সর্বহারা শ্রেণীর মহান নেতা ও শিক্ষক, বিপ্লবী দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্কসের দুইশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী) এর উদ্যোগে ৫ মে ২০১৮ বিকেল সাড়ে ৪টায় তোপখানা রোডস্থ শিশু কল্যাণ পরিষদ মিলনায়তনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় আলোচনা করেন বাসদ (মার্কসবাদী)’র সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। সভাটি পরিচালনা করেন বাসদ (মার্কসবাদী)’র কেন্দ্রীয় কার্য পরিচালনা কমিটির সদস্য কমরেড আলমগীর হোসেন দুলাল ও সভাপতিত্ব করেন কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী।
সভায় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “কার্ল মার্কস একদিকে ছিলেন একজন জ্ঞানসাধক; দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনীতি ও অর্থনীতিকে তিনি বিশ্লেষণ করে মানব ইতিহাসের গতিপথ নির্দেশ করেছেন আবার একইসাথে তিনি ছিলেন একজন সংগঠক। তিনি সর্বহারা আন্তর্জাতিক গড়ে তুলেছেন। একই চরিত্রে এই দু’য়ের সমন্বয় ইতিহাসে বিরল। তিনি সেই বিরল সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। একইসাথে তিনি ছিলেন একজন মানবিক মানুষ। নিজের যে গুণকে তিনি শ্রেষ্ঠ মনে করতেন তা হল তাঁর সরলতা। মার্কসের সমাধিপাশে এঙ্গেলস বলেছেন, মার্কস হলেন তাঁর যুগের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ।
মার্কস দেখালেন কিভাবে সমাজ বিকাশের গতিপথে পুঁজিবাদ এসেছে, উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে কিভাবে সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছে। রাষ্ট্র ও পার্টি প্রশ্নে কার্ল মার্কসের চিন্তাকেও আমাদের ভালভাবে বুঝতে হবে। কার্ল মার্কসের এই চিন্তাকে পরবর্তীতে লেনিন আরও উন্নত করেছেন। কার্ল মার্কসের শিক্ষার ভিত্তিতে লেনিন রাশিয়ায় বিপ্লব সংগঠিত করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম হয়েছে। আমাদের এ উপমহাদেশে কেন বিপ্লব সংগটিত হলনা তা আমাদের অনুসন্ধান করা দরকার।”কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর কী ভুলের কারণে বিরাট আত্মত্যাগ ও অপরিসীম চেষ্টা ব্যর্থ হল সেসব সম্পর্কে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আলোচনা করেন। তিনি দেখান যে, আমাদের দেশ ও গোটা বিশ্বে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কারণে মানুষ কিভাবে শোষিত-নিপীড়িত হচ্ছে। মনুষ্যত্ব-মানবিকতা কোথায় নেমে যাচ্ছে। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া ভিন্ন কোন পথ নেই।
সভায় কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী বলেন, “মানুষের ইতিহাসে কার্ল মার্কসই সর্বপ্রথম সমাজবিজ্ঞান ও প্রকৃতিবিজ্ঞানের নানান শাখা হতে বস্তুজগৎ এবং সমাজ-সম্পর্কিত বিশেষ জ্ঞানসমূহের একীভূতকরণ ও সাধারণীকরণের প্রক্রিয়ায় একটি বৈজ্ঞানিক দর্শন হিসেবে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এটি কেবল বস্তুজগৎ এবং সমাজবিকাশের নিয়ম ব্যাখ্যাই করেনি, বরং পৃথিবীকে পরিবর্তনের রূপরেখা প্রদান করেছে। মার্কস দেখালেন যে, এ পর্যন্ত অবস্থিত সকল সমাজের ইতিহাসই শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। অভ্যন্তরে বিপরীতের এই সংঘাতের মীমাংসার মধ্য দিয়েই সমাজ এগিয়ে চলে, পুরোন সমাজ ভেঙে গিয়ে একটি নতুন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। এ নিয়মেই ধনতন্ত্রকে নিঃশেষ করে একটি নতুন সমাজব্যবস্থা, অর্থাৎ সমাজতন্ত্র গড়ে উঠবে যা সর্বহারার নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমেই কেবল হতে পারে।”
তিনি আরো বলেন, “প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রগতি সত্ত্বেও পুঁজিবাদের প্রাথমিক নিয়মগুলো যা মার্কস আবিষ্কার করেছেন তা এখনও ক্রিয়াশীল। পুঁজিবাদীরা এখনও শ্রমশক্তি দ্বারা সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করে। ফলে পুঁজিবাদ যতদিন পুঁজিবাদ রয়ে যাবে, ততদিন শ্রমিকরা শোষিত হতে থাকবে এবং পুঁজি ও শ্রমের দ্বন্দ্ব অমীমাংসেয় মূল দ্বন্দ্ব হিসেবে থেকে যাবে। সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনই এই দ্বন্দ্বের নিরসন ঘটানোর একমাত্র ইতিহাস নির্ধারিত পথ। সময়ের সাথে সাথে সমস্যার চরিত্রও বদলায়, আর এর যথাযথ উপলব্ধি ঘটানো সম্ভব কেবল পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে মার্কসবাদের সৃজনশীল প্রয়োগ ও বিকাশের মাধ্যমেই।”
কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী দেশে দেশে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা কী কী সমস্যা সৃষ্টি করছেন তা দেখান। তিনি বলেন, “আমাদের দেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটা ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম হয়ে আছে। দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিরা আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি সমর্থন দিয়ে এখনও বহাল রেখেছে। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে দরকার বামপন্থীদের নেতৃত্বে ব্যাপক গণআন্দোলন। অথচ বামপন্থীদের অনেকেই আজ একটি-দুটি সিটের আশায় আওয়ামী লীগের দরজায় গিয়ে হাত পাতছেন। মুখে বিপ্লবের কথা বলা ও কাজে এই আচরণ করা খুবই দুঃখজনক। বামপন্থীদের বুঝতে হবে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একের পর এক গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলা ভিন্ন এই অবস্থা থেকে মুক্তির অন্য কোন পথ নেই। মহান কার্ল মার্কসের জীবন থেকে লড়াইয়ের এই শিক্ষা নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।”
সর্বহারা আন্তর্জাতিক সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে আলোচনা সভা শেষ হয়। সভা শেষে মার্কস এর ওপর রচিত গান ও ইন্টারন্যাশনাল পরিবেশন করে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের শিল্পীরা।