পরীক্ষা কেমন হবে তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের এখন ততটা ভয় বা উৎকণ্ঠা কাজ করে না, যতটা করে পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র পাওয়া নিয়ে। শিক্ষাব্যবস্থায় এখন এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। দেশের কোমলমতি পরীক্ষার্থীদের এমনই হাল বানিয়ে ছেড়েছেন দেশের কর্তাব্যক্তিরা। প্রশ্নফাঁস এখন খুব সাধারণ ঘটনা। রীতিমত ঘোষণা দিয়ে প্রশ্নফাঁস করা হচ্ছে। এবারের এসএসসি পরীক্ষার প্রতিটি বিষয়ে এমনটি ঘটছে। পরীক্ষার সময় ফেসবুক বন্ধ করে দেয়া কিংবা হোতাদের ধরিয়ে দিতে পারলে ৫ লাখ টাকা জরিমানা দেবার ঘোষণা — এ সবই খুব হাস্যকর আর বালখিল্য ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ তাই দাবি তুলেছেন — বছরের শুরুতেই প্রশ্নপত্র দিয়ে দেয়া হোক! তাহলে কষ্ট করে বেশি পড়ার প্রয়োজন হবে না। সরকারের যেটা দেখানো প্রয়োজন- পাশের হার বৃদ্ধি কিংবা হাজার হাজার ‘এ প্লাস’ তা আরও সহজে করা সম্ভব হবে। এতদিন শিক্ষামন্ত্রী প্রশ্নফাঁসের সকল ঘটনাকে অস্বীকার করেছিলেন। এমনকি গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার হুমকিও দিয়েছিলেন। কিন্তু, এখন উনি চাইলেও আর তা বলতে পারছেন না। কেননা প্রশ্নফাঁস যে প্রতিনিয়ত হচ্ছে — তা এখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রটিও জানে। পত্রিকা, টেলিভিশনে তো প্রতিদিনই আসছে প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার রমরমা ব্যবসার খবর। ফেসবুকের কিছু পেজ এর মাধ্যমে প্রশ্নফাঁসের খবর এখন ছাত্র-অভিভাবকদের মুখে মুখে। সবাই জানে কেবল পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন অপরাধীদের খুঁজে পাচ্ছে না। দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী চাইলে কী পারে — তা সবাই জানে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল কিংবা কোনো ফায়দা আদায় করতে হলে আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারার ব্যবহার আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনৈক যুবক ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে অশালীন কিছু বলেছে বলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এতকিছু করা যায় কিন্তু জাতির মেরুদন্ডকে ভেঙে দিচ্ছে যে অপরাধ, শিক্ষাব্যবস্থার সমস্ত নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে যে ঘটনা, তার সাথে জড়িতদের ধরতে পারা যাচ্ছে না। এ কি কোনো বিশ্বাসযোগ্য কথা?
একটি দেশে যখন দিনের পর দিন অপরাধের বিচার হয় না, সমাজের বিভিন্ন স্তরের ক্ষমতাবান ব্যক্তিবর্গ যখন অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে তখন অপরাধেরও একটা সামাজিকীকরণ ঘটে। প্রশ্নফাঁসের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি তাই ঘটেছে। গত ৪ বছরেই ৬৫টি প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। একটিরও বিচার হয়নি। বিচার যখন হয় না তখন অভিভাবক-শিক্ষকরাও এখন থেকে যতটা সম্ভব সুবিধা নেবার চেষ্টা করে। রেজাল্টসর্বস্ব এই শিক্ষাব্যবস্থাও অভিভাবক-শিক্ষকদের ঠেলে দেয় প্রশ্নফাঁসের প্রলোভনে পা দিতে। এই অনিশ্চিত সমাজে ভবিষ্যত যখন কেবল ভালো রেজাল্ট আর ভালো উপার্জনের উপর নির্ভর করে, তখন অনৈতিকভাবেই পাশ করাটাও অনেকের কাছে জায়েজ হয়ে যায়। এতে করে কতিপয়ের ফলাফল ভালো হচ্ছে, কিন্তু যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হচ্ছে, সেটা অত্যন্ত অন্যায্য। এই প্রক্রিয়াতেই আজকের অবোধ-সরল শিশুটি আগামী দিনের ভয়ংকর ক্রিমিনাল হয়ে বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা নিয়ে বড় হচ্ছে। আজকে তাই শিক্ষক-অভিভাবকদেরও ভাবতে হবে প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে ভালো ফলাফল করা সন্তানটির কোন ভবিষ্যৎ আপনি ডেকে আনছেন?
আমরা জানি, ব্যবসা মানেই মুনাফা। শিক্ষা যখন মুনাফার হাতিয়ার হয়ে যায়, তখন শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষাব্যবস্থার সাথে জড়িত সকলের মধ্যেই নীতিহীন মুনাফার মনোবৃত্তি ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষাকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করার যে চক্রান্ত চলছে তা থামানো না গেলে বিচ্ছিন্নভাবে প্রশ্নফাঁস রোধ করা যাবে না। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি স্তরেই শিক্ষা যখন টাকার নিক্তিতে মাপতে হয় তখন সেখানে প্রশ্নপত্রও একটা কেনা-বেচার পণ্য। তাই অবিলম্বে সমাজের সকল বিবেকবান মানুষকে এই ভয়ংকর অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। প্রশ্নপত্র কিনে নিজের সন্তানকে কোনোদিনই প্রকৃত অর্থে উচ্চশিক্ষিত ও বিবেকবান মানুষ করতে পারবেন না — এ সত্যও আজ অনুধাবন করা প্রয়োজন। সময় থাকতে প্রশ্নফাঁসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামুন, নাহলে শিক্ষা-সংস্কৃতি-নৈতিকতাসহ সকল ক্ষেত্রে একটি ভঙ্গুর জাতি হওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ খোলা থাকবে না।