Saturday, November 23, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - জানুয়ারি ২০১৮যে হাত সভ্যতা বাঁধাই করে

যে হাত সভ্যতা বাঁধাই করে

1514979005571-516951827 copy

পুরান ঢাকার কাগজীটোলা, শ্যামবাজার কিংবা ফরাসগঞ্জের রাস্তা। রাস্তার ধারের অধিকাংশ বাড়িই পুরনো। আর বেশিরভাগ বাড়ির নিচতলা জুড়ে চলে কর্মযজ্ঞ- বই বাঁধাইয়ের কাজ। জানুয়ারির বই উৎসব ফেব্রুয়ারিতে বই মেলা কিংবা সারা বছর ধরে ছাপা বিভিন্ন প্রকাশনীর বিভিন্ন প্রকারের বই বাঁধাইয়ের কাজ হয় পুরানো ঢাকার একটা বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে। আমরা সুন্দর বাঁধাই বই হাতে পাই, জানিনা বাঁধল কে? জানিনা তার জীবনের বাঁধুনিটাই বা কেমন।

পুরনো বাড়ী। আলো-বাতাসহীন বদ্ধ ঘর। তার স্যাঁতসেতে মেঝেতে বিভিন্ন বয়সের লোক পুস্তক বাঁধাইয়ের কাজ করছে। এরা পুস্তক বাঁধাই শ্রমিক নামে পরিচিত। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিদ্যুতের আলোতে চলে বই বাঁধাইয়ের কাজ। পাঠ্যবই থেকে শুরু করে কবিতা-গল্প-উপন্যাস কিংবা ধর্মগ্রন্থ — সবই বাঁধেন তারা। শিশু থেকে শুরু করে পঞ্চাশোর্ধ বয়সের মানুষরাও এ পেশায় জড়িত। এদের কাজের ধরনও আলাদা। কেউ ছাপানো বড় কাগজ ভাঁজ করেন, কেউবা ভাঁজ করা কাগজ সাজিয়ে রাখেন। কেউ সুঁইয়ে সুতা লাগিয়ে ফর্মাগুলো ধারাবাহিকভাবে সাজিয়ে দেন, যাতে ফর্মার কোনো ওলট-পালট না হয়। এইভাবে মলাট লাগানো, তারপর মেশিনে বইয়ের তিনধার কেটে ফিনিশিং দেওয়া ও প্যাকেজিং করার পর সেই বই আমরা বাজারে পাই। পাঠকের বইটি পড়ার সময় যাতে বিষয়ের ধারাবাহিকতার কোনো ব্যাঘাত না ঘটে সে জন্য শ্রমিকদের খুবই সতর্ক থাকতে হয় পুরো সময়টাতে। ছাপাখানা থেকে নিয়ে আসার পর শুরু করে বই বাঁধাই করা পর্যন্ত রাখতে হয় অখ- মনোযোগ।

পুস্তক বাঁধাইয়ের কাজে শ্রমিকরা আসে মূলত টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর, সিরাজগঞ্জের চৌহালী ও মানিকগঞ্জের দৌলতপুর অঞ্চল থেকে। অভাবের তাড়নায়, জীবন ধারণের তাগিদে তারা ঢাকায় আসে। শুরু করে বাঁধাইয়ের কাজ।

এদের কাজের বিভিন্ন ধরন আছে। কেউ করে রোজ অনুযায়ী আবার কেউ দিন চুক্তি হিসেবে। সকাল ৮ থেকে শুরু হয় কাজ। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ১ম রোজ এবং বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০ পর্যন্ত ২য় রোজ আর রাত ১০টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত হাফ রোজ। যদি একজন শ্রমিক সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করে তাহলে তার মোট আড়াই রোজ কাজ হয়। তবে বেশির ভাগ শ্রমিকরা ২ রোজ পর্যন্ত কাজ করতে বাধ্য হয়। দুই রোজ মানে সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা। এই বাজারে ২ রোজ কাজ করা ছাড়া সংসার চলে না। একজন দক্ষ মজুরের প্রতি রোজ মজুরি ১৭৫ টাকা। ২ রোজ অর্থাৎ ১২ ঘন্টা কাজ করলে প্রতিদিন সর্বসাকুল্যে ৩৫০ টাকা মজুরি পেতে পারে একজন শ্রমিক। এর মধ্যে সারাদিনের খাবার বাবদ তাকে খরচ করতে হয় একেবারে কম করে হলেও ১০০ টাকা। তাহলে সারা মাস কাজ করলে খাবার খরচ বাদ দিয়ে তার হাতে থাকে মাত্র ৬০০০-৬৫০০ টাকা। এই টাকা দিয়ে নিজের ওষুধপত্র ও হাত খরচ বাদ দিলে পরিবারের জন্য গ্রামে পাঠাতে পারে খুবই সামান্য টাকা। একজন দক্ষ শ্রমিকের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে অদক্ষ ও শিশু শ্রমিকদের কী অবস্থা তা অনুমান করা যায়। এই কারাখানাগুলোতে ১০/১২ বছরের শিশুরা খাবার ও মাসে ২০০০/৩০০০ টাকার বিনিময়ে দিন রাত কাজ করে, যে সময়ে তাদের স্কুলে যাওয়ার কথা! একমাত্র ঈদ উৎসব ছাড়া অন্য কোনো ছুটি তাদের নেই। সকল ধরনের উৎসব বোনাস থেকে তারা বঞ্চিত। উৎসবের সময় শুধুমাত্র মাসের মজুরি নিয়ে শুষ্ক মুখে শ্রমিকরা বাড়ি ফেরে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন কিংবা শুক্রবার Ñ তাদের কাজ কখনও বন্ধ হয় না।

বাঁধাই শ্রমিকরা কাজের জায়গাতেই খায়। কাজ শেষে জায়গা পরিষ্কার করে তারা লাইন দিয়ে ঘুমাতে যায়। কাজের মৌসুমে কারখানায় যখন প্রচুর কাগজ থাকে তখন তারা এর উপরেই ঘুমায়। আলো-বাতাসহীন অপরিষ্কার ঘর, স্যাঁতসেতে মেঝে আর কাগজের ধুলো-ময়লা — এর উপরই হাড়ভাঙা খাটুনির পর প্রায় নেতিয়ে পড়া শরীর নিয়ে শুয়ে পড়া।

অত্যাবশ্যকীয়ভাবে লেগে থাকে হাঁপানি, চর্মরোগসহ নানা ধরনের রোগের প্রকোপ। কেউ অসুস্থ হলে বিশ্রামের জন্য কোনো জায়গা নেই। অসুস্থ হয়ে বইয়ের বান্ডিলের উপর বিশ্রাম নিতে গেলেও মালিক বা ম্যানেজারের গালিগালাজ শুনতে হয়। কারখানায় বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই। লাইনের পানি পান করতে শ্রমিকরা বাধ্য। এই সেক্টরের শ্রমিকদের কাজের সময় দুর্ঘটনায় শারীরিক কোনো ক্ষতি বা মৃত্যু হলে মালিকপক্ষ রাষ্ট্র তার দায়-দায়িত্ব বহন করে না।

এইভাবে শ্রম দিতে দিতে তারা একসময় কাজ করার শক্তি হারায়। যখন আর কাজ করার সামর্থ্য থাকে না তখনি তাদের সময় হয় বাড়ি ফেরার। বাড়ি ফেরার সময় ভবিষ্যৎ জীবন নির্বাহের জন্য সরকারি-বেসরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো কোনো এককালীন টাকা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচিউটি বা শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের কোনো টাকা তাদের জোটে না। পরিশ্রম করার সামর্থ্যহীন দেহ নিয়ে তারা বাড়ি ফেরে। তখন নিঃস্ব অসহায় অবস্থায় শ্রমিকদের ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়।বই মানুষের জীবনকে আলোকিত করে। কিন্তু বইয়ের কারিগররা আলোর দেখা পায় না। আর দেখা পায় না আরেকটি বস্তুর, সেটা হল মানবতা — যা ওই বইয়ে লেখা থাকে।

সাম্যবাদ জানুয়ারি ২০১৮

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments