সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নাঈমা খালেদ মনিকা এবং সাধারণ সম্পাদক স্নেহাদ্রি চক্রবর্ত্তী রিন্টু কোটা আন্দোলন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে নিম্নোক্ত বিবৃতিটি প্রদান করেছেন।
নেতৃবৃন্দ বিবৃতিতে বলেন, “সরকারি চাকুরিতে কোটা প্রথার বৈষম্য নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে চলমান ছাত্র আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ ১১ এপ্রিল সংসদে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি দাবি করেছেন সরকারি চাকুরির বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেধার ভিত্তিতেই নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে আন্দোলনকারীদের সঠিক ধারণা নেই এবং তার নানাভাবে প্ররোচিত হয়েই এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে। এমনকি আন্দোলনকারীরা তাঁকে দেয়া প্রতিশ্রুত সময়সীমা রক্ষা করেনি। বরং পুনরায় আন্দোলন করে জনজীবনে চরম দুর্ভোগ নামিয়ে এনেছে এবং সামগ্রিকভাবে দেশে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে। এমন অবস্থায়, কোটা প্রথা সম্পূর্ণরূপে বাতিল করার কথা প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যে কোটা আন্দোলন নিয়ে ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। এ কথা তাঁর জানা থাকার কথা যে, বাংলাদেশে এখন প্রায় ৪ কোটি ৮০ লক্ষ বেকার। প্রতিবছর শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে ১২-১৫ লক্ষ কর্মক্ষম যুবক-যুবতী। নতুন কর্মসংস্থান, সরকারি চাকুরির সুযোগ অত্যন্ত অপ্রতুল। বেসরকারি চাকুরি বলে যা আছে তাতে অর্থনৈতিক-সামাজিক নিরাপত্তা বলে প্রায় কিছু নেই। এরকম অবস্থায় জেলা কোটা, নারী কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা, উপজাতি কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা ইত্যাদি ২৫৮ ধরনের কোটা সরকারি চাকুরিতে রয়েছে। মাত্র ৪৪ শতাংশ শিক্ষার্থী মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকুরির সুযোগ পায়। আর এই কোটা নিয়ে কোটি কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্যও সর্বজনবিদিত। ফলে অত্যন্ত সীমিত সুযোগ এবং চরম অনিশ্চয়তা নিয়ে যুবক-যুবতীদের চাকুরি নামক যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়। তাই কোটা প্রথা সংস্কারের দাবিতে তাদের এই আন্দোলন কোনোভাবে অযৌক্তিক হতে পারে না। প্ররোচিত হয়ে লাখ লাখ শিক্ষার্থী এ আন্দোলন করছে বলাটাও তাই অন্যায়। এই আন্দোলনে জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন চোখে পড়েছে। রাস্তা অবরোধের কারণে চলাচলে বিঘ্ন ঘটেছে ঠিক, কিন্তু তবুও সরকারের ‘উন্নয়ন মিছিলে’ জনগণকে যেভাবে দুর্ভোগ পোহাতে বাধ্য করা হয় – তার সাথে এর কোনো তুলনা হয় না। এবারের আন্দোলনে বহু জায়গায় আন্দোলনকারীরা জরুরি সেবা নিতে যাওয়া যাত্রীদের, এ্যাম্বুলেন্সে থাকা রোগীদের রাস্তা ছেড়ে দিয়ে চলাচলে সহায়তা করেছে। জনদুর্ভোগের অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য তাই গ্রহণযোগ্য নয়।
কোটা বাতিল নিয়ে বক্তব্যেও প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের অবস্থানের সাথে একাত্ম হতে পারেননি। এই আন্দোলনে ছাত্রদের সুস্পষ্ট দাবি কোটা ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নিয়ে আসার। অর্থাৎ কোটা প্রথা সংস্কারের, বাতিল নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কোটা প্রথা পুরোপুরি বাতিলের কথা বললেন। প্রথমত, এই ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কেননা সংবিধানের ২৯ নং অনুচ্ছেদে ‘নাগরিকের অনগ্রসর অংশ, ধর্মীয়-উপ সম্প্রদায়ের’ কাউকে বিশেষ সুযোগ দেবার কথা বলা আছে। দ্বিতীয়ত, দেশের বর্তমান বৈষম্যমূলক আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটেও কোটা ব্যবস্থার পুরোপুরি বিলোপ সাধনের সুযোগ নেই। এখনো আদিবাসী, প্রতিবন্ধী কোটার প্রয়োজন আছে। অন্যান্য কোটা নিয়েও আলোচনা হতে পারে। কিন্তু তা না করে যদি কোটা তুলে দেয়া হয় তাহলে সেটা হবে আন্দোলনকারীদের মধ্যেই বিভক্তি আনার অপকৌশল। তখন প্রকৃত অর্থে যারা কোটা সুবিধা পাবার যোগ্য তাদের সাথে অন্যদের দ্বন্দ্বের সুযোগ তৈরি হবে। যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগেও আন্দোলনকারীদের দাবির প্রতি ন্যূনতম ভ্রুক্ষেপ না করেই মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও তাদের নাতি-পুতিদের ৩০ শতাংশ কোটা বহাল রাখার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কোটা সংস্কারের কোনো সুযোগ নেই বলেই মত দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ তীব্র ছাত্র আন্দোলনের মুখে তাঁকে সেই অবস্থান থেকে সরে আসতে হলো। তিনি তাঁর মত পাল্টালেন কিন্তু ছাত্রসমাজের ন্যায্য আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিতে পারলেন না। উপরন্তু বারে বারে তাঁর সরকারকে যেভাবে ‘শিক্ষাদরদী’ হিসেবেই উপস্থিত করলেন, তাতে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার চরম অসারতাই যেন বারবার দেশের জনগণকে উপহাস করছিল।”
নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে আন্দোলনকারীদের কোটা সংস্কারের ন্যায্য দাবি মেনে নিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান।