Saturday, November 23, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - জুলাই ২০১৮‘১৫ টাকায় থাকা আর ৩৮ টাকায় খাওয়া’? আবাসিক হল জীবনের গল্প

‘১৫ টাকায় থাকা আর ৩৮ টাকায় খাওয়া’? আবাসিক হল জীবনের গল্প

DU_L20170821040007

তরিকুল বাড়ি ছেড়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় আসে ২০১৬ সালে। এখন সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষের ছাত্র। দু’বছর ধরে সে গণরুমে গাদাগাদি করে থাকে। একদিক থেকে সে ভাগ্যবান। কারণ কেউ কেউ গণরুমেও আশ্রয় পায় না। তাদের কেউ থাকে খোলা বারান্দায়, কেউ বা মসজিদে। পড়ে কখনও লাইব্রেরি, কখনও হলের রিডিং রুমে, কখনও বিভাগের সেমিনার রুমে – আর কোথাও জায়গা না পেলে নিজের বিছানার উপর বসে বসে। কবে সিট পাবে তা সে জানে না। না পেলে তার করারও কিছু নেই। এই উপায়েই তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকে থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ঘুর্ণিঝড়ের সময় খোলা সাময়িক আশ্রয়কেন্দ্র নয়। ছাত্ররা এখানে আশ্রয় চাইতে আসেনি। এখানে সিট পাওয়া তার অধিকার। কিন্তু ব্যাপারটা অবস্থাদৃষ্টে এখন একরকম আশ্রয়কেন্দ্র হয়েই দাঁড়িয়েছে।

দেশের প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই অভিন্ন চিত্র। ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়ে চার লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে আবাসন সুবিধা রয়েছে ৬৬ হাজার ১৪৯ জনের। অর্থাৎ শতকরা ৮৫ ভাগ শিক্ষার্থীরই কোন আবাসন সুবিধা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থীর শতকরা প্রায় ৩৫ শতাংশের, বুয়েটের প্রায় ৩০ শতাংশের, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৪৮ শতাংশের, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২২ শতাংশের আবাসনের ব্যবস্থা আছে। পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই অবস্থা দেখে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা বুঝতে অসুবিধা হয় না। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের কোন আবাসন ব্যবস্থাই নেই। নতুন প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনটিরই আবাসন সুবিধা শতকরা ৩০ শতাংশের বেশি নয়।

একটা ঘুমাবার বিছানা ও একটা পড়ার টেবিল, মোটামুটি চলা যায় এমন একটা ঘর – এর বাইরে কোন বিলাসিতা আশা করে না দূর-দূরান্ত থেকে পড়তে আসা তরিকুলদের মতো ছাত্ররা। কিন্তু বাস্তব চিত্র খুবই করুণ। পত্রিকায় এ নিয়ে খবর এসেছে, ছবি এসেছে। হাজতিদের মতো হলের ডাইনিং, টিভি রুম, মসজিদে লাইন দিয়ে শুয়ে আছে ছাত্ররা। এই রুমগুলো পেলে ভাল, অনেক জায়গায় রুম না পেয়ে তাদের আশ্রয় নিতে হয় হলের বারান্দাতে। লাইন দিয়ে খোলা বারান্দাতে সারিবদ্ধভাবে শুয়ে আছে ছাত্ররা; সেখানে রোদ আসছে, বৃষ্টি আসছে, শীত আসছে – এই চিত্র তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী হলের। দুই সিঁড়ির সংযোগস্থলের ফাঁকা জায়গায় চেয়ার-টেবিল পেতে পড়তে বসেছে ছাত্ররা কিংবা বারান্দার কোণে পেতেছে চেয়ার-টেবিল – এ চিত্রও বিরল নয়। এই অবস্থার মধ্যে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের ১৫ টাকার সিটে থাকা আর ৩৮ টাকা খাবারের খোটা দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের জীবন যাপন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য নির্মম রসিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

অমানবিক পরিস্থিতিতে হলে থাকার পরও একজন ছাত্রের মাসিক খরচ কত হতে পারে? গড়ে তাদের দুটো টিউশনি করতে হয়। কেউ কেউ তিনটা করেন, কেউ চারটা। কিন্তু ন্যূনতম প্রয়োজন কেউই মেটাতে পারেন না। বাস্তব অবস্থা হল খাবার বাবদ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র গড়ে খরচ করেন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা, সারা মাসে মোট খরচ করেন গড়ে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দারিদ্র্যসীমা পরিমাপের জন্য যে ‘cost of basic needs (CBN)’ পদ্ধতি ব্যবহার করে। সে অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ শতাংশ ছাত্রই দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করে। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় খাবার, জীবনধারণ ও লেখাপড়ার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সে জোগাড় করতে পারে না। ৮০ ভাগ ছাত্রই পারে না। তারা কোনরকমে চলে।

এই হচ্ছে হলে থাকা শিক্ষার্থীদের জীবনের বাস্তব চিত্র। একটি লেখায় এই সংকটের পুরোটা তুলে ধরা অসম্ভব। হলের খাবারের গুণগত মান নিয়ে এক দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে। আলোচনাু হতে পারে হলগুলোর স্যানিটেশন নিয়ে – যেখানে এক একটা ফ্লোরের দুপাশের ৬/৮ টি বাথরুমে শত শত ছাত্র যাতায়াত করে। দুজনের রুমে ৮ জন গাদাগাদি করে কোনরকমে শুতে পারে, কিন্তু বাথরুমের ক্ষেত্রে সে নিয়ম খাটে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর চিত্র আজ অনেকটা রিফিউজি ক্যাম্পের মতো। দেশের যারা ভবিষ্যৎ, যারা চিন্তা করবে, লিখবে, পথ দেখাবে, নেতৃত্ব দেবে, সাহিত্যিক-শিল্পী-বিজ্ঞানী-শিক্ষক-প্রশাসক হবে তাদের প্রতিদিনের জীবনযাপন চলে এই যুদ্ধের মধ্যে। এই যুদ্ধ চিন্তা করার কোন অবসর রাখে কি? এই ভাবনাই সে প্রতিনিয়ত তৈরি করতে থাকে যে, কবে দুটো পয়সা রোজগার করব, একটু ভাল থাকব, এই দুঃসহ জীবন থেকে মুক্তি পাব।
ছাত্রদের জন্য নতুন হল, ক্যান্টিনে ভর্তুকি, বৃত্তির ব্যবস্থা করা – সরকারের পক্ষ থেকে এই উদ্যোগগুলো নেয়া প্রয়োজন। না হলে উচ্চশিক্ষা রক্ষা পাবে না। উচ্চশিক্ষা রক্ষা না পেলে সুশিক্ষিত ও দক্ষ জনগোষ্ঠী সৃষ্টি হবে না। কিন্তু ঘটছে তার বিপরীত। ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ‘উচ্চশিক্ষার ২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্র’ গ্রহণ করেছে। তাতে স্পষ্ট বলা আছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ধীরে ধীরে স্বনির্ভর হয়ে উঠতে হবে। রাষ্ট্র তার বরাদ্দ একসময় তুলে নেবে। ২০০৬ সালের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির উপর প্রবল জোর দেয়া শুরু হল। ফলশ্রুতিতে প্রতি বছর ছাত্রবেতন বৃদ্ধি করা হচ্ছে। চলতি ছাত্রদের বেতন বেশি বাড়ালে আন্দোলন হয়। তাই এখন ব্যাপকহারে বৃদ্ধিটা করা হয় যখন ছাত্ররা প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়। বেতন ফি বাড়ানো, হল-হোস্টেল থেকে সবরকম ভর্তুকি প্রত্যাহার, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগুলো ভাড়া দেয়া, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নাইট কোর্স – এসবের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ আয় বাড়ানো হচ্ছে। তার ফলে শিক্ষাব্যয় এখন প্রতিবছর বাড়ছে। ছাত্রদের অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে।

সম্প্রতি মন্ত্রী-এমপি-আমলাদের মোবাইল ফোন কেনার জন্য বরাদ্দ ১৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। তাদের মোবাইল বিলের ক্ষেত্রে কোন সীমা থাকবে না, মাসে যত টাকা খরচ করবেন তত টাকাই রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে পরিশোধ করা হবে। গত ৮ বছরে সরকার ১১০০০ হাজার কোটি টাকা লোকসানে পড়া রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোকে দিয়েছে। ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা সরানো হয়েছে, যারা সরিয়েছেন তারা সবার সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাদের চুরির টাকা জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দ কমানো হচ্ছে। ‘ছাত্রদের বেতন এত কম থাকতে পারে না, এটাকে বাড়াতে হবে’ এই মত জোরালোভাবে প্রচার করা হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ছাত্ররা মোবাইলের পেছনে অনেক বেশি টাকা খরচ করে (যদিও বরাদ্দ তারাই পান)। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন ‘পিবিএফ’ (পারফরমেন্স বেইজড ফান্ডিং) চালু করতে হবে। অর্থাৎ বক্তব্য পরিস্কার, এত সুবিধা ছাত্রদের দেয়া যায় না।

একদিকে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর জীবন, অন্যদিকে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী-লুটপাটকারী – রাষ্ট্র কাকে তার ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্ব দিচ্ছে? রাষ্ট্রটা কার? সে কী চাইছে? দেশের উন্নয়ন বলে যারা গলা ফাটিয়ে দিচ্ছেন তাদের উদ্দেশ্য কী?

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে এখন একটি জনপ্রিয় বাক্য হচ্ছে ‘আমি রাজনীতি পছন্দ করি না।’ রাষ্ট্রের টাকা কোথায় যায়, কাকে দেয়া হয়, আমাদের শিক্ষাজীবনের এই অবস্থা কেন – এই প্রশ্নগুলো সরাসরি রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত। পরিত্রাণের রাস্তাও রাজনৈতিক। দেশটা একটা শ্রেণী চালায় ও তাদের স্বার্থেই সবরকম বরাদ্দ-বন্টন, আইন প্রণয়ন ও নীতি নির্ধারণ হয়। ছাত্ররা এই সত্য না বুঝলে, বুঝে লড়াই না করলে তাদের মুক্তি নেই, পরিত্রাণ নেই। দাসের মতো অমানবিকভাবে উচ্চশিক্ষা জীবন কাটালে বুদ্ধিবৃত্তি কিংবা আত্মমর্যাদাবোধ কোনকিছুরই বিকাশ ঘটে না। বরং ছোটবেলায় পারিবারিকভাবে গড়ে ওঠা নৈতিকতা ও মূল্যবোধের স্তর আরও নিচে নেমে যাবে। একটা জাতির জন্য এর চেয়ে সংকটের আর কিছু হতে পারে না।

সাম্যবাদ জুলাই-আগষ্ট ২০১৮

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments