১৫ আগস্ট। কেবল সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে আকাশে। এরই মধ্যে অন্ধকার ভেদ করে দাউ দাউ জ্বলে উঠল আগুনের লেলিহান শিখা। যে আগুন আকাশ আলোকিত করেনি, অন্ধকার নামিয়ে এনেছে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের জীবনে — ঢাকার মিরপুরে। ঝিলপাড় বস্তিতে হাজার দুয়েক ঘর। রাস্তা থেকে প্রায় সাত-আট ফুট নিচু জমিতে কাঠ আর বাশের পাটাতনের উপর টিন দিয়ে তৈরি একতলা, দু’তলা ঘরগুলো। গা ঘেষে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। চার পাঁচ হাত ঘরে ৪/৫ জন করে মানুষ বসবাস করে। সরু রাস্তায় হাঁটার জায়গা পর্যন্ত নেই। ঘিঞ্জি পরিবেশ। ময়লা স্যাঁতসেতে। একটু দাঁড়ালেই দুর্গন্ধে টেকা দায়। অথচ এমন পরিবেশেই বছরের পর বছর হাজার হাজার মানুষ বাস করছে। আলো নেই, বাতাস নেই, পানি নেই; রোগ-শোক লেগে আছে সারা বছর। এই দুর্বিষহ পরিস্থিতিতেও এরা এই পরিবেশে কেন আছে? এখানে এই বস্তিতে যারা থাকে বেশিরভাগই হয় পোশাকশ্রমিক, নয়তো গৃহকর্মী, রিকশাচালক কিংবা দিনমজুর। গ্রামে কাজ না পেয়ে অথবা কেউ নদী ভাঙনের শিকার হয়ে ভিটেমাটি হারিয়ে শহরে আশ্রয় নিয়েছে বাঁচার তাগিদে। দিনমজুরি বা অন্য যে কাজই করুক, তাতে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাড়ই দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। মাথা গোঁজার জন্য ভালো বাসা কীভাবে পাবে? তাই বাধ্য হয়ে বস্তির ঘিঞ্জি পরিবেশে আশ্রয় নেয়। কাজ করে কেউ হয়তো দু’টি পয়সা জমিয়ে ছিল ভবিষ্যতের আশায়, কেউ খাট-টিভি-ফ্রিজ কিনেছিল ধার করে অথবা কিস্তিতে। কিস্তির টাকাও এখনও শোধ হয়নি — এরই মধ্যে সর্বনাশা আগুন সব ছারখার করে দিয়ে গেল। একেবারে পথে নামিয়ে দিয়ে গেল। সর্বশেষ আশ্রয়টুকুও হারিয়ে তারা আজ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
অবশ্য নিশ্চয়তা বস্তিবাসীদের জীবনে কখনওই থাকে না। শুধু ঝিলপাড় বস্তি কেন, ঢাকা শহরে প্রায় হাজার পাঁচেক বস্তিতে যে প্রায় ৪০ লাখেরও অধিক মানুষ বসবাস করে, প্রতি দিন প্রতি মুহূর্তের অনিশ্চয়তা তাদের জীবনের সঙ্গী। এই বস্তিগুলো যেসব এলাকায় গড়ে উঠেছে, তা চাকচিক্যময় অভিজাত এলাকা ধানমন্ডি, গুলশানের মতো এলাকাগুলোর পাশেই। এসব জায়গায় গড়ে ওঠা বস্তিগুলো সবসময়ই ক্ষমতাসীনরা নিয়ন্ত্রণ করেছে। বস্তিবাসীরা হয়েছে ক্ষমতাসীনদের ঘুঁটি। ভাড়া আর চাঁদার টাকায় গড়ে তুলেছে অঢেল অর্থের পাহাড়। ফলে মানুষের জীবনের চেয়েও এদের কাছে টাকার মূল্যই বেশি। তাই কখনও বস্তি গড়ে টাকা তুলেছে। আবার জমির মূল্য বাড়ায় জমি দখলের জন্য উচ্ছেদ করেছে। বস্তিবাসীদের প্রতিরোধের মুখে সরাসরি উচ্ছেদ করতে পারে না। তাই রাতের অন্ধকারে আগুনে পুড়িয়ে সর্বস্বান্ত করে তাড়ায়। এর আগেও কড়াইল বস্তিতে এরকম একাধিক বার আগুন লেগেছে। আগুন লেগেছে মিরপুরের মোল্লা বস্তিতে, কল্যাণপুর বস্তিতে। প্রত্যেকটি ঘটনার পেছনেই দখলদারদের ইন্ধন ছিল। ঝিলপাড় বস্তিতেও আগুনের ঘটনার পেছনে এই ভূমিদস্যুদের হাত আছে বলে ইতোমধ্যেই বস্তিবাসীরা অভিযোগ করেছে। যারা ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা। তাই সবসময়ই এরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে।
প্রতিবারই বস্তি পুড়লে সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীরা পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছোটান। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু দিন শেষে কেউই আর খোঁজ রাখে না। সরকারের উন্নয়নের ছিটেফোঁটাও এসব হতভাগ্যের কপালে জুটে না। উন্নয়ন (!) হয় বস্তি উজাড় করে, আর অট্টালিকার সংখ্যা বাড়ে শহরে। যেখানে বস্তির মানুষের ঠাঁই নেই।