গত আগস্ট মাসে ছিল রোহিঙ্গা গণহত্যা ও লাখে লাখে তাদের বাংলাদেশে শরণার্থী হওয়ার দুই বছর পূর্তি। এরই মধ্যে সেই আগস্ট মাসেরই ২২ তারিখে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের জন্য দ্বিতীয় দফা চেষ্টা করা হয়। গত বছরের নভেম্বরে প্রথম চেষ্টা করা হয়েছিল। দুটো চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে, কেউ ফেরেনি। কিন্তু রোহিঙ্গা সংকটের প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এখন আগের চেয়ে এখন অনেক স্পষ্ট। এ আলোচনা প্রথমদিকের উত্তেজনার ধাপ পার করে এখন উদ্বিগ্নতার স্তরে পৌঁছেছে। ফলে এ সময়ে বিভিন্ন দিক থেকে এই সংকট নিয়ে বিশ্লেষণ জরুরি, যাতে সচেতন মানুষ এ সম্পর্কিত একটা দৃষ্টিভঙ্গি স্থির করতে পারেন।
রোহিঙ্গা শরণার্থী — বর্তমান পরিস্থিতি কী
আমরা দীর্ঘ আলোচনা ও বহু সংখ্যক উদাহরণে না ঢুকে এটা বলতে পারি যে, শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া একটা নৈতিক-মানবিক দায়িত্ব। আবার এই শরণার্থীরা আশ্রয়দাতা দেশ ও জনগোষ্ঠীর উপর একটা প্রভাবও সৃষ্টি করে। বাস্তবে অর্থনৈতিক প্রভাবের চেয়েও এর সামাজিক প্রভাব অনেক বেশি। বাংলাদেশে দু’বছর আগে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যার প্রেক্ষিতে এক ধাক্কায় ৭ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী এসেছে। এর আগে বিভিন্ন সময়ে আসা শরণার্থীদের সংখ্যা যোগ করলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ১১ লক্ষাধিক। এরা বেশিরভাগ অংশই বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে কক্সবাজার জেলায় অবস্থান করে। এই শরণার্থীদের প্রতিপালনের জন্য সরকার বিদেশ থেকে ত্রাণ সংগ্রহ করছেন, দেশি-বিদেশি অনেকগুলো সংস্থা এদের নিয়ে কাজ করছে। ফলে এটাই মূল সংকট নয়। এ অবস্থার পরিণতি কী হবে, সেটা নিয়ে যখন অনিশ্চয়তা থাকে; সেটা তখন শরণার্থী, শরণার্থী ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকার অধিবাসী এবং দেশের জনগণ — সবাইকেই চিন্তিত করে এবং একটা পরিবর্তন তখন সমাজের অভ্যন্তরে ঘটে যায়। পুঁজিবাদী এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্ষমতা ও ক্ষমতার বাইরে থাকা সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী এই অনিশ্চয়তাকে কাজে লাগায়। নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ হাসিলের জন্য ভবিষ্যতের ভয়াবহ সংকটকে ডেকে আনে। যেহেতু রাষ্ট্রব্যবস্থাও পুঁজিবাদী, রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দলটিও সমস্যার সঠিক সমাধানের পরিবর্তে সুবিধাজনক সমাধান চায়, যাতে সেটা তার ক্ষমতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে। ফলে প্রত্যেকেই তার মতো করে ঘটনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে ও তা প্রচার করে। এতে সঠিক বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি চাপা পড়ে যায়, শরণার্থী ও আশ্রয়দাতাদের মধ্যে তৈরি হয় বৈরী সম্পর্ক।
দু’বছর আগে রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল যখন এদেশে ঢোকে, তখন গোটা দেশ তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তখনও যে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো এ থেকে ফায়দা হাসিল করতে চায়নি তা নয়, কিন্তু দেশের জনগণ স্বতঃস্ফুর্তভাবেই তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। মাত্র দু’বছরের ব্যবধানে জাতীয় মনস্তত্বের একটা বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। এখন রোহিঙ্গা একটা গালি, বাজারে, রাস্তাঘাটে রোহিঙ্গা বলে গালিগালাজ করতে লোককে দেখা যায়। ফেসবুকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কেউ কোনো সহানুভূতিপূর্ণ লেখা লিখলে যে ধরনের মন্তব্য পোস্টের নিচে দেখা যায়, তা চিন্তিত না করে পারে না। ঘটনাকে ও তার পরিবর্তনের ক্রমকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ধরতে না পারলে একদিনের ভালোবাসা আরেকদিন ঘৃণায় পরিণত হতে বাধ্য।
এরই মধ্যে বিএনপি রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তাদের ১০ দফা সম্বলিত বক্তব্য হাজির করেছে। অনেক দলই সুষ্ঠু সমাধানের ব্যাপারে কথা বলছেন। কিন্তু এই বিষয়টা সর্বাগ্রে দেশের জনগণের সামনে আনা গুরুত্বপূর্ণ যে, শরণার্থীদের দ্বারা সৃষ্ট কিছু সংকটকে কেন্দ্র করে গোটা শরণার্থীদের দোষী করা ও তাদের প্রতি ঘৃণার মনোভাব তৈরি করা সংকটকে নিয়ে আরেকধরনের খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই খেলা সরকার থেকে শুরু করে ক্ষমতাবহির্ভূত বিরোধী দলগুলো, সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো সবাই খেলে যাচ্ছেন। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা দেখিয়ে সাম্প্রদায়িক উগ্রতা তৈরি করা, আবার দু’বছর পরে রোহিঙ্গারা আরাম পেয়ে গেছে বলে আঞ্চলিক উগ্রতা সৃষ্টি — একই রাজনীতির অংশ। দেশের সচেতন, শিক্ষিত মানুষের এই ফাঁদে পা দেওয়া উচিত নয়।
এত বিরাট সংখ্যক শরণার্থীদের সবাই একই রকম হবে না, সেটাই স্বাভাবিক। সবচেয়ে বড় কথা হলো, দুই বছর পরেও দেশে ফেরার অনিশ্চয়তা, আবার প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দুর্বল অবস্থান, যে কারণে তারা কেউই দেশে ফিরতে চাইছেন নাÑএসবকিছু মিলে তাদের জীবনের পথের সামনের দু’পাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। এইরকম পরিস্থিতিতে তাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ও আন্তর্জাতিকভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা হলে একটা দিশা তারা পেতে পারতেন। কিন্তু অসহায় এই মানুষেরা এ ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট উদ্যোগ দেখতে পারছেন না। এই অনিশ্চিত জীবন তাদের বিভিন্ন অনৈতিক, বেআইনি কাজে যুক্ত করে দেবে, যেটা হয়তো স্বাভাবিক জীবনে তারা ভাবতেই পারতেন না।
বাংলাদেশ সরকারের ব্যর্থতা
বাংলাদেশ প্রত্যাবাসনের এই চুক্তি করেছে দ্বিপাক্ষিকভাবে। অর্থাৎ মিয়ানমার যদি চুক্তি ভাঙে, তাহলে তৃতীয় কেউ বিচার করার বা সিদ্ধান্ত দেওয়ার মতো নেই। আজ অবস্থার চাপে পড়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক কমিশন করা হোক, যারা দেখবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অবস্থা কী। এখন তিনি বুঝতে পারছেন যে, দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে ভুল আছে। কিন্তু এখন এই সমস্যার আন্তর্জাতিকীকরণ করতে চাইলেও তা পারা খুবই কঠিন। যখন মিয়ানমারে এই গণহত্যা চলছিল, যখন দলে দলে লোক বাংলাদেশে ঢুকছিল — তখনই ছিল এর উৎকৃষ্ট সময়, কারণ তখন গোটা বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্র ছিল এই রোহিঙ্গা সমস্যা। কিন্তু এখন একটা আন্তর্জাতিক কমিশন করা একটা কঠিন ব্যাপার। কারণ আন্তর্জাতিক মনযোগ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যু অনেকটাই সরে গেছে। সে সময় রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘের তত্ত¡াবধানে ‘সেফ জোন’ গঠন করার প্রস্তাব উঠেছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এসকল গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছাড়াই বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ভারতের সাথে দেশের ধন-সম্পদ উজার করে দেওয়া বন্ধুত্ব থাকলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে তার সামান্যতম সহযোগিতা আদায় করতে পারেনি সরকার। ভারত মিয়ানমারের প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে তাদের দেশে আমন্ত্রণ করে লাল গালিচা সংবর্ধনা দিয়েছে। বাংলাদেশের অন্যতম মিত্র চীন ও রাশিয়ার সহযোগিতাও সে পায়নি। এক কথায় কূটনৈতিক পরিসরে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সরকার।
ব্যর্থ কূটনীতির পর উস্কানিমূলক বক্তব্য — সরকারের উদ্দেশ্য কী
“রোহিঙ্গাদের ফিরে যেতেই হবে। তাদের আর বসিয়ে বসিয়ে আমরা খাওয়াতে পারব না। … আমরা তো তাদের দাবির কাছে জিম্মি হয়ে থাকতে পারি না। তাদের দাবি নিজের দেশে গিয়েই অর্জন করতে হবে।” — এরকম বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী করছেন কোনো পরিণাম চিন্তা না করে। এই চিন্তা মানুষের মধ্যে ছড়ায়। তার অভিযোগের কোনোটারই কোনো সারবস্তু নেই। গণহত্যাকারী সামরিক জান্তার কাছে গিয়ে সে কীসের দাবি করবে? একেবারে হতদরিদ্র এই জনগোষ্ঠীর কী ক্ষমতা আছে? তাদের কোনো নেতাও নেই। শিক্ষিত মানুষের সংখ্যাও খুব কম এদের মধ্যে, কারণ মিয়ানমার সরকার শিক্ষার অধিকার তাদের দেয়নি। বাংলাদেশ সরকারই ছিল বিশ্বের দরবারে তাদের প্রতিনিধি। সরকার যদি একটা অসম দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে আসেন, তার দায় কেন রোহিঙ্গারা নেবে?
এখন এ ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য ছড়ানো মানে পরিস্থিতি জটিল করে তোলা। সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতাসহ সার্বিক ব্যাপার দেখে মনে হচ্ছে, সরকার নিজেও চাইছে না রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ফিরে যাক। কিছু লোক দেখানো পদক্ষেপ ছাড়া সরকার এই ইস্যু নিয়ে দেশে দেশে ঘুরছে — এমনটা আমরা দেখছি কি? যে সকল রাষ্ট্র এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষে ছিল তাদের নিয়ে সরকার বিশ্বের দেশে দেশে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছে কি? আমাদের চোখে এর কিছুই পড়েনি। ফলে সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুকে নিয়ে তার নিজস্ব এজেন্ডা হাসিলের বাইরে সঠিক সমাধানের কথা ভাবছে না — এ আশঙ্কা অমূলক নয়।