১২ জানুয়ারি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের মহানায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের ৮৮তম ফাঁসি দিবস। এ দিনটির সাথে জড়িয়ে আছে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আর এক মহান বিপ্লবীর জীবনসংগ্রামের অমরগাথা।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খলে পরাধীন ভারতবর্ষের এক কোণে বন্দর শহর চট্টগ্রাম। এর রাউজান থানার নোয়াপাড়া গ্রামে ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ সূর্য সেনের জন্ম। স্কুলে পড়ার সময়ই পরাধীনতার যন্ত্রণা, দেশবাসীর দুঃখ-কষ্ট সূর্য সেনের বুকে গভীর বেদনা জাগিয়েছিল। পিতৃতুল্য শিক্ষকের কাছে শুনেছেন এদেশের বড় মানুষদের গল্প। শিক্ষক পড়ে শুনিয়েছিলেন ‘দেশের কথা’ বইটি। কলেজে পড়ার সময়ই বিপ্লবী সংগ্রাম ও বিপ্লবীদের প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ তৈরি হয়। বিএ পাশ করে সূর্য সেন যোগ দেন উমাতারা উচ্চ বিদ্যালয়ে। ছাত্রদের পড়াশুনা করানোর পাশাপাশি তাদের নিয়ে গড়ে তোলেন ছাত্র সমিতি। ছাত্রদের মধ্যে যুক্তিবাদী মানসিকতা, দেশপ্রেম গড়ে তোলার জন্য বিতর্কসভা, সাহিত্যসভার আয়োজন করতেন। নিঃস্ব, অসহায়, গরীব মানুষের সেবা করার মধ্য দিয়ে মানুষের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করতে গড়ে তোলেন সেবা সমিতি। এভাবে শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় সূর্য সেন হয়ে উঠেন সবার প্রিয় ‘মাস্টারদা’।
এর মধ্যে ১৯১৯ সালে ঘটে গেল পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড। দেশের মানুষের উপর নৃশংস এ হত্যাকান্ড সূর্য সেনকে অস্থির করে তোলে। যন্ত্রণাদগ্ধ হৃদয়ে ভাবতে থাকেন — এ অত্যাচারেরর কি কোনো প্রতিকার নেই? পরাধীনতার গ্লানি কি ঘুচবে না? শপথ নেন, এমন সুদৃঢ় বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলতে হবে, যার আঘাতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিমূল কেঁপে উঠবে। সেসময় স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেসের মধ্যে দুটি ধারা ছিল। একটি গান্ধীর নেতৃত্বে আপোষমুখী অহিংসপন্থী ধারা, আরেকটি সুভাষ বসুর নেতৃত্বে আপোষহীন বিপ্লাত্মক ধারা, যারা বিশ্বাস করতেন আবেদন নিবেদন করে নয়, একমাত্র সশস্ত্র পথেই স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব। মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা সুভাষ বসুকে সমর্থন করেন। সূর্য সেন ও তাঁর অনুগামীরা পরিকল্পনা করলেন এক সংগঠিত, পরিকল্পিত সশস্ত্র অভ্যুত্থানের, যা দেশবাসীর মুক্তিসংগ্রাম বেগবান করতে প্রবলভাবে উদ্দীপ্ত করবে। এ পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রয়োজন ছিল বিস্তৃত বিপ্লবী সংগঠন, গণভিত্তি আর সশস্ত্রসংগ্রামের উপযোগী পরীক্ষিত নির্ভীক কর্মী।
সূর্য সেনের ছিল দুর্বল শরীর। কিন্তু তাঁর চোখে জ্বল জ্বল করা স্বাধীনতার স্বপ্ন, অল্প অল্প কথায় মর্মস্পর্শী আবেদন, সহজ সরল আন্তরিকতা, অনাড়ম্বর জীবন, গভীর দেশপ্রেম, দরদী মন ছাত্র-যুবকদের প্রবলভাবে আকর্ষণ করত। তিনি তাঁদের বলতেন, “জন্মেছি যখন মৃত্যু তো অনিবার্য। মরবই যখন তখন সার্থক মৃত্যুবরণই শ্রেয় নয় কি? কোটি কোটি মানুষের দাসত্ব শৃঙ্খল মোচনের পথে যে মৃত্যু আসবে, তাই আমরা বরণ করব।” গণভিত্তি তৈরির উপর মাস্টারদা জোর দিয়েছিলেন। এজন্য চট্টগ্রাম শহরসহ আশেপাশের অঞ্চলে নানা ধরনের সেবামূলক কাজ পরিচালনার জন্য কর্মীদের পাঠাতেন।
তখনকার দিনে বিপ্লবীরা অস্ত্র কেনার টাকা সংগ্রহ করত কখনও কখনও ডাকাতি করে, এটাকে বলা হতো স্বদেশি ডাকাতি। মাস্টারদা এ পথ বর্জন করলেন। বললেন, “যাঁরা স্বদেশি, যাঁরা দেশের জন্য প্রাণ দেবে, তাঁরা অন্যের বাড়িতে ডাকাতি করবে কেন? তাঁরা নিজের ঘর থেকে আনবে, সেটাই তো তাঁদের আত্মত্যাগ।” এ আহ্বান শুনে কর্মীরা ঘর থেকে অর্থ এনে দলের তহবিলে দিত। বীরেন নামে এক দরিদ্র ঘরের কর্মী তাঁর মায়ের একমাত্র অলংকার মাস্টারদা’র হাতে তুলে দিয়েছিল। মাস্টারদা তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে অন্যদের বলেছিলেন, ‘এটাই সবচেয়ে বড় দান!’
এভাবে প্রস্তুতির পর মাস্টারদার নেতৃত্বে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সংঘটিত হলো ঐতিহাসিক যুব বিদ্রোহ। বিপ্লবীরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করে। টেলিফোন-টেলিগ্রাফ অফিস দখল করে চট্টগ্রামের সাথে বাইরের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ব্রিটিশ বাহিনী যাতে শহরে ঢুকতে না পারে, তাই রেললাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। অতর্কিত আক্রমণে ব্রিটিশ বাহিনী পরাস্ত হয়। দামপাড়া পুলিশ লাইনে সমবেত হয়ে ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র সভাপতি হিসেবে মাস্টারদা স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন। চট্টগ্রামবাসীর মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রচারপত্র বিলি করা হয়। পরাধীন ভারতের বুকে চট্টগ্রাম চারদিন স্বাধীন ছিল।
২২ এপ্রিল বিশাল ব্রিটিশ বাহিনী চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করে। জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেয়া বিপ্লবীদের সাথে শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। সেখানেও ইংরেজরা পরাস্ত হয়। এরপর ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৩৪ সাল, তারপর আরো দুই বছর চট্টগ্রাম শহরের দু’পাশে গ্রামাঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার মতো দুঃসাধ্য সাধন করেছিল সূর্য সেনের বিপ্লবী বাহিনী। আত্মগোপন অবস্থায় থেকে সূর্য সেন নানা দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেন। বিস্ময়ের ব্যাপার, চট্টগ্রাম শহরের কুড়ি কিলোমিটার এলাকার মধ্যে ব্রিটিশ মিলিটারি, পুলিশ, গোয়েন্দাদের নাকের ডগায় তিনটি বছর ধরে সূর্য সেন আত্মগোপন করে ছিলেন। তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। মিলিটারি ক্যাম্প বসিয়ে শহরের পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে তল্লাশি চালানো হয়েছিল। তারপরও মাস্টারদাকে ধরতে পারেনি ব্রিটিশ সরকার।
ব্রিটিশ শাসকরা প্রচার করতো সূর্য সেনরা ‘সন্ত্রাসী’, ’জনবিচ্ছিন্ন’। এসব প্রচারের প্রভাব পরবর্তীতেও অনেকের মধ্যে ছিল বা আজও আছে। অথচ সূর্য সেন সাধারণ মানুষের কত আপন ছিলেন। বোঝা যায় প্রচন্ড বিপদ মাথায় নিয়েও, গ্রামের সাধারণ গরীব মানুষ, মুসলিম ঘরের মায়েরা পর্যন্ত তাঁকে বুক আগলে রক্ষা করেছিল। দেখা যেত পুলিশ বাড়ি তল্লাশি করছে, আর বাড়ির ভেতরের ঘরে মহিলাদের মধ্যে সূর্য সেন বসে আছেন। মাছ যেমন জলে বাঁচে, তেমনি মাস্টারদা সাধারণ মানুষের আশ্রয়ে বেঁচে ছিলেন। এরকম গণভিত্তি সেসময় অন্যান্য বিপ্লবী সংগঠনের ছিল না।
মৌলবাদী দলগুলো উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচার করে, সূর্য সেন সাম্প্রদায়িক ছিলেন, মুসলিম বিরোধী ছিলেন। অথচ ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা। তাঁর দলে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য অবারিত দ্বার ছিল। গীতা হাতে, কালি প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে শপথ নেওয়া তাঁর দলে ছিল না। আত্মগোপনকালীন সময়ের বড় অংশ ছিলেন গরীব মুসলিম চাষীদের পরিবারে। মীর আহমেদ, আফসারউদ্দিন, আবদুস সাত্তার, কামালউদ্দিন আহমদ, সৈয়দুল হকের মতো মুসলিম তরুণদের মাস্টারদা বিপ্লবী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। আত্মগোপনকালে সূর্য সেন মীর আহমেদের ঘরে কিছুদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন। ঘরের মধ্যে একটা গর্তে মাস্টারদা থাকতেন, গর্তের উপর খাট বিছিয়ে আহমেদের মা শুয়ে থাকতেন। মাস্টারদা সাম্প্রদায়িক হলে, একটা রক্ষণশীল মুসলিম মায়ের ভালোবাসা কীভাবে অর্জন করলেন?
মাস্টারদার সংস্পর্শে প্রীতিলতা, কল্পনা দত্তের মতো সংগ্রামী নারী চরিত্র সৃষ্টি হয়েছিল। মাস্টারদা দেশবাসীর সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চেয়েছিলেন, শুধু পুরুষরা নয়, নারীরাও সশস্ত্র লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে পারে। প্রীতিলতা ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের সফল অভিযান শেষে আত্মাহুতি দেন। ১৯৩৩ সালের ১৬ জানুয়ারি ব্রিটিশ সৈন্যদের হাতে গ্রেপ্তার হলেন সূর্য সেন, তাও নেত্র সেনের বিশ্বাসঘাতকতায়। ব্রিটিশ সরকারের প্রহসনের বিচারে মাস্টারদা আর তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির রায় হলো।
ভাবতে অবাক লাগে, এ দেশে একসময় মাস্টারদা সূর্য সেনের মতো বড় চরিত্র জন্ম নিয়েছিল! আজ যখন সর্বাত্মক সংকটের ঘোর অন্ধকার দেশের আকাশে, দেশের রাজনীতি-সমাজনীতি-শিক্ষা-সংস্কৃতি-মূল্যবোধের অবক্ষয় চারিদিকে তখন মাস্টারদা’র সংগ্রামী স্মৃতি আজও অম্লান। আজ দেশের জনগণ পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-শাসন থেকে মুক্তি চায়। এই লড়াইয়ে মাস্টারদা সূর্য সেন বিরাট প্রেরণা। মাস্টারদা সূর্য সেন — লাল সালাম!
(লেখাটি ভারতের এসইউসিআই(সি)’র সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মাস্টারদা সূর্য সেন’ পুস্তিকা অবলম্বনে রচিত।)