চট্টগ্রামে হোল্ডিং ট্যাক্সবিরোধী লড়াইয়ে প্রমাণিত হলো গণআন্দোলনের বিকল্প নেই
মানুষের মধ্যে খুব প্রচলিত একটি কথা হলো- আন্দোলন করে কিছু হবে না, সরকার যা চায় তাই হয়। গায়ের জোরে যা ইচ্ছা তাই করবে। তাতে মানুষ বাঁচুক আর মরুক। এমনি ফ্যাসিবাদী নিপীড়ন চলছে দেশব্যাপী। সে সময় মানুষের মনে আশা জাগানিয়া হয়ে এসেছে চট্টগ্রামের হোল্ডিং ট্যাক্সবিরোধী আন্দোলন। সংগঠকদের একনিষ্ঠতা, কষ্টসহিষ্ণুতা, সাহসী ভূমিকা, হাজারো মানুষের সম্পৃক্ততা ছিনিয়ে এনেছে বিজয়।
গত বছরের আগ পর্যন্ত, চট্টগ্রাম শহরে বাড়ির আয়তনের ভিত্তিতে হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্য করা হতো। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অধীনে এই কর ধার্য হতো। ২০১৬ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন আয়তনের পরিবর্তে ঘর ভাড়ার ভিত্তিতে ১৭% হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ করেছে। যা পূর্বের তুলনায় ১৫/২০ গুণ হারে বেড়েছে। যা ভাড়াটিয়া, বাড়ির মালিক সবার উপর এক বিশাল বোঝা। নগরীতে হোল্ডিং রয়েছে ১ লক্ষ ৮৫ হাজার ২৪৮টি। যা থেকে বিগত বছরে আয় করা হয়েছে ১০৩ কোটি ৪৪ লক্ষ ১৮ হাজার ৫৩৭ টাকা। এই আইন কার্যকারি করে সিটি কর্পোরেশন আয় করতে চায় ৮৫১ কোটি ৩০ লক্ষ ৬৪ হাজার ৫৫৯ টাকা। চাটগাঁবাসীর দাবি তাদের আয়ের উপর সরকার ট্যাক্স ধার্য করছে, তাহলে আবার বাড়ির আয়ের উপর কেন এই গলাকাটা ট্যাক্স আরোপ? এর চাপ পড়বে ভাড়াটিয়াদের উপর।
চট্টগ্রামকে ২য় রাজধানী বলা হলেও চট্টগ্রামবাসী পায় না কোনো নাগরিক সুবিধা, বরং দিন দিন বাড়ছে জনদুর্ভোগ। জলাবদ্ধতা, যানজট, অপরিকল্পিত ফ্লাইওভার, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট রেখে বাড়াতে চাইছে হোল্ডিং ট্যাক্স। আগ্রাবাদ, হালিশহর, বাকলিয়াসহ অধিকাংশ অঞ্চল জোয়ারের পানিতে ডুবে থাকে। সেই অঞ্চলে গৃহকর মওকুফ করার কথা উল্টো বাড়িয়ে দিচ্ছে! ৬০ লক্ষ চট্টগ্রামবাসীর এই সংকট মুহুর্তে একদল মানুষ এগিয়ে আসে, এই অন্যায়-অন্যায্য-অযৌক্তিক হোল্ডিং ট্যাক্স বাতিলের দাবিতে। গঠিত হয় ‘করদাতা সুরক্ষা পরিষদ’।গত বছর নভেম্বর মাস থেকে টানা ১২ মাস ধারাবাহিকভাবে এই কমিটি আন্দোলন পরিচালনা করে।
কদমতলীর অধিবাসী নুরুল আফসারের নেতৃত্বে ‘চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ’র নামে শুরু হয় এই আন্দোলন। শুরুতে মানব বন্ধন, মিছিল, প্রেস কনফারেন্স, সমাবেশ করা হয়। প্রথমদিকে জনগণ বুঝতে না পারলেও যখন বাড়ির অ্যাসেসমেন্ট শুরু হয়, তখন তাদের ক্ষোভ দানা বেধে উঠে। আস্তে আস্তে শুরু হয় ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বৈঠক, স্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচী, সমাবেশ ও মিছিল। একই দিনে বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরদের স্মারকলিপি পেশ। অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ¦, ভয়, হতাশা নিয়েও আসতে থাকে জনগণ। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা। গঠিত হয় ওয়ার্ডভিত্তিক জনগণের সম্মিলিত জোট।
অন্যদিকে এই গলাকাটা হোল্ডিং ট্যাক্স আরোপের হোতা মেয়র আ জ ম নাসির করদাতা সুরক্ষা পরিষদের সাথে মতবিনিময় করার নামে বাস্তবে ভয় ভীতি দেখায় যেন আন্দোলনের পথ থেকে সরে যায়। আপিলের ব্যবস্থা করে ৭০/৮০ ভাগ কর ছাড় দেয়া শুরু হয়। যেন জনগণ আন্দোলনে না যায়। পত্রিকায় এসেছে অ্যাসেসমেন্ট এর নাম করে প্রায় কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য হয়েছে। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারী নেতৃবৃন্দকে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা করার হুমকি দেন মেয়র! কিন্তু নেতৃবৃন্দ অবিচল থাকেন তাদের আন্দোলনের পথে। ১৯৮৬ সালে স্বৈরাচারী এরশাদের তৈরি করা গৃহকরের এই আইন বাতিলের দাবিতে জোয়ার ওঠে চট্টগ্রামে।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হলো গণ মানুষের গান, প্রতিটি সমাবেশ শেষে পরিবেশন হতো সেই গান। আন্দোলন যখন আরো তুঙ্গে উঠল তখন সুরক্ষা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর আমীর উদ্দীনকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর রুমে ঢুকে সরকারি সংগঠন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অস্ত্র ধরে হুশিয়ারি দিয়ে যায়। এর ফল হলো উল্টো। চট্টগ্রামবাসীর ক্ষোভ বিস্ফোরিত হলো । শুরু হলো আরও প্রতিবাদ, মিছিল।
৪ ডিসেম্বর নগর ভবন ঘেরাওকে সামনে রেখে করদাতা সুরক্ষা পরিষদের নেতৃবৃন্দ ৪১টি ওয়ার্ডে অলিতে-গলিতে প্রচারণা চালায়। প্রতিদিন ট্রাকে করে ওয়ার্ড অভিযাত্রা, লিফলেট বিলি, মাইকিং, সমাবেশ করে। এই অভিযাত্রাকালে বিভিন্ন পয়েন্টে মেয়র সমর্থিত ছাত্রলীগের বাধার সম্মুখীন হতে হয়। সাধারণ জনগণকে যুক্ত করে যে আন্দোলন তাকে বাধা দেবে কে? সমস্ত ধরনের ভয়-ভীতি, বাধাকে উপেক্ষা করে আন্দোলন এগিয়ে যায়। সেই আন্দোলনের তহবিল বা ফান্ড তৈরি হয় জনগণের সহযোগিতায়।
আন্দোলনের এক পর্যায়ে নগর ভবন ঘেরাও-এর চারদিন আগে গণআন্দোলনের চাপে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে স্থগিত করে ভাড়ার ভিত্তিতে গৃহকর নির্ধারণ। পরবর্তীতে করদাতা সুরক্ষা পরিষদের পক্ষ থেকে বিজয় মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। অন্যায্য ট্যাক্স বাতিল হওয়ায় কয়েক হাজার মানুষের বিজয় সমাবেশ থেকে নেতৃবৃন্দ ঘোষণা করেন, এই আন্দোলন শেষ নয় বরং শুরু। আগামী দিনে যেকোনো নাগরিক অধিকার আদায়ের দাবি নিয়ে আরো বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলবে।’
এই আন্দোলনে নেতৃত্বকারী ভূমিকা রেখেছেন করদাতা সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি নুরুল আফসার, সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর আমীর উদ্দিন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক , সাবেক কাউন্সিলর ও বাসদ (মার্কসবাদী) নেত্রী জান্নাতুল ফেরদাউস পপি; করদাতার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান মারুফ রুমী, সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ারুল করিমসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।
আমরা দেখতে পেলাম চট্টগ্রামবাসীর উপর যে বিশাল করের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হলো, সে সময় বড় রাজনৈতিকদলগুলো যারা জনগণের কথা বলে মুখে ফেনা তোলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে, মুক্তিযুদ্ধের চ্যাম্পিয়ান বলে নিজেদের ঘোষণা করে তাদের নেতৃত্ব তখন জনগণের পক্ষে ছিল না। ছিল না প্রধান বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ। চট্টলাবাসী দেখলো অভিভাবক মেয়রের আসল রূপ! দেখেছে জনপ্রতিনিধি ওয়ার্ড কাউন্সিলররা অনেকে জনগণের পাশে নেই। তাই আবারো প্রমাণিত হলো জনজীবনের সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য জনগণের নিজস্ব শক্তিতে গণকমিটি করে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর পূর্তি — প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
বিশ বছর পূর্তি হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির। বড় বড় হরফে শিরোনাম করেছে দৈনিক পত্রিকাগুলো — ‘পাহাড় জুড়ে উৎসব শুরু হয়েছে।’ সরকারি উদ্যোগে তিন পার্বত্য জেলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে র্যালি-শোভাযাত্রা-সভা-সেমিনার। কোথাও কোথাও আয়োজন করা হয়েছে কনসার্টের। সরকারি উদ্যোগে সাফল্যের বিরামহীন ঢাক পাহাড়ের গায়ে গায়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
কিন্তু যাদের জন্য এ চুক্তি সেই পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা কী? নিজের দেশে প্রতিদিন টিকে থাকার জন্য লড়াই করা তাদের জীবনের কী পরিবর্তন হলো এ চুক্তি দিয়ে? বাস্তবে কিছুই হয়নি। তাদের চোখে মুখে এখনও আতঙ্ক, এখনও অবিশ্বাসের ছায়া। দেশের কাউকে তাদের বিশ্বাস করার উপায় নেই। কয়েক মাস আগেও লংগদুতে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর বসত বাড়িতে সেটেলার বাঙালিদের আগুন লাগানোর দৃশ্য তাদের চোখে লেগে আছে। নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা করা অথবা রাঙামাটিতে ১৭ বছরের যুবক রোমেল চাকমাকে রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা নৃশংস হত্যা — সবই বলে দেয় আজ পাহাড়ের কী অবস্থা। এ অবস্থায় উৎসব চলে না।
সরকার বলছে, ‘চুক্তির প্রায় সবটুকুই বাস্তবায়িত হয়েছে’। অন্যদিকে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস- সন্তু লারমা) সভাপতি সন্তু লারমা সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘সরকার মিথ্যাচার করছে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি সম্পন্ন, ১৫টি আংশিক ও ৯টি ধারার বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান আছে বলে মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। আসলে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে এর মধ্যে মৌলিক ধারাগুলোর একটিও বাস্তবায়িত হয়নি।’ (সূত্র : প্রথম আলো ২ ডিসেম্বর ২০১৭) এমন আস্থাহীন অবিশ্বাসের মধ্য দিয়ে যখন সরকার বর্ষপূর্তির আয়োজন করছে তখন এই চুক্তি ভবিষ্যতে কতটুকু বাস্তবায়িত হবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। চুক্তির কয়েকটি ধারার উপর আলোকপাত করলে তার অসঙ্গতিগুলো ধরা পড়বে। এবং সরকারের মনোভাবও পরিষ্কার হবে।
চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো ‘ভূমি সংক্রান্ত বিশেষ বিধান’, যেখানে স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে ‘ভূমি কমিশন গঠন’ করা হবে। বাস্তবে ভূমি সংক্রান্ত সমস্যা নিরসনের জন্য যে কমিশন গঠন করা হয়েছে তার কার্যকারিতা নেই। বরং ভূমি সমস্যা পাবর্ত্য অঞ্চলে সমাধান না করে চুক্তির পর সরকার হাজার হাজার একর জমি নানা সংস্থার কাছে লিজ দিয়ে, নানান অবকাঠামো নির্মাণ করেছে। এখনও পর্যন্ত অব্যাহতভাবে পাহাড়ীদের ভূমি দখল করা হচ্ছে। পার্বত্য অঞ্চলে সংঘাতের কারণে‘৮০ ও ‘৯০ এর দশকের শুরুতে ভারতে চলে যায় হাজার হাজার পাহাড়ী জনগোষ্ঠী। বিভিন্ন সময় হামলা, অগ্নি সংযোগের মতো ঘটনায় অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হয় হাজার হাজার পাহাড়ী পরিবার। এদের পুনর্বাসন নিয়ে সরকারের ভূমিকা নেই। এর মধ্যে যারা ভারত থেকে ফেরত এসে পুনর্বাসিত হয়েছে, তারা এখনও পর্যন্ত জমির দখল পায়নি।
চুক্তিতে উল্লেখ ছিল, ধারাবাহিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পগুলো প্রত্যাহার করা হবে। বাস্তবে প্রত্যাহার তো দূরে থাক, দ্বৈত শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানকার পাহাড়ী জনগোষ্ঠীকে প্রতি মুহূর্তে নজরদারিতে থাকতে হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাহাড়ী-বাঙালি বিরোধকে মদত দিয়ে যাচ্ছে এবং প্রতি মুহূর্তে অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কা জাগিয়ে তুলছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ি-বাঙালি বিরোধ দীর্ঘদিনের। স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি প্রত্যেক শাসক সমতলের নদীভাঙ্গা অসহায় গরীব মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থার কথা বলে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। যার ফলে প্রতিনিয়ত সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে শাসকদের মদতে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ‘বাঙালি ছাত্র পরিষদ’ ব্যানারসহ নানা ব্যানারকে ব্যবহার করছে।
আমাদের বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর যে আশা-আকাক্সক্ষা তা ধারণ করার পরিবর্তে তাদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে। পাহাড় ও সমতলের গরীব মানুষদের মধ্যে বিভেদের দেয়াল তৈরি করেছে। আমাদের সংবিধানেও পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র জাতিসত্তার কোনো স্বীকৃতি নেই। বাংলাদেশে ৪৫টি আদিবাসী গোষ্ঠীর অবস্থান রয়েছে পাহাড়ে ও সমতলে। তাদের ভাষার সংখ্যা ৩২টি। তাদের ভাষা-সংস্কৃতি আজ হুমকির সম্মুখীন। তাদের অস্তিত্ব ক্রমশ বিপন্ন।
আজ দেশে দেশে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্র ছোট ছোট জাতিসত্তার উপর জাতিগত নিপীড়ন নামিয়ে এনেছে। আমাদের এই রাষ্ট্র তার ব্যতিক্রম নয়। প্রতিমুহূর্তে শাসকগোষ্ঠী কখনও চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলে, কখনো পাহাড়ী-বাঙালি বিরোধকে উস্কে দিয়ে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীকে বিভক্ত করে তার ফ্যাসিবাদী শাসন পাহাড়ে কায়েম করেছে। এর বিরুদ্ধে পাহাড় ও সমতলের গরীব মানুষের ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন জরুরি।
রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শততম বার্ষিকী ও বাসদ (মার্কসবাদী)’র ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত
গাইবান্ধা: রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শততম বার্ষিকী ও বাসদ (মাকর্সবাদী)’র ৩৭তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে গাইবান্ধা স্বাধীনতা বিজয় স্তম্ভ প্রাঙ্গণে বুধবার বিকেলে জেলা শাখার উদ্যোগে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। আহসানুল হাবীব সাঈদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রধান বক্তা ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় কার্যপরিচালনা কমিটির সদস্য কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী। বক্তব্য রাখেন জেলা সদস্য সচিব মনজুর আলম মিঠু, সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আহবায়ক বীরেন চন্দ্র শীল, সমাজতান্ত্রিক ক্ষেতমজুর কৃষকফ্রন্ট নেতা প্রভাষক গোলাম সাদেক লেবু, বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্র জেলা সভাপতি অধ্যাপক রোকেয়া খাতুন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট জেলা সাধারণ সম্পাদক পরমানন্দ দাস প্রমুখ।
বগুড়া: সাতমাথায় অনুষ্ঠিত জনসভায় বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় কার্যপরিচালনা কমিটির সদস্য কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্তী। বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় বর্ধিত ফোরামের সদস্য কমরেড মনজুর আলম মিঠু এবং বগুড়া জেলা নেতৃবৃন্দ। সভাপতিত্ব করেন জেলা সমন্বয়ক কমরেড সামছুল আলম দুলু।
সিলেট: গত ৯ডিসেম্বর’১৭ বিকাল ৪ টায় সিলেট শহীদ মিনারে জনসভা ও লাল পতাকা মিছিল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বৃষ্টিপাতের কারণে তাৎক্ষণিকভাবে সিলেট জেলা ২ নং বার হল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে উপেক্ষা করে বেলা ৩টায় সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চল, পাড়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শত শত শ্রমিক-কর্মচারী-পেশাজীবি-ছাত্র-নারী একে একে জড়ো হতে থাকে। সভায় প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় কার্যপরিচালনা কমিটির সদস্য কমরেড আলমগীর হোসেন দুলাল। জেলা আহ্বায়ক কমরেড উজ্জ্বল রায় সভাপতিত্ব করেন এবং জেলা কমিটির সদস্য সুশান্ত সিনহা সভা পরিচালনা করেন। আরও বক্তব্য রাখেন জেলা কমিটির সদস্য হুমায়ূন রশীদ সোয়েব।
রোকেয়া দিবস উদযাপন
বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্র কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে ৯ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি চত্ত্বর থেকে র্যালি সহযোগে রোকেয়া হল প্রাঙ্গনস্থ রোকেয়া ভাস্কর্যে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয় এবং বিকাল ৩.৩০ টায় ডাকসু কনফারেন্স হলে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের সভাপতি সীমা দত্তের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বাসদ (মার্কসবাদী)’র কেন্দ্রীয় কার্যপরিচালনা কমিটির সদস্য কমরেড মানস নন্দী, নারীমুক্তি কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও ঢাকা নগর শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট সুলতানা আক্তার রুবি, সাধারণ সম্পাদক মর্জিনা খাতুন।
রুশ বিপ্লবের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে ভারতের ‘এসইউসিআই (কমিউনিস্ট)’ পার্টির বিশাল সমাবেশ
মহান রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে ভারতের ‘এসইউসিআই (কমিউনিস্ট)’ পার্টির উদ্যোগে গত ১৭ নভেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত হলো এক বিশাল সমাবেশ। সমাবেশের তিনদিন আগে থেকেই চলছিল ভীষণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। দেশের ২৩টি রাজ্য থেকে মানুষ এসেছে ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে, কোনো কোনো রাজ্য থেকে আসতে যেখানে দু-তিন দিন পর্যন্ত সময় লাগে। সমাবেশের সময়ও চলছিল বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজে, মাথায় ছাতা ধরে, কোনোরকমে কোলের শিশুটির মাথা বাঁচিয়ে সমাবেশের বক্তব্য শুনেছেন হাজার হাজার মানুষ।
দলের পলিট ব্যুরোর সদস্য মানিক মুখার্জির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন এসইউসিআই’র কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ। আমন্ত্রিত হয়ে বক্তব্য রাখেন বাসদ (মার্কসবাদী)’র কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী। তিনি বলেন,“মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তার ভিত্তিতে গঠিত দল এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) প্রতিদিনই বিকশিত হচ্ছে — এটা আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্য খুবই আশার দিক। কোনো মন্ত্রী-এমপি ছাড়া, পুঁজিপতিদের ব্যাকিং ছাড়া কেবলমাত্র আদর্শের জোরে এই দল এত বড় জমায়েত করেছে, গোটা বিশ্বের যেখানেই মেহনতি মানুষ লড়ছে তাদের সকলকেই এই সংবাদ অনুপ্রাণিত করবে। আমাদের দেশে বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আপনাদের দলের অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য শিক্ষা হিসেবে থাকবে।”
কড়াইল বস্তি উচ্ছেদ করে লাখো মানুষকে পথে বসানো যাবে না
গভীর রাত। হঠাৎ আগুনের লেলিহান শিখা। দাউ দাউ করে জ্বলছে চারপাশ। চোখে ঘুম নিয়েই এক দল ছেলে-মেয়ে ছুটে চলছে আগুন নেভাতে। না, নিজের ঘরটা নয়। বাঁচাতে গেছে তাদের বহু যতেœ গড়া পাঠাগারটিকে। শহীদ রুমি স্মৃতি পাঠাগার তার নাম। একে রক্ষা করতে না পারলে তাদের স্বপ্নগুলোও যে মরে যাবে। এ পাঠাগারে বসেই তো তারা জীবনের কথা বলে, বড় মানুষ হবার স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখায় অনেককে। শুধু কিছু ছেলে-মেয়ে নয়, পাঠাগারের সাথে যুক্ত তাদের পরিবারগুলোও। অভিভাবকরাও যেন নিশ্চিন্ত থাকেন। এখানে যুক্ত হলে অন্তত নষ্ট হবার ভয় থাকে না। এত ভালোবাসার পাঠাগার কি আগুন পোড়াতে পারে? সবার সম্মিলিত চেষ্টায় সেদিন পাঠাগারটিকে রক্ষা করা গিয়েছিল। এই পাঠাগারটি ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীর মাঝখানে, দক্ষিণ এশিয়ার সবচাইতে বড় বস্তি কড়াইলে অবস্থিত। পাঠাগারটি রক্ষা করা গেলেও কিছু প্রশ্ন সামনে এসেছে, কেন কিছুদিন পর পর এই বস্তিতে আগুন লাগে? কারা লাগায়?
কড়াইল বস্তিতে প্রায় ৩ লাখ মানুষ বসবাস করে। সবাই শ্রমজীবী মানুষ। এদের মধ্যে কেউ গার্মেন্টসে কাজ করে, কেউ রিকশা চালায়, কেউবা দিনমজুর। শ্রমজীবী এই মানুষদের পেটে লাথি মারার মতো একটি ঘোষণা গত কিছু দিন আগে পুলিশ প্রধান দিলেন। বললেন, ‘এই বস্তি উচ্ছেদ করা হবে।’ কেননা এখানে মাদক ব্যবসায়ী, চোরাকারবারী, অপরাধীরা থাকে। তাদের কারণে সমাজে অপরাধ বাড়ছে। এদের ধরতে হলে এই বস্তি উচ্ছেদ করতে হবে।
বস্তিতে থাকে কারা? দরিদ্র মানুষ, যাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, মূলত তারাই এখানে বাস করে। গ্রামে কাজ নেই। সবকিছু খুইয়ে শহরে এসেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদী ভাঙ্গন, বন্যা, ক্ষুদ্র ঋণের কারবারীদের চাপ ইত্যাদি বহু কারণে একদল মানুষ কোনো মতে বেঁচে থাকবার জন্যই তো এখানে আশ্রয় নেয়। ঢাকা শহরসহ অন্যান্য বড় শহরগুলোতে এমন মানুষদের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। বাড়ছে, কেননা এই মানুষগুলোর জন্য এলাকাভিত্তিক কোনো কাজের ব্যবস্থা সরকার করতে পারেনি।
বেঁচে থাকার ব্যবস্থা সরকার করতে না পারলে কী হবে? অত্যাচার তো করতে পারবে। তাই বস্তি উচ্ছেদের ফরমান এসেছে। বলা হয়েছে, বস্তিগুলো অপরাধীদের আবাসস্থল। যেন অপরাধ কেবল বস্তিতে হয়! বস্তিতে যেমন অপরাধ হয় তেমনি অভিজাত পাড়াগুলোতেও চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি, খুন, ধর্ষণ, মাদক চোরাচালান সবই হয়। সারা দেশেই তো একই চিত্র। যে অপরাধ করবে, দেশের আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। তাহলে বস্তি উচ্ছেদের প্রশ্ন আসে কেন? আর অপরাধীদের ধরবে যারা, সেই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনদেরও তো এসবের সাথে যুক্ত থাকার খবর প্রায়ই শিরোনাম হয়। সর্ষের ভেতর ভূত থাকলে, ভূত সারাবে কে? এ কথাও সবার জানা যে, যারা মাদক ব্যবসা ও নানা ধরনের অপরাধের সাথে যুক্ত তাদের বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে টিকে থাকে। সরকার কিন্তু এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। তাহলে বস্তি উচ্ছেদের উদ্দেশ্য কী?
বস্তিতে বসবাস করা শহিদুল নামের এক কলেজ ছাত্র জানালো এর কারণ। বললো, ‘গুলশান সোসাইটির উদ্যোগে গুলশান লেক সম্প্রসারণ করার কথা। কিন্তু এই বস্তি থাকার কারণে সেই কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে যেকোনো মূল্যে তারা বস্তি উচ্ছেদ করতে চায়।’ আরেকটি বিষয়ও এখানে উল্লেখ করার মতো। সম্প্রতি কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় কিছু রিপোর্ট এসেছে। বলা হচ্ছে, বস্তিটি উঠিয়ে দিয়ে সেখানে গড়ে তোলা হবে ‘তথ্যপ্রযুক্তি গ্রাম’। কাগজপত্রে এর নাম হবে ‘মহাখালী আইটি ভিলেজ’। (সূত্র : বাংলাদেশ টুডে, ২৬ নভেম্বর ’১৭) সরকার বলছে তারা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেবে, পুনর্বাসন করবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে ইত্যাদি। এর আগেও যখন আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর কিংবা মিরপুরে বস্তি উচ্ছেদ করা হয়, তখন তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য এ ধরনের কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ এলাকাতেই পুনর্বাসন কার্যক্রম খুব সামান্যই বাস্তবায়িত হয়েছে। কড়াইলের ক্ষেত্রেও একই পরিণতি হবে, এটা সহজেই বলা যায়।
আজ ঢাকাকে আধুনিক নগরীতে পরিণত করতে চায় সরকার। কিন্তু এই আধুনিকতা কার স্বার্থে? কাদের স্বার্থে গরীব মানুষদের একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই সরকার উচ্ছেদ করতে চাইছে? পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায় সরকারের এই পরিকল্পনা দেশের মুষ্টিমেয় বড়লোকদের জন্য। আইটি ভিলেজ তো বড়লোকদের জন্য দরকার। তারা কাড়ি কাড়ি টাকা বিনিয়োগ করবে, প্রযুক্তির ব্যবসা করবে। এজন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ পথে বসবে কি না, তা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র ভাবনার সময় নেই। একইভাবে কড়াইল বস্তি উচ্ছেদ করে গুলশান লেকের নয়নাভিরাম দৃশ্য তৈরি করতে পারলে তা তো বড়লোকদের জন্যই উপভোগের ব্যাপার হবে। আমরা বুঝতে পারি এদেরই স্বার্থে রাতের অন্ধকারে বারে বারে আগুনের লেলিহান শিখা বস্তির বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, সেখানকার মানুষদের সর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে।
আজ এ কথা বোঝার সময় এসেছে, আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি-জামাত এরা কেউই গরীব মানুষদের দল নয়। এদের প্রত্যেকের চরিত্র এক। এরা যখন যারা ক্ষমতায় ছিল, প্রত্যেকে গরীব-অসহায় মানুষদের বঞ্চিত করে বড়লোকদের সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলায় সহযোগিতা করেছে। আজ কড়াইলের বস্তি উচ্ছেদের ঘটনার সাথেও একই উদ্দেশ্য জড়িত। তাই সময় এসেছে ঐক্যবদ্ধ হবার। একসাথে লড়াইয়ে নামার।
কড়াইল বস্তির ছেলে-মেয়েরা শহীদ রুমি স্মৃতি পাঠাগারকে যেভাবে রক্ষা করেছে, তা একটি প্রতীকী ব্যাপারও। তাদের এই চেষ্টা বলে গেল, একইভাবে শাসকদের লোভের আগুন থেকে বাঁচতে হলে ঐক্যবদ্ধ লড়াই করতে হবে। এখান থেকে পিছিয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই। কেননা এ লড়াই বাঁচার লড়াই, স্বপ্নগুলোকে জীবন্ত রাখার লড়াই।