রগতির দ্বার সে রুদ্ধ করছে। প্রযুক্তির বিকাশ ও আধুনিকীকরণ সত্ত্বেও পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার চরম সঙ্কট দেখা দিচ্ছে, যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা দূর করতে পারছে না। পুঁজিপতিদের মধ্যে প্রতিযোগিতা এবং জনসাধারণের ওপর দেশের ও দেশের বাইরে পুঁজিপতিদের, অর্থাৎ, দু’দিকের শোষণের ফলে বর্ধিত উৎপাদিকা শক্তির তুলনায় বাজারের সংকোচন ক্রমাগত উৎপাদনে সঙ্কট ডেকে আনছে। আর, এই সংকট উল্টো দিক থেকে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে জ্ঞানবিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প-দর্শন-সাহিত্য-সংস্কৃতি-নৈতিকতার যে বিকাশ ঘটে — সেই প্রক্রিয়ার উপরও প্রভাব ফেলছে, তাকে খর্ব করছে। তাহলে, সমস্ত দিক থেকে পুঁজিবাদ হচ্ছে ক্ষয়িষ্ণু এবং প্রগতিবিরোধী। ফলে, তাকে বিপ্লবের আঘাতে হটাতে হবে। এই বিপ্লবে অবশ্যই সর্বহারাশ্রেণী নেতৃত্ব দেবে।

দ্বিতীয়ত, বিশ্বের পিছিয়ে-পড়া পুঁজিবাদী দেশগুলোতে, অর্থাৎ পুঁজিবাদী বিকাশের অর্থে যে দেশগুলো বনেদি পুঁজিবাদী দেশগুলোর থেকে পিছিয়ে আছে, যেখানে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কায়েম আছে, যেখানে বুর্জোয়াদের প্রগতিশীল ভূমিকা শেষ হয়ে গিয়েছে, সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষকের ঐক্য সাধন করে বুর্জোয়াদের উচ্ছেদ ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করতে হবে।

তৃতীয়ত, যেসব দেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবই হয় নি, বা যেসব দেশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী উপনিবেশবিরোধী জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন বা জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের স্তরে রয়েছে, সেইসব দেশেও শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক এবং জাতীয় বুর্জোয়াদের কোনো অংশ যদি সেই লড়াইতে আসতে চায়, আসবার মতন জায়গায় থেকে থাকে, তবে তাদের নিয়ে জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গঠন করে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন সংগঠিত করতে হবে। কিন্তু, তাকে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বা সর্বহারা বিপ্লবের অংশ ভাবতে হবে এবং অবশ্যই শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বেই সেগুলো পরিচালনা করতে হবে। এভাবে যদি কেউ না ভাবে, তবে তারা ভুল করবে এবং ভুলের মাশুল তাদের দিতে হবে এই অর্থে যে, এই বিপ্লব সফল পরিণতিতে পৌঁছুবে না। কারণ, শ্রমিকশ্রেণী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে, সেই দেশের বুর্জোয়ারা তার নেতৃত্ব দখল করবে এবং সেই বুর্জোয়ারা আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়ার অংশ হিসেবে বিপ্লবের পথ ও গতি রুদ্ধ করবে, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব খন্ডিতভাবে সমাপ্ত হবে। এর ফলে গণমুক্তি আসবে না, বরং পুঁজিবাদ সংহত হবে, এমনকী জাতীয় স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পরও তা বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি থাকবে। আজ যে নয়া-উপনিবেশবাদের কথা বলা হচ্ছে, লেনিনের সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কিত ব্যাখ্যাতেও তার স্বীকৃতি রয়েছে। তিনি নিজেই এটা বলে গেছেন। নয়া-উপনিবেশবাদ শব্দটা লেনিন ব্যবহার করেছেন কি করেন নি, সেটা আমার কাছে খুব বড় কথা নয়। কিন্তু নয়া-উপনিবেশবাদের মূল কথাটা লেনিনেই পাওয়া যাবে যে, এযুগে সাম্রাজ্যবাদীরা অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব বিস্তার করার মধ্য দিয়ে পিছিয়ে-পড়া স্বাধীন বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক, এমনকী সামরিক কর্তৃত্ব পর্যন্ত কার্যত নিজেদের অধীনে এনে ফেলবে। সাম্রাজ্যবাদ পুরনো ঢঙে থাকবে না, নতুন ঢঙে আসবে অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের মধ্য দিয়ে। তাই এযুগে জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনগুলোতে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারলে, তবেই সেগুলো সঠিক ও সফল পরিণতিতে পৌঁছুবে, সেগুলোকে মূল লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া যাবে। অর্থাৎ, এই সমস্ত দেশের বিপ্লবকে ক্রমে ক্রমে উত্তরণ ঘটানোর মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে নিয়ে যাওয়া যাবে, জাতীয় স্বাধীনতাও পুরোপুরি অর্জিত ও রক্ষিত হতে পারবে।

কিন্তু অক্টোবর বিপ্লবের ও লেনিনের এই শিক্ষাগুলো, বা আরও যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আছে, সেগুলো তো বইয়েই লেখা আছে, মুখস্থ করে যে কেউ সেগুলো বলতে পারে, বা সমস্ত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টি এগুলো জানে। অনেকেই যাঁরা একটু খোঁজখবর রাখেন, লেনিনের বই পড়েছেন, তাঁরাই এগুলো বলতে পারবেন। এসব জানার দরকার নিশ্চয়ই আছে। প্রাথমিক শিক্ষা হিসেবে এগুলো সকলকে শেখাবার অবশ্যই প্রয়োজন আছে। এগুলো না জানলে, ইতিহাসের এই প্রাথমিক জ্ঞানটুকু না থাকলে, আজকের বিপ্লবী কর্মীরা মানুষকে কাছে টানবে কী করে? কিন্তু আমি যেটা বলতে চাইছি, তাহলো, এই শিক্ষাগুলো একটা দেশের কোনো পার্টির নেতা-কর্মীরা খুব ভাল করে বলতে পারছে কি পারছে না, তা দিয়ে সেই পার্টিটা প্রকৃত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টি কিনা, তাদের মার্কসবাদের উপলব্ধিটা সঠিক কিনা, চিন্তা ও তত্ত্বটা ঠিক কিনা — এগুলো বিচার হয় না।…শ্রমিকশ্রেণীর দল ও নেতৃত্বের বিষয়টিকে লেনিন পরিষ্কার করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন এবং এর অপরিহার্যতার কথা বারবার বলেছেন। তিনি একথা বলেন নি যে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে মানলেই একটা দল বিপ্লব করতে পারবে। উল্টো তিনি বলেছেন, সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া বিপ্লব হতে পারে না। এই তত্ত্ব বলতে গিয়ে তিনি যৌথ জ্ঞান, দলের নেতৃত্বের সর্বাত্মক জ্ঞানকে বুঝিয়েছেন, শুধু একটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তত্ত্বকে বোঝান নি। কারণ, তার দ্বারা সমাজের গুরুতর সমস্যাগুলোকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করা যায় না। নানা সমস্যার চরিত্র ও তার উৎপত্তির মূল জায়গাটা ঠিকমতো জানতে হলে, নেতৃত্বের জ্ঞানটা সর্বাত্মক হওয়া চাই।

IMG_6294 copyলেনিনবাদের আর একটা মূল সিদ্ধান্ত আছে মার্কসবাদের মূল নীতিগুলোর উপলব্ধি সম্পর্কে। সেটা হচ্ছে মার্কস-এঙ্গেলস ও লেনিন যে মূল নীতিগুলো নির্ধারণ করে দিয়ে গেছেন, সেগুলো যে যুগে যে মূল পরিস্থিতির ওপর মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বিচার-বিশ্লেষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করে নির্ধারিত হয়েছে, সেই যুগ ও মূল পরিস্থিতিটা বিশ্বে শ্রেণী সমাবেশের দিক থেকে যতক্ষণ মূলগতভাবে এক থাকবে, ততক্ষণ সেগুলো মূলনীতি হিসেবে থাকবে। কিন্তু এই মূল নীতিগুলোর উপলব্ধি এক জায়গায় থাকবে না। যেহেতু বাস্তব পরিস্থিতি ক্রমাগত পাল্টাচ্ছে, গুণগত পরিবর্তন ঘটতে সময় লাগলেও পরিমাণগত পরিবর্তন প্রতিনিয়তই ঘটতে থাকে, সেহেতু তাকে প্রয়োগ করতে গিয়ে একটা পার্থক্য ও দ্বন্দ্ব দেখা দেবে। এই সত্যটা সাধারণ মানুষের বোঝার জন্য তিনি খুব সুন্দর রাজনৈতিক পরিভাষায় একটা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, যেকোনো মূল নীতিকে যখনই একটা বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে যাওয়া হবে, তখনই একটা দ্বন্দ্ব দেখা দেবে। এই দ্বন্দ্বটা হচ্ছে জেনারেলের (সাধারণের) সঙ্গে পার্টিকুলারের (বিশেষের), অর্থাৎ মূল নীতিগুলোর সাধারণ উপলব্ধি ও তার বিশেষ প্রয়োগ —এই দুইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব। এর অর্থ হচ্ছে, বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে গেলেই মূল নীতিগুলোর উপলব্ধি আর আগের জায়গায় থাকে না, তা বিকশিত হয়, সম্প্রসারিত হয়, প্রয়োজনে তা সংশোধিত হয়, তার ক্যাটাগরিটা পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত ও উন্নত হতে থাকে। এজন্যই বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণের উপর, অর্থাৎ অবজেক্ট-এর উপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তা না হলে বিপ্লবের গোটা ব্যাপারটাই দাঁড়িয়ে যায় সাবজেকটিভ (বাস্তব বিবর্জিত অলীক কল্পনা)।” (বৈজ্ঞানিক দ্বন্দ্বমূলক বিচারপদ্ধতিই মার্কসবাদী বিজ্ঞান। রচনাবলী, দ্বিতীয় খন্ড)।

সৌমেন বসু, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক, সোস্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়া (কমিউনিস্ট)
নতুন দিগন্ত, অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৭ সংখ্যা থেকে সংগৃহীত

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments