গত ৬ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের রাষ্ট্রীয় বাজেট উত্থাপন করলেন অর্থমন্ত্রী। সরকারি মহল ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস’ার পড়্গ থেকে বলা হচ্ছে – নির্বাচনের আগে ভোটারদের খুশি করতে এবার না কি জনতুষ্টির বাজেট করা হয়েছে। আসলেই কি এই বাজেট জনকল্যাণমূলক? এত বড় বাজেটের বাসত্মবায়নযোগ্যতা নিয়ে এবং এত রাজস্ব আদায় হবে কি না তা নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেেছন। বিপুল বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার বিশাল অংকের ঋণ নেবে। এর ফলে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণ কমে যাবে বলে অনেক অর্থনীতিবিদ আশংকা ব্যক্ত করেছেন। এসবই বাজেটের কিছু প্রায়োগিক দিক, কিন’ মূল বিবেচ্য হওয়া দরকার – এই বাজেটের মাধ্যমে জনসাধারণ কি উপকৃত হবে, না কি প্রচলিত লুটপাট-বৈষম্যের অর্থনীতিই অব্যাহত থাকবে? বাজেটের চরিত্র বিশেস্নষণ করতে গেলে প্রথমেই দেখা দরকার এ বাজেট কোন্ প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে এবং কোন্ প্রক্রিয়ায় এ বরাদ্দ বন্টিত হবে। বাজেট প্রণয়ন ও বাসত্মবায়ন প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ ও জবাবদিহি নেই বললেই চলে, পুরো প্রক্রিয়াটিই আমলাতান্ত্রিক ও দুর্নীতিগ্রসত্ম। দ্বিতীয় বিবেচ্য বিষয় হল, সরকারি রাজস্বের প্রধান যোগানদাতা কারা, পড়্গানত্মরে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের সুফল মূলত কাদের ঘরে যায়। তৃতীয়ত, বিভিন্ন খাতে বাজেট পরিকল্পনার মাধ্যমে যে রাষ্ট্রীয় নীতি প্রতিফলিত হয়েছে তা কোন্ শ্রেণীর স্বার্থে।
২,২২,৪৯১ কোটি টাকার বাজেটে অনুন্নয়নমূলক ব্যয় ধরা হয়েছে ১,৩৪,৪৪৯ কোটি টাকা, আর উন্নয়নমূলক ব্যয় ৭২,২৭৫ কোটি টাকা। কর ও অন্যান্য খাত থেকে প্রাপ্ত আয় ও ব্যয়ের হিসাবকেই ‘রাজস্ব বাজেট’ বলা হয়। এর আরেক নাম ‘অনুন্নয়ন বাজেট’। কেন একে অনুন্নয়ন বাজেট বলে? কারণ সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং সরকার পরিচালনার অন্যান্য খরচ, ঋণের সুদ পরিশোধ এই খাতের অধীনে হয়ে থাকে। আরেকটু সহজ করে বললে আমাদের মন্ত্রী-এমপিদের বেতন-ভাতা, তাদের বাড়ি-গাড়ি, পিয়ন-দারোয়ান-বাবুর্চি, বিদেশ ভ্রমণ, চিকিৎসা ইত্যাদি যাবতীয় খরচ এই খাত থেকে করা হয়। বাজেটের দ্বিতীয় অংশটি হল ‘উন্নয়ন বাজেট’। সরকার আগামী এক বছরে যে সকল উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে, যেমন – নতুন স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল নির্মাণ, সড়ক-ব্রীজ-কালভার্ট নির্মাণ ইত্যাদি প্রকল্প বাসত্মবায়নের জন্য তার খরচ নির্বাহের হিসাবকেই উন্নয়ন বাজেট বলা হয়। বাংলাদেশের মত পশ্চাৎপদ দরিদ্র দেশে শিল্পায়ন, কৃষি উন্নয়ন, অবকাঠামো নির্মাণ, শিড়্গা-স্বাস’্যসেবার প্রসার ইত্যাদি প্রয়োজনে বিপুল সরকারি বিনিয়োগ দরকার। ফলে, উন্নয়ন বাজেটের পরিমাণ বেশি হওয়া উচিত, কিন’ বাংলাদেশে সাধারণত বাজেটের বড় অংশই হল অনুৎপাদনশীল রাজস্ব বাজেট। এই অর্থবছরেও উন্নয়ন বাজেট মোট বাজেটের ৩২% মাত্র। তাও পুরো বাসত্মবায়ন হবে না, অতীতের অভিজ্ঞতায় নিশ্চিতভাবেই তা বলা যায়। অর্থবছরের শেষ দিকে এসে তাড়াহুড়ো করে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ খরচ করার নামে বাসত্মবে লাগামছাড়া লুটপাট-অপচয় চলে।
এবারের বাজেটে মোট ব্যয় ২,২২,৪৯১ কোটি টাকা, রাজস্ব আয়ের লড়্গ্যমাত্রা ১,৬৭,৪৫৯ কোটি টাকা, অর্থাৎ ঘাটতি ৫৫,০৩২ কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি মেটাতে আগামী অর্থবছরে সরকারকে ৩৩,৯৬৪ কোটি টাকা অভ্যনত্মরীণ উৎস থেকে ঋণ নিতে হবে। অন্যদিকে আগামী অর্থবছরে ২৩,৭২৯ কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
আগামী বাজেটে অনুদানসহ রাজস্ব পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকছে ১,৭৪,১২৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১,৬৭,৪৫৯ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়া এবং বিদেশি অনুদান ৬,৬৭০ কোটি টাকা। তিন ধরনের সংগ্রহের মধ্যে আগামীবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত করব্যবস’া থেকে ১,৩৬,০৯০ কোটি টাকা, এনবিআর-বহির্ভূত করব্যবস’া থেকে ৫,১২৯ কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত প্রাপ্তি বাবদ ২৬,২৪০ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
এনবিআর কর্তৃক আদায়কৃত করের মধ্যে প্রত্যড়্গ কর অর্থাৎ ব্যক্তি আয়কর ও কোম্পানি কর থেকে আসবে ৩৫.৫% রাজস্ব। পড়্গানত্মরে মূল্য সংযোজন কর ৩৬.৭%, আমদানি শুল্ক ১০.৮%, সম্পূরক শুল্ক ১৫.৩% ও অন্যান্য কর ১.৭%। অর্থাৎ মোট পরোড়্গ করের অংশ ৬৪.৫%, যা শেষপর্যনত্ম সর্বসত্মরের জনগণ পরিশোধ করবে। আরো চুলচেরা হিসাব করলে, এনবিআর বহির্ভূত কর ও কর বহির্ভূত প্রাপ্তি সহ মোট রাজস্ব আয় ১,৬৭,৪৫৯ কোটি টাকার মধ্যে ৪৮,২৯৭ কোটি টাকা অর্থাৎ মাত্র ২৮.৮% আসবে ধনী লোকের কর থেকে। বাকী অর্থের যোগান দেবে সাধারণ মানুষ। বিপুল বাজেট ঘাটতি পোষানোর জন্য নেয়া দেশি-বিদেশি ঋণ ও তার সুদ এদেশের জনগণকেই পরিশোধ করতে হবে। গতবারের চাইতে এবারের বাজেটে আজস্ব আদায়ের লড়্গ্যমাত্রা প্রায় ২৮,০০০ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে কর তেমন বাড়ানো না হলেও করভিত্তি সম্প্রসারণের নামে এই বাড়তি অর্থ আদায়ের বোঝা প্রধানত সাধারণ মানুষের ঘাড়েই চাপানো হবে।
প্রধানতঃ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ বরাদ্দের বেলায় এমন সব খাতকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে যার সাথে জনকল্যাণের কোন সম্পর্ক নেই। এবারের বাজেটের সর্বোাচ্চ বরাদ্দ জনপ্রশাসন খাতে ১৪.৪%, এর পরই সুদ পরিশোধ ১২.৫%। প্রতিরড়্গা খাতে বরাদ্দ ৬.৫%, অথচ ১৫ কোটি মানুষের স্বাসে’্যর জন্য বরাদ্দ ৪.৩% অর্থ। প্রতিরড়্গা (৬.৫%) এবং জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা (৪.৭%) খাতের সম্মিলিত বরাদ্দ কৃষি খাতে বরাদ্দ (৭.৯%)-এর চাইতে বেশি। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ৯.৩%, বিবিধ ব্যয় খাতে ৮.৩% বরাদ্দ রাখা হয়েছে আসন্ন নির্বাচনী বছরকে মাথায় রেখে।
এবারের বাজেটকে অভিনন্দন জানিয়েছে এফবিসিসিআই, বিজ্িমইএ, বিকেএমইএসহ ব্যবসায়ী ও মালিকদের বিভিন্ন সংগঠন। কারণ শিল্পপতিদের রপ্তানি সহায়তার জন্য ২৫৯২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, বিভিন্ন খাতে নতুন বিনিয়োগের জন্য ট্যাক্স হলিডে অব্যাহত থাকবে, শেয়ারবাজার চাঙ্গা করার নামে নানা কর প্রত্যাহার করা হয়েছে। কালো টাকা সাদা করার সুবিধা চালু রেখে লুটপাটের অর্থনীতিকেই উৎসাহিত করা হয়েছে। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের মুনাফা বাড়াতে পস্নট ও ফ্ল্যাট কিনলে টাকার উৎস জানতে চাওয়া হবে না বলে ঘোষণা করা হয়েছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানী শুল্ক ৩% থেকে কমিয়ে ২% , মধ্যবর্তী কাচামালের শুল্ক ১২% থেকে ১০% করা হয়েছে। চামড়া শিল্পের বিভিন্ন উপকরণের আমদানী শুল্ক ১২% থেকে কমিয়ে ৫%, সুপার শপ প্রসারে ৩০% সম্পূরক শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। বসুন্ধরা গ্রম্নপসহ দেশি নিম্নমাানের কাগজশিল্পের বাজার নিশ্চিত করতে সংবাদপত্রে ব্যবহৃত বিদেশি নিউজপ্রিন্টের আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ওভেন কাপড় আমদানীর শুল্ক ৪৫% থেকে কমিয়ে ২০%, সোয়েটারের সুতা তৈরীর কাচামাল আমদানীর উপর ৫% শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে।
দেশে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও আনত্মর্জাতিক বাজারে মূল্যহ্রাসের ফলে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে সরকারি হিসাবে বর্তমানে ৮%-এর মত। অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৭%-এ নামিয়ে আনার টার্গেট ঘোষণা করেছেন। প্রথমত, এই টার্গেট বাসত্মবায়নের সম্ভাবনা ড়্গীণ। কারণ সরকার আইএমএফ-এর কাছ থেকে নেয়া ঋণের শর্ত অনুযায়ী জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়াবে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গ্যাসভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ পস্ন্যান্ট নির্মাণে দীর্ঘসূত্রিতা করে ব্যয়বহুল রেন্টাল পাওয়ার পস্ন্যান্ট নির্ভরতার কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়বে। ফলে উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বাড়বে। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের। বাজেট বক্তৃতায় চাল.ডাল, পিঁয়াজসহ কিছু পণ্যের শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধা অব্যাহত রাখা ও টিসিবিকে সক্রিয় করার কথা বলা হয়েছে। কিন’ অতীতে শুল্ক তুলে নেয়ার পরও মুখচেনা মুনাফালোভী ব্যবসায়ী সি-িকেট কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়েছে। ফলে এদের বিরম্নদ্ধে ব্যবস’া নেয়া এবং রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যের আয়োজন ছাড়া মূল্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। অতীতের মতই ব্যবসায়ীদের স্বার্থরড়্গাকারী ও মুক্তবাজার নীতি অনুসরণকারী বর্তমান সরকারের সে পথে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। তাই মূল্যস্ফীতি যেকোন সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছেই। দ্বিতীয়ত, ৭% মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় ধরা হচ্ছে কোন্ যুক্তিতে? দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক-কৃষক নিম্নবিত্তের মজুরি বা আয় কি প্রতি বছর বাড়ে? জাপানে মূল্যস্ফীতি শূণ্য শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ২% মাত্র। অতীতে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে দেখা গেছে মূল্যস্ফীতির পরিবর্তে বরং দফায় দফায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ব্যক্তি মালিকানা উচ্ছেদ ও মুনাফার পরিবর্তে জনগণের প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে পরিচালিত পরিকল্পিত অর্থনীতি মূল্যস্ফীতি সমস্যার সমাধান করেছিল।
চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরে মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেয়ে বাজারমূল্যে ৯২৩ মার্কিন ডলারে বা ৭৪,৩৮০ টাকায় উন্নীত হয়েছে। এর আগে ২০১১-১২ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ৮৪০ মার্কিন ডলার বা ৬৬,৪৬৩ টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে চলতি বাজারমূল্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৯৮৬ টাকা। গত অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ১৮ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। জিডিপি বা মাথাপিছু আয় দিয়ে উন্নয়নের প্রকৃত চেহারা পুরোটা বোঝা যায় না। একজনের এক কোটি টাকা আয় আর ১০ জনের ১০ হাজার টাকা করে আয় গড় করলে প্রত্যেকের মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ৯ লাখ ১৮ হাজার ১৮১ টাকা। এতে কি আসলে ওই ১০ জনের প্রকৃত আয় বোঝা যায়? বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকটের মাঝেও বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬%-এর ওপরে থাকায় অর্থমন্ত্রী সনেত্মাষ প্রকাশ করেছেন ্এবং আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লড়্গ্যমাত্রা ৭.২% সি’র করেছেন। প্রশ্ন হল, প্রবৃদ্ধি বাড়লেও দারিদ্র্য কি কমবে? গত দুই দশকে প্রবৃদ্ধির হার তো নিশ্চয় বেড়েছে, তাই বলে প্রকৃত দারিদ্র্য কি কমেছে? কমেছে ধনী-দরিদ্রের আয় বন্টনের ব্যবধান? কৃষকরা তাদের রক্ত মাংস নিংড়ে দিয়ে যে বাম্পার ফলন ফলিয়ে থাকে এ ফসলের ন্যায্য মূল্য কি কৃষকের পকেটে যায়, না ফড়িয়াদের পকেটে যায়? প্রবৃদ্ধি অর্জনে অসামান্য অবদান রেখেও যে কৃষক সর্বস্বানত্ম হয়ে পড়েছে তার দারিদ্র্য ঘুচাবে কে? গার্মেন্টস শ্রমিকদের রক্ত ঘাম করা শ্রমে মালিকরা ফুলে ফেঁপে উঠছে, বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে – কিন’ শ্রমিকের জীবনে আঁধার কাটছে না। বাজেটে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের জন্য কর-রেয়াত, রপ্তানি বোনাস-সহ নানা প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিনত্ম শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, বিশেষ করে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ৮ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবি সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। শ্রমিকদের অভুক্ত রেখে মালিকদের নানা প্রণোদনা দিয়ে যে শিল্প রড়্গা বা শিল্পায়ন সম্ভব নয় এ বিষয়টি সরকার বুঝতে পারছে বলে অনত্মত বাজেট দেখে মনে হয় না।
কৃষিখাতে ২০১২-১৩ অর্থ বছরে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন ব্যয় বরাদ্দ ছিল ১৪,৮৭৮ কোটি টাকা। কিন’ এবার এ খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১২,২৭৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৮.৬ শতাংশ, আর বর্তমানে বরাদ্দ ৭.৯%। কৃষিতে ভর্তুকি ৩ হাজার কোটি টাকা হ্রাস করা হয়েছে, গতবছর ছিল ১২ হাজার কোটি টাকা, এবার ৯ হাজার কোটি টাকা। বিশ্ববাণিজ্য সংস’া (ডবিস্নউটিও)’র বিধি অনুযায়ী, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি উৎপাদনের ১০% এ খাতে ভর্তুকি দিতে পারে। অথচ দেশের ইতিহাসে ২০০৪-০৫ অর্থবছরে এ খাতে সর্বোচ্চ ৩.৬ শতাংশ ভর্তুকি দেয়া হয়। গত অর্থবছরে ভর্তুকির হার দাঁড়িয়েছে কৃষি জিডিপির ১.৪১ শতাংশ।
কৃষি বাজেটের মতোই এ খাতে দেয়া ভর্তুকির পরিমাণও প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য। স্বাধীনতার পর সরকারিভাবে স্বল্পমূল্যে সার, বীজ ও কীটনাশক কৃষকের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস’া ছিল। সেচ ব্যবস’াও পরিচালিত হতো সরকারি তত্ত্বাবধায়নে। ১৯৮০’র দশকে বীজ, সেচ ও সারের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ বিলুপ্ত করে ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়। সরকারি ব্যবস’াপনায় সার উৎপাদনের ব্যবস’া থাকলেও বণ্টন ব্যবস’া চলে যায় ব্যবসায়ীদের হাতে। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে সারসহ বিভিন্ন উপকরণের ওপর ভর্তুকি তুলে দেয়া হয়। এসব কারণে প্রতি বছরই বাড়তে থাকে সার, কীটনাশক, বীজসহ বিভিন্ন উপকরণের দাম। একই সঙ্গে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে সেচ খরচ। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে দেশে ব্যাপক সার সংকট সৃষ্টি হওয়ায় আবার ভর্তুকি ব্যবস’া চালু হলেও সে ভর্তুকি প্রকৃত কৃষকের কাছে পৌঁছানোর কোন ব্যবস’া নেই। সার, বীজ ও কীটনাশক ব্যবসায়ী এবং সেচ যন্ত্রের মালিকরা ভর্তুকির টাকা পেলেও কৃষকের তেমন কোন উপকার হচ্ছে না। অন্যদিকে ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকারের উদ্যোগ লোকদেখানো। ফলে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের হাতে কৃষক জিম্মি হয়ে পড়েছে।
২০১৩-’১৪ অর্থবছরের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রসত্মাব করা হয়েছে ১৩,৪৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জ্বালানির জন্য প্রসত্মাব করা হয়েছে ৭,৯৫০ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের প্রায় অর্ধেক। লোকসানজনিত বিপুল ঘাটতি সত্ত্বেও ভর্তুকি প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে এনে এই খাতের ব্যয় মেটানোর জন্য সরকারকে অবশ্যই জ্বালানির দাম বাড়াতে হবে। বিদ্যুতে চলতি অর্থবছরের তুলনায় ভর্তুকি কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। তবে এই বর্ধিত ভর্তুকি দিয়েও বিদ্যুৎ খাতের, বিশেষ করে ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে না। এরই মধ্যে ভাড়াভিত্তিক ছয়টি কেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। নতুন করে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র দীর্ঘমেয়াদে নেয়ার পরিকল্পনা হয়েছে। বিকল্প জ্বালানির জোগানে অগ্রগতি না থাকায় সরকারের রেন্টাল নির্ভরতা আগামীতে ভর্তুকি আরো বাড়িয়ে তুলবে।
‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নে পথনকশা : অগ্রগতির ধারা’ শিরোনামের প্রকাশনায় দেখা যায়, ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ খাতে তরল জ্বালানির ব্যবহার ছিল ৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। চলতি বছরে তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৯ শতাংশে পৌঁছবে। এর বিপরীতে স্বল্প মূল্যের বিদ্যুৎ উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। গ্যাসচালিত বিদ্যুতের পরিমাণ ৮৮.৮৪ থেকে কমে হয়েছে ৭৬ শতাংশ। আর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ার কথা থাকলেও তা ৩.৮৮ থেকে কমে ৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর প্রভাব গিয়ে পড়েছে গ্রাহকের ওপর। এরই মধ্যে এ সরকার পাইকারি পর্যায়ে ছয় দফা ও খুচরায় পাঁচ দফা বাড়িয়েছে বিদ্যুতের দাম।
বাজেটে এ চক্র থেকে বেরিয়ে আসার কোনো কথা নেই, বিদ্যুৎ-জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ খাতে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি, সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনে সক্ষমতা অর্জন ইত্যাদি খাতে কোনো বরাদ্দ নেই।
স্বাস’্য খাতে বরাদ্দের হার ক্রমশ কমছে। গত বছর বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৪.৮২% আর এই বাজেটে বরাদ্দ হয়েছে ৪.২৬% । ২০০৯-১০ অর্থবছরে স্বাস’্য খাতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৬.১৮%। লক্ষণীয় হলো পাবলিক সেক্টরে বরাদ্দের হার হ্রাসের সাথে সাথে মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি আমদানীর শুল্ক ২৫% থেকে কমিয়ে ১০% নামানোর মাধ্যমে প্রাইভেট মেডিক্যালের ব্যবসায় বাড়তি প্রণোদনা দেয়া হয়েছে।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর নামে সামান্য কিছু সাহায্য দিয়ে হতদরিদ্র মানুষের অবস’ার মৌলিক কোন পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়। এই বরাদ্দ মূলত সরকারদলীয় নেতা-কর্মী ও স’ানীয় ড়্গমতাশালীদের লুটপাট ও প্রভাব বৃদ্ধির কাজে লাগবে। দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য স’ায়ী কর্মসংস’ান সৃষ্টি ও আয়বৃদ্ধির কোন পদড়্গেপ বাজেটে নেই।
শিড়্গা খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে বাজেটের ১১.৭%। টাকার অংকে শিড়্গায় বরাদ্দ বাড়ছে, এবারও বাজেটে তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, কিন’ প্রয়োজনের তুলনায় তা কতটুকু? শিড়্গা ব্যবস’ার সাথে ছাত্র-শিড়্গক-কর্মচারি মিলিয়ে অনত্মতঃ ৩ কোটি মানুষ জড়িত, সব সত্মর মিলিয়ে শিড়্গা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা লড়্গাধিক। জিডিপি-র অনত্মতঃ ৬% শিড়্গাখাতে বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তার কথা আনত্মর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। অথচ এবারের বাজেটে বরাদ্দ জিডিপি-র ২.৫২% মাত্র। এমনকি মহাজোট সরকারের বহুলপ্রচারিত ‘যুগানত্মকারী’ শিড়্গানীতি বাসত্মবায়ন করতে হলেও এই হারে বরাদ্দ অপ্রতুল – শিড়্গামন্ত্রী নিজেই এ কথা বহুবার বলেছেন। এই বাজেটে শিড়্গা খাতে নতুন কোন প্রকল্পের কথা বলা হয়নি। আন্দোলনরত বেসরকারি শিড়্গকদের এমপিওভুক্তির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়নি।
পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপকে উৎসাহিত করতে অর্থমন্ত্রী এবারো বাজেটে বরাদ্দ রেখেছেন। পিপিপি’র নামে শিড়্গা, স্বাস’্য, খাবার পানি সরবরাহের মতো অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ খাতের উন্নয়ন দেশি-বিদেশি লুটেরাদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে। ইতোমধ্যে, এসব খাতে বেসরকারিকরণ কীভাবে বাণিজ্যিকীকরণের জোয়ার তৈরি করেছে এবং তার ফলে এসব সেবা থেকে গরিব মানুষদের বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টা আমরা দেখছি। পিপিপি তাদের এ অবস’াকে আরও শোচনীয় পর্যায়ে ঠেলে দেবে।
ফলে, এবারের বাজেটের আকার বড় হলেও তা জনকল্যাণে তেমন কাজে আসবে না, কারণ নীতিগত দিক থেকে এতে নতুন কিছু নেই। জনগণের অংশগ্রহণ ও তাদের কাছে জবাবদিহিতাবিহীন বাজেট প্রণয়ন ও বাসত্মবায়ন প্রক্রিয়া বর্তমানের লুটপাট-অপচয়-দুর্নীতির ধারাকেই অব্যাহত রাখবে।