সন্ধ্যা সাতটা। দিনাজপুরের রাণীরবন্দর বাজার। বাজারের ঠিক উত্তর দিকটায় অগণিত আলু রাস্তায় পরে থাকতে দেখা যায়। সেখানে বিক্রেতার হাক-ডাক নাই। ক্রেতারও ভীড় ঠেলে চাহিদা মতো আলু কেনার চেষ্টা নেই। প্রথম দেখায় মনে হবে, আলু কিনতে বোধহয় আজকাল আর টাকা লাগে না! রংপুরের তারাগঞ্জের একজন আলুচাষী, তার ছোট্ট ছনের ঘরটির দিকে তাকালেই বোঝা যায়, চৈত্রের রুদ্র মূর্তি কতটা কঠোর হতে পারে। কোথাও যেন করুণার আভাস পর্যন্ত নেই। থাকবেই বা কেন! এ জীবনে দুঃখ যন্ত্রণার কোনো অন্ত নেই, সমাপ্তি নেই। ফুটফুটে তিনটি সন্তানের ব্যথাতুর চোখের ভাষাও অস্পষ্ট নয়। শৈশবেই তাদের জীবনে কঠিন বাস্তবতা নেমে এসেছে। ওই সংসারে কিন্তু আরও একজন আছে। পড়নের মলিন কাপড়ের মতোই মলিন তার মুখখানি। কেননা তার স্বামী যে আলুচাষী।
প্রতি বছর আলুর বাম্পার ফলন হয়। কিন্তু তা চাষীর জীবনে সুখ নয় কেবল দুঃখ-কষ্টই বয়ে আনে। উদয়াস্ত রক্ত জল করা শ্রম দিয়ে, এনজিও বা মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে নিজের সামান্য জমিতে বা বর্গা জমিতে আলু চাষ করে ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন উত্তরবঙ্গের অনেক কৃষক। কিন্তু উৎপাদনের খরচও তুলতে পারেন না। ক্ষোভে-দুঃখে জমিতেই আলু ফেলে আসেন চাষীরা। ধরিত্রীর অন্ন যোগানদাতাদের সিক্ত কন্ঠের করুণ আর্তনাদ শাসকদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। এ এক ভীষণ যন্ত্রণা। এত অপমান, লাঞ্ছনায় বিপন্ন হয়ে যাওয়া এ জীবনের প্রশ্ন তো একটাই, ‘আলুচাষীরা কি মানুষ’?
কথা হচ্ছিল জয়পুরহাটের একজন আলুচাষীর সাথে। বললেন, ‘আলুর বস্তা ছোট করা হয়েছে। এখন একেকটি বস্তায় ৫০ কেজি আলু ধরে। অথচ বস্তাপ্রতি কোল্ডস্টোরেজ ভাড়া ১৫০ টাকা-ই আছে’। অর্থাৎ বস্তাপ্রতি আলুর পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে কোল্ডস্টোরেজ ভাড়া আগের মতই রাখা হয়েছে। হাইকোর্টের এক রিটে কৃষকদের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে কোল্ডস্টোরেজে আলুর বস্তা ৫০ কেজি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে কিন্তু ভাড়া কমানোর ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি।
ব্যক্তি মালিকানাধীন কোল্ডস্টোরেজে সিন্ডিকেট ও মধ্যসত্ত্বভোগীদের দাপটে আলু চাষীরা আলু রাখতে পারেন না। কোল্ডস্টোরেজগুলো আগে থেকেই মালিকের দখলে থাকে। ফলে চাষীরা আলু রাখার জায়গা না পেয়ে সস্তা দরে তাদের কাছেই বিক্রি করে দেয়। বিভিন্ন এনজিও বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে চাষীরা যেসব সার, বীজ ও কীটনাশক কেনে, সেগুলো অনেকক্ষেত্রে নিম্নমানের হওয়ায় উৎপাদনে বিপর্যয় নেমে আসে। এই বছর রংপুরে নিম্নমানের বীজ ও ভেজাল কীটনাশকের কারণে উৎপাদন কম হয়েছে বলে অভিযোগ চাষীদের। উত্তরাঞ্চলে যখন ৫-১০ টাকা দরে আলু বিক্রি হচ্ছে তখন রাজধানীসহ দেশের শহরাঞ্চলে আলুর দাম কেজিপ্রতি ২০-২৫ টাকা। বাজার অব্যবস্থাপনার সুযোগ নিয়ে মধ্যসত্ত্বভোগীরা বিশাল অঙ্কের মুনাফা লুটছে। অন্যান্য সবজি ও রবিশস্যের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।
২০১৪ সালে আমাদের সংগঠন ‘সমাজতান্ত্রিক ক্ষেতমজুর ও কৃষক ফ্রন্ট’ এর আহ্বানে আলুচাষী সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। রাস্তা অবরোধ করে শত শত কৃষক দেশবাসীর বিবেকের কাছে এই প্রশ্নই রেখেছে, নিজের গায়ের বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে সমস্ত মানুষের আহার যোগায় যে কৃষক, দিনান্তে সেই কিনা থাকে উপবাসী? এ অন্যায় অবিচার আর কতদিন চলবে?
আন্দোলনের অর্জন হিসেবে- এ বছর জয়পুরহাট ও দিনাজপুরের আলুচাষীরা উৎপাদন খরচ পেয়েছে। আলু বিক্রি করে মণপ্রতি গড়ে ২৩-২৫ হাজার টাকা এসেছে। ‘ডায়মন্ড’ জাতের আলুতে সামান্য লাভও হয়েছে চাষীদের। ধারাবাহিকভাবে ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কৃষকদের আন্দোলন অব্যাহত আছে। আমাদের সংগঠন দাবি করে, হাট-বাজারে সরকারি ক্রয়কেন্দ্র খুলে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে আলু ক্রয় করতে হবে। যাতে মধ্যসত্ত্বভোগীরা এখান থেকে মুনাফা লাভের সুযোগ না পায়। এছাড়া কোল্ডস্টোরেজের ভাড়া কমিয়ে তা সরকারি উদ্যোগে পরিচালিত করা এবং সার, বীজ ও কীটনাশকের দাম কমানো।
পুঁজিবাদ মানুষকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে। উত্তরবঙ্গের আলুচাষীরাও এই ব্যবস্থার নিপীড়নের শিকার। একদিকে চাষীদের দুর্দশা অন্যদিকে এ থেকে ফায়দা লুটছে ব্যবসায়ী ও মুনাফাখোরেরা। কিন্তু আশার ব্যাপার হলো- আলুচাষীরা রাস্তায় নামছে। তারা জীবন থেকে এ শিক্ষাই নিয়েছে যে, সংগ্রাম-ই মানুষকে শক্তি দেয়।