স্বাধীনতা তুমি ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি – কবি শামসুর রাহমান কৃষকের হাসির মাঝে এভাবে স্বাধীনতাকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন ফসলের মাঠে। সেই ফসলের মাঠে আজ কৃষকের হাসি নয়, ধাউ ধাউ আগুন জ্বলে। বীজ বোনা থেকে চারা রোপণ, সময়ে সময়ে নিড়ানি – এভাবে ধান পাকা পর্যন্ত প্রতিটি সময় সন্তানের মতো পরম আদরে একজন কৃষক ফসলের মাঠ সুরক্ষিত রাখেন। উৎপাদিত সেই ধান এদেশের ১৬ কোটি মানুষের বেঁচে থাকার রসদ জোগায়। যে কৃষক আমাদের বেঁচে থাকার রসদ জোগায় – তাঁরা কীভাবে বেঁচে আছে? রক্ত জল করা পরিশ্রমে ফসল ফলানোর পর কৃষক নিজেই সেই ফসলের মাঠে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছেন! কতটা ব্যথা ও অভিমান বুকের মধ্যে সঞ্চিত হলে কৃষকেরা এই কাজ করতে পারেন, তা বোঝার মতো মন মন্ত্রীমশাইদের নেই। তাই তারা ঠাট্টা-মশকরা করেন। আগুন দেয়া ধানক্ষেতের ছবি বাংলাদেশ নয়, ভারতের হিসেবে উড়িয়ে দেন। কখনো এখানেও ‘সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার ষড়যন্ত্র’ খুঁজে পান। শুধু খুঁজে পান না কৃষকের মুখ। কী অব্যক্ত যন্ত্রণা চোখে-মুখে, শীর্ণকায় শরীর আগামী দিনের দুশ্চিন্তায় আরও শীর্ণ হয় দিনকে দিন। এইভাবেই আজ আমাদের দেশের কৃষকরা দিনাতিপাত করছেন। যতবেশি ফসল ফলে, কৃষকের কষ্ট তত বাড়ে।
এবছরও বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। রেকর্ড ২ কোটি টন ধান উৎপাদিত হয়েছে। কিন্তু ফসলের ন্যায্যমূল্য তো দূরের কথা এমনকি উৎপাদন খরচও তুলতে পারছে না কৃষক। প্রতি মণ ধান উৎপাদনে ৮০০ টাকা খরচ হলেও বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে ৫০০-৬০০ টাকা মণ ধরে। বছরের পর বছর ধরে লোকসান গুণে গুণে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন ছোট ও মাঝারি কৃষক। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে কৃষকদের রক্ষার কোন কার্যকর উদ্যোগ নেই। নামকাওয়াস্তে ধানের ক্রয়মূল্য ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ সরকারের উদ্যোগ। এবছর সরকার ধান সংগ্রহের সরকারি ক্রয়মূল্য ঘোষণা করেছে ১০৪০ টাকা। এই দামে সরকার ধান ক্রয় করবে দেড় লাখ টন মাত্র অর্থাৎ উৎপাদিত ধানের ১ শতাংশ মাত্র। তবু এইটুকু সুফলও কৃষক পাবে না। সরকারের ধান সংগ্রহের যে পদ্ধতি তাতে মধ্যস্বত্ত¡ভোগী ফড়িয়া ও চালকল মালিকরাই এতে লাভবান হবে। কারণ সরকারি সংগ্রহের বেশিরভাগটাই চালÑআর চাল মিল মালিকদের থেকেই কেনা হয়। ধান ক্রয়ের ক্ষেত্রেও সরকারি দলের স্থানীয় লোকজনেরই আধিপত্য থাকে। উপরন্তু নিয়ম করা হয়েছে ১৪ শতাংশের বেশি আর্দ্রতা থাকলে সেই ধান গুদামে কেনা হবে না। আমাদের দেশের বাস্তবতায় একজন কৃষক জানেই না আর্দ্রতা কী? সে কীভাবে সরকারের এই নিয়ম রক্ষা করে ধান বিক্রি করবে? ধান সংরক্ষণেরও পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। এই সমস্ত বিড়ম্বনা এবং পাওনাদারের চাপে কৃষক দ্রুত ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়। আর মধ্যস্বত্ত্ব ভোগী ব্যবসায়ীরা কৃষকের কাছ থেকে প্রায় কম দামে ধান কিনে প্রায় দ্বিগুণ দামে সরকারের কাছে বিক্রি করে। ফলে এই প্রক্রিয়া কৃষকদের সুরক্ষা দেয়া সম্ভব নয়।
আমাদের পাশ্ববর্তী দেশের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার প্রতিবছর প্রায় ৫০ লাখ টন ধান ক্রয় করে। এবং তা খোদ কৃষকের কাছ থেকে। আর্দ্রতা পরীক্ষার মতো নিয়ম সেখানে নেই। সরকার ‘সেলফ হেলপ স্কেপ’ নামে কিছু গ্রুপ তৈরি করে। যারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে ধান কিনে জেলা খাদ্য কর্মকর্তাকে জানায়। সেই ধান সরকারই শুকানোর ব্যবস্থা করে। বেসরকারি গুদাম ভাড়া নিয়ে সেখানে ধান সংরক্ষণ করে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা ভারত নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সরকার কৃষকদের সুরক্ষায় ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি নগদ সহায়তা বা কৃষিতে বিপুল ভর্তুকি দেয়। আমাদের দেশে সরকার মুখে কৃষকবান্ধব বলে বলে গলা ফাটালেও কৃষিখাতে প্রতিবছর বরাদ্দ হ্রাস করছে। ফলে বীজ, সার, কীটনাশকের দাম বাড়ছে। সর্বোপরি কৃষকের হাতে নগদ অর্থ না থাকায় যে ঋণ নিয়ে কৃষকরা ফসল ফলাবে সেই ঋণও মেলে না। খাদ্যনীতি পরামর্শ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি)-র তথ্যমতে, দেশের কৃষকরা মাত্র ৬ শতাংশ ঋণ পায় সরকারি কৃষি ব্যাংক থেকে। আর বেসরকারি উৎস থেকে ঋণ নেয় ৮১ শতাংশ। যার সুদের হার ১৯ থেকে ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে উচ্চ সুদের ঋণ, সার, বীজ, কীটনাশকের বর্ধিত দামের কারণে ধানের উৎপাদন খরচও বেশি। প্রতিবেশি ভারতে এক কেজি ধানের উৎপাদন খরচ ১৮ টাকা ৭৫ পয়সা। থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া বা ভিয়েতনামেও ২০ টাকার কম। আর বাংলাদেশে এক কেজি ধানের উৎপাদন খরচ ২৫ টাকা। এই উৎপাদন খরচ কমাতে না পারলে কৃষকদের লোকসান থেকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। আর উৎপাদন খরচ কমাতে হলে কৃষিখাতে বরাদ্দ বৃদ্দি ও সরাসরি ভর্তুকি, অল্প সুদে ছোট ও মাঝারি কৃষকদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।
দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখনো প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কৃষি পেশার সাথে যুক্ত। কৃষিই জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। ফলে কৃষি ও কৃষক বিপর্যস্ত হলে গোটা অর্থনীতিই বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। তবু সরকারের টনক নড়ছে না। অল্পসুদে সরকার কৃষকদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করতে পারে না অথচ এক ব্যাংকিং খাতেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি। কৃষি ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত না করলেও কৃষি পণ্য রপ্তানিকারী ব্যবসায়ীদের জন্য ২০ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে, পোশাক শিল্প মালিকদের জন্য প্রণোদনা দিচ্ছে ২ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা, ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর ছাড় দেয়া হচ্ছে কিন্তু কৃষকদের উন্নয়নের জন্য কোন বরাদ্দ নেই। তাই সরকার যে উন্নয়নের কথা বলছে, বুঝতে হবে সে উন্নয়ন এদেশের সাধারণ মানুষদের তথা কৃষকদের উন্নয়ন নয়, বড় বড় ব্যবসায়ী পুঁজিপতিদের উন্নয়ন।