Saturday, November 23, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - এপ্রিল ২০১৮এই ‘উন্নয়নশীল’ লইয়া আমরা কী করিব?

এই ‘উন্নয়নশীল’ লইয়া আমরা কী করিব?

poverty1
গ্রাম বাংলার একটি লোককাহিনী সম্ভবত সবারই জানা। সেই যে এক জোলা, কাজকর্ম কিছু করে না। তাকে তার বউ পাঠাল বাজারে ডিম বিক্রি করতে। জোলা ডিমের ঝাঁকা মাথায় নিয়ে বাজারে যেতে যেতে ভাবছে এই ডিম বিক্রি করে সে আরো ডিম কিনবে। তারপর সেই ডিম ফুটিয়ে তার অনেক মুরগি হবে। সেই মুরগিগুলো অনেক ডিম দেবে। এভাবে তার খামার অনেক বড় হবে। মুরগির খামার থেকে গরু-ছাগলের খামার হবে। তার বাড়িতে পাকা দালান উঠবে। সে খাটের উপর শুয়ে শুয়ে পা নাচাবে আর বউকে আদেশ দেবে। বউ যদি কথা না শোনে তাহলে দেবে এক লাথি। ব্যস। সেই কল্পনায় বিভোর হয়ে জোলা যেই লাথি চালালো, মাথায় থাকা ডিমের ঝাঁকা মাটিতে পড়ে সব ডিম গেল ভেঙে।

আমাদের অবস্থা অনেকটা ওই জোলার মতো। স্বাধীনতার পর যে সময় দেশের অর্থনীতি, বিশেষত ব্যাংকিং খাত সবচেয়ে সংকটময় সময় পার করছে তখন আমরা মহাসমারোহে ৭ দিন ধরে ‘উন্নয়নশীল’ খেতাবের উৎসব করেছি, জনগণের টাকা খরচ করে। যদিও এই ‘উন্নয়নশীল’ স্বীকৃতি আসার জন্যে আমাদের ২০২৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর এখানেই শেষ নয়। তার পরের তিন বছর, অর্থাৎ ২০২৭ সাল পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে একটি কৌশলপত্র তৈরি করে বাংলাদেশ তা বাস্তবায়ন করবে। তবেই জাতিসংঘের ঘোষণা ও মানদ- অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাবে।

২০২৪ সালে গিয়ে আমরা যে স্বীকৃতি পাব তার জন্য এরই মধ্যে জনগণের টাকা খরচ করে প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনা, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আতশবাজি, হাতিরঝিলে আলোকসজ্জাসহ জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সপ্তাহব্যাপী বহু আয়োজন করা হয়েছে। জাতীয় স্টেডিয়ামের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রের ৫৭টি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অধীনস্থ দপ্তরের কর্মকর্তা, কর্মচারীরা ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে শোভাযাত্রা করে যোগ দিয়েছেন। এসব শোভাযাত্রায় স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদেরও পথে নামানো হয়েছিল।

উন্নয়নশীল দেশ আসলে কী?
২০১৫ সালের ১ জুলাই বিশ্বব্যাংক একটি ঘোষণায় প্রকাশ করেছে যে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। আর গত মার্চ মাসে জাতিসংঘের এক ঘোষণা থেকে আমরা জানতে পারি যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করেছে।

জাতিসংঘের হিসাবে বিশ্বে তিন ধরনের দেশ রয়েছে – উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত (এলিডিসি)। জাতিসংঘ হিসাবটি করে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা বা সংকট সূচক অনুযায়ী।

এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের হিসাব ভিন্ন। মাথাপিছু মোট জাতীয় আয় দিয়ে বিবেচনা করা বিশ্বব্যাংকের ভাগগুলো হলো – নিম্ন আয়, মধ্যম আয় এবং উচ্চ আয়ের দেশ। মধ্যম আয় আবার দুই রকম – নিম্ন-মধ্যম আয় এবং উচ্চ-মধ্যম আয়।

মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৪৫ ডলার বা তার নিচে হলে সেই দেশগুলো বিশ্বব্যাংকের বিবেচনায় নিম্ন আয়ের দেশ। মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার পর্যন্ত হলে সেগুলো মধ্যম আয়ের দেশ। আয় ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে ৪ হাজার ১২৫ পর্যন্ত হলে তা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ, আর ৪ হাজার ১২৬ থেকে ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার পর্যন্ত হলে সেটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ। মাথাপিছু জাতীয় আয় ১২ হাজার ৭৩৬ ডলারের চেয়ে বেশি হলেই তখন দেশটি উচ্চ আয়ের দেশ হিসাবে গণ্য হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬১০ ডলার। সুতরাং এ হিসাবে বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের মধ্যে আছে। ২০২৮ সালের মধ্যে কি আমরা এই মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ১২৬ ডলারে নিয়ে যেতে পারব?

জাতিসংঘের মানদ-
জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি সামাজিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সূচক তৈরি করে থাকে। তারই ভিত্তিতে স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশ Ñ তিন শ্রেণিতে ভাগ করে সিডিপি। বাংলাদেশসহ ৪৮টি দেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় আছে। প্রতি তিন বছর পরপর জাতিসংঘের সিডিপি এ তালিকায় থাকা দেশগুলোর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে।
প্রশ্ন হলো, বিশ্বব্যাংক বা জাতিসংঘ এই যে উন্নয়নের সূচকগুলো নির্ধারণ করে এবং পরিমাপ করে সেগুলো কি সমালোচনার ঊর্ধ্বে? কোনোভাবেই নয়। বিশেষত মাথাপিছু আয়ের হিসাবটা। একজন দরিদ্র রিকশাচালক, পৃথিবীর সবচেয়ে কম মজুরি পাওয়া গার্মেন্ট শ্রমিক কিংবা ফসলের ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত কৃষকের আয় আর ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে লোপাট করে দেওয়া কিংবা শত শত গার্মেন্ট শ্রমিককে ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিতকারী এবং রাষ্ট্রীয় বহু সুবিধা ভোগকারী মালিকের আয়কে এক কাতারে দাঁড় করানোর তাৎপর্য কী?

মেকাপের নিচে
আমাদের ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে অনেকটা মেকাপের মতো যা দিয়ে আমাদের চেহারার কুৎসিত দিকটাকে আড়াল করা হয় মাত্র। এই মেকাপের একটি হলো মাথাপিছু গড় আয়।

সিপিডির এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে গত ছয় বছরে যখন জিডিপি বাড়ছে তখন সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয় বেড়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা, আর সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে ১০৫৮ টাকা। অর্থাৎ মাথাপিছু আয়ের এই সূচকটি আসলে উন্নয়ন, আইনের শাসন, মানুষের ভালো থাকা, খারাপ থাকা এসবের কিছুই বোঝায় না।

১৬ কোটি মানুষের দেশে ঠিক কতজন মানুষ ১ হাজার ৬১০ ডলার আয় করেন? আর শুধু আয় তো মানুষের জীবনের অপরাপর চাহিদাগুলোর নিশ্চয়তা দেয় না। বিভিন্ন গবেষণা ও অনুসন্ধান থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে গত চার বছরে এদেশে ধর্ষণে শিকার হয়েছে ১৭ হাজার নারী ও শিশু। এখানে প্রতিদিন বিউটি-তনু-পূজাদের জীবন ও সম্মান আমাদের সামনে খবর হয়ে আসে। আন্তর্জাতিক একটি জরিপে ঢাকা পৃথিবীর সপ্তম বিপজ্জনক শহর। যৌন সহিংসতায় ঢাকার অবস্থান চতুর্থ। ২০০২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যাসংশ্লিষ্ট মামলাগুলোর ৯৭ শতাংশেরই কোনো সাজা হয়নি। ‘সুষ্ঠু তদন্ত’, ‘দ্রুত তদন্ত’, ‘সুষ্ঠু আইনি প্রক্রিয়া’ ইত্যাদি প্রায় সব কটি সূচকেই বাংলাদেশের স্থান নিচের দিকে।

‘নাগরিক নিরাপত্তা’র বেলাতেও বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩টি দেশের মধ্যে ১০২। প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় মরছে গড়ে প্রায় ২০ হাজার মানুষ। বছরে গড়ে ৭০০ শ্রমিক নিহত হচ্ছেন, আহত হচ্ছেন ১ হাজার ৩০০ জন।

‘সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারে’ বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে! সামগ্রিকভাবে ‘আইনের শাসনে’ ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০২। খেলাপি ঋণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ‘নম্বর ওয়ান’! নয় বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে তিন গুণ।

পরিবেশ সুরক্ষায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৯! ভয়াবহ ক্ষতিকর সালফার ডাই-অক্সাইড বা কার্বন মনো-অক্সাইড নির্গমনেও ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোতে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম আর সিসার দূষণ ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা বলছে, ঢাকায় সিসাদূষণের শিকার ছয় লাখ মানুষ (বেশির ভাগই শিশু) এবং দেশের ১ কোটি ২৭ লাখ মানুষের দেহে অস্বাভাবিক কোষের বৃদ্ধি (অর্থাৎ ক্যান্সার জাতীয় রোগ) ঘটছে। এ ছাড়া পরপর কয়েক বছর ধরেই ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে বসবাস-অনুপযোগী শহরগুলোর মধ্যেও অন্যতম শীর্ষে।
[তথ্যসূত্র : সত্যিই সেলুকাস, এ এক অদ্ভুত উন্নয়নের দেশ! – মাহা মির্জা; ২ এপ্রিল ’১৮/ উন্নয়ন, দুর্নীতি ও জিডিপি : একসঙ্গে বাড়ার রহস্য কী – মাহা মির্জা, ৩ এপ্রিল ’১৮; প্রথম আলো]

এই উন্নয়ন লইয়া আমরা কি করিব?
বঙ্কিমচন্দ্রের হাত দিয়ে বাংলা সাহিত্যে একটি বাক্য অমরত্ব লাভ করেছে : ‘এ জীবন লইয়া কি করিব?’ এই বাক্যের বহু অনুকরণ হয়েছে, তবু এর উপযোগিতা শেষ হয়নি। আমাদেরও বলতে ইচ্ছে হয়, ‘এই উন্নয়ন লইয়া আমরা কি করিব?’ এই দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হোক বা উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হোক তাতে কি এদেশের সাধারণ মানুষ, নারী-শিশু, কৃষক-শ্রমিক, পাহাড়-সমতলের মানুষের জীবনের কোনো পরিবর্তন ঘটছে? বা অদূর ভবিষ্যতে আদৌ ঘটবে কি?

সাম্যবাদ এপ্রিল ২০১৮

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments