Sunday, November 24, 2024

গাঢ় লিকারের কষ্ট

tea worker 1 copy

আধুনিক নাগরিক সভ্যতা, কত ব্যস্ত মানুষ, কত বিচিত্র তার প্রকাশ। ভোরের আলোর সাথে পাল্লা দিয়ে জেগে ওঠে আরও একটি কর্মমুখর দিন। মানুষ ছুটে চলছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। তারই মাঝখানে একটুখানি অবসর, জিরিয়ে নেয়া। কুঁড়েঘর থেকে রাজপ্রাসাদ, ঘরোয়া আড্ডা থেকে রাষ্ট্র নেতাদের সংগোপন বৈঠক সর্বত্র তো এই একই চিত্র। কাব্যে-সাহিত্যে, শিল্পে-সংগীতে চলে এরই বর্ণীল আখ্যান। জীবনের এইসব সূক্ষ্ম প্রকাশ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বিষাদ সবখানে গাঢ় লিকারের এক কাপ চা, আহ! কী গভীর তৃপ্তি, নিশ্চিত নির্ভার। শুধু কি তাই? এ তো একদিক মাত্র। শিল্পীর নিপুণ আঁচড়ের মতো সাঝানো সবুজের রাজ্য চা বাগান, কী দারুণভাবে টানে আমাদের। নাগরিক জীবনের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় প্রকৃতির নির্মল পরশে। অনেকের কাছে এই তার আকর্ষণ, এই তার পরিচয়। অথচ আলোর নীচে অন্ধকারের মতো আরেকটি চিত্রও এখানে প্রকট, তা আমরা জানি ক’জন? শৈল্পিক সৌন্দর্যে আর প্রাণ মাতানো সৌরভে বিমোহিতজন কতটুকু খোঁজ রাখেন কত কান্না, রক্ত, আর্তনাদ আছে এর ভেতর?

বাসকী চৌহান, হবিগঞ্জের লস্করপুর চা বাগানের শ্রমিক। বয়স ৪২ কি ৪৩ বছর হবে। কখন, কীভাবে বাগানের কাজে যুক্ত হয়েছেন তা মনে নেই। তিন সন্তানের জননী বাসকী গত ৫/৬ মাস থেকে অসুস্থ, কী হয়েছে জানেন না। কিন্তু গোটা শরীর প্রায় পঁচে গেছে। শয্যাশায়ী অবস্থা। খাবার দিতে হয় তরল করে। ৮/১১ ফুটের ঝুপড়ি ঘরে স্বামী, সন্তান, হাঁস, মুরগি নিয়ে বেঁচে আছেন কোনো মতে। ৪/৫ বার চিকিৎসার জন্যে বাগানের ডিসপেনসারিতে গিয়েছেন, কম্পাউন্ডার সাহেব কয়েক দফায় হিসটাসিন, প্যারাসিটামল দিয়ে দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে আশ্বাস দিয়েছেন! আর বাগান কর্তৃপক্ষ, শ্রমিকের এ রকম দুঃসময়ে কি চুপ থাকতে পারেন, মহান তারা, তারাও দু’দফায় চিকিৎসার জন্যে ১৭’শ টাকা দিয়েছেন। কী চমকে উঠলেন? ওঠারই কথা। এমন শত সহস্র বাসকী’র জীবনের সব রং নিংড়ে নিয়েই তৈরি হয় পরম তৃপ্তির চা আর নান্দনিক সৌন্দর্যের চা বাগান।

বর্তমানে চা বাংলাদেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল, বিশ্বের ২৫টি দেশে বিশ্ববাজারের মোট ২ শতাংশ চা বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়। প্রায় ১২ লক্ষাধিক চা জনগোষ্ঠীর পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ শ্রমে সচল হয় দেশের অর্থনীতির চাকা। প্রতিদিন তিলে তিলে নিজেকে নিঃশেষ করে যে সম্পদের সৃষ্টি তা নিজেদের জীবনে কাজে না লাগলেও তাতে প্রতিদিন ফুলে ফেঁপে ওঠে মালিকের ধনভান্ডার। এরই নাম মালিকী ব্যবস্থা, পুঁজিবাদ। আজ যখন ১ কেজি মোটা চালের দাম ৬০ টাকা, পেঁয়াজ ৮০/১০০ টাকা তখন চা শ্রমিকের মজুরি মাত্র ৮৫ টাকা। বাংলাদেশের চা শ্রমিকদের নিয়ে আইএলও’র প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে ৫৫% চা শ্রমিকের মাসিক আয় ১৫০১ টাকা, ৩৩ শতাংশের ১৫০০ টাকা এবং মাত্র ২ শতাংশ চা শ্রমিকের মাসিক আয় ৩ হাজার টাকা। গত ১০ বছরে চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি বেড়েছে ৫৩ টাকা! সরকার প্রতিদিন উন্নয়নের গল্প শোনায়, সত্যি এ উন্নয়ন বটে! এই মজুরি দিয়ে শিক্ষা, চিকিৎসা তো দূরের কথা কোনো রকমে বেঁচে থাকাই দায়। যুগ যুগ থেকে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে চা শ্রমিকরা বসবাস করলেও ভূমির অধিকার তো অনেক দূরের কথা, একটি আলো বাতাসহীন ঝুপড়ি ঘরে কোনো রকমে বসবাস করে। দৈনিক খাবার তালিকায় প্রধানত পোড়া রুটি, চা পাতা ও আলু ভর্তা এবং নিজেদের তৈরি লাল চা। ফলে পুষ্টির ন্যূনতম চাহিদাও পূরণ হয় না আবার কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিসপত্র, বিশ্রাম এবং পানীয় জল ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের অভাবে চা শ্রমিকরা আছেন চূড়ান্ত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। ১৯৬৬ সালের ‘টি প্ল্যান্টেশন লেবার অর্ডিনেন্স’ ও ১৯৭৭ সালের ‘প্ল্যান্টেশন রুলস’ অনুযায়ী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বাগান কর্তৃপক্ষের। কিন্তু তা আছে কাগজে কলমে। সারা দেশের ১৬৪টি চা বাগানের মধ্যে ১ জন করে এমবিবিএস ডাক্তার আছেন মাত্র ৬টিতে। আইএলও বলছে ৬৩ শতাংশ শ্রমিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে। চা শ্রমিকদের মধ্যে ৭২ শতাংশ পেটের ব্যথা, ৮৪ শতাংশ মাথা ব্যথা এবং ৭৪ শতাংশ শ্রমিক মাংসপেশির ব্যথায় ভুগছেন। চা শ্রমিকদের আর একটি বড় সমস্যা রক্তশূন্যতা। আবার চা শ্রমিকদের মধ্যে ৬৪ শতাংশই নারী শ্রমিক, তাদের অবস্থা আরও করুণ। শ্রম আইনে মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস কার্যকর হলেও বাগানে কোনোরকমে ৪ মাস চলে। আর ৯১ ভাগ নারী শ্রমিকরা তাদের সর্দারদের দ্বারা নিগ্রহের শিকার হয়। আরও বহুদিক নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করে সরকার ও মালিকী ব্যবস্থার সত্যিকারের চিত্র উন্মোচন করা যাবে কিন্তু এই কি যথেষ্ট নয়?

এই তো এদেশের শ্রমিকদের জীবন। শ্রমিক শ্রেণির সকল সাধ, স্বপ্ন কেড়ে নিয়ে তৈরি হয় মালিকের মুনাফার সৌধ। আর একেই সরকার ঘোষণা দেয় উন্নয়ন বলে। এ উন্নয়ন কার? এ সরকার, রাষ্ট্র কার?

সাম্যবাদ ডিসেম্বর ২০১৭

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments