গত বছরের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের অতিদারিদ্র্য ও মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ র্যাপর্টিয়ার (Rapporteur) প্রফেসর ফিলিপ অ্যাস্টন একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১৫টি অঞ্চলে যেখানে দরিদ্র মানুষের বসবাস, সেগুলোতে ঘুরে ঘুরে তিনি প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিলেন। অ্যালাবামা, ক্যালিফোর্নিয়া, পূর্ব ভার্জিনিয়া, টেক্সাস, ওয়াশিংটন ডিসি, পোয়ের্ত রিকা- এসব জায়গায় ঘুরে যে বর্ণনা তিনি দিলেন তা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রধান সারির মিডিয়া প্রকাশ করেনি। ব্যাপারটি অস্বাভাবিক নয়। এর আগেও আমরা দেখেছি ইরাক-আফগানিস্তানে যুদ্ধ বাঁধানোর জন্য মিডিয়াকে দিয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়েছিল। মিডিয়া কার স্বার্থকে রক্ষা করে, তা তো বোঝাই যায়।
প্রফেসর ফিলিপ অ্যাস্টন, যিনি নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক, তাঁর বর্ণনায় আমরা বর্তমান আমেরিকার কিছু বাস্তবচিত্র দেখব। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে লিখছেন, ‘লস এঞ্জেলসে মাদকাসক্ত এমন অনেকের সাথে আমার দেখা হলো যারা কোনো রকমে বেঁচে আছে। সান ফ্রান্সিসকোতে দেখলাম একজন পুলিশ অফিসার গৃহহীন কিছু মানুষকে রাস্তা থেকে চলে যেতে বলছে। তারা যখন জিজ্ঞাসা করছে কোথায় যাবো, পুলিশ অফিসার তখন নিরুত্তর রইল। আমি দেখেছি বহু অঞ্চলের নালা-নর্দমা ময়লায় পরিপূর্ণ। এগুলো পরিষ্কার করার দায়িত্ব সরকারের থাকলেও তারা তা করছে না। আমি দেখেছি, বিভিন্ন অঞ্চলে গরীব মানুষরা তাদের সবগুলো দাঁত হারিয়েছে। কেননা সরকার তাদের ‘দাঁতের সুরক্ষায়’ কোনো চিকিৎসা সেবা দেয়নি। আমি পরিবারগুলোতে চিকিৎসা সেবার অপর্যাপ্ততা ও মাদকাসক্তির কারণে ক্রমবর্ধমান মৃত্যুহারের কথা শুনেছি। আমি দক্ষিণ পোয়ের্ত রিকায় এমন কিছু মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছি যারা পাহাড়ের কয়লাখনির কাছে সম্পূর্ণ অনিরাপদ অবস্থায় বসবাস করে। কয়লাখনি থেকে প্রবাহিত ছাই তাদের মারত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলেছে, বাড়ছে অসুস্থতা, বিকলাঙ্গতা এবং মৃত্যু।’
ফিলিপ অ্যাস্টনের এই বর্ণনা আমেরিকা সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। যে আমেরিকা গণতন্ত্রের বড়াই করে, উন্নত জীবনের স্বপ্ন ফেরি করে দুনিয়া ব্যাপী — তার এই অবস্থা? অ্যাস্টনের বক্তব্য এতটুকুতে শেষ হয়নি। তিনি বলছেন, ‘২০১৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুহার ছিল উন্নত দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধনী-গরীব বৈষম্যের হার অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে ‘জিকা’ রোগটি এখন বেশ প্রচলিত। ২০১৭ সালের একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে কৃমিজাতীয় রোগ গরীব মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। স্থূলতার সমস্যা অন্যান্য দেশের মধ্যে আমেরিকায় সর্বোচ্চ। পানি ও স্বাস্থ্যবিধিসম্মত ব্যবস্থায় আমেরিকা পৃথিবীর ৩৬ তম। কারারুদ্ধ মানুষের সংখ্যা আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি। প্রায় ১৯ মিলিয়ন মানুষ ভয়াবহ দারিদ্রসীমার মধ্যে বাস করছে। ইউনিসেফ’র মতে ১৫টি উচ্চ ধনী দেশের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিশু দারিদ্র্য সর্বোচ্চ। অ্যাকাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স বলছে আমেরিকার অর্ধেকেরও বেশি শিশু অপুষ্টির ঝুঁকিতে আছে। এককথায় গড় মৃত্যুহার, শিশু মৃত্যুহার, মাতৃমৃত্যুহার, স্থূলতার হার, পুষ্টিহীনতা, শিক্ষিত হবার হার, শিশু দারিদ্র্য, গৃহহীন মানুষের সংখ্যা, আয় বৈষম্য, আত্মহত্যার হার ইত্যাদি ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘মৌলিক অধিকার পরিমাপক’ এ যুক্তরাষ্ট্র অনেক পিছিয়ে।’
উপরোক্ত তথ্যগুলো আমেরিকার প্রধান সাড়ির মিডিয়াগুলো কেন প্রচার করেনি — তা খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে। তবে ভুল বোঝার কোনো অবকাশ নেই যে — আমেরিকায় কেবল দরিদ্র মানুষেরও বসবাস। সারা পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পদশালী দেশের তকমা এখনও আমেরিকার আছে। কিন্তু বুঝতে হবে এই তকমা সে কীভাবে পেল। পৃথিবীর প্রথম দশজন ধনকুবেরের মধ্যে তো অর্ধেকেরই বেশি আমেরিকান। পৃথিবীর ৫০ ভাগেরও বেশি সম্পদ মাত্র ৮ জন পুঁজিপতির হাতে — অক্সফাম কর্তৃক প্রকাশিত এ তথ্যের সেই ৮ জন পুঁজিপতির বেশিরভাগই আমেরিকান। কিন্তু আমেরিকার শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা কী?
প্রদীপের নীচে যেমন অন্ধকার থাকে তেমনি অবস্থা আমেরিকাতেও। সেখানে প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার অধিকার সংকুচিত হচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষের জীবন হয়ে উঠছে দুর্বিষহ। একটি ছোট উদাহরণ দেয়া যাক, আমেরিকায় শ্রমজীবী মানুষদের কোনো রকমে বেঁচে থাকার জন্য ‘ফুড স্ট্যাম্প’ দিয়ে খাবার সংগ্রহ করার সুযোগ আছে। শ্রমিকদের বেতন থেকে কেটে (৬ ডলার কাটা হয়) সরকার এ ব্যবস্থা করে। সামান্য এই অধিকারটুকুও সরকার এখন ছেঁটে ফেলতে চাইছে। বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই ব্যবস্থা তারা বাতিল করবে। এ প্রসঙ্গে প্রফেসর ফিলিপ অ্যাস্টন বিশ্বখ্যাত ওয়ালমার্ট কোম্পানির একজন শ্রমিকের সাথে কথা বলেছেন। তিনি জেনেছেন, ওই শ্রমিক যে বেতন পান তাতে কোনোভাবেই তার বেঁচে থাকা সম্ভব নয় যদি না ‘ফুড স্ট্যাম্প’র এই সুবিধা থাকে। শ্রমিকদের মধ্যে ন্যূনতম মজুরির দাবি বারবার উঠেছে কিন্তু সরকার কেনো কর্ণপাত করেনি।
এবারে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতার আসার আগে একটি শ্লোগান তুলেছিলেন, ‘Make America Great Again’ অর্থাৎ আমেরিকাকে আবারও সর্বশ্রেষ্ঠরূপে গড়ে তোল। ট্রাম্পের এ ঘোষণা আমেরিকার সমস্ত জনগণের উদ্দেশ্যে ছিল না, ছিল স্বল্প কিছু বড়লোকদের জন্য। এটা বোঝা যায় যখন ক্ষমতায় এসেই ট্রাম্প বড়লোকদের ট্যাক্স ছেঁটে ফেলে, অথচ জনগণের শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে বাজেট কমিয়ে দেয়। পৃথিবীব্যাপী অস্ত্রব্যবসা, পর্নোব্যবসা, সফটওয়ার বাণিজ্য করে আমেরিকান পুঁজিপতিরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করে। আমেরিকায় যে পরিমাণ সম্পদ আছে তার সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় এখন অস্ত্র কেনা-বেচা খাতে। এই অস্ত্র কেনা-বেচা করেই আমেরিকার অর্থনীতি টিকে আছে। পুঁজিপতিরা অস্ত্র উৎপাদন করে, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ বরাদ্দ করে এ অস্ত্র কেনা হয়। এই ব্যয় সম্মিলিতভাবে চীন, সৌদি আরব, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ভারত, ফ্রান্স এবং জাপানের মোট ব্যয়ের সমান।
অথচ একই সাথে আমেরিকার সরকার শ্রমিকের কোনো রকমে বেঁচে থাকার জন্য ‘ফুড স্ট্যাম্প’র অধিকার কেড়ে নেয়। এ সমস্যা আজ আমেরিকায় তীব্রভাবে দেখা দিয়েছে। কিন্তু সংকটের সূচনা আজকের নয়। একই রকম সিদ্ধান্ত ওবামা, তার আগে বুশ কিংবা কিনটন প্রত্যেকেই নিয়েছিল। ডেমোক্র্যাট কিংবা রিপাবলিক ক্ষমতায় যেই আসুক, দৃশ্যপটের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। পার্থক্য কেবল এতটুকুই— আজ কোনো কিছু দিয়েই তথাকথিত উন্নত আমেরিকার কদাকার ছবিটা আর আড়াল করা যাচ্ছে না। ধনী-গরীবের মধ্যে যে প্রবল বৈষম্য তা এখন সাদা চোখেই দৃশ্যমান হচ্ছে।
বহুদিন আগে সর্বহারার মহান নেতা কার্ল মার্কস শ্রমিকশ্রেণির লড়াইকে শাণিত করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন, ‘সর্বহারা শ্রেণির শৃঙ্খল ছাড়া হারানোর কিছু নেই।’ আজ আমেরিকার শ্রমজীবী-নিপীড়িত মানুষকেও এ সত্য উপলব্ধি করে এগিয়ে আসতে হবে। যে ‘গ্রেট আমেরিকান’র কথা শাসকরা বলে, যে আমেরিকার জীবনস্বপ্নের কথা বিশ্বব্যাপী প্রচার করা হয় — তা একটি মোহ মাত্র। এই শৃঙ্খল থেকে বেড়িয়ে এসে সংগঠিতভাবে পুঁজিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম জোরদার করতে হবে।
সূত্র: https://www.theguardian.com/society/2017/dec/15/america-extreme-poverty-un-special-rapporteur