Saturday, November 23, 2024

কতিপয় ‘তুঘলকি কাণ্ড’!

‘তুঘলকি কাণ্ড’ বলে একটা প্রবাদ আছে। চতুর্দশ শতাব্দির দিল্লীর সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক শাহ’র অদ্ভুত সব কাণ্ডকীর্তি, জোর-জবরদস্তির ঘটনাগুলোই ইতিহাসে ‘তুঘলকি কাণ্ড’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। আজ সেই সুলতানি আমলও নেই, তুঘলক শাহও নেই, কিন্তু ‘তুঘলকি কাণ্ড’ আছে। আসুন দেখে নিই এরকম কিছু ঘটনা।

ডেঙ্গু নিয়ে সারা দেশ যখন শঙ্কিত, তখন এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী বলছেন “ … ডেঙ্গু এলিট শ্রেণির একটি মশা। এ মশা সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, কলকাতা শহরে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন উন্নত দেশ হতে যাচ্ছে, তাই এখন ডেঙ্গু এসেছে…।”

সম্প্রতি গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ করলে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বলছেন “ … এখন লোডশেডিং নেই, সবাই বেশ আরাম-আয়েশে আছে বলেই ভুলে গেছে অতীতের কথা …।” তিনি ব্যঙ্গ করে আরও বলছেন “খুব ভালো, বহুদিন পর হরতাল পেলাম তো, পরিবেশের জন্য ভালো …।”

রানা প্লাজায় ভবন ধ্বসে শত শত শ্রমিক নিহত হবার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য হলো “হরতালকারী ও মৌলবাদীরা এই ভবনের স্তম্ভ ধরে টানাটানি করায় ভবন ধসে পড়তে পারে …।”

হলমার্ক কেলেংকারিতে চার হাজার কোটি টাকা লোপাট হবার পর অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘এ তো সামান্য টাকা’।
বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে নারী লাঞ্ছনার পর পুলিশের আইজিপি বলেছিলেন “পহেলা বৈশাখের ঘটনা কয়েকটি ছেলের দুষ্টামি।”

রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এরকম বক্তব্য ‘তুঘলকি কাণ্ড’ নয় কি? এই ধরনের বক্তব্য থেকে আমরা কী ধারণা নিতে পারি?

উপরোক্ত বক্তব্য থেকে এ-দেশের তথাকথিত রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, এমপি, প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়বোধের করুণ চিত্রটি বের হয়ে এসেছে। বাস্তবে এ রকম ঘটল কেন? এর উত্তর খুজতে হবে আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার চরিত্রের উপর। এদেশ আজ দু’ভাগে বিভক্ত, একদিকে শাসক ধনিক শ্রেণি, অন্যদিকে শ্রমজীবী মেহনতি জনতা। যতদিন যাচ্ছে, সমাজে বৈষম্য ততই প্রকট হচ্ছে। বৈষম্য শুধু সম্পদের দিক থেকে নয়; আইন, প্রশাসন, ন্যায়বিচার, সমাজিক সুরক্ষাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই তা বাড়ছে। গত ১৯ জানুয়ারি ২০১৯ প্রথম আলো তাদের এক প্রতিবেদনে দেখাচ্ছে “অতিধনীর বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ ছিল বিশ্বে প্রথম। এখন দেখা যাচ্ছে, ধনী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক থেকেও বাংলাদেশ এগিয়ে, বিশ্বে তৃতীয়।” তার পরদিন একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ‘গরীব মানুষের বসবাসে বিশ্বে পঞ্চম বাংলাদেশ’। অর্থাৎ গোটা সমাজটা স্পষ্টতই দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। কথাটা এত সহজ ভাবে বুঝলে হবে না, এর মধ্যে নিহিত আছে সমাজের ভাঙনের চিত্র। বিষয়টা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, সম্পদ ক্রমেই মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, আর দীর্ঘ হচ্ছে গরীব মানুষের মিছিল। এই গরীব যারা হচ্ছেন তারা কারা? এরা হলেন এক সময়ের ক্ষুদ্র ও মাঝারি পুঁজির মালিক বা মধ্যবিত্ত; যারা দ্রæতই তাদের অবস্থান থেকে ছিটকে যাচ্ছেন।
ফলে আমাদের সমাজে, গণতান্ত্রিক সংগ্রামে, প্রতিদিনের যাপিত জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। সমাজে নানা চিন্তাভাবনার আদান প্রদান, নানা মত ও পথের অবস্থান সংকুচিত হয়ে পড়ছে। তাই বুর্জোয়া অর্থেও যে বহুদলীয় সংস্কৃতি ছিল, তা মার খাচ্ছে। ’৯০ পরবর্তী গত ৩০ বছরে কার্যত এদেশে বড় কোনো রাজনৈতিক সংগ্রাম বা গণআন্দোলন গড়ে ওঠেনি। ফলে তথাকথিত মন্ত্রী, এমপি বা প্রতিষ্ঠিত দলের বর্তমান নেতাদের একটি বড় অংশ ন্যূনতম রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আসেননি। আবার একচেটিয়া ধনকুবেরদের স্বার্থে দেশে একটি ফ্যাসিবাদী শাসন কাঠামো দরকার। গত প্রায় ১৫ বছর ধরে মহাজোট সরকার এই প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে সমাজের সর্বনিম্ন স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কায়েমী স্বার্থবাদী একটি শক্তিশালী চেইন গড়ে উঠেছে। প্রশাসন, আমলাতন্ত্রসহ একটি কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে উঠেছে, যা গত নির্বাচনে মূর্ত হয়েছে। এই গোটা আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির মুখপত্র আমাদের মন্ত্রী, এমপি, আমলারা। ফলে তাদের দায়হীন-উন্মাদ বক্তব্যগুলো, শুধু একটা কথার কথা নয়, বরং অন্যায্য সমাজ ব্যবস্থার স্বাভাবিক প্রকাশমাত্র।

আমরা চাই বা না চাই, শেষ বিচারে রাজনীতিই আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। নেতৃত্বই মূলত জনগণকে, সমাজকে পরিচালনা করে। ফলে নেতৃত্বের গুণাগুণ, আচরণ দেশের মানুষের সাংস্কৃতিক-নৈতিক মানকে প্রভাবিত করে। আবার জনগণের সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই নেতৃত্ব বের হয়ে আসে। আজকে পুঁজিবাদ অবক্ষয়ী, মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজন সে ধারণ করে না। আর এই পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থ রক্ষাকারী নেতৃত্ব কোনোভাবেই জনগণকে একটা নৈতিক বোধে উজ্জীবিত করতে পারে না। এই কারণেই মন্ত্রী, এমপি, আমলাদের বক্তব্যে ক্ষমতার দম্ভ, অহমিকা প্রকাশ পায়। প্রকৃত অর্থে জনস্বার্থে লড়াই ছাড়া নৈতিকতা মূল্যবোধের জাগরণ ঘটানো সম্ভব নয়। তাই শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের স্বার্থকে ধারণ করে সর্বব্যাপক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগ্রাম গড়ে তোলা আজ জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করার একমাত্র পথ।

সাম্যবাদ সেপ্টেম্বর ২০১৯

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments