[এ বছর সর্বহারা শ্রেণির মুক্তি সংগ্রামের পথপ্রদর্শক মহান কার্ল মার্কসের ২০০তম জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষে বছরব্যাপী মার্কসের জীবন সংগ্রাম ও তাঁর অবদান নিয়ে সাম্যবাদে ধারাবাহিক লেখা ছাপানোর অংশ হিসেবে এবারের সংখ্যায় পল লাফার্গের ভাষ্যে কার্ল মার্কসের জীবনযাপনের কিছু দিক তুলে ধরা হলো। ব্যক্তিজীবনে কার্ল মার্কস মানুষটি কেমন ছিলেন, কী তিনি ভালোবাসতেন, প্রতিদিনের জীবনযাপনে কীভাবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন — তা-ই অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেছেন লাফার্গ। স্থানের সীমাবদ্ধতার জন্য কিছুটা সংক্ষেপিত করে দুই পর্বে আমরা লেখাটি প্রকাশ করছি। পল লাফার্গ (১৮৪২-১৯১১) ছিলেন ফ্রান্সের এবং আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের প্রখ্যাত নেতা, ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, মার্কস ও এঙ্গেলসের বন্ধু ও প্রিয় শিষ্য এবং মার্কসের কন্যা লারা মার্কসের স্বামী। লেখাটি আমরা পেয়েছি এসইউসিআই (কমিউনিস্ট)র ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘সাম্যবাদী দৃষ্টিকোণ’র চতুর্থ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা (এপ্রিল ২০১৩) থেকে।]
মানুষ ছিলেন তিনি, দোষেগুণে যথার্থ মানুষ, অমন মানুষ আমি এ-জীবনে দেখব না কখনও।
[শেক্সপীয়র, ‘হ্যামলেট’, প্রথম অঙ্ক, দ্বিতীয় দৃশ্য]
আমার বয়স তখন ২৪ বছর। ওই প্রথম দর্শন আমার মনে সে সময়ে যে- রেখাপাত করেছিল যতদিন বাঁচব তা অক্ষুণ্ন থাকবে। মার্কসের শরীর তখন ভালো যাচ্ছিল না। ‘পুঁজি’ বইটির প্রথম খন্ডটি লিখছিলেন তিনি। খন্ডটি অবশ্য তার পরেও দুই বছর, অর্থাৎ ১৮৬৭-র, আগে প্রকাশিত হয়নি। আরদ্ধ কাজ শেষ করে যেতে পারবেন না ভেবে ভয় পাচ্ছিলেন তিনি, আর তাই অল্পবয়সী মানুষজন দেখা করতে এলে ভারি খুশি হতেন। উনি তখন প্রায়ই বলতেন, ‘আমার পরেও যাতে কমিউনিস্ট প্রচার চালানো সম্ভব হয় তার জন্যে লোকজনকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে আমায়’।
কার্ল মার্কস ছিলেন সেই ধরনের বিরল ব্যক্তিদের একজন যিনি একই সঙ্গে বিজ্ঞান ও জনজীবনের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে সমর্থ ছিলেন। এই দুটো দিক তাঁর মধ্যে এত ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল যে একমাত্র বিদ্বজ্জন ও সমাজতন্ত্রী যোদ্ধা-এই দুই চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য একই সঙ্গে হিসেবের মধ্যে ধরলে তবেই তাঁকে বোঝা সম্ভব।
মার্কসের মত ছিল এই যে, গবেষণার চূড়ান্ত ফলাফল কী হবে তার পরোয়া না রেখেই বিজ্ঞানের চর্চা চালিয়ে যাওয়া উচিত। তবে, তিনি এটাও মনে করতেন যে, সমাজজীবনে সক্রিয়ভাবে যোগদান না করা কিংবা রেশমের মধ্যে গুটিপোকার মতো নিজেকে পড়ার ঘরে ল্যাবরেটরিতে আবদ্ধ রাখা এবং সমকালীন জীবন, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা, বিজ্ঞানীর পক্ষে আত্ম-অবমাননা ছাড়া কিছু নয়। মার্কস বলতেন, ‘বিজ্ঞানচর্চাকে স্বার্থপর আনন্দ-উপভোগে পরিণত করা ঠিক নয়। বিজ্ঞানচর্চায় আত্মনিয়োগ করার মতো সৌভাগ্য অর্র্জন করেছে যারা, অর্জিত জ্ঞানকে মানুষের সেবায় তাদেরই সর্বপ্রথম কাজে লাগানো উচিত।’ তাঁর একটি প্রিয় কথাই ছিল ‘মানুষের জন্য কাজ কর’।
শ্রমিক শ্রেণির দুঃখকষ্টের জন্যে যদিও তাদের প্রতি মার্কসের সহমর্মিতা ছিল গভীর, তবু কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করেছিলেন তিনি ভাবাবেগ আপ্লুত হয়ে নয়, বরং ইতিহাস ও রাজনীতি-সংক্রান্ত অর্থশাস্ত্রের চর্চার ফলেই। তিনি বলতেন, পুঁজিবাদী স্বার্থের প্রভাব থেকে মুক্ত এবং শ্রেণিগত কুসংস্কারে অন্ধ নয় এমন যেকোনও পক্ষপাতশূন্য মনকে অবশ্যই এই এক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে।
সে যাই হোক, পূর্বনির্ধারিত কোনো মতামত পোষণ না করে মানবসমাজের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশের অনুধাবনে রত থাকার সময়ে কলম ধরার পিছনে মার্কসের অপর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না, কেবল তিনি চেয়েছিলেন গবেষণালব্ধ ফলাফলগুলি প্রচার করতে এবং যে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন তখনও পর্যন্ত কল্পস্বর্গ স্থাপনের স্বপ্নবাষ্পে আচ্ছন্ন ছিল, তাকে একটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি যুগিয়ে দেওয়ার দৃঢ়সংকল্পই ছিল তাঁর অবলম্বন। যে শ্রমিকশ্রেণির ঐতিহাসিক ব্রত হলো সমাজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নেতৃত্ব অর্জনের পরে পরেই কমিউনিজমের প্রতিষ্ঠা, একমাত্র সেই শ্রেণির বিজয়কে অগ্রসর করে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই সেই মতামত প্রকাশ্যে প্রচার করেছিলেন তিনি।
যে দেশে জন্ম নিয়েছিলেন একমাত্র সেই দেশে নিজ কার্যকলাপকে সীমাবদ্ধ রাখেননি মার্কস। তিনি বলতেন, ‘আমি হচ্ছি বিশ্ব-নাগরিক। যেখানেই থাকি না কেন সেইখানেই আমি সক্রিয়।’ অবশ্য মেটল্যান্ড পার্ক রোডের বাড়িতে পড়ার ঘরে সেদিন প্রথম যাঁকে দেখি তিনি অক্লান্ত ও অতুলনীয় সমাজতন্ত্রী প্রচারক নন, বরং বলা যায়, ধ্যানী বিজ্ঞানী। ওই পড়ার ঘরটি ছিল সেই কেন্দ্র যেখানে সভ্য জগতের দূরদূরান্তের সকল অঞ্চল থেকে পার্টি-কমরেডরা আসতেন সমাজতান্ত্রিক চিন্তাগুরুর মতামত জানতে। মার্কসের মানসিক জীবনের অন্তরঙ্গতায় প্রবেশ করতে হলে এই ঐতিহাসিক ঘরখানির পরিচয় আগে জানা দরকার।
ঘরখানা ছিল বাড়ির দোতলায়। টানা একটা জানলা দিয়ে আলো এসে ভরে দিত ঘরখানা। জানলা দিয়ে চোখে পড়ত পার্কের দ”শ্য। জানলার বিপরীত দিকে ঘর গরমের চুল্লীর দু’পাশে দেয়াল জুড়ে ছিল বইয়ের তাক। তাকগুলো ছিল বইয়ে ভরা আর ছাদ পর্যন্ত উঁচু হয়ে ওঠা খবরের কাগজ পান্ডুলিপিতে ঠাসা। চুল্লীর বিপরীত দিকে জানলার একপাশে থাকত দুটো টেবিল, তার উপর কাগজপত্র, বই আর খবরের কাগজের স্তুপ। ঘরের মাঝখানে সবচেয়ে আলোকিত জায়গাটায় ছিল একখানা ছোট্ট সাদাসিধে ডেস্ক (তিন ফুট বাই দুই ফুট আয়তনের) আর একখানা কাঠের আর্মচেয়ার। আর্মচেয়ারের পিছনের বইয়ের তাকগুলোর মাঝখানে, জানালার বিপরীত দিকে ছিল চামড়ায় মোড়া একটা সোফা। সময়ে সময়ে বিশ্রামের জন্যে এই সোফাটায় শুতেন মার্কস। চুল্লীর উপরকার তাকে থাকত আরও কিছু বই, চুরুট আর দেশলাই, তামাকের বাক্স, কাগজ চাপা আর কিছু ছবি মার্কসের স্ত্রী আর মেয়েদের, ভিল্হেল্ম ভল্ফ* আর ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের।
মার্কস ছিলেন কড়া ধূমপায়ী। কথায় কথায় একবার আমায় বলেছিলেন, ‘পুঁজি’ বইটা লেখার সময় যত চুরুট টেনেছি বইটা থেকে এমনকি তারও দাম উঠবে না’। তবে দেশলাইয়ের খরচ ছিল তাঁর অনেক বেশি। পাইপ বা চুরুট টানতে ঘনঘন ভুলে যেতেন, আর সেগুলো জ্বালাতে অল্প সময়ের মধ্যে এমন বাক্সের পর বাক্স দেশলাই খালি করে ফেলতেন যে তার সংখ্যা দেখলে অবিশ্বাস্য ঠেকত। বই কিংবা কাগজপত্র গুছিয়ে রাখতে — কিংবা বলা চলে অগোছালো করতে কাউকেই দিতেন না তিনি। বইপত্রের অগোছালো ভাবটা ছিল আপাত বিশৃঙ্খলা, আসলে সবকিছুই থাকত তাদের নির্দিষ্ট জায়গায়, ফলে দরকার পড়লেই নির্দিষ্ট বই কিংবা নোটবইটি হাতের কাছে পেয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে সহজ হতো। এমনকি আলাপের সময়ও প্রায়ই তাক থেকে বই টেনে নিতেন, আর ঠিক তখন যে-বিষয়ের উল্লেখ করছিলেন বই থেকে তার সপক্ষে উদ্ধৃতি কিংবা পরিসংখ্যানের নজির দেখাতেন। তিনি ও তাঁর পড়ার ঘর ছিল একাত্ম, নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যতখানি তাঁর আয়ত্তে ছিল ঠিক ততখানিই আয়ত্তে ছিল ওই পড়ার ঘরের বই আর কাগজপত্রগুলি।
বই সাজানোর ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক সামঞ্জস্য রক্ষা নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না মার্কসের। তাঁর বইয়ের তাকে নানা আকার-আয়তনের বই আর পুস্তিকা পাশাপাশি রাখা থাকত। বইপত্র সাজিয়ে রাখতেন তিনি বিষয়বস্তু অনুসারে, আকার অনুযায়ী নয়। বই ছিল তাঁর কাছে মনের হাতিয়ার, বিলাসদ্রব্য নয়। মার্কস বলতেন, ‘ওরা আমার দাস, যেমনটি চাইব সেইভাবে আমার কাজে লাগতে হবে ওদের’। বইয়ের আকার বা বাঁধাই, কাগজ বা টাইপের গুণাগুণ — এসবের ভ্রূক্ষেপ ছিল না তাঁর। অবলীলায় তিনি পাতার কোণ মুড়ে রাখতেন, মার্জিনে পেন্সিল দিয়ে চিহ্ন দিতেন, লাইনকে লাইন দাগ দিয়ে রাখতেন। বইয়ের মার্জিনে লেখা অভ্যাস ছিল না তাঁর, তবে বইয়ের লেখক মাত্রা ছাড়িয়ে গেছেন মনে হলে কখনও এক-আধটা বিস্ময়সূচক কিংবা জিজ্ঞাসা চিহ্ন দেওয়া থেকে আত্মসংবরণ করতে পারতেন না। লেখার নিচে দাগ দেওয়ার তাঁর যে—পদ্ধতি ছিল তাতে যেকোনো বই থেকে প্রয়োজনীয় অনুচ্ছেদ খুঁজে পাওয়া তাঁর পক্ষে সহজ হতো। বহুদিন পরে পরে নোট বইগুলো আর বইয়ের নিম্নরেখ অনুচ্ছেদগুলো আবার পড়ার একটা অভ্যাস ছিল তাঁর, স্মৃতিতে সেগুলো জিইয়ে রাখার জন্যে এর প্রয়োজন হতো। মার্কসের ছিল অসামান্য নির্ভরযোগ্য স্ম”তিশক্তি। হেগেলের উপদেশ অনুযায়ী অপরিচিত বিদেশি ভাষায় লেখা কবিতা তরুণ বয়স থেকে কণ্ঠস্থ করে এই শক্তিকে বাড়িয়ে তুলেছিলেন।
হাইনে আর গ্যায়টের কাব্য ছিল তাঁর কণ্ঠস্থ, কথাবার্তায় হামেশাই তাঁদের লেখা থেকে ঊদ্ধৃতি দিতেন। সকল ইউরোপীয় ভাষার কবিদের তিনি ছিলেন অধ্যবসায়ী পাঠক। প্রতি বছর একবার করে মূল গ্রীক ভাষার ইস্কাইলস** পড়ার তাঁর অভ্যাস ছিল। তিনি মনে করতেন, মানবসমাজ যত নাট্যপ্রতিভার জন্ম দিয়েছে তাঁদের মধ্যে দুই মহত্তম স্রষ্টা হলেন ইস্কাইলস আর শেক্সপীয়র। শেক্সপীয়রের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। কবির রচনাবলী একেবারে খুঁটিয়ে পড়েছিলেন তিনি, এমনকি সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রটিও ছিল মার্কসের নখদর্পণে। এই মহান ইংরেজ নাট্যকারের প্রতি সমগ্র মার্কস পরিবারের ছিল সত্যিকার অচলা ভক্তি; শেক্সপীয়রের বহু রচনাই মার্কসের তিন মেয়ের কন্ঠস্থ ছিল। আগেই ইংরেজি পড়তে পারতেন মার্কস, কিন্তু ১৮৪৮ সালের পর তিনি যখন ওই ভাষায় তাঁর দখল পাকাপোক্ত করতে মনস্ত করলেন তখন শেক্সপীয়রের নিজস্ব শব্দ ও বাক্যভঙ্গি খুঁজে বের করে তার একটা তালিকা পর্যন্ত তৈরি করে ফেলেছিলেন। তাঁর প্রিয় কবিদের তালিকায় দান্তে আর রবার্ট বার্নসও অন্তর্ভূক্ত ছিলেন; মেয়েরা যখন এই শেষোক্ত স্কটিশ কবির ব্যঙ্গ কবিতা আবৃত্তি করতেন কিংবা তাঁর রচিত গাথাগুলি গাইতেন তখন পরমানন্দে তা উপভোগ করতেন মার্কস।
…. সময়ে-সময়ে সোফাটায় শুয়ে পড়ে উপন্যাস পড়তেন। কখনও-কখনও একই সঙ্গে কয়েকখানা উপন্যাসও পড়তেন তিনি, ঘুরে ঘুরে একেকবার একেকটা বই একটু-একটু করে। ডারউইনের মতো মার্কসও ছিলেন একেবারে উপন্যাসের পোকা; তাঁর পছন্দ ছিল আঠারো শতকের উপন্যাস, বিশেষ করে ফিলডিঙের ’টম জোন্স’ বইটি। অপেক্ষাকৃত আধুনিক ঔপন্যাসিকদের মধ্যে তাঁর কাছে সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক ঠেকত পোল দ্য কক, চার্লস লেভার, বয়োজ্যেষ্ঠ আলেকসান্দর দ্যুমা ও ওয়াল্টার স্কটের রচনাবলী; ‘স্কটের ওলড মর্টালিটি’ বইটিকে তো সেরা শিল্পকর্ম বলেই গণ্য করতেন। অ্যাডভেঞ্চার আর হাসির গল্পের দিকে স্পষ্টতই পক্ষপাতিত্ব ছিল তাঁর।…বালজাকের তিনি এত ভক্ত ছিলেন যে ভেবেছিলেন রাজনীতি-সংক্রান্ত অর্থশাস্ত্র বিষয়ে বই লেখা শেষ করেই বালজাকের মহৎ রচনাবলী ‘La Comedie Humaine’ নামের একটি দীর্ঘ সমালোচনা লিখে ফেলবেন। বালজাককে শুধু যে তাঁর যুগের ইতিহাসবেত্তা জ্ঞান করতেন মার্কস তাই নয়, লুই ফিলিপের রাজত্বকালে যে-সব চরিত্র ছিল ভ্রুণাকারে এবং লেখকের প্রয়াণের পর তৃতীয় নেপোলিয়ানের আমলে একমাত্র যেগুলি পূর্ণপরিণত হয়ে উঠেছিল সেইসব সম্ভাব্য চরিত্রের ভবিষ্যৎ-দৃষ্টিমান স্রষ্টা বলেও তাঁকে মনে করতেন।
…নানা ভাষা আয়ত্ত করার প্রতিভা ছিল তাঁর অসামান্য। তাঁর মেয়েরাও উত্তরাধিকারসূত্রে বাবার এই গুণটি পেয়েছিলেন। রুশ ভাষা শিখতে শুরু করেন তিনি যখন তাঁর বয়স পঞ্চাশ অতিক্রান্ত করে গেছে। যদিও ওই ভাষার সঙ্গে মার্কসের জানা আধুনিক বা প্রাচীন কোনও ভাষারই ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য ছিল না, তবু মাত্র মাস ছয়েকের মধ্যে ভাষাটি তিনি এতদূর ভালোভাবে আয়ত্ত করেছিলেন যে রুশ কবি ও গদ্যলেখকদের রচনা পড়ে তা থেকে আনন্দ পাওয়ার অবস্থায় পৌঁছে ছিলেন। রুশ কবি ও লেখকদের মধ্যে তাঁর পছন্দ ছিল পুশ্কিন, গোগোল ও শ্চেদ্রিনের রচনা। সরকারি তদন্তের যে রিপোর্টগুলি রাজনৈতিক সত্য উদ্ঘাটনের কারণে তৎকালীন রুশ গভর্নমেন্ট প্রকাশ না করে চেপে দিয়েছিল সেগুলি যাতে পড়তে পারেন এই উদ্দেশ্যেই রুশ ভাষা শিখেছিলেন তিনি। গুণগ্রাহী বন্ধুরা ওই সব দলিল মার্কসের জন্যে সংগ্রহ করেছিলেন; ফলে সারা পশ্চিম ইউরোপে তিনিই ছিলেন নিশ্চিন্তভাবে একমাত্র রাজনীতি-সংক্রান্ত অর্থশাস্ত্রবিদ, ওই দলিলগুলি সম্পর্কে যাঁর জ্ঞানগম্যি ছিল।
কবি ও ঔপন্যাসিকদের রচনাপাঠ ছাড়াও মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেওয়ার অপর একটি আশ্চর্য উপায় আবিষ্কার করেছিলেন মার্কস, তা হলো অঙ্ক কষা। গণিতের প্রতি তাঁর একটা বিশেষ ধরনের ঝোঁক ছিল। বীজগণিত এমনকি তাঁকে মানসিক সান্ত¡না পর্যন্ত যোগাত, ঘটনাবহুল জীবনে সবচেয়ে মনোকষ্টের মুহূর্তগুলিতে তিনি শরণ নিতেন এই অঙ্কশাস্ত্রটির। স্ত্রীর শেষ অসুখের দিনগুলিতে স্বাভাবিক বৈজ্ঞানিক কাজে মন দিতে পারতেন না তখন স্ত্রীর রোগযন্ত্রণার দরুন যে-মনোকষ্ট ভোগ করতেন তা ভুলে থাকতেন একমাত্র অঙ্ক কষায় ডুবে থেকে। মানসিক কষ্টভোগের ওই সময়টায় লিখে ফেলেছিলেন অণুকলন (infinitesimal calculas) বিষয়ক উচ্চতর গণিতের একখানা বই। বিশেষজ্ঞদের মতে বইখানির বৈজ্ঞানিক মূল্য অপরিসীম। উচ্চতর গণিতের মধ্যে মার্কস প্রত্যক্ষ করেছিলেন দ্বান্দ্বিক গতির সবচেয়ে যুক্তিগ্রাহ্য এবং ওই একই সঙ্গে সরলতম নমুনা। তিনি এই মত পোষণ করতেন যেকোনো বিজ্ঞানকে সত্যিকার পরিণত বিজ্ঞান আখ্যা দেওয়া চলে না যতক্ষণ না তা গণিতের ব্যবহারে অভ্যস্ত হচ্ছে।
যদিও মার্কসের নিজস্ব গ্রন্থাগারে তাঁর সারা জীবনব্যাপী গবেষণাকার্যের সঙ্গে সঙ্গে সযত্নে সংগৃহীত হাজার খানেকেরও বেশি বই ছিল, তবু তাঁর পক্ষে তা যথেষ্ট ছিল না। বেশ কয়েক বছর ধরে তাই নিয়মিতভাবে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গিয়ে পড়াশুনা করেছিলেন তিনি। ওই গ্রস্থাগারে গ্রস্থতালিকার প্রশংসায় তিনি ছিলেন পঞ্চমুখ।
যদিও অনেক রাত করে শুতে যেতেন মার্কস তবু সর্বদাই সকাল আটটা থেকে নটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে পড়তেন। তারপর খানিকটা কালো কফি খেয়ে নিয়ে খবরের কাগজগুলো দেখতেন। অতঃপর ঢুকতেন গিয়ে পড়ার ঘরে, রাত দুটো-তিনটে পর্যন্ত সেখানে কাজ করতেন তিনি। একমাত্র খাওয়ার সময়গুলোয় তিনি কাজ বন্ধ রাখতেন আর বন্ধ রাখতেন আবহাওয়া অনুকূল থাকলে সন্ধ্যের দিকে হ্যাম্পস্টেড হীথে *** এক চক্কর বেড়ানোর জন্যে। কখনও-কখনও দিনের বেলায় ঘন্টা খানেক কি ঘন্টা দুয়েক সেই সোফায় শুয়ে ঘুমিয়েও নিতেন। যৌবন-বয়সে প্রায়ই রাত জেগে কাজ করা তাঁর অভ্যাস ছিল।
* ভিল্হেল্ম ভল্ফ (১৮০৯-১৮৬৪) জার্মান প্রলেতারিয়ান বিপ্লবী এবং মার্কস ও এঙ্গেলসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহকর্মী। এঁর নামেই ‘পুঁজি’ গ্রšে’র প্রথম খ-টি উৎসর্গ করেন মার্কস।
** ইস্কাইলস (খ”. পূ. ৫২৫-৪৫৬ সাল) — বিশ্ববিশ্রুত প্রাচীন গ্রীক কবি ও নাট্যকার। ধ্রুপদী বিয়োগান্তক কাব্যনাটক রচয়িতা।
*** লন্ডনের উপকণ্ঠে এক টিলাসঙ্কুল প্রান্তর।