‘রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল’ — একটি বহুল ব্যবহৃত প্রবাদ বাক্য। প্রবাদ বাক্যটি প্রচলিত আছে নির্মম দায়িত্বহীনতার প্রকাশ হিসেবে। নিরো ছিলেন জুলিও-ক্লডিয়ান রাজতন্ত্রের সর্বশেষ রোমান সম্রাট। আর যে অগ্নিকান্ডের কথা বলা হয় তা ঘটেছিল ৬৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এটি ছিল রোমের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অগ্নিকান্ড। কথিত আছে, নিরো চেয়েছিলেন এমন ঘটনা। আগুনে সব পুড়ে যাবার পর সেখানে তিনি একটি স্বর্ণগৃহ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার (পিইসি) আলোচনায় রোমের ঘটনা ‘ধান ভানতে শিবের গীত’র মতো শোনালেও নিরোর মতো এমন চরিত্র আমাদের দেশে বিরল নয়। জনগণের ‘ত্রাহি মধূসুদন’ অবস্থা হলেও শাসকের চাওয়াটাই এখানে শেষ কথা। কেননা শাসকদের কিছু উদ্দেশ্য বা এজেন্ডা থাকে, যা সে বাস্তবায়ন করে বাহ্বা পেতে চায়। তা করতে গিয়ে জনগণের কী হবে, তাতে তাদের থোড়াই কেয়ার।
এই নিয়ম সবক্ষেত্রে অনুসৃত হয়। যেমন ঘটেছে পিইসি পরীক্ষা চালিয়ে যাবার ঘটনায়। এমন নয় যে, এই পরীক্ষা বন্ধের দাবিতে কোনো প্রতিবাদ হয়নি। ২০০৯ সাল থেকে পিইসি পরীক্ষাটি চালু হবার পর থেকে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টসহ অভিভাবক-বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন নানা সময়ে প্রতিবাদ করে বলেছেন, এই পরীক্ষা শিশুর শৈশব ধ্বংস করছে, সৃজনশীলতাকে মেরে দিচ্ছে, মুখস্থ ও গাইড বই নির্ভর প্রজন্ম গড়ে উঠছে, অভিভাবকদের কাড়ি কাড়ি টাকা চলে যাচ্ছে, প্রশ্নফাঁস হচ্ছে, স্কুলগুলো একেকটা কোচিং সেন্টারে পরিণত হচ্ছে ইত্যাদি। কিন্তু কে শোনে কার কথা? সরকারের মুখে এক রা — ‘পরীক্ষা চালুর কারণে শিশুদের পরীক্ষাভীতি কাটছে, ঝরে পড়ার হার কমছে, সব শিশু একটি সার্টিফিকেট পাচ্ছে, পাশের হার বাড়ছে ইত্যাদি। সুতরাং এই পরীক্ষা বন্ধ করা যাবে না।’ সরকার আর জনগণের চাওয়া সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। কোনো উপায় না পেয়ে অভিভাবকদের একটি অংশ যখন পরীক্ষা বন্ধে হাইকোর্টে রিট করেছে, তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী একটু যেন ধমকের স্বরেই বলেছেন ‘পিইসি-জেএসসি পরীক্ষার মতো খুচরা বিষয় নিয়ে আদালতের সময় কাটানো কেন?’ যে ঘটনায় শিশুদের ভবিষ্যৎ সংকটাপন্ন, জনগণের জীবন ওষ্ঠাগত, প্রধানমন্ত্রীর কাছে সেটা ‘খুচরো বিষয়’!
অথচ এই পরীক্ষা চালু হবার পর থেকে শিশুরা কী ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে! পত্রিকায় এসেছে একজন অভিভাবকের কাতরোক্তি — ‘পিইসি শিশুদের উপর মারাত্মক মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার। ১২-১৪ টা বই আর এত পড়াশুনা, এটা অমানবিক। স্কুলের চাপ, কোচিংয়ের চাপ, তারপর আবার প্রাইভেট। সবমিলিয়ে এগুলো শিশুদের উপর চূড়ান্ত নির্যাতনের শামিল। সরকার এ পরীক্ষা চালু করার ফলে স্কুলগুলো হয়ে গেছে সব ব্যবসাখানা। আজ এই মডেল টেস্ট, কালকে এই টিউটোরিয়াল, পরশু আরেক পরীক্ষা। বাচ্চাদের পড়ার সুযোগ না দিয়ে কেবল পরীক্ষা।’ সরকার যাকে বলছে ‘পরীক্ষা উৎসব’ — এই হলো তার অবস্থা।
পরীক্ষা মানে যদি মূল্যায়ন হয়, তবে তাকে এমন জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে যাবার উদ্দেশ্য কী? মূল্যায়ন তো শ্রেণি কক্ষেও হতে পারে। সরকার কথায় কথায় যে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দেয় সেখানেও শিশু বয়সে এই ধরনের পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। মাধ্যমিক স্তরে ওঠার আগ পর্যন্ত শিশুদের পড়াশুনা, খেলাধুলা সবকিছু স্কুলেই। ‘হোমওয়ার্ক’ বলতে সামান্য কিছু বাড়িতে করতে হয়। শিশুরা খেলতে খেলতে, একসাথে থাকার মাধ্যমে, পরিবেশের মধ্যে অনেক কিছু শেখে। জাতীয় পর্যায়ের একটি পরীক্ষা যদি তাকে দিতেই হয় তবে সেটা তো একটা পরিপক্বতা আসলেই কেবল নেয়া প্রয়োজন।
তবুও কেন এই পরীক্ষা চালু রাখা হয়েছে? এখানে সরকারের কিছু উদ্দেশ্য আছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) এবং ‘সবার জন্য শিক্ষা’র লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে দেশের সকল নাগরিকের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার ঘোষণা ছিল। কিন্তু সরকার আজও ‘সবার জন্য শিক্ষা’ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। অব্যাহত প্রশ্নফাঁস, উত্তর বলে দেয়া, মূল্যায়নে কারচুপি করেও সকল শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করানো যায়নি। একইভাবে অর্থনৈতিক নানা বৈষম্যের কারণেও প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শিশুদের ঝরে পড়া ঠেকানো যাচ্ছে না। পঞ্চম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উঠতে উঠতে প্রায় এক তৃতীয়াংশ শিশু ঝরে যায়। এই ঝরে যাওয়া শিশুদের ধরে রাখার ক্ষমতা সরকারের নেই। সেটা করতে হলে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিলোপ ঘটাতে হবে। তা না করে ঝরে যাওয়া শিশুদের রক্ষা করা যাবে না, এমডিজিও অর্জিত হবে না। এমডিজি অর্জিত না হলে মধ্যম আয়ের তকমা বা আরও কিছু তথাকথিত গৌরবের পালক যুক্ত হবে না। তাই সরকারের প্রয়োজন হলো পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পিইসি বহাল রেখে লোক দেখানো সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা।
এখানে অর্থনৈতিক স্বার্থটিও গুরুত্বপূর্ণ। সরকার ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে নিজের উদ্যোগে স্কুল নির্মাণ করেনি। কেবল আগের প্রতিষ্ঠিত কিছু স্কুল জাতীয়করণ করেছে। এর বাইরে লক্ষ লক্ষ শিশুর পড়ার জন্য তৈরি হয়েছে বেসরকারি স্কুল-কিন্ডারগার্টেন-ক্যাডেট ইত্যাদি। যত বেশি স্কুল তত বেশি বাণিজ্য; যত বেশি কাঠামোগত পরিবর্তন; তত বেশি বাণিজ্য। শুধু তাই নয়, পিইসি-জেএসসি পরীক্ষা চালু হবার মাধ্যমে গাইড বই ও কোচিং ব্যবসা এখন রমরমা। যদি প্রায় ৩০ লক্ষ শিশু প্রাথমিক স্তরে পরীক্ষা দেয়, এদের অধিকাংশই যদি একাধিক গাইড বই কেনে, গড়ে যদি ১টা গাইডও সবাই কেনে, তার দাম যদি হয় গড়ে ৫০০ টাকা, তবে এখান থেকে ব্যবসা হয় প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা। আবার প্রতিটি শিশু কোচিং করতে বাধ্য হয়েছে। মাসে ৫০০ টাকা করে হলেও ১০ মাসে প্রতিটি শিক্ষার্থী ৫০০০ টাকা খরচ করেছে। তাহলে কোচিং খাতে বাণিজ্য হয়েছে প্রায় ১৭৫০ কোটি টাকা। হিসাবটি হয়তো পুঙ্খানুপুঙ্খ নয়, তবুও বোঝা যায় শুধু প্রাথমিক শিক্ষাতেই কীভাবে কোটি কোটি টাকার শিক্ষা ব্যবসা চলছে। জিপিএ-৫ পাবার মোহ শিক্ষাব্যবসাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। যেভাবেই হোক জিপিএ-৫ পেলেই যেন জীবন বর্তে যাবে — এই সবার মনোবাসনা। শাসকরাও বোঝাতে চায়, শিক্ষা মানে ডিগ্রি বা পরীক্ষার ফল। কিন্তু শিক্ষা মানে ডিগ্রি নয়, শিক্ষা জ্ঞানচর্চার ভিত্তি তৈরি করে, জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে চিন্তা, মনন ও মানসে উন্নত জীবন গঠনে সহায়তা করে। অনুশীলন করে জ্ঞান অর্জন করতে হয়। ডিগ্রি অর্জন হলো এই জ্ঞানার্জনের বিভিন্ন ধাপে পৌঁছানোর স্বীকৃতি। কিন্তু আজ জ্ঞানশূন্য ডিগ্রি অর্জনই হয়ে যাচ্ছে মূল উদ্দেশ্য। সে কারণে উচ্চডিগ্রিধারী অশিক্ষিত মানুষে দেশ ভরে যাচ্ছে, নীতি-নৈতিকতার ক্ষেত্রে শিক্ষিত মানুষরাই করছে চরম লঙ্ঘন। ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো পরীক্ষা। পরীক্ষা মানে একটি সার্টিফিকেট, যেটাকে কখনো একজন অভিভাবকও মনে করে তার শিশুর অর্জন। কিন্তু এসব করে আমরা তাদের শিক্ষিত মানুষ তৈরি করছি না, তৈরি করছি পরীক্ষার্থী। এর কি দীর্ঘমেয়াদী কোনো ফলাফল নেই?
এভাবে রিলে রেসের ঘোড়া হয়ে ছুটতে ছুটতে কী পরিণতি হচ্ছে আমাদের? এমন ধারাবাহিক নিরবচ্ছিন্ন চাপের কারণে শিশুর নিজের এবং তার অভিভাবকের সাথে চিত্তের সম্পর্কই স্থাপিত হয় না। মন মরে যায়, শিশুর প্রবণতা কীসে তা অভিভাবকও বোঝেন না। একজন পরীক্ষার্থীও এভাবে পরীক্ষার চাপে পড়ে পড়ে হাপিয়ে ওঠে। পড়াশুনা হয়ে ওঠে বোঝা, ছাত্রত্ব পরিণত হয় দাসত্বে। কত দ্রুত পড়াশুনা শেষ করা যায়, এ থাকে লক্ষ্য। এক ক্লাসের পড়াশুনা আরেক ক্লাসে মনে রাখার প্রয়োজন হয় না। কেননা পড়াশুনা তো আনন্দের খোরাক নয়, কেবল মুখস্থের বোঝা। কবিতা যখন কেবল মুখস্থ করে পরীক্ষায় উগড়ে দেবার বিষয় হয়, তখন তা আবেগ সৃষ্টি করতে পারে না। উদ্ভিদবিজ্ঞান যখন কেবল গাছের নাম, বিজ্ঞানবিষয়ক কিছু তথ্য মনে রাখার বিষয়, তখন সেই জ্ঞান গাছ-পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করে না। বিজ্ঞানের পড়া যখন পরীক্ষায় লেখার বাইরেও নিজে কিছু আবিষ্কারের মন তৈরি করে না, তখন তা অর্থহীন কিছু সূত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। মাটি, গাছ. ফুল, ফল, জলবায়ু, পরিবেশ, সমাজ সবকিছু বোঝার মধ্যেই থাকে মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার শর্ত। এসবের সাথে যদি জীবনের যোগ না ঘটে তবে শিক্ষিত মানুষ হওয়া বলে না।
শাসকদের একটা লক্ষ্য থাকে। সেই লক্ষে-উদ্দেশ্যে তারা দেশ পরিচালনা করে, দেশের মানুষের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। এ লক্ষ্যেই পিইসি পরীক্ষা চালু করা হয়েছে। সরকার তার স্বার্থে যা চাইছে তা এদেশের জনগণের স্বার্থের বিপরীত। সেক্ষেত্রে জনগণের কী করা উচিত? যে পরীক্ষা স্পষ্টভাবেই এদেশের ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে নামা ছাড়া আর কি কোনো গত্যন্তর আছে?
তথ্যসূত্র :
১. যে কারণে পিইসি বাতিল করা যাচ্ছে না – রাখাল রাহা
২. হা শিক্ষা, হা পরীক্ষা – আবুল মোমেন