পাহাড়ের ঝরণা ধারা আজ অনেকটাই শুকিয়ে মৃতপ্রায়। একই অবস্থা পাহাড়ে বাস করা মানুষগুলোর। নিত্যদিনের জীবনে অপমান, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, আতঙ্ক আর মৃত্যুর হাতছানি। সংঘাত-খুনোখুনি যেন লেগেই আছে। জাতীয় এবং আঞ্চলিক রাজনীতির বলি হচ্ছে নিরাপরাধ সাধারণ মানুষ। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তি হয়েছিল। প্রত্যাশা ছিল সংঘাতের অবসান ঘটবে। কিন্তু দুই দশক অতিক্রান্ত হবার পর দেখা যাচ্ছে পার্বত্য অঞ্চল এখন আরও অশান্ত। বহুমাত্রিক সংঘাত জীবনের স্বস্তিটুকু কেড়ে নিয়েছে। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। গুম অপহরণ, ধর্ষণ, আগুনে পুড়িয়ে ভূমি উচ্ছেদ তো লেগেই আছে।
সম্প্রতি রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলায় একটি গ্রামে সেনা অভিযানে দুই মারমা বোনের উপর যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে। সেনাসদস্যরা এর সাথে জড়িত বলে অভিযোগ করা হলেও শুরু থেকে তা অস্বীকার করেছে কর্তৃপক্ষ। পার্বত্য অঞ্চলে প্রতিবাদ কর্মসূচিগুলোতে বাধা দেয়া হয়েছে। এক পর্যায়ে সেখানকার রানী ইয়ে ইয়েনের উপর বর্বরোচিত হামলা চালানো হয় এবং হাসপাতাল থেকে ধর্ষিতা দু বোনকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় রাতের আঁধারে। এর কিছুদিন আগে ইউপিডএফ নেতা মিঠুন চাকমা বাড়ির সামনে খুন হয়েছেন। নয়ন চাকমা, রমেল চাকমাসহ মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হয়েছে আরও অনেক নাম। কিন্তু আজও এর কোনোটির বিচার হয়নি। প্রকৃত অপরাধী ধরা না পড়লেও নিরীহ নিরাপরাধ ব্যক্তিদের হয়রানি হরহামেশা লেগে আছে।
এদেশের রাজনৈতিক নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো কখনোই পাহাড়ের মানুষের আশা-আকাড়ক্ষা পূরণ করতে পারেনি। বৃটিশ শাসন আমল থেকেই শাসকগোষ্ঠী পাহাড়ি জনগণের জন্য বৈষম্যমূলক নীতি-পদ্ধতি, নানা আইনি জটিলতা সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তান পর্ব থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ — কোথাও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। যে স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালি-পাহাড়ী সকল জনগোষ্ঠীর আত্মত্যাগ ছিল, ১৯৭২ সালের সংবিধানে তার স্বীকৃতি মেলেনি। বাংলাদেশের সকল নাগরিককে ‘বাঙালি’ পরিচয় দিয়ে বাস্তবে এদেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর কৃষ্টি, সংস্কৃতি, জীবনযাপন, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষার স্বাতন্ত্র্যকেই অস্বীকার করা হয়েছিল। সেদিন গণপরিষদে তার প্রতিবাদ করেছিলেন এম এন লারমা। কিন্তু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন সরকার তা মেনে নেয়নি। এরপর নিরাপত্তার নামে পাহাড়ে শত শত সেনা ক্যাম্প বসেছে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর বাঙালি অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে পাহাড়ি-বাঙালি দ্বন্দ্বের চিরস্থায়ী রূপ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে মোট ১৬ লাখ অধিবাসীর মধ্যে প্রায় ৮ লাখ বাঙালি।
এদেশে পাহাড়ি-বাঙালি মিলেমিশে বাসবাস করত। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগ্রামেও তারা একসাথে লড়াই করেছে। কিন্তু আজ শাসকগোষ্ঠীর নোংরা রাজনীতির চালে সেই সম্প্রীতি-সদ্ভাব বিনষ্ট। এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতি মুহূর্তের আশঙ্কা — কখন যেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। পরস্পর অবিশ্বাস-অনাস্থার পরিবেশ বিরাজ করছে। অলিখিত সেনা শাসন চলছে দীর্ঘদিন। অনেকগুলো আঞ্চলিক সংগঠন গড়ে উঠেছে। তাদের নিজেদের মধ্যকার কোন্দল, বিভিন্ন গ্রুপে গ্রুপে সংঘর্ষ লেগে আছে। এই আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর সাথে জাতীয় পর্যায়ের দল-সংগঠনের সম্পর্ক আছে। বুর্জোয়া শাসনব্যবস্থার নানা কূটচালে ভ্রাতৃঘাতি সংঘর্ষ এখানে নিত্যদিনের ব্যাপার। তাই ভাবার সময় এসেছে — ভাইয়ে-ভাইয়ে এমন বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হলো কেন? সমাধানও বা কোন পথে আসবে?
পার্বত্য অঞ্চলের সামাজিক জীবন ভীষণ বৈষম্যমূলক। কোনো সরকারই এ অঞ্চলের মানুষের ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ এবং উন্নত করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী (লুসাই, পাংখোয়া, খুমি, চাক) ইতোমধ্যে বিলুপ্তির পথে। এখানে পড়াশুনা-চিকিৎসাসহ জীবনযাপনের সুব্যবস্থা নেই। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও শিক্ষা-দীক্ষা-কর্মসংস্থান ইত্যাদিতে পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। আমরা জানি, একটা বৈষম্যমূলক সমাজে সংখ্যালঘু প্রান্তিক জনগোষ্ঠির মানুষ সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয়। তা-ই চলছে আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে।
পার্বত্য অঞ্চলে সামরিক বাহিনীর দৌরাত্ম্য, বাঙালি উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তির দাপট কিংবা ভাষা-সংস্কৃতির উপর আগ্রাসন আছে। এ কারণে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ, ভূমি উচ্ছেদ, নারী নিপীড়নসহ নানা ধরনের নির্যাতন, ভূমি অধিকার না পাওয়াসহ বিভিন্ন সংকট সৃষ্টি হয়েছে। পাহাড়ে এই সংকটগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। কিন্তু তবুও আমাদের অনুধাবন করা দরকার এ সমস্ত সংকটের উৎসমুখ কোথায়। আজ দেশজুড়ে যে পুঁজিবাদী শাসন ব্যবস্থা তা-ই পাহাড়ী-বাঙালিদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বদলে সংঘাত সৃষ্টি করেছে, সেনাবাহিনীর শাসন পাকাপোক্ত করেছে, জনজীবনের সকল অধিকার থেকে ওই অঞ্চলের মানুষকে বঞ্চিত করেছে। কিন্তু মূল কারণের দিকে যেন আমাদের দৃষ্টি না যায় — সেজন্য বারে বারে শাসকরা পাহাড়ী-বাঙালি, পাহাড়ী-পাহাড়ী, মুসলমান-বৌদ্ধ এরকম নানা ধরনের বিভাজনের চেষ্টা করেছে। এখনও এই অপতৎপরতা চলছে।
রাঙামাটিতে দুই বোনের ধর্ষণের যে ঘটনা ঘটলো তার বিরুদ্ধে যদি পাহাড়ি-বাঙালি একসাথে প্রতিবাদ না করা যায়, যদি শিক্ষা-স্বাস্থ্য-নিরাপত্তাসহ সকল গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি নিয়ে মিলিতভাবে সোচ্চার না হওয়া যায় — তবে পাহাড়ে বসবাস করা মানুষগুলোর চোখের জল শুকাতে আরো বহু যুগ অপেক্ষা করতে হবে।