বাইরে যখন উন্নয়নের মিছিল, দেশ জুড়ে যখন নারীর ক্ষমতায়নের গল্প তখনই কোনো এক তরুণীর চিৎকারে হয়তো বাতাস স্তব্ধ হয়ে পড়ছে, তার কান্নায় আক্রান্ত হচ্ছে সভ্যতার ছন্দ, তার বাঁচতে চাওয়ার ইচ্ছা নিশ্চিহ্ন হচ্ছে কোনো হিংস্র মানুষরূপী পশুর তীক্ষ্ম থাবায়। পৈশাচিকতার কত ঘটনা আমরা জেনেছি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে। মায়ের সামনে মেয়েকে, ভাইয়ের সামনে বোনকে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। এই অপকর্ম করেছিল পাকিস্তানি সেনা, বাঙালি রাজকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী। নারীর প্রতি এই অপমান সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। এমন বহু মূল্যে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা। কিন্তু স্বাধীন দেশেও কি সেই নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? হয়নি। কেননা ভূ-খন্ডের মালিকানা পরিবর্তিত হলেও পাল্টায়নি ব্যবস্থাটা। যে ব্যবস্থা নারীকে অপমান করে, ঘরে বন্দি রাখতে বলে, পণ্যসামগ্রী বানায় — সেই ব্যবস্থা পাকিস্তানেও ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশেও আছে। ফলে নারীর অপমান-অপদস্ত হবার অবস্থা নতুন নতুন মাত্রা নিয়ে হাজির হয়েছে। তাই তো এখন কেবল ধর্ষণ নয়, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নেয়ার মতো নৃশংস ঘটনা হর-হামেশা ঘটছে। মধ্যবয়স্ক পুরুষ প্রবৃত্তির লালসা মেটায় তিন বছরের শিশুর উপর। অনেক কষ্টে পাওয়া স্বাধীন দেশে নারীর চোখের জল আজও তাই মোছেনি। নারীর এই অপমান প্রশ্নবিদ্ধ করছে গোটা সামাজিক প্রক্রিয়াকে।
এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে সিলেটের শায়েস্তাগঞ্জে। শায়েস্তাগঞ্জের ব্রাহ্মণডোরা গ্রামের সায়েদ আলীর মেয়ে বিউটি আক্তারকে (১৪) গত ২১ জানুয়ারি বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায় বাবুল মিয়া ও তার সহযোগীরা। এক মাস আটকে রেখে বিউটিকে ধর্ষণ করে। এরপর বিউটিকে তার বাড়িতে রেখে পালিয়ে যায় বাবুল মিয়া। এর আগে ঘটে আরেকটি ঘটনা। ব্রাহ্মণডোরা ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত হয় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। যাতে অংশ নেয় বাবুল মিয়ার মা কলমচান বিবি এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ময়না মিয়ার স্ত্রী আছমা বেগম। নির্বাচনে কলমচান বিবি জেতেন। তখন থেকে ময়না মিয়া এর প্রতিশোধ নেবার সুযোগ খুঁজতে থাকে। সুযোগ এসে যায় যখন জানাজানি হয় কলমচান বিবির ছেলে বাবুল একটি মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। ময়না মিয়া বাবুলকে ফাঁসাতে বিউটিকে খুন করার পরিকল্পনা করে। ময়না মিয়া বিউটির বাবা সায়েদ আলীকে বোঝায় যে, বিউটি নষ্ট হয়ে গেছে। সে বেঁচে থাকলেই বরং সায়েদ আলীর অসুবিধা। সমাজের নানা কথা শুনতে হবে। মেয়ে হত্যার প্রস্তাবে রাজি হয় বাবা। এরপর গত ১৬ মার্চ ময়না মিয়া, সায়েদ আলী ও অপর এক ব্যক্তি মিলে বিউটিকে খুন করে এবং শায়েস্তাগঞ্জের হাওরে লাশ ফেলে দেয়।
না, এটা কোনো সিনেমা-উপন্যাসের কাল্পনিক গল্প নয়। পুলিশের কাছে ময়না মিয়া ও সায়েদ আলীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেই উঠে এসেছে এই ভয়াবহ রোমহর্ষক ঘটনাটির বর্ণনা। স্বাধীনতা, মানবতা, মনুষ্যত্ব এই শব্দগুলো যেন অপমানিত হয়ে ফিরে আসছে ১৪ বছর বয়সী কিশোরীর মুখের দিকে চেয়ে।
বিউটি আক্তারের হত্যাকান্ড প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে এ যাবৎকালের সমস্ত প্রতিষ্ঠিত ধারণাকে — ধর্মীয় মূল্যবোধ, পারিবারিক আবেগ, গণতান্ত্রিক চেতনা সবকিছু। সায়েদ আলী ধর্মভীরু মানুষ ছিলেন। বিউটি ছিল তার মেয়ে। পারেননি তিনি সেই মূল্যবোধ বা আবেগ দিয়ে বিউটিকে রক্ষা করতে। বাবুল মিয়া কিংবা ময়না মিয়া আমাদেরই চারপাশে বসবাস করা একেক জন। এদেশের আলো-বাতাসেই বড় হওয়া। কীভাবে তারা পারলো একমাস ধরে একটি মেয়েকে নির্যাতন করতে কিংবা নিজের রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য খুন করতে? এরপরও কী শুনতে হবে এ দেশ গণতান্ত্রিক? এদেশে আইনের শাসন আছে? আজ যদি বিউটির মতো কোনো কিশোরী এসে রাষ্ট্রের কর্তাদের সামনে বিউটির এমন পরিণতির জন্য প্রশ্ন করে, তারও এমন হবে কি না জিজ্ঞাসা করে — পারবেন কি তারা চোখ তুলে কথা বলতে? ন্যূনতম নৈতিকতা থাকলেও কেউ পারবে না। বিউটি আক্তারের লাশের ছবি যেন এই ব্যর্থ রাষ্ট্রটিরই একটি ভগ্ন প্রতিচ্ছবি।
বিউটি আক্তারের ঘটনাটিকে মুখোশ খুলে দিয়েছে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির। বাবুল মিয়া একমাস ধরে বিউটিকে আটকে রেখে নির্যাতন করলেও পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। বিচার হওয়া তো সুদূর পরাহত। এই বিচারহীনতার পরিবেশই এরকম অসংখ্য বাবুল মিয়ার জন্ম দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, গত ১৬ বছরে ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৪,৫৪১টি। এর মধ্যে মাত্র ৬০টি মামলায় দোষী ব্যক্তিরা শাস্তি পেয়েছে। এখনো নিষ্পত্তি হয়নি ৩,৩১২টি মামলা। যখন ৭৩ শতাংশ মামলার নিষ্পত্তি হয় না বছরের পর বছর, তখন তো স্বাভাবিকভাবেই অপরাধের মাত্রা বেড়ে চলে। নতুন নতুন বাবুল মিয়াদের জন্ম হয়। এর দায় কার?
হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ময়না মিয়া এদেশের চূড়ান্ত নোংরা অধঃপতিত রাজনীতির আরেক চরিত্র। যে ক্ষমতার জন্য মানুষ খুন করতেও দ্বিধা করেনা। সে এমন এক রাজনীতি করে যেখানে ক্ষমতায় যাবার জন্য বা টিকে থাকার জন্য যেকোন অনৈতিক কাজও জায়েজ। রাজনীতির প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সে একটি নিরাপরাধ মেয়েকেই কেবল খুন করেনি, মেয়ের বাবাকেও জড়াতে পেরেছে এমন চূড়ান্ত গর্হিত একটা কাজে। কতটা নীচ হলে এমন কুকর্ম করা যায়! ময়না মিয়ার মতো খুনীরা প্রতিনিয়ত লালিত-পালিত হয় এই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির ছায়াতলে।
বিউটি আক্তারের বাবাও তার ধর্মীয় নৈতিকতা দিয়ে মেয়েকে রক্ষা করতে পারেননি। এ সমাজ তাকে শিখিয়েছে ধর্ষিত একজন নারী মানে সে ‘নষ্ট মেয়ে’। ধর্ষণের জন্য ধর্ষক নয়, দায়ী ধর্ষিতা নিজেই। ধর্ষিতা একজন পাপী। সায়েদ আলী মেয়েকে খুন করে সেই পাপেরই প্রায়শ্চিত্ত করলেন যেন! বিবেক-মনুষ্যত্ববোধ জাগলো না, মেয়ের করুণ আর্তনাদও উপেক্ষা করতে পারলো সমাজের কটুবাক্য থেকে বাঁচতে। সায়েদ আলীর মতো চিন্তা করা মানুষ আমাদের সমাজে কি খুব কম?
বিউটি আক্তারের মৃত্যু অপরাধী করে গেল গোটা সমাজকে। এমন করুণ মৃত্যু প্রশ্ন করে গেল আমাদের ‘মানুষ’ নামের পরিচয়।