পিইসি- জেএসসি বাতিল কর – প্রশ্নপত্র ফাঁস, কোচিং ব্যবসা বন্ধ কর
‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর/ সবার আমি ছাত্র’ শৈশবে পাঠ করা কবিতা দিয়েছিল বৃহৎ জগতের হাতছানি । জ্ঞান তো এমনই এক বিষয় যার সীমা পরিসীমা নেই। সামাজিক সম্পদ হিসেবে এই জ্ঞান আমরা আহরণ করি শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। স্বাভাবিক নিয়মেই শিক্ষা আমাদের মধ্যে নবচেতনার উন্মেষ ঘটাবে, নব নব সৃজনে উদ্ভাবনে আরও পরিশীলিত করবে এটাই প্রত্যাশিত।কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা তা করছে কি? কিন্তু বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা আদৌ এই শিক্ষা পাচ্ছি কি? প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে একজন শিক্ষার্থীর অর্জন কী – প্রশ্নগুলো আজ প্রতিটি সচেতন মানুষকে ভাবাচ্ছে।
আজ প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি পেরোতেই একজন কোমলমতি শিক্ষার্থীকে বসতে হচ্ছে পিইসি পরীক্ষায়। এই পরীক্ষা তাকে দিচ্ছে একটি সার্টিফিকেট আর বিনিময়ে কেড়ে নিচ্ছে আনন্দময় শৈশব। বইয়ের বোঝা নিয়ে স্কুল, কোচিং-এ দৌড়াদৌড়ি করতে করতে সকাল গড়িয়ে বিকেল বা রাত হয়ে যায়। বন্ধুদের সাথে গল্প করার সময় পর্যন্ত নেই খেলাধুলা আরও দুরস্ত ব্যাপার। ফলে সামাজিকভাবে বেড়ে ওঠার পথ বন্ধ হয়ে গিয়ে শিশুরা হয়ে পড়ছে উদ্যমহীন, ভারাক্রান্ত যন্ত্রবৎ মানুষ। পিতা-মাতারাও যেন সন্তানদের তৈরি করছেন পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ফলাফল প্রাপ্তির জন্যই। ‘অমুক এ প্লাস পেলে তুমি কেন পাবে না?’ পিতা-মাতার প্রত্যাশার চাপ শিশুমনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পাশের সহপাঠীটিএখন আর বন্ধু নয়, প্রতিযোগী। তাকে পেছনে ফেলে সামনে এগুতে হবে। ফলে শিশু বেড়ে উঠছে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে।
এভাবে পিইসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি এই চারটি পাবলিক পরীক্ষার প্রভাব কী পড়ছে? প্রথমত. প্রতি বছর পিইসি পরীক্ষার্থী ধরে নিই ৩০ লক্ষ। এদের অধিকাংশ যদি গড়ে যদি ২ টা গাইডও সবাই কেনে, এর দাম যদি হয় গড়ে ৫০০ টাকা, তবে এখান থেকে ব্যবসা হয় গড়ে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। আবার প্রতিটি শিশু স্কুলে কোচিং করতে বাধ্য হয়েছে। মাসে ৫০০ টাকা করে হলেও কোচিং খাতে বাণিজ্য হয়েছে প্রায় ১৮০০ কোটি টাকা। আজ এত এত পাবলিক পরীক্ষা আর সৃজনশীল পদ্ধতির উদ্ভাবনে একজন ছাত্র প্রত্যেকটি বিষয় কোচিং করে। একাধিক গাইড বই অনুসরণ করে। যে শিক্ষকরা পড়াচ্ছেন তাদের বড় অংশই এই পদ্ধতির ব্যাপারে অভিজ্ঞ নন। ফলে তারাও গাইড বইয়ের উপর নির্ভর করেই শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন। এহেন পরিস্থিতিতে শিক্ষার মান না বাড়লেও বাড়ছে শিক্ষাবাণিজ্য। ফলস্বরুপ অভিভাবকরা আজ হিমশিম খাচ্ছেন সন্তানদের পড়াশুনার খরচ যোগাতে।
আবার গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো একের পর এক পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হচ্ছে। পরিস্থিতি এতটাই সঙ্গিন যে আজ প্রথম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হচ্ছে। নীতি-নৈতিকতাকে ধসিয়ে দিয়ে ছাত্রদের বানানো হচ্ছে ক্রিমিনাল। প্রশ্নফাঁসের বিরুদ্ধে সমাজে তীব্র আলোড়ন সত্ত্বেও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা নির্বিকারভাবে এর পক্ষে সাফাই গাইছেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও সরকার ক্রমাগত তার দায়িত্ব অস্বীকার করে বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণের পথ অবারিত করছে। ইউজিসি’র কৌশলপত্রের বাস্তবায়ন চলছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে বরাদ্দ দিন দিন কমছে, বাড়ছে শিক্ষাব্যয়। নিত্যনতুন বাণিজ্যিক কোর্স খোলা হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা তেমন না বাড়লেও, বাণিজ্যের ধারায় গড়ে উঠছে একের পর এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সমস্যা কার্যকরভাবে সমাধানের উদ্যোগ না নিয়ে টোট্কা চিকিৎসা পদ্ধতির নানা রকম প্রয়োগে শিক্ষার্থীদের জীবন আজ বিপর্যস্ত।
প্রশ্ন জাগে, কোন সমাজে আমরা বসবাস করছি? গত ৪৬ বছর জনস্বার্থবিরোধী শাসকরা দেশ পরিচালনা করছে। বর্তমান সময়ে ফ্যাসিবাদী দু:শাসন জনজীবনে চেপে বসে আছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি, দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে জনজীবন জেবরার । মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই, গুম-খুনসহ নানা ঘটনায় জনজীবন নিরাপত্তাহীন। শিক্ষা,স্বাস্থ্যসহ সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত এমন এক সমাজে আমরা বসবাস করছি যেখানে অন্যায়ের কোনো প্রতিকার নেই। ফলে জনস্বার্থবিরোধী মুনাফাকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থায় শিক্ষাও একটা পণ্য। নিজেদের ক্ষমতা নিশ্চিত রাখাই যখন শেষ কথা তখন সরকার শিক্ষাকে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিচ্ছে মুনাফার জন্য। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ১৯৮৪ সালের ২১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠাকালে সর্বজনীন ,বিজ্ঞানভিত্তিক, সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক একইধারার শিক্ষানীতির দাবি তুলেছিলো। আমরা শিক্ষার সমস্ত স্তরে বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই আন্দোলন করে আসছি। দীর্ঘ ৩৪ বছরের পথচলায় ছাত্র সমাজের কাছে আমাদের আহ্বান -আসুন, শিক্ষার উপর সমস্ত আক্রমণের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলি। শিক্ষা-সংস্কৃতি-মনুষ্যত্ব রক্ষার সংগ্রাম বেগবান করি।