লেখক হুমায়ুন আজাদ ‘সবুজ পাহাড়ে হিংসার ঝর্ণাধারা বইতে লিখেছেন, “বাঙ্গলাদেশের এক রূপময় খন্ড পার্বত্য চট্টগ্রাম, তিন দশক ধরে আহত অসুস্থ’’। এই বইটি যখন লিখেছিলেন তখন পাহাড় ছিল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধরত। রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী বনাম পাহাড়ী মুক্তিকামী জনতা। সে লড়াই থেমে গেছে। চুক্তি হয়েছে। দুই দশক পার হলেও চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। সেই সাথে লড়াই এখন নতুন রূপে, নতুন মাত্রায় গতি পেয়েছে। পাহাড়ি জনগণের প্রত্যাশার শান্তি তো মেলেনি। আঞ্চলিক রাজনীতি এবং বিশেষ সেনা ব্যবস্থার দ্বন্দ্বে দুঃসহ যন্ত্রণায় পতিত পাহাড়ি খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের জীবন।
গত কয়েক মাসে পাহাড়ে আঞ্চলিক রাজনৈতিক কোন্দলে গুম, খুন, হত্যা, অপহরণ নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। গত পাঁচ মাসে কমপক্ষে ১৮ জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে। রাজনৈতিক অপহরণ, গুম মামুলি ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সর্বশেষ নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা হত্যা এবং তাঁর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যাওয়ার পথে ৬ জন হত্যাকান্ডের ঘটনাটি সর্বমহলে আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। তার পূর্বে মিঠুন চাকমা হত্যাকান্ড, নারী নেত্রী অপহরণ জনমনে সংঘর্ষের দুশ্চিন্তাকে শক্তিশালী করেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে চারটি আঞ্চলিক সংগঠন রয়েছে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তির বিরোধিতা করে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রসিত খীসার নেতৃত্বে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) গঠন করা হয়।
এছাড়া ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রাজনৈতিক চাপে জনসংহতি সমিতিতে সংস্কার আসে। গড়ে উঠে জনসংহতি (এম এন লারমা)। বদলে যায় রাজনৈতিক হিসাব। গত ২০ বছরে জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ-এর এলাকা নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই দলের কোন্দলের কারণে বহু নেতা-কর্মী নিহত হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশ তাদের দলীয় মতবিরোধে ১ হাজার খুন আর ১৫শ’ গুম হয়। ২০১৬ সালে দুই দলের মধ্যে অলিখিত ও অপ্রকাশ্য সমঝোতায় সশস্ত্র সংঘাত থামলে কিছুটা স্বস্তি আসে পাহাড়িদের মনে।
২০১৭ সালে ভাঙে প্রসিত খীসার ইউপিডিএফ। তপন জ্যোতি চাকমার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), যা সংঘাতে নতুন মাত্রা দেয়। দৃশ্যত চারভাগে বিভক্ত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনীতি। আবার এ দলগুলোর আছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি সহ জাতীয় বড় দলগুলোর সাথে স্বার্থকেন্দ্রিক যুক্ততা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা অনেকদিন ধরেই লক্ষ্য করছিলাম পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। আমরা যেহেতু বুঝতে পারছিলাম, আমার মনে হয় প্রশাসনও বুঝতে পেরেছে। অথচ তারা কোন ব্যবস্থা নেয়নি।” তিনি বলেন, তারা যদি আগে থেকে ব্যবস্থা নিত তাহলে এই ধরণের খুনোখুনি থামানো যেতো বলেই আমি মনে করি। এখানে চারটি গ্রুপ সক্রিয়। তারা নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে তৎপরতা চালাচ্ছে। এর সঙ্গে সামনে নির্বাচন একটা বড় কারণ। আর শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া আরো বড় কারণ। এখনই সমাধানের উদ্যোগ না নিলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে”।
পাহাড়ের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী কারা? স্বাধীনতার পর থেকেই রাষ্ট্র সবসময়ই পাহাড়ি জনগণের উপর বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা চালু করেছে। দ্বৈত শাসননীতির কারণে তারা একদিকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন সহ্য করে। আবার সেই সাথে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে সেনাবাহিনী তাদের উপর চালায় দমন-পীড়ন-নির্যাতন। এ কাজে ব্যবহৃত হয় গরীব সেটেলার বাঙালি। এখানকার জনগণ দীর্ঘদিন ধরেই ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি করে তাদের ভূমি ফিরিয়ে দেবার দাবি করছে। চুক্তি বাস্তবায়ন করে সামাজিক ও প্রশাসনিক অধিকার নিশ্চিতের দাবি জানিয়ে আসছে। জাতিগত বিরোধ, সেনা প্রত্যাহার, ভূমি বিরোধ, সেটেলার সমস্যা নিরসনের কোনো উদ্যোগ রাষ্ট্রের তরফ থেকে নেয়া হয়নি। ২০১২ সালে রাঙ্গামাটিতে, ২০১৩ সালে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায়, ২০১৪ সালে নানিয়ারচরে বড় ধরনের জাতিগত হামলা হয়েছে। আইনবহির্ভূতভাবে সেনাবাহিনী কর্তৃক হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেই চলেছে। যথেচ্ছ গ্রেপ্তার, হয়রানি, সেনা হেফাজতে শারীরিক অত্যাচার ও মৃত্যু প্রতিবছর বাড়ছে। সামরিক কর্মকর্তা ও সেটলারদের ভূমি দখলের ফলে আদিবাসীরা প্রান্তিকতার শেষ প্রান্তে পৌঁছেছে। সেনা-সেটলার কর্তৃক আদিবাসী নারীদের ধর্ষণের পরিসংখ্যান প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। অথচ বিচার হয়নি একটি ঘটনারও। আবার পাহাড়ি সংগঠনগুলো প্রতিশোধ নিতে নিরস্ত্র মানুষকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে সরে এসে তারাও সুবিধা, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজিসহ বুর্জোয়া রাজনীতির ধারায় পরিচালিত হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন এমন একজন বিশেষজ্ঞ আমেনা মহসিন বলেন, পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর বিভক্তির প্রধান কারণ আর্থিক, আর সে কারণেই তারা এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বাড়াতে চায়। এই অর্থ আদায়কে কেন্দ্র করে অপহরণ, হামলা আর কোন্দলের সুযোগ নেয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং জাতীয় দলগুলো। গণতান্ত্রিক আন্দোলনকারী শক্তির দুর্বলতা, আঞ্চলিক রাজনৈতিক কোন্দল, রাষ্ট্রীয় বৈষম্য এবং অবৈধ সেনাশাসনের দৌরাত্মে পাহাড়ি ও পাহাড়ে বসবাসকারী সকল মানুষের জীবন আতঙ্কগ্রস্ত। প্রয়োজন গণতান্ত্রিক আন্দোলন।