উন্নত সংস্কৃতি ও চেতনার উঁচু মান গড়ে তোলার সংগ্রামে এগিয়ে আসুন
কমরেড মবিনুল হায়দার চৌধুরী
[গত ৩০ মে ঢাকায় অবস’ানরত বাসদ সমর্থক-শুভার্থীদের এক বিশেষ সভা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনটে ভবনের অ্যালামনাই ফ্লোরে অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তব্য রাখেন বাসদ কনভেনশন প্রস’তি কমিটির আহ্বায়ক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী, সদস্য কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রকৌশলী হারম্নন আল রশীদ, পরিচালনা করেন বেলাল চৌধুরী। অনুষ্ঠানে প্রদত্ত কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর বক্তব্যটি সম্পাদনা করে এখানে পত্রস’ করা হল।]
শিবদাস ঘোষের চিনত্মার আলোকে এদেশের বুকে আমাদের পার্টিটা কীভাবে একটা মান নিয়ে গড়ে উঠেছিল, একটা বিপ্লবী পার্টি হিসেবে সমা্ভবনা নিয়ে গড়ে উঠছিল, তাকে অস্বীকার করার বা ছোট করে দেখবার প্রশ্ন নেই।
মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গীতে, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীতে যে কোনো সমস্যা বিশ্লেষণ করা গুরুত্বপূর্ণ – আমার কাছে তো ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদী চিনত্মা শুধু আমার কাছে নয়, সবার কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। মানব জাতির যারাই বর্তমান কালে সমসত্ম রকমের শোষণের হাত থেকে মুক্ত হতে চান তাদের সবার কাছেই তা অত্যনত্ম গুরুত্বপূর্ণ। সেই শোষণমুক্তির হাতিয়ার মার্কসবাদী বিজ্ঞানকে আয়ত্ত্ব করা দেশে দেশে একটি যথার্থ বিপ্লবী পার্টি ব্যতিরেকে সম্ভব নয়। পার্টি হলো, শ্রমিকশ্রেণীর সবচেয়ে অগ্রণী চিনত্মার আধার এবং তার সবচেয়ে উন্নত সুসংগঠিত বাহিনী। এই পার্টি ছাড়া পৃথিবীর কোথাও বিপ্লব সম্ভব নয়।
সম্প্রতি আমরা অনেক বড় বড় সংগ্রাম দেখছি। সারা পৃথিবীতে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে পুঁজিবাদের ভয়াবহ সংকটকে কেন্দ্র করে একেবারে উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম সর্বত্র শ্রমিক বিদ্রোহ, শ্রমিক-মেহনতিদের বিশাল বিক্ষোভ, বিরাট আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে। একেকটা শহরে ৫ লাখ, ৭ লাখ মানুষ জড়ো হয়েছে, প্রতিবাদ করেছে, বিক্ষোভ করেছে। পাশ্চাত্যের বুকে এত বড় বড় বিক্ষোভ সাম্প্রতিক ইতিহাসের আর কোনো লগ্নে, কোনো সময়ে হয়নি। কিন’ এই সবগুলি বিক্ষোভ হল লাখো লাখো মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমবেত বিক্ষোভ। কিন’ এর দ্বারা, ভবিষ্যতে মানুষের সামনে সমসত্ম রকম শোষণের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার যে সংগ্রাম, সেই সংগ্রামের পথে মানুষ অনেকখানি এগিয়ে গেছে এধরনের কোনো প্রমাণ নেই। সমসত্ম লড়াইই ব্যর্থ হয়েছে একথা আমি বলছি না। এসব লড়াই এর মাধ্যমে মানুষের চিনত্মায় আলোড়ন হতে থাকে। অবশ্যই শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে মানুষ ভাবছে. চিনত্মা করছে। কিন’ এ লড়াইয়ে সত্যিকার অর্থে বিপ্লবী পার্টি না থাকার কারণে সুনিদির্ষ্টভাবে তা ধারাবাহিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে এরকম কিছু দেখা যাচ্ছে না।
ইউরোপ ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, যারা পেট্রোডলারের কারণে আমাদের তুলনায় অনেক সচ্ছল জীবন ধারণ করে, সেখানেও লক্ষ লক্ষ মানুষ কীভাবে তিউনেশিয়া থেকে শুরু করে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আরব দেশগুলোতে বিশাল গণআন্দোলন গড়ে তুলেছে – সেই গণআন্দোলনে বামপন’ী, দক্ষিণপন’ী বহুরকমের শক্তি যুক্ত হয়েছে। এইসব দেশগুলোতে বেশিরভাগ জায়গায় দক্ষিণপন’ী যে পার্টিগুলি শাসন করতো, তাদেরকে সরিয়ে দিয়ে মৌলবাদীরা ক্ষমতায় এসেছে। এই যে এতবড় বিক্ষোভ-আন্দোলন – এর মধ্য দিয়েও মানুষ কোনোমতেই যথার্থ পথের দিকে, সঠিক পথে এগিয়ে যেতে পারছে না এর মূল কারণ হলো একটি সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবী দলের অনুপসি’তি। জনগণের এই যে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ, যন্ত্রণায় অসি’র হয়ে মানুষ বিক্ষোভ করবেই, লড়াই সংগ্রামে আসতে থাকবেই, বারে বারে ফিরে আসবে। কিন’ সঠিক বিপ্লবী পার্টি ছাড়া কোনোদিন মানুষ, শতবার বিক্ষোভে ফেটে পড়লেও কোনও পথ পাবে না। নিপীড়ন-নির্যাতন-শোষণমূলক সমাজব্যবস’ার হাত থেকে নিসত্মার পাবে না। এই প্রসঙ্গেই আমি বলতে চাই যে, যুক্তিবাদী বৈজ্ঞানিক চিনত্মাকে পরিবেশ-পরিসি’তি ও সমস্যার ধরন ও রূপ পাল্টাবার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিকশিত করতে হয়। না হলে সমসত্ম সঠিক চিনত্মা যা অতীতে হয়ত অত্যনত্ম কার্যকর ছিল সেগুলো অকার্যকর হতে থাকে। তাই ক্রমাগত বিজ্ঞানভিত্তিক চিনত্মারও বিকাশ ঘটাতে হয়। ইতিহাসের দিকে তাকান। যে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, স্ট্যালিন-মাও সেতুং-এর চিনত্মা হাতিয়ার হিসেবে মানুষের জানা ছিল, সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস’া ছিল, সব ধসে গেল। ধসে গেল কেন?
কমরেড শিবদাস ঘোষ, ১৯৪৮ সালে ভারতে এসইউসিআই(সি) পার্টির সূচনা করেছিলেন। সর্বহারাশ্রেণীর বিপস্নবী পার্টি হচ্ছে একটা আনত্মজার্তিকতাবাদী পার্টি। সেই কারণে তখনকার বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনে নতুন যে সমস্যা-সংকট দেখা দিয়েছিল, সে সম্পর্কে আলোচনা দিয়েই তিনি শুরম্ন করেছিলেন। তাঁর সেই হুঁশিয়ারি পরে সত্য হয়েই দেখা দেয়। স্ট্যালিনের নেতৃত্বে বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিশ্বের দেশে দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের শেষের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিপস্নবী অভ্যুত্থান হয়েছিল। একটা সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে একা বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির দেশে দেশে আক্রমণগুলোর প্রতিবাদ করেছে। কিন’ একা মোকাবেলা করতে পারেনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলির পরাজয় ঘটল। তারপর বিশ্বের আরো বিশাল অংশ মহাচীন এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, কমপুচিয়া, লাওস পরবর্তীকালে কিউবা, উত্তর কোরিয়া এইসব দেশগুলো সমাজতান্ত্রিক শিবিরেরই অনত্মর্গত হয়। সমাজতান্ত্রিক শিবির একটা বিশ্বব্যবস’া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। একদিকে পুঁজিবাদী শিবির আরেকদিকে শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক শিবির। এতবড় একটা বিজয়ের পরবর্তীকালে অল্প সময়ের মধ্যেই কমরেড শিবদাস ঘোষ বিপদের কিছু লক্ষণ দেখতে পেয়েছিলেন যা পরবর্তীকালে পাকাপোক্ত হতে থাকে।
এই যে বিশাল শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক শিবির তা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী শিবিরকে মোকাবেলা করার শক্তি হিসেবে, কোথাও কোথাও তাদের চেয়েও শক্তিশালী হিসেবে এবং সারা বিশ্বের মানুষের সমর্থন নিয়ে শানিত্মর পক্ষে যুদ্ধের বিরুদ্ধে দুর্ভেদ্য দুর্গের মতো অবস’ান করছিল। সমগ্র বিশ্বের শোষিত মানুষ, যথার্থ গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষও প্রবল আশা নিয়ে তাকিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে। এতবড় শক্তি নিয়ে অভ্যুত্থান ঘটার পরও, কমরেড শিবদাস ঘোষের ভাষায়, আবার এক গোলক ধাঁধায় পড়ে গেল। কমরেড স্ট্যালিনের মৃত্যুর পরে ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে যারা সোভিয়েত পার্টির শীর্ষে এল, তারা মার্কসবাদী বিপ্লবী রাজনীতির যে সারমর্ম তার থেকে বিচ্যুত হয়ে ধীরে ধীরে বুজোর্য়া চিনত্মার শিকার হয়ে গেল। শোধনবাদী আপোষকামী চিনত্মায় প্রভাবিত হয়ে আপোষকামী নেতৃত্ব, সুবিধাবাদী নেতৃত্ব আপোষ করেছে বুর্জোয়া জীবনযাপন, বুর্জোয়া ভোগবিলাস, বুর্জোয়া ব্যক্তিবাদী চিনত্মা এই সবের সঙ্গে । ফলে চিনত্মার জগতে, নীতি নৈতিকতার জগতে যে অবক্ষয় ধীরে ধীরে আসতে শুরু করল ক্রমাগত সেগুলি বড় হতে হতে পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তনে পরিণত হল। ক্রুশ্চেভ শুরু করেছিল, কিন’ ক্রুশ্চেভের সময়ে সবটা ধসে যায়নি, তখনও সমাজতন্ত্রের মূল ভিত্তি, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও তার অর্থনীতির একটা শক্তভিত্তি ছিল। কিন’ কালক্রমে শোধনবাদী রাজনীতি, আপোষকামী রাজনীতি ধীরে ধীরে সোভিয়েত পার্টিকে অধঃপতিত করল এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস’ার মর্মে-মূলে অবক্ষয় ধরিয়ে সমাজতন্ত্রকে ধসিয়ে দিল। কোনো সাম্রাজ্যবাদী দেশের সঙ্গে যুদ্ধে পরাসত্ম হয়ে, যুদ্ধ মোকাবেলা করতে না পেরে শক্তিহীন হয়ে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন ঘটেনি। এই পতন ঘটিয়েছে মাকর্সবাদী বিপ্লবী রাজনীতির যে শর্তগুলি, তার মধ্যে নানা ধরনের শোধনবাদী চিনত্মার অনুপ্রবেশ। একটা বিপস্নবী তত্ত্ব, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির নিয়ম, যা কার্যকরী আছে সেটাকে ধীরে ধীরে অকার্যকরী করার মতো করে যুক্তি করে তাকে পরিবর্তন করার প্রক্রিয়া শুরু করে দেয় শোধনবাদীরা। কমরেড শিবদাস ঘোষ বিশদ আলোচনা করে দেখিয়েছেন কীভাবে বিপস্নবী চেতনার নিম্নমানের সুযোগ নিয়ে ক্রমাগত শোধনবাদী আক্রমণ ধীরে ধীরে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস’ার পতন অনিবার্য করে তুলেছিল। এর মোকাবেলা কীভাবে হতে পারে সেটাও দেখিয়েছিলেন। পুঁজিবাদী শোষণমূলক ব্যবস’া থেকে যে বুর্জোয়া ব্যক্তিবাদী অহংবোধ ব্যক্তিমানসে ঢুকে পড়েছিল তা সকল সময়ে সত্য আহরণের পথে বাধা সৃষ্টি করে থাকে। কেউ কোনো কথা জানতো না, বুঝতো না, খোঁজ খবর রাখতো না বিষয়টি এরকম নাও হতে পারে। একটা সময় ছিল যখন চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) এর এক সময়কার ইংরেজি পত্রিকা ‘স্যোসালিস্ট ইউনিটি’ নামে প্রকাশিত হতো তা সংগ্রহ করত। হংকং এর একজন ব্যক্তি ৫০/৬০ কপি ক্রয় করে নিয়ে যেত। বোঝা যেত চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা বিভিন্ন আর্টিকেলগুলো যা বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত হতো সেগুলো সংগ্রহ করতেন এবং পড়তেন। কমরেড শিবদাস ঘোষের পার্টি সেসময় খুবই ছোট পার্টি। সেই পার্টির বক্তব্য সবাই পায়নি এটা ঠিক, কিন’ একদম পায় নি এটা ঠিক না।
তাই যে কথা বলছিলাম, শুরুতেই ১৯৪৮ সালে উনি সাম্যবাদী শিবিরের আত্নসমালোচনা করেছেন। লড়্গণীয় যে সমালোচনা নয়, আত্নসমালোচনা করেছেন। নিজেকে সাম্যবাদী শিবিরের পার্ট এন্ড পার্সেল মনে করে, সমপূর্ণ অংশীদার মনে করে, কমরেড স্ট্যালিনের জীবদ্দশাতেই সংকট ধীরে ধীরে ঘনীভূত হচ্ছে সেটা দেখিয়েছিলেন। টিটোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি দেখান যে, কীভাবে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা সাম্যবাদী আন্দোলনের মধ্যে খাদ হয়ে মিশে আছে।
শিবদাস ঘোষ অত্যনত্ম সহজভাবে দেখিয়েছেন – ধারাবাহিকভাবে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের মধ্যে কী বিপদ আসছে এবং সোভিয়েত নেতৃত্বের কী ধরনের ভুলের কারণে হাঙ্গেরিতে কী ধরনের বিপদ এল, পোলান্ডে কী সমস্যা এল, কী করে যুগোশ্লোভিয়ার টিটো, যিনি আনত্মর্জাতিকের অত্যনত্ম অনুগত একজন নেতা ছিলেন অর্থাৎ কমিউনিস্ট ইনফরমেশন ব্যুরোর অত্যনত্ম অনুগত, শক্তিশালী, সংগ্রামী মানুষ হিসেবে মার্শাল টিটো ছিলেন, কোন ধরনের চিনত্মার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, উগ্র জাতীয়তাবাদী চিনত্মাকে ব্যবহার করে কীভাবে উনি, পূর্ব ইউরোপের অন্য দেশের কমিউনিস্টদের মধ্যেও তার তার জাতীয় কমপ্লেক্স বাড়িয়ে দিতে ঠিকই পারলেন। টিটো বহিষ্কৃত হলেন কিন’ যে চিনত্মাকে নিয়ে উনি এ সমস্যা সৃষ্টি করেছিলেন সেই চিনত্মা উৎপাটনের জন্য যে লড়াই, সেই লড়াই কিন’ তখনকার আনত্মর্জাতিক কমিউনিস্ট নেতৃত্ব, এমনকী কমরেড স্ট্যালিনের সময়েও যথার্থভাবে হয়নি। ফলে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে বলকান জাতীয়তাবাদী চিনত্মা বা উগ্র জাতীয়বাদী চিনত্মার যে প্রভাব সেগুলি বাড়তেই লাগলো।
পরবর্তীকালে কমরেড স্ট্যালিন এগুলি বুঝতে পেরে আনত্মজার্তিকতাবাদী চিনত্মাভাবনার একটা নতুন রিজেনারেশনের সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। তখনকার সময়ে কমিউনিস্ট ইনফরমেশন ব্যুরোর মুখপত্র ‘ফর এ লাস্টিং পিস, ফর পিপলস ডেমক্রাসি’ বের হ’ত প্রাগ থেকে। তার মধ্যে অনেকে আনত্মর্জাতিকতাবাদী চিনত্মাভাবনার রিজেনারেশনের জন্য লিখতে শুরু করেছিলেন।
কিন’ কমরেড স্ট্যালিনের মৃত্যুর পরে সোভিয়েত তার বিংশতি কংগ্রেসে শানিত্মপূর্ণ উপায়ে বিপ্লব, বুজোর্য়া পার্লামেন্টকে জনগণের ইচ্ছার যন্ত্রে পরিণত করে বিপ্লবের সম্ভাবনা – এসব, ও আরও অন্যান্য বিষয়ে শোধনবাদী চিনত্মা, ভুল চিনত্মা, অকার্যকর চিনত্মা ক্রুশ্চেভ আমদানি করতে শুরু করলো। ঐ সব নিয়ে কমরেড শিবদাস ঘোষ প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন। প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন একথা যখন আমরা বললাম তখন একদিন যারা সব মানতো, তারা মান্যতা না দেখাবার জন্য বলছেন যে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রথম বিরোধিতা করেছিলো। উনি যে প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন তার কী প্রমাণ আছে? এখানে কে প্রথম, কে দ্বিতীয় বা তৃতীয়, তা প্রশ্ন নয় – মূল কথাটা হলো প্রতিবাদ যথার্থভাবে করা না করা। কিন’ কমরেড শিবদাস ঘোষের লেখা এবং তদানীনত্মন বহু লেখায় বিষয়গুলির প্রতিবাদ বা সেই সব বিষয়গুলি নিয়ে আলাপ আলোচনা যে করেছিলেন, বিশ্লেষণ করেছিলেন এই প্রমাণ আছে। আর অন্যেরা যে পরে করেছে তারও প্রমাণ আছে। আমি এই নিয়ে মারামারি করছি না যে কে আগে করেছে কে পরে করেছে। সঠিক কথা বলার প্রশ্ন। এখন বলা হচ্ছে আলবেনিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি বলেছে। কিন’ আলবেনিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি এইসব কথা যতখানি উচ্চস্বরে বলেছে ততখানি তাত্ত্বিক যুক্তি দিয়ে বলতে পারে নি। এই তাত্ত্বিক যুক্তি দিয়ে বলতে না পারলে শোধনবাদী চিনত্মাকে পরাসত্ম করা অসম্ভব। রাগ, ক্ষোভ, ক্রোধ সরষরঃধহপু, ভবৎাড়ৎ দিয়ে এসমসত্ম কাজ হয় না। আনোয়ার হোজা, তিনি তেজস্বী নেতা ছিলেন। স্ট্যালিনের অত্যনত্ম অনুগত কমরেড ছিলেন। কিন’ স্ট্যালিনকে যেভাবে ফবহবমৎধফব করা হচ্ছিল, বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে ডিফেন্ড করা যায়, সেই উচ্চ মানের তাত্ত্বিক বক্তব্য তিনি রাখতে পারেন নি। এই সব প্রশ্নে তদানিনত্মন কালে যেসব কমিউনিস্ট নেতারা এমনকি প্রতিবাদ করেছেন তাদের মধ্যে কমরেড শিবদাস ঘোষ সমপূর্ণ বিশিষ্ট অবস’ানে আছেন। এগুলো আপনাদের পড়তে হবে, পড়ে বুঝতে হবে। তুলনামূলক পাঠ আজ খুব প্রয়োজন, বিশেষ করে যারা খুব গভীরভাবে বুঝতে চান।
এবার ভাবুন, যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন প্রক্রিয়া শুরু হল, সেই সময় থেকে আমাদের পার্টির শুরু। আনত্মর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে যখন শোধনবাদী রাজনীতি প্রাধান্য বিসত্মার করেছে সেই সময় আমাদের পার্টি বাংলাদেশের বুকে ১৯৮০ সালে আমরা শুরু করলাম। তার আগে ১৯৭২ সালে আমি প্রথম, জাসদের জন্ম যখন হয় নি, তখন জাসদের যে প্রধান নেতা সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। যে শ্লোগানগুলি জাসদ তুলেছিল, সেই শ্লোগানগুলি বাসত্মবিক কি রূপে এদেশের বুকে একটা বিপ্লবী রাজনীতি দ্বারা পরিচালিত হবে তার দিশা ছিল না। এই যে লক্ষ লক্ষ যুব শক্তি, বিশাল যুব শক্তি বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি গ্রামে গ্রামে এই যুবশক্তির অবস’ান ছিল, এতবড় প্রতিবাদী যুবশক্তিকে পথ দেখাতে পারছিলনা। কতগুলো শেস্নাগানের জোরে আর অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে মানুষের যে ক্ষোভ, সেগুলির বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করতে করতেই বেশ খানিক দিন চলেছে। কিন’ এটা বেশিদিন চলে না। যদি এই যুবশক্তিকে একটি ওয়েল ডিসিপ্লিনড্ বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বে পরিচালিত করার মতো জ্ঞানের ভিত্তি তৈরি করা না যায়, তবে তাকে ধরে রাখা যাবেনা। যায়ও নি। সেইসময় কমরেড শিবদাস ঘোষের চিনত্মা নিয়ে আমি জাসদের অভ্যনত্মরে কাজ করতে পেরেছি। তার ফলে যুব সমাজের মধ্যে নেতৃত্বকারী বেশ কিছু মানুষকে প্রভাবিত করে এর পক্ষে এনেছিলাম। কিন’ খেয়াল রাখবেন যে, বাসত্মবিক তাদের জীবনে সেটাকে গ্রহণ করিয়ে, অনুশীলন করে নিজেদের সমপূর্ণ পাল্টে ফেলা বোলতে যা বোঝায়, সেই সত্মরে আমি তাদের তুলতে পারিনি। এ আমার সাধ্যের অতীত ছিল। অলমোস্ট একটি পার্টির ঢ়ৎড়পবংং ড়ভ ঃযরহশরহম নিয়ে চলা মানুষগুলিকে আরেকটা সমপূর্ণ নতুন পার্টির ঢ়ৎড়পবংং ড়ভ ঃযরহশরহম এ নিয়ে আসার ন্যায় প্রায় অসম্ভব একটা কাজের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলাম। ঢোকার মধ্যে আমার তখনকার যে সীমাবদ্ধ জ্ঞান, জ্ঞানের কিছু ঘাটতি ছিল। যাই হোক, এইভাবে আমাদের পার্টি ‘বাংলাদেশর সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ’ নিয়ে ১৯৮০ সালে যাত্রা শুরু করি।
এরপরে শুরু হয় আমাদের পার্টির মধ্যে ‘পারবো না’, ‘পারলো না’, ‘তারাতো পারবে না’, ‘এইভাবে বলবে না’ ইত্যাদি কথাবার্তা। ‘পারবো না’ – এই কথাটার মধ্যে যুক্তি থাকতে হয়। ‘জীবনের সর্বক্ষেত্রে মার্কসবাদ অবাসত্মব’, ‘ঊঃযরপধষ সড়ঃযবৎযড়ড়ফ (এথিক্যাল মাদারহুড) বা সার্বজনীন মাতৃত্ব আবার কী!’, ‘মায়ের আবার ঊঃযরপধষ সড়ঃযবৎযড়ড়ফ কী, মা তো মা!’ প্রভৃতি প্রশ্ন তোলা হল। বঃযরপধষ সড়ঃযবৎযড়ড়ফ মানে নিজের গর্ভের সনত্মান না হলেও মা হওয়া যায়। একজন নারী অপরের সনত্মানের প্রতিও অনির্বচনীয় এবং অকৃত্রিম মাতৃত্বের প্রকাশ তার চরিত্রে বৈশিষ্ট্যে ঘটাতে পারেন সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্য দিয়ে। এই উপমহাদেশের বুকে কমরেড শিবদাস ঘোষ নতুন নতুন ধারণাসম্বলিত কিছু নৈতিকতা, কিছু মূল্যবোধ যা সাম্যবাদী সংস্কৃতির পরিপূরক নিয়ে এলেন, যা অন্য কেউ আনেন নি। ঊঃযরপধষ, সড়ৎধষ সকল ক্ষেত্রেই তার চিনত্মা যেগুলোর কিছু কিছু যা বুঝেছি, তার সবই ডকুমেন্ট ছিল না, এসে যুক্তিতর্ক করে বোঝাবার চেষ্টা করেছি। এইভাবে একদল চলতে পারলেন না। জীবনে গ্রহণ করে ধারণ করার ক্ষমতা তাঁদের ছিলনা। ‘জীবনের কতিপয় ক্ষেত্রে পারা যাবে’, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পারা যাবে না’ এই সব গোঁজামিলের কথা বলে তারা চলে গেলেন। পারলেন না বলে চলে গেলেন এবং মেজরিটি দেখিয়ে আলাদা একটা দল গঠন করলেন। সেই দল দাঁড়ালো না, দাঁড়ানোর কথা নয় – মার্কসবাদী কথাবার্তা বলতে বলতে মার্কসবাদ বিরোধী কার্যক্রম করলে কেউ টিকে থাকতে পারবে না।
পার্টির অনেক রকমের ংড়পরধষ নধপশরহম থাকতে পারে। বহু বামপন’ী পার্টি তো ভুল রাজনীতি করতে করতেই টিকে আছে। টিকে আছে মানে সত্যিকারের বিপ্লবী শক্তি নিয়ে এদেশের বুকে গড়ে উঠছে বা উঠবে সেই সম্ভাবনা নেই এবং সেটা বুজোর্য়ারা ভালই বুঝতে পারে। ফলে এমন কিছু পার্টি তারা রাখবে যারা বামপন’া ও মার্কসবাদের বুলি আওড়ে জনগণকে নবভড়ড়ষ করতে পারে, বিপথগামী করতে পারে। বুজোর্য়াদের স্বার্থবুদ্ধি, তাদের ইনটিউশন নিজেদের স্বার্থের পক্ষে তীক্ষ্ণ, তীব্র, প্রখর। সাধারণভাবে সর্বহারা শ্রেণী যতক্ষণ তার নিজের শ্রেণীর স্বার্থে বিপ্লবী পার্টি নির্মাণের সংগ্রামে নিখুঁত নিরবিচ্ছিন্ন না থাকবে, বুজোর্য়াদের সমান প্রখর ও তীড়্গ্ন শ্রেণী স্বার্থবোধ অর্জন করা অসম্ভব।
আমি বোঝাতে চাইছি, বুজোর্য়াদের ঘ্রাণ শক্তি অত্যনত্ম প্রখর। ঈষধংং এর কথা বলছি আমি। তারা তাদের স্বার্থ রক্ষায় প্রচ- ঘ্রাণশক্তির অধিকারী। কোথাও স্বার্থে আঘাত পড়ার সম্ভাবনা থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারে। শত্রুকে মুহূর্তের মধ্যে চিনতে পারে, চিহ্নিত করতে পারে। শত্রুর মধ্যে যে দোদুল্যমান, যে াঁষহবৎধনষব যাকে সে ভেঙে ফেলতে পারে তাকে চিনতে পারে। তারা সেইভাবে ক্রিয়া করে।
যাই হোক, কমরেডস্, কমরেড শিবদাস ঘোষ এর মতো এসব কথা, এসব চিনত্মা – সংস্কৃতিতে, নৈতিকতায়, মূল্যবোধে, মার্কসবাদী রাজনীতিতে এত ব্যাপকতা নিয়ে এত কার্যকরীরূপে কোনও মার্কসবাদী নেতা ইতিপূর্বে বলেন নি। বলেন নি মানে, এতখানি প্রয়োজনই তাঁদের হয়নি। কারণ এতখানি সংকটের মধ্যে তাঁরা পড়েননি।
বুজোর্য়া মানবতাবাদ আজকে যেভাবে সমপূর্ণ নিঃশেষ হয়ে গেছে, তখন পর্যনত্ম সমসত্ম ক্ষেত্রে নিঃশেষ হয় নি। স্বার্থপরতা আজ যে চরম ভয়ংকর রূপ নিয়েছে এসব কিছু দেখেননি অতীতের নেতারা। এগুলি দেখতে পেয়ে বিশ্বব্যাপী এবং নিজের দেশে একে কীভাবে মোকাবেলা করা যাবে, আদর্শের শক্তি, যুক্তির শক্তি, নৈতিকতার শক্তি কত উচুঁ মানে তুললে এটাকে মোকাবেলা করা যাবে তা মহান নেতা মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-স্ট্যালিন-মাও সে তুংয়ের সুযোগ্য ছাত্র হিসাবে কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছেন। এই ভাবে আর কেউ বলেন নি। ভাল করে পড়াশুনা করলে বুঝতে পারবেন। আগে কেউ বলেননি মানে, অতীতের নেতারা চিনত্মায়-ভাবনায় খাটো ছিলেন মনে করাটা ভুল, মূর্খতা। মার্কসবাদ একটা বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের এই নিয়ম। বিজ্ঞানের একটা তত্ত্ব যেমন স’ান ও কালের পাথর্ক্যের সাথে সাথে রহধফবয়ঁধঃব (অপর্যাপ্ত) হতে থাকে। কিন’ ভুল বা মিথ্যে হয়ে যায় না, বিফলে যায় না। বিজ্ঞানের কোনো আবিস্কারই অকার্যকর হয়নি। তার স’ানে তার কালে সেগুলি সত্য। আমাদের বর্তমান স’ান-কালে যা সত্য ভিন্ন একটি স’ানে-কালে তা অপর্যাপ্ত। যেমন মহাকাশে ঘর বানাবার জন্য যে নিয়মে ড্রয়িং করা হবে সেটি পৃথিবী থেকে ভিন্ন। এইখানে যেটা কার্যকরী ঐখানে তা কার্যকরী না। ওখানে যেটা কার্যকরী এখানে সেটা কার্যকরী না। কাজেই সব সময় সত্য হল আপেক্ষিক, সত্য মূর্ত, সত্য বিশেষ। সত্য তার স’ানে-কালে পড়সঢ়ষবঃব বা পরিপূর্ণ এবং ধফবয়ঁধঃব – এইভাবে বুঝতে হবে। এই হল শিবদাস ঘোষের কথা, তাঁর শিক্ষা।
শোধনবাদী আক্রমণ মোকাবেলার অভাবে যখন সমাজতান্ত্রিক শিবির ধসে যাচ্ছে সেসময়ে, মাকর্সবাদ-লেনিনবাদের কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করে শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন শোধনবাদী আক্রমণ ভরমযঃ করার উপায় কী। সেটা করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি ভারতের বুকে একটি বিকাশমান পার্টি গড়তে পেরেছেন। বিকাশমান – ংষড়ষিু, নঁঃ ংঃবধফরষু ঃযবু ধৎব মৎড়রিহম, ঐ পার্টিটা বাড়ছে। তারা স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। কী ভয়ংকর বিপরীতের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে, শক্তিশালী হচ্ছে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে। বিজ্ঞানের বিশ্লেষকদের জন্য এটা বোঝা সমস্যা নয়। অনেক গুরুগম্ভীর, অনেক ংবৎরড়ঁং বিষয়, এগুলি বুঝবার জন্য একটি উঁচু মানের সংস্কৃতি দরকার।
সবশেষে যে কথাটা বলতে চাই, কমরেড্স্ – মানা না মানার প্রশ্ন। যখনই ‘না মানা’টা শুরু হল, ‘না মানা’ মানে যে অথরিটি এখনও কার্যকরী, যাকে মেনেই সামনের দিকে এগুতে হবে তাকে না মেনে, তাকে ফবহু করে পতন শুরম্ন করল। দেখুন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন স্ট্যালিনকে ফবহু করে হয়েছে। স্ট্যালিনকে ফবহু করছে মানে হল লেনিনকে ফবহু করছে। কারণ স্ট্যালিন কে? স্ট্যালিন হলেন লেনিনবাদের ব্যাখ্যাকার। ডযধঃ রং খবহরহরংস? লেনিনবাদই যে সাম্রাজ্যবাদ-সর্বহারা বিপ্লবী যুগে মার্কসবাদ সেটা জগতকে শিখিয়েছেন স্ট্যালিন। লেনিন যে কথা বলে গিয়েছেন সেটা জগতকে পাল্টানোর জন্য কীভাবে বুঝতে হবে সেটা শিখিয়েছেন স্ট্যালিন। এই শেখানোর মধ্য দিয়ে নেতা হয়েছেন, শিক্ষক হয়েছেন, পথপ্রদর্শক হয়েছেন। মার্কসবাদের ভঁহফধসবহঃধষং তো মার্কস-এঙ্গেলসই দিয়ে গেছেন। লেনিনকে শুনতে হয়েছে, এসব কথা তো মার্কসই বলে গেছেন। আর স্ট্যালিনকে বলা হয়েছে, সবই তো লেনিনের কথা, তুমি আর কী বললে? এইভাবে অনেকেই ভুল বোঝাবার, বিভ্রানত্ম করার চেষ্টা করেছেন। কোনো কোনো নেতা আবার মার্কসবাদের ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন’ এগুলি সবই ভুল, তাই দাঁড়ায়নি। বরং লেনিন-স্ট্যালিনের যে ওহঃবৎঢ়ৎবঃধঃরড়হ বা বিশ্লেষণ সেটাই মার্কসবাদ-লেনিনবাদ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এই মহান নেতাদের ছাত্র হিসাবে শিবদাস ঘোষ একইভাবে তাঁর সময়ে যেসব সমস্যা দেখেছেন তাকে মোকাবেলা করেছেন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে সমুন্নত রেখেছেন। মার্কস এঙ্গেলসের সময়ে একটা বিপ্লবী পার্টির ধারণা এসেছে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালকে কেন্দ্র করে। এসেছে মানে হলো কোনো একটা দেশে বিপ্লবের জন্য ওনারা পার্টি তৈরী করতে পারেন নি। ওনারা কী করেছেন? ওনারা দেখিয়েছেন, বিপ্লবী পার্টি ছাড়া, বিপ্লব ছাড়া, সাম্যবাদ ছাড়া, সমাজতন্ত্র ছাড়া মানুষের মুক্তি নেই। কীভাবে পুঁজিবাদ অবক্ষয়ী সামাজিক ব্যবস’া এটা বুঝিয়ে তার ভিত্তিতে বিপ্লবী পার্টি করতে হবে একথা বুঝিয়েছেন। কিন’ বিপ্লবী পার্টি দেশে দেশে কীভাবে গড়তে হবে মার্কস এঙ্গেলেস সেটা বিসত্মারিত বলে যান নি। মার্কস-এঙ্গেলসের পরে লেনিন বিশেষ দেশের বিশেষ বিপ্লব ঘটাতে গিয়ে বুঝতে পেরেছেন যে মার্কস-এঙ্গেলস এর এই আদর্শ জগৎব্যাপী প্রয়োজন। তিনি এই আদর্শের কার্যকারিতা বুঝিয়েছেন। এখন তাকে কীভাবে বাসত্মবীকৃত করতে হবে, সেটা নিজেদের দেশের বুকে একটা বিপ্লবী পার্টি তৈরীর সংগ্রাম করতে গিয়ে বুঝেছেন। প্রত্যেক দেশে দেশে ন্যাশনাল বাউন্ডারির মধ্যে মধ্যে সব পার্টিকেই বিপ্লব করতে হবে। সেই বিপ্লবের লক্ষ্য আনত্মর্জাতিক, তার কন্টেন্ট আনত্মর্জাতিক, ফর্ম জাতীয়। এভাবে বিশ্ববিপ্লবের একটি ধারণা কমরেড লেনিন দিয়েছিলেন। আমি এ স্বল্প পরিসরে বিসত্মারিত বলতে পারবো না।
লেনিন বলেছেন যেহেতু মার্কসবাদ একটা বিজ্ঞান পরবর্তীকালে যারাই মার্কসবাদী বিপ্লবী রাজনীতি দেশে দেশে সংগঠিত করবে, বিপ্লব করবে তাদের কিন’ এই বিপ্লবী তত্ত্বকে ক্রমাগত বিকশিত করে উন্নত করত হবে। কমরেড স্ট্যালিন বলছেন যে, পার্টি সংক্রানত্ম ধারণা এ পর্যনত্ম যেটা কমরেড লেনিন ফবাবষড়ঢ় করিয়েছেন এটাই শেষ না, পড়হঃরহঁড়ঁংষু অবস’ার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত আরও বিকশিত করতে হবে। কমরেড শিবদাস ঘোষ তাকে আরও ফবাবষড়ঢ় করেছেন, আরও বহৎরপয করেছেন এবং আরও প্রাঞ্জল-বাসত্মব কার্যকরীভাবে বিকশিত করেছেন। এবং তিনি মার্কসবাদী বিপ্লবী রাজনীতিতে যৌথ নেতৃত্বের ধারণাকে এক নতুন মূর্ত রূপে জগতের সামনে এনেছেন। আপনারা বই পড়ুন, পড়লে বুঝতে পারবেন। কারণ মার্কসবাদ তো আপনার বোঝার জন্য, প-িতদের পা-ত্িযের জন্য নয়। প্রত্যেক কথা, প্রত্যেক শব্দ যদি বুঝিয়ে দিতে হয় তাহলে খুব অন্যায় কথা। আপনাদের পড়তে হবেই। পড়ে আপনারা সেই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে, তর্ক-বিতর্ক করতে আসবেন, বুঝ আরও উন্নত করবেন। সেই কারণে আমি বলছি আপনারা গভীরভাবে পড়াশুনা করলে বুঝতে পারবেন কমরেড শিবদাস ঘোষ কমিউনিস্ট পার্টি-সর্বহারা বিপ্লবী পার্টি সমপর্কে সমপূর্ণ নতুন কিছু কথা বলেছেন। যার আধারে দাঁড়িয়ে দুনিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলন করে যেতে হবে। এটা এজন্য বলছি কোনো একটি বিপ্লবী তত্ত্ব, যেটা বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদী তত্ত্ব, সেটা যখন আগের চিনত্মাকে আরও উন্নত, আরও বিকশিত ও সমৃদ্ধ করার জন্য আসে, সেটা গোটা বিশ্বের জন্য সার্বজনীন – ইউনিভার্সাল। কথাটা এরকম না যে, শিবদাস ঘোষের চিনত্মা ছাড়া দুনিয়া চলবে না। শিবদাস ঘোষ ছাড়া বিপ্লব হবে না! বিপ্লব করা যাবে না! এইভাবে তাচ্ছিল্য করে কথা বললে চলবে না। লেনিনের চিনত্মা ছাড়া বিপ্লব করবেন কীভাবে? মার্কসবাদ ছিল, কিন’ স্ট্যালিন বলছেন, লেনিনবাদ ছাড়া বিপ্লব করা যাবে না। লেনিনবাদ না বুঝলে দুনিয়ায় বিপ্লব হবে না। তো লেনিন সেই ব্যক্তি। সেই যুগে মার্কসের পরবর্তী সাম্রাজ্যবাদ-সর্বহারা বিপস্নবী যুগে লেনিনকে মানতেই হবে মাকর্সবাদী হলে। মার্কসবাদ মানেই হলো বিজ্ঞান। পরিপূর্ণ বিজ্ঞান। প্রকৃতি বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানের সকল নৎধহপয-গুলোকে পড়-ড়ৎফরহধঃব করে যে জেনারালাইজড্ বিজ্ঞানের জন্ম হয়েছে সেটাই মার্কসবাদ। ‘মার্কসবাদ’ কথাটা মার্কসের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। কিন’ মার্কসবাদ মানে হল বিজ্ঞান – দ্বন্দ্বমূলক বস’বাদী বিজ্ঞান।
তাহলে পরিপূর্ণ বিজ্ঞানের কোনো তত্ত্ব কেউ যদি ফবাবষড়ঢ় করিয়ে থাকে তবে দুনিয়ার সকলের জন্য তা ইউনিভার্সাল কার্যকরী। এটা মানতেই হবে। না মানলে কী বিপ্লব করতে পারবেন? প্রশ্ন তুলেছেন, ‘ঐ দেশে (ভারত) তো বিপ্লব হয় নি’। দেখুন, মার্কস তো বিপ্লব করতে পারেননি। তাহলে দুনিয়ার এতবড় নেতা হলেন কী করে? বিপস্নব না করেও দুনিয়ার বিপস্নবের জন্য কত বড় আদর্শকে এই মহান নেতা রেখে গেলেন। কাজেই তাচ্ছিল্য করবেন না। শিবদাস ঘোষ অমোঘ এবং কার্যকরী, একথা বুঝতে হবে কমরেডদের। অনুশীলন করলেই বুঝতে পারবেন, সংস্কৃতি থাকলে বুঝতে পারবেন। জীবন পাল্টানোর সংগ্রাম করলেই বুঝতে পারবেন কত বড় দরকারী আদর্শ এটি।
‘আমরা শিবদাস ঘোষের চিনত্মাধারার ভিত্তিতে গড়ে উঠি নি’ – প্রথম ওঁরা এই কথা বললেন, এখন আবার বলছেন – ‘না, কিছুতো ওনার কাছ থেকে শিখেছি’, কিন’ কি শিখেছেন সেটা কনক্রিটাইজ করে বলতে পারছেন না। কি শিখেছেন বলতে গেলে যদি ফাঁদে পড়ে যান! মহা মুশকিল। কমরেডরা যখন বলল, ‘আমরাতো গড়ে উঠেছি এইভাবে’, তখন বললেন, ‘না এইভাবে গড়ে উঠি নি’। তারপর দেখলেন যে এইভাবে বললে পুরো পার্টি খালি হয়ে যাবে – বেশি জোরে বললে শূন্য হয়ে যাবে। তখন বলছেন, ‘কিছু শিখেছি’। বুজোর্য়া স্বার্থ এমন এক জিনিস, যে এক মুহূর্তে বুঝতে পারে বিপদ। বিপদ বুঝতে পেরে তখন সামাল দেয়ার জন্য আবার গোঁজামিলের কথা শুরু করে দিল।
তেং শিয়াও পিং, মাওসেতুং কে না মানার মধ্য দিয়ে চীনের কী অবস’া করল? মাও সেতুংকে না মানার মধ্য দিয়ে চীন ধ্বংস হয়ে গেল, স্ট্যালিনকে না মানার মধ্য দিয়েই সোভিয়েত ইউনিয়ন ধ্বংস হয়ে গেল। তাহলে বোঝেন অথরিটি কাকে বলে? আমাদের একটা ছোট্ট পার্টি, সেটা ধসার জন্য কী লাগবে? সোভিয়েত পার্টির তুলনায়, চীনের পার্টির তুলনায় আমাদের পার্টি কী? অণু পরমাণুও তো না সেই অর্থে! অথরিটিকে অস্বীকার করে অত বড় বড় পার্টিগুলি ধসে গেছে।
চীনের নেতারা, দেঙ জিয়াও পিং-রা একসময় সামাল দেয়ার জন্য বলেছিলেন, মাও সেতুঙ-এর কথা ৭০ পারসেন্ট ঠিক, ৩০ পারসেন্ট ভুল! এ ধরনের গোঁজামিল করে যুক্তি এনারাও দিচ্ছেন। শিবদাস ঘোষ বলেছেন, চেতনার অনুন্নত মান হলো বিপদ। কমরেডদের অনুন্নত মানের সুযোগ নিয়েছেন। এসব আপনাদের বুঝতে হবে, বোঝাতে হবে, আপনাদের দায়িত্ব। আমি বলতে শুরু করেছি বলে কী সব আমার দায়িত্ব নাকি? আসুন, সবাই এগিয়ে আসুন! আপনাদের বলছি, সব সমর্থক-দরদী হয়ে আছেন! সমর্থক-দরদী নয়, কর্মী হয়ে যান, সংগঠক হয়ে যান, নেতা হয়ে যান। এই পার্টির আগে কর্মী হন। পার্টিতে ছেলে-মেয়ের আলাদা বিচার নেই, পার্টিতে বয়স্ক ও যুবকদের জন্য আলাদা মানদ- নেই, পার্টি হলো যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষের জায়গা। যোগ্যতা অনুযায়ী থাকবেন তাঁরা। একটা কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার এটাই তো যোগ্যতার ব্যাপার, গৌরবের ব্যাপার! জগতের সবচেয়ে বড় গৌরবের বিষয়! কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার হয়েই শুরু করম্নন রাজনীতি। সেটা হয়েই আনুগত্য নিয়ে কাজ শুরু করম্নন। আনুগত্য মানে নিয়মের শাসনের কাছে আনুগত্য, কোনো ব্যক্তির কাছে না। জগৎ পরিবর্তনের যে নিহিত নিয়ম সে মেনেই একজন বিজ্ঞানী তার উপরে ক্রিয়া করে, তাকে ধপপবষবৎধঃব করে, তাকে ফবাবষড়ঢ় করায়। এর মানে হলো, নিয়ম মানুন, নিয়ম বুঝে ক্রিয়া করম্নন। না মানার লোকই হলো ‘ারপঃরস ড়ভ হধঃঁৎধষ ষধং’ ি(প্রকৃতির অন্ধ নিয়মের শিকার)। মান্যতা মানেই হল জ্ঞানের প্রতি মান্যতা, স্বেচ্ছায় মান্যতা। কাজেই এখানে বড় ছোট কেউ নেই, সবাই আপনারা বিপ্লবী পার্টির কর্মী সংগঠক এবং লড়াই করতে করতে নেতা হয়ে উঠবেন। আপনাদের দায়িত্ব বিপ্লব করা এই দেশে। আমার চেয়ে কম বয়সী বলে সবাই খুবই ভাল করে পারবেন। চমৎকার করে পারবেন, এখনও সময় আছে। এই আহবান রাখতেই থাকবো।