মানুষের মধ্যে খুব প্রচলিত একটি কথা হলো- আন্দোলন করে কিছু হবে না, সরকার যা চায় তাই হয়। গায়ের জোরে যা ইচ্ছা তাই করবে। তাতে মানুষ বাঁচুক আর মরুক। এমনি ফ্যাসিবাদী নিপীড়ন চলছে দেশব্যাপী। সে সময় মানুষের মনে আশা জাগানিয়া হয়ে এসেছে চট্টগ্রামের হোল্ডিং ট্যাক্সবিরোধী আন্দোলন। সংগঠকদের একনিষ্ঠতা, কষ্টসহিষ্ণুতা, সাহসী ভূমিকা, হাজারো মানুষের সম্পৃক্ততা ছিনিয়ে এনেছে বিজয়।
গত বছরের আগ পর্যন্ত, চট্টগ্রাম শহরে বাড়ির আয়তনের ভিত্তিতে হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্য করা হতো। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অধীনে এই কর ধার্য হতো। ২০১৬ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন আয়তনের পরিবর্তে ঘর ভাড়ার ভিত্তিতে ১৭% হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ করেছে। যা পূর্বের তুলনায় ১৫/২০ গুণ হারে বেড়েছে। যা ভাড়াটিয়া, বাড়ির মালিক সবার উপর এক বিশাল বোঝা। নগরীতে হোল্ডিং রয়েছে ১ লক্ষ ৮৫ হাজার ২৪৮টি। যা থেকে বিগত বছরে আয় করা হয়েছে ১০৩ কোটি ৪৪ লক্ষ ১৮ হাজার ৫৩৭ টাকা। এই আইন কার্যকারি করে সিটি কর্পোরেশন আয় করতে চায় ৮৫১ কোটি ৩০ লক্ষ ৬৪ হাজার ৫৫৯ টাকা। চাটগাঁবাসীর দাবি তাদের আয়ের উপর সরকার ট্যাক্স ধার্য করছে, তাহলে আবার বাড়ির আয়ের উপর কেন এই গলাকাটা ট্যাক্স আরোপ? এর চাপ পড়বে ভাড়াটিয়াদের উপর।
চট্টগ্রামকে ২য় রাজধানী বলা হলেও চট্টগ্রামবাসী পায় না কোনো নাগরিক সুবিধা, বরং দিন দিন বাড়ছে জনদুর্ভোগ। জলাবদ্ধতা, যানজট, অপরিকল্পিত ফ্লাইওভার, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট রেখে বাড়াতে চাইছে হোল্ডিং ট্যাক্স। আগ্রাবাদ, হালিশহর, বাকলিয়াসহ অধিকাংশ অঞ্চল জোয়ারের পানিতে ডুবে থাকে। সেই অঞ্চলে গৃহকর মওকুফ করার কথা উল্টো বাড়িয়ে দিচ্ছে! ৬০ লক্ষ চট্টগ্রামবাসীর এই সংকট মুহুর্তে একদল মানুষ এগিয়ে আসে, এই অন্যায়-অন্যায্য-অযৌক্তিক হোল্ডিং ট্যাক্স বাতিলের দাবিতে। গঠিত হয় ‘করদাতা সুরক্ষা পরিষদ’।গত বছর নভেম্বর মাস থেকে টানা ১২ মাস ধারাবাহিকভাবে এই কমিটি আন্দোলন পরিচালনা করে।
কদমতলীর অধিবাসী নুরুল আফসারের নেতৃত্বে ‘চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ’র নামে শুরু হয় এই আন্দোলন। শুরুতে মানব বন্ধন, মিছিল, প্রেস কনফারেন্স, সমাবেশ করা হয়। প্রথমদিকে জনগণ বুঝতে না পারলেও যখন বাড়ির অ্যাসেসমেন্ট শুরু হয়, তখন তাদের ক্ষোভ দানা বেধে উঠে। আস্তে আস্তে শুরু হয় ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বৈঠক, স্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচী, সমাবেশ ও মিছিল। একই দিনে বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরদের স্মারকলিপি পেশ। অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ¦, ভয়, হতাশা নিয়েও আসতে থাকে জনগণ। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা। গঠিত হয় ওয়ার্ডভিত্তিক জনগণের সম্মিলিত জোট।
অন্যদিকে এই গলাকাটা হোল্ডিং ট্যাক্স আরোপের হোতা মেয়র আ জ ম নাসির করদাতা সুরক্ষা পরিষদের সাথে মতবিনিময় করার নামে বাস্তবে ভয় ভীতি দেখায় যেন আন্দোলনের পথ থেকে সরে যায়। আপিলের ব্যবস্থা করে ৭০/৮০ ভাগ কর ছাড় দেয়া শুরু হয়। যেন জনগণ আন্দোলনে না যায়। পত্রিকায় এসেছে অ্যাসেসমেন্ট এর নাম করে প্রায় কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য হয়েছে। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারী নেতৃবৃন্দকে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা করার হুমকি দেন মেয়র! কিন্তু নেতৃবৃন্দ অবিচল থাকেন তাদের আন্দোলনের পথে। ১৯৮৬ সালে স্বৈরাচারী এরশাদের তৈরি করা গৃহকরের এই আইন বাতিলের দাবিতে জোয়ার ওঠে চট্টগ্রামে।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হলো গণ মানুষের গান, প্রতিটি সমাবেশ শেষে পরিবেশন হতো সেই গান। আন্দোলন যখন আরো তুঙ্গে উঠল তখন সুরক্ষা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর আমীর উদ্দীনকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর রুমে ঢুকে সরকারি সংগঠন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অস্ত্র ধরে হুশিয়ারি দিয়ে যায়। এর ফল হলো উল্টো। চট্টগ্রামবাসীর ক্ষোভ বিস্ফোরিত হলো । শুরু হলো আরও প্রতিবাদ, মিছিল।
৪ ডিসেম্বর নগর ভবন ঘেরাওকে সামনে রেখে করদাতা সুরক্ষা পরিষদের নেতৃবৃন্দ ৪১টি ওয়ার্ডে অলিতে-গলিতে প্রচারণা চালায়। প্রতিদিন ট্রাকে করে ওয়ার্ড অভিযাত্রা, লিফলেট বিলি, মাইকিং, সমাবেশ করে। এই অভিযাত্রাকালে বিভিন্ন পয়েন্টে মেয়র সমর্থিত ছাত্রলীগের বাধার সম্মুখীন হতে হয়। সাধারণ জনগণকে যুক্ত করে যে আন্দোলন তাকে বাধা দেবে কে? সমস্ত ধরনের ভয়-ভীতি, বাধাকে উপেক্ষা করে আন্দোলন এগিয়ে যায়। সেই আন্দোলনের তহবিল বা ফান্ড তৈরি হয় জনগণের সহযোগিতায়।
আন্দোলনের এক পর্যায়ে নগর ভবন ঘেরাও-এর চারদিন আগে গণআন্দোলনের চাপে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে স্থগিত করে ভাড়ার ভিত্তিতে গৃহকর নির্ধারণ। পরবর্তীতে করদাতা সুরক্ষা পরিষদের পক্ষ থেকে বিজয় মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। অন্যায্য ট্যাক্স বাতিল হওয়ায় কয়েক হাজার মানুষের বিজয় সমাবেশ থেকে নেতৃবৃন্দ ঘোষণা করেন, এই আন্দোলন শেষ নয় বরং শুরু। আগামী দিনে যেকোনো নাগরিক অধিকার আদায়ের দাবি নিয়ে আরো বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলবে।’
এই আন্দোলনে নেতৃত্বকারী ভূমিকা রেখেছেন করদাতা সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি নুরুল আফসার, সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর আমীর উদ্দিন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক , সাবেক কাউন্সিলর ও বাসদ (মার্কসবাদী) নেত্রী জান্নাতুল ফেরদাউস পপি; করদাতার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান মারুফ রুমী, সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ারুল করিমসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।
আমরা দেখতে পেলাম চট্টগ্রামবাসীর উপর যে বিশাল করের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হলো, সে সময় বড় রাজনৈতিকদলগুলো যারা জনগণের কথা বলে মুখে ফেনা তোলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে, মুক্তিযুদ্ধের চ্যাম্পিয়ান বলে নিজেদের ঘোষণা করে তাদের নেতৃত্ব তখন জনগণের পক্ষে ছিল না। ছিল না প্রধান বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ। চট্টলাবাসী দেখলো অভিভাবক মেয়রের আসল রূপ! দেখেছে জনপ্রতিনিধি ওয়ার্ড কাউন্সিলররা অনেকে জনগণের পাশে নেই। তাই আবারো প্রমাণিত হলো জনজীবনের সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য জনগণের নিজস্ব শক্তিতে গণকমিটি করে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।