Saturday, November 23, 2024
Homeফিচারআবারও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পাঁয়তারা

আবারও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পাঁয়তারা

fuel_cost-1

আবারও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো. ফয়েজউল্লাহ জানান, “শুধু শিল্প-কারখানা নয়, অন্যান্য শ্রেণির ব্যবহারকারীর গ্যাসের দর আনুপাতিক হারে বাড়বে।” (তথ্যসূত্র : ৪ মার্চ, দৈনিক প্রথম আলো) এর অর্থ সরকার জনগণকে নতুন করে ভোগান্তিতে ফেলতে চায়। সরকার গ্যাস খাতের সংকট মোকাবেলার নামে বিভিন্ন দেশ থেকে এলএনজি (তরুলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির পরিকল্পনা করেছে। এজন্য প্রাথমিকভাবে রাস গ্যাস কোম্পানির সাথে চুক্তির আওতায় দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস আমদানি হবে। যা আগামী ১৫ মে’র মধ্যে জাতীয় গ্রীডে যুক্ত হওয়ার কথা। এলএনজি টার্মিনালের মাধ্যমে তরল থেকে গ্যাসে রূপান্তরিত করে তা ব্যবহৃত হবে। এজন্য পেট্রোবাংলা এলএনজি রি-গ্যাসিফিকেশন করার জন্য সরকারের ঘনিষ্ঠ সামিট গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘সামিট এলএনজি টার্মিনাল কোম্পানি প্রা: লি:’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘অক্সিলারেট এনার্জির’ সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে।

বর্তমানে দেশে উৎপাদিত গ্যাসের দাম পড়ছে প্রতি হাজার ঘনফুট ২.২ ডলার। কিন্তু প্রতি হাজার ঘনফুট আমদানিকৃত এলএনজি’র দাম পড়বে ৭/৮ ডলার। এতে বছরে গ্যাস কেনা বাবদ খরচ হবে দেড় বিলিয়ন ডলার। সরকারের দাবি অনুযায়ী বেশি দামের গ্যাসের সাথে বিদ্যমান গ্যাসের দামের মূল্য সমন্বয় করতেই এ মূল্যবৃদ্ধি। পর্যায়ক্রমে ২০২৫ সালের মধ্যে আরও ৪০০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সমপরিমাণ এলএনজি আমদানির ব্যাপারে সরকার চুক্তি স্বাক্ষর করবে। (তথ্যসূত্র : ৪ মার্চ, দৈনিক প্রথম আলো)

আমদানিকৃত এলএনজি দেশে এলে শিল্পে প্রতি ঘনফুট গ্যাসের দাম হবে ১৪.৯০ টাকা। বর্তমানে ৭.৭৬ টাকা – যা প্রায় দ্বিগুণ। সিএনজি যার বর্তমান মূল্য প্রতি ঘনফুট ৩২ টাকা তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ৫১.৭০ টাকা। বাণিজ্যিক গ্যাসের দাম যা বর্তমানে ছিল প্রতি ঘনফুট ১৭.৪ টাকা তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ৩৫ টাকা। অন্যদিকে এক চুলা গ্রাহকের মাসিক বিল যা আগে ছিল ৭৫০ টাকা তা বেড়ে হবে ১০০০ টাকা এবং দুই চুলার গ্রাহকের যা আগে ছিল ৮০০ টাকা তা বেড়ে দাঁড়াবে ১০৫০ টাকা। (তথ্যসূত্র : ৯ মার্চ, দৈনিক প্রথম আলো)

এলএনজি আমদানির সরকারি সিদ্ধান্তের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, “সরকার যেভাবে এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা করছে তা আমাদের জ্বালানি ভারসাম্য ও অর্থনীতিতে বিরাট একটা আঘাত হয়ে দাঁড়াবে। … কিন্তু যেভাবে এই গ্যাস আসবে তা অতি উচ্চমূল্যের। এটা দেশে একটা বিরাট ‘প্রাইস শক’ (মূল্য দুর্ভোগ) ঘটাবে।”

প্রতিবার মূল্যবৃদ্ধির প্রাক্কালে সরকার বিশ্ববাজারের দামের সাথে সমন্বয়, ভর্তুকি, লোকসান কমানো, অপচয় রোধ ইত্যাদির অজুহাত দেখায়। কিন্তু এর পিছনের কথা সরকারের দুর্নীতি, ভুল জ্বালানি নীতি, জনগণের পকেট কেটে মুনাফা করার মনোভাব, ব্যবসায়ী পুঁজিপতিদের অবাধ মুনাফার সুযোগ করে দেয়া।

গ্যাস উৎপাদনের ১১ শতাংশ পাইপ লাইনের মাধ্যমে রান্নার কাজে সরবরাহ করা হয়। গ্রাহকদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণির। সে সময় পাইপ লাইনের গ্যাসের দাম বাড়িয়ে মূলত মানুষকে এলপিজি সিলিন্ডারের উপর নির্ভরশীল করার অপচেষ্টা চলে – যা এখনও অব্যাহত। বর্তমানে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবসা মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ীদের হাতে কুক্ষিগত। সরকার ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় এ হেন সিদ্ধান্ত নেয়, যা জনস্বার্থ বিরোধী। গত কয়েকবছরে দফায় দফায় বেড়েছে গ্যাসের দাম। যদিও গ্যাস খাত এখনো লাভজনক অবস্থায় রয়েছে।

গ্যাসের দাম বাড়লে পণ্যের প্রত্যক্ষ উৎপাদন খরচ ও পরোক্ষ পরিবহন খরচ বাড়বে – বাড়বে পণ্যের দাম। ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত খরচ তুলবেন কিন্তু শেষবিচারে ক্ষতিগ্রস্ত হবে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত জীবন। সরকারের ভুল জ্বালানি নীতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণ যেন আদালতে যেতে না পারে সেজন্য তৈরি করা হয়েছে ‘দায়মুক্তি আইন’ – যা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি বিশেষ বিধান ২০১০ নামে পরিচিত।

গ্যাস খাতে উন্নয়নের জন্য এ মুহূর্তে প্রয়োজন গ্যাস রপ্তানিমূলক সকল চুক্তি বাতিল, জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের কাজের সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ, জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন। স্থল ও গভীর-অগভীর সমুদ্রে নিয়মিত অনুসন্ধান জোরদার করা প্রয়োজন। সরকার যদি জাতীয় সক্ষমতার উপর ভিত্তি করে নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান ও উত্তোলনের উদ্যোগ নেয়, তবে এলএনজি আমদানির মতো ব্যয়বহুল প্রকল্প থেকে বেড়িয়ে আসা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেছেন, “দেশের স্থলভাগের ও সমুদ্রসীমায় জ্বালানি অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়ানো হলে এলএনজি আমাদানি দরকার হত না। আমদানির ফলে জ্বালানির দাম বাড়তে থাকলে অর্থনীতি ও জনজীবনের সবক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়বে।’ (তথ্যসূত্র : ৯ মার্চ ’১৮, দৈনিক প্রথম আলো)

সামনে জাতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচনের জন্য সরকারের প্রচুর অর্থ প্রয়োজন। সরকার একদিকে যেমন মূল্যবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে জনগণের পকেট থেকে সরাসরি অর্থ কেড়ে নিতে চায়, অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের লুটপাটের সুযোগ করে দিয়ে বিনিময়ে লুটের টাকার ভাগ পেতে চায়। সম্প্রতি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কথা বলে নতুন করে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। এতে প্রতি লিটার কেরোসিনে ১১ টাকা, ডিজেলে ৭ টাকা ও ফার্নেস অয়েলে ১৩ টাকা বাড়াতে বলেছে। (৫ এপ্রিল ’১৮, দৈনিক বণিক বার্তা) এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা। শেষ করছি প্রথম আলোর অনলাইন পেজে একজন পাঠকের মন্তব্য দিয়ে – “জীবন দুর্বিসহ। দয়া করে আমাদের কাছ থেকে আর অর্থ কেড়ে নিয়েন না।”

সাম্যবাদ এপ্রিল ২০১৮

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments