মাত্র নয় বছর বয়সে বাবার হাত ধরে মাছ ধরতে নদীতে যাওয়া শুরু করেছিল চাঁদপুরের বড় স্টেশন ৭নং ওয়ার্ড টিলাবাড়ি নদীর পাড়ের নাজমুল হোসেন। গত ১৫ বছর ধরে মেঘনার বুকে মাছ ধরেই তার জীবন চলেছে। কেমন আছে জানতে চাইলে বলল, ‘বাইচা থাকার লাইগা আমরা প্রতিদিন সংগ্রাম কইরা যাই। একটু বাইচা থাকার লাইগা। রোদে শুকাই, বৃষ্টিতে ভিজি কিন্তু আমাগো কপাল ভিজে না। মাঝে মাঝে মনে হয় জেলে হইয়া জন্মানোটাই একটা অন্যায় আচিল।’ পরিবারের তীব্র অভাব-দারিদ্র্য নাজমুলকে বাধ্য করেছিল মাছ ধরার কাজে যুক্ত হতে। এ কাজ না করলে তার রান্নাঘরে আগুন জ্বলত না, ছোট ভাই-বোনগুলো হয়ত এতদিনে না খেয়েই মরত। এমন দুর্বিষহ পরিস্থিতির মধ্যে চাঁদপুর জেলার ১৫ হাজার জেলে তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে। সমুদ্র তীরবর্তী বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুরসহ উপকূলীয় এলাকায় বসবাসরত লক্ষ লক্ষ জেলে পরিবার এরকম অবস্থার মধ্যে জীবন পার করছে।
ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। উচ্চ পুষ্টিগুণ ও অর্থনৈতিক মূল্য ছাড়াও বাঙালি সংস্কৃতিতে এই মাছটির রয়েছে আলাদা স্বকীয়তা। বাংলাদেশে পাঁচ লাখেরও বেশি উপকূলীয় জনগণ এই মাছ ধরার সাথে সাথে সরাসরি জড়িত। পাশাপাশি মাছ বিপণন, পরিবহন ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে যুক্ত আছে আরো প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। সম্প্রতি চাঁদপুর জেলা প্রশাসন ‘ব্র্যান্ড অব হিলসা’ উপাধি পেয়েছে। কিন্তু যারা প্রত্যক্ষভাবে এ কাজের সাথে যুক্ত তাদের অবস্থা কী? পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, চাঁদপুর নদীর পাড়ে ৩৩% জেলের নিজস্ব কোনো বসতভিটা নেই, প্রায় ৪০% জেলের কোনো নৌকা নেই এবং ২৯% জেলের কোনো মাছ ধরার জাল নেই। অন্যান্য জেলায় বসবাসরত জেলেদের অবস্থা এর চেয়ে ভালো নয়।
ইলিশ মাছের ডিম পারার মৌসুমে জেলেদের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। কেননা তখন মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা থাকে। এ অবস্থায় দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার প্রতি পরিবারের জন্য ১৬০ কেজি করে চাল দেবার কথা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এসব ঘোষণা ছিল লোক দেখানো। প্রকৃতপক্ষে তথাকথিত জন প্রতিনিধিদের দুর্নীতির কারণে ২৫-৩০ কেজির বেশি চাল জেলেরা পায় না। আবার এ চালও আসে নিষেধাজ্ঞা মৌসুম পেরোনোর অনেক পরে। এ অবস্থায় একমুঠো খাবারের জন্য অনেকেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ ধরতে যেতে বাধ্য হয়। এজন্য নেমে আসে পুলিশের নির্মম নির্যাতন। নাজমুল হোসেন জানালেন, তিনিও ছয় মাস জেল খেটেছিলেন। দেশের আইন-বিচারব্যবস্থা কতটা বৈষম্যমূলক! দরিদ্র-অসহায় জেলেদের কারাগারে ঢুকাতে পারলেও সরকার কোটি কোটি লুটপাটকারী-পাচারকারীদের টিকিটিও ছুঁতে পারে না।
মাছ ধরার সাথে যুক্ত মানুষরা আসলে কারা? তারা প্রায় সকলে নিম্ন আয়ের মানুষ। সরকার এদের কাজ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এরা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, হাট দখল, চর দখলের সাথে যুক্ত নয়। তারা তাদের জীবনকে বাঁচাতে, পরিবারকে বাঁচাতে এ পেশায় এসেছে। এ কাজ করতে গিয়েও কেউ হয়তো জমি বন্ধক রেখেছে, কেউ হয়ত গোয়ালের গরুটাও বিক্রি করেছে, নিজে একবেলা কম খেয়ে পরিবার-পরিজনকে কম খাইয়ে টাকা জমিয়ে জাল কিনেছে। অথচ এদের সাথে নিজেদের ক্ষমতার জোর দেখায় সরকার। একজন ১২-১৫ বছরের শিশু কখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যায় – তা বোঝার মতো ন্যূনতম সংবেদনশীলতা দেশের কর্তাব্যক্তিদের নেই। সমুদ্রের ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, দুর্যোগ উপেক্ষা করে তাদের মাছ ধরতে যেতে হয়। এই যে এত কষ্ট করে তবুও আসে না সোনালী দিন। কেননা তারা যে বন্দি আড়তদারদের কাছে। অভাবের তাড়নায় ঋণ নিতে হয় আড়তদারদের কাছ থেকে আবার আড়তদারদের নির্ধারণ করা দামে মাছ বিক্রি করতে হয়। যে টাকায় মাছ বিক্রি করে তাতে পরিশ্রমের মূল্যও ওঠে না, পরিবার-পরিজনদের ভালো রাখা তো কষ্টকল্পনা। ফলে ঋণের বোঝা বাড়তেই থাকে। জীবনের অবসান ঘটে কিন্তু ঋণ থেকে মুক্তি মেলে না।
প্রবল দারিদ্র আর পুলিশের নলের মাথার সামনে দাঁড়িয়ে মাছ ধরতে যায় নাজমুলরা। তারা সারা দেশের মানুষের আমিষের অভাব পূরণ করে। কিন্তু তাদের জীবনের অভাব পূরণ হয় না।