বিজেপি সরকারের পরামর্শে ভারতের রাষ্ট্রপতির আকস্মিক এক ঘোষণার মধ্য দিয়ে কাশ্মীরের জন্য প্রযোজ্য সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করা হলো, জম্মু-কাশ্মীর থেকে লাদাখকে পৃথক করা হলো এবং জম্মু-কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে নামিয়ে আনা হলো। শুধু তাই-ই নয়, বিশাল সংখ্যক সেনা মোতায়েন করে কাশ্মীরকে একটা ইস্পাতের চাদরে মুড়ে ফেলা হলো। মোবাইল, ইন্টারনেট, টিভি সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে, লাগাতার কারফিউ জারি করে কাশ্মীরের জনজীবন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে দেয়া হলো। এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, কাশ্মীরের জনগণের উপর অত্যাচার চলছে এবং দেশ ও বিদেশের নানান মহল থেকে যখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে, তখন ভারত সরকার কোনো উত্তর দিচ্ছে না। স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিয়ে, সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতাদের গৃহবন্দি করে কাশ্মীরে একটা যুদ্ধাবস্থা জারি করা হলো এবং সেটা সরকারের দিক থেকেই। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া আমাদের দেশেও এসে পড়েছে। এদেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীরের উপর চলতে থাকা ভারত সরকারের দমন-পীড়ন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আমাদের দেশে বিভিন্ন সময় এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভও হয়েছে। আবার কাশ্মীরের বেশ কিছু শিক্ষার্থী আমাদের দেশের বড় বড় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়া করে। এ ঘটনার পর তারা সংগঠিত হয়ে ঢাকায় একটি মিছিলও করেছে। ঢাকায় বাম ছাত্রসংগঠনগুলো ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে। সব মিলিয়ে কাশ্মীর ইস্যুটি এ সময়ে বেশ আলোচিত ও সংবেদনশীল। আবার একথাও সত্য যে, কাশ্মীরের বাস্তব পরিস্থিতি কী, কেন এমন হলো, সমাধানের রাস্তা কীÑএ নিয়ে খুব স্পষ্ট বক্তব্য রাজনৈতিক মহলগুলো থেকে খুব একটা পাওয়া যায়নি, অন্তত আমাদের চোখে পড়েনি। কাশ্মীর ইস্যু অনেক বিস্তৃত। এ বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে ইতিহাসের অনেক ঘটনা ও অনেকগুলো তাত্তি¡ক প্রশ্নের মীমাংসা করে এগোতে হয়। একটা ক্ষুদ্র পরিসরের নিবন্ধে এটা সম্ভব নয়। তারপরও এ নিবন্ধে আমরা মূল বিষয়গুলোর উপর মোটাদাগে কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করব।
প্রেক্ষাপট
ভারত ও পাকিস্তানের জন্মকালীন কিছু অসঙ্গতি না জানলে এ আলোচনা শুরু করা যাবে না। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য প্রাণদানের বিরাট ও মহৎ ইতিহাস থাকলেও তৎকালীন আপোসকামী নেতৃত্বের কারণে ভারতের স্বাধীনতার সিদ্ধান্ত হয় ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে, গঠিত হয় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্র। গভর্নর জেনারেল মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতাদের সাথে বসেন এলাকা ও সীমানা নিয়ে। বাস্তবে স্বাধীনতার সকল আয়োজন শাসক প্রভুই করেন, সবাই নিজেদের অংশ গোছানোর জন্য প্রতিদিন তার দরজায় এসে দাঁড়ান।
সে সময় এ উপমহাদেশে নানা আকৃতি ও প্রকৃতির ৫৬২টি রাজ্য (Princely states) ছিল। এরমধ্যে ১৪০টি রাজ্য ছিল পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন। জম্মু ও কাশ্মীর ছিল দেশীয় রাজা শাসিত — এরকমই একটি রাজ্য।
কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের মতো এই রাজ্যগুলোর রাজারাও বসেন মাউন্টব্যাটেনের সাথে। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়ে দুটি দেশে বিভক্ত হওয়ার পরও মাউন্টব্যাটেনের তদারকিতে এই রাজ্যগুলো নিয়ে সওয়াল চলতে থাকে। মাউন্টব্যাটেন তখন ব্রিটিশ অধ্যুষিত ভারতবর্ষের ভাইসরয় থেকে স্বাধীন ভারতের গভর্নর জেনারেল হয়েছেন। ১৯৪৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত তিনি সে দায়িত্বে ছিলেন। তখন ভারত স্বাধীন কিন্তু তার রাষ্ট্রীয় পরিচয় হলো দেশের রাজা চতুর্থ জর্জ, গভর্নর জেনারেল মাউন্টব্যাটেন এবং প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু। এই প্রেক্ষাপটে দেশীয় পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন রাজ্যগুলো ভারত কিংবা পাকিস্তান কার সাথে যুক্ত হবে, নাকি স্বাধীন থাকবে এটা নিয়ে রাজারা একবার মাউন্টব্যাটেনের সাথে, একবার নেহেরুর সাথে, একবার জিন্নাহ্র সাথে বসেছেন। জটিল সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই রাজ্যগুলোর সামনে ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রণীত ‘গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট’-এর অন্তর্গত ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন (অন্তর্ভুক্তি দলিল)’ অনুযায়ী তিনটি রাস্তা খোলা ছিল। তারা ভারতের সাথে কিংবা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবেন, নয়তো তৃতীয় পথ নেবেন। অর্থাৎ স্বাধীন রাজ্য হিসেবে অবস্থান করবেন।
এসময়ে ত্রিবাঙ্কুর ও হায়দ্রাবাদের মহারাজা শাসিত সরকারগুলি স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কাশ্মীরের রাজা হরি সিংও একই পথে যাওয়ার কথাই ভাবছিলেন। এই পরিস্থিতিতে ভারত ও পাকিস্তানের শাসকরা প্রমাদ গুনলেন। ভারত ও পাকিস্তান এই দুই জাতীয় রাষ্ট্রের পাশাপাশি নানা স্বাধীন দেশীয় রাজ্যের অবস্থান তাদের মেনে নিতে হবে —এই সম্ভাবনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নতুন জন্ম নেওয়া দেশ দুটির শাসকবৃন্দ দুটো কাজ করলেন। এক, রাজ্যগুলোর সাথে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার চুক্তি করার চেষ্টা করলেন। দুই, বুঝিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করিয়ে অন্তর্ভুক্তির পাশাপাশি বলপ্রয়োগের রাস্তাও অবলম্বন করলেন।
আবার রাজ্যগুলোর দিক থেকেও অন্তর্ভুক্তির চুক্তিতে স্বাক্ষর করার একটা প্রয়োজন ছিল। কারণ রেল, সড়ক ও জলপথের যোগাযোগ; ডাক ও তার; খাদ্য ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তারা ব্রিটিশ ভারতের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিল। ফলে সহজেই আলাদা হয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, বরং যথাসম্ভব স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে এই রাষ্ট্র দুটির কোনো একটিতে অন্তর্ভুক্তিই ছিল তুলনামূলকভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত। এই অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্ম ও তাদের অবস্থানগত সংলগ্নতা – এ দুটি বিষয়ই মূলত মানদন্ড হিসেবে কাজ করেছে।
কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তি
জম্মু ও কাশ্মীর একটি মুসলিমপ্রধান রাজ্য, যার শাসনভার ছিল হিন্দু রাজা হরি সিংয়ের হাতে। মাউন্টব্যাটেন প্ল্যান অনুযায়ী এ রাজ্যের পাকিস্তানের সাথেই সংযুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু মাউন্টব্যাটেন প্ল্যান কিংবা হরি সিংয়ের ইচ্ছা নয়, কাশ্মীরের সংযুক্তির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ালো আরেকটি ফ্যাক্টর। কাশ্মীরের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে তখন শেখ আব্দুল্লাহ্ উঠে এসেছেন। তাঁর নেতৃত্বে ‘ন্যাশনাল কনফারেন্স’ কাশ্মীর উপত্যকার জনগণকে নিয়ে সামন্তী রাজা হরি সিং ও তার চূড়ান্ত অত্যাচারী ডোগরা সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম পরিচালনা করে এক কাশ্মিরী আত্মপরিচয়ের জন্ম দিয়েছিল। কাশ্মিরী জনগণের এই স্বতন্ত্র জাতিসত্তাবোধ অন্তর্ভুক্তির মূল মানদন্ড ধর্মভিত্তিক দ্বি-জাতি তত্ত্বকে সমর্থন করেনি। যখন ধর্মভিত্তিক দেশভাগ নিয়ে গোটা উপমহাদেশ দাঙ্গা কবলিত ও হিন্দু-মুসলমান এই সম্প্রদায়ের মানুষের একাংশ হত্যার তান্ডবলীলায় উন্মত্ত, কাম্মীর মুসলমানপ্রধান রাজ্য হওয়া সত্ত্বেও ‘ন্যাশনাল কনফারেন্স’-এর নেতৃত্বে দাঙ্গার পথে পা বাড়ায়নি, পাকিস্তানের সাথেও অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছে। এই মূল্যবোধ সেই অগ্নিগর্ভ সময়ে দৃষ্টান্তমূলক।
এরকম একটি পরিস্থিতিতে জম্মু ও কাশ্মীরকে দখল করতে পাকিস্তান সামরিক অভিযান চালায় ১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবরে। তারা প্রথমেই বাধা পায় শেখ আব্দুল্লাহ্র ন্যাশনাল কনফারেন্সের উদ্যোগে সংগঠিত ‘গণবাহিনী’র (People’s militia) কাছ থেকে। পাকিস্তানের এ আক্রমণকে কাশ্মীরের জনগণ তাদের স্বাতন্ত্র্য ও আজাদীর উপর আঘাত হিসেবেই নিয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে কাশ্মীরের জনগণ, তাদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ আব্দুল্লাহ্ ন্যাশনাল কংগ্রেসের মাধ্যমে ভারতে অন্তর্ভুক্তিকে অনুমোদন দেয়। রাজা হরি সিং ভারতে অন্তর্ভুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করেন। ১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ শেখ আব্দুল্লাহ্ কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী হন।
শুধু পাকিস্তানের আক্রমণের কারণেই যে এমনটা ঘটে গেল ব্যাপারটা তা নয়। কাশ্মীরের জনগণের আকাক্সক্ষা তখন পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হওয়ার অনুকূলে ছিল না। শেখ আব্দুল্লাহ্ নেতৃত্বে দীর্ঘদিন সকল ধর্মের মানুষকে নিয়ে রাজার বিরুদ্ধে লড়াই করার মধ্য দিয়ে সেখানে একটা ধর্মনিরপেক্ষ মনন গড়ে উঠেছিল। এই প্রেক্ষিতেই ১৯৩২ সালে গঠিত ‘কাশ্মীর মুসলিম কনফারেন্স’ সকল ধর্মের কাশ্মীরীদের রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য ১৯৩৯ সালে তার নাম পাল্টে ‘ন্যাশনাল কনফারেন্স’ রাখে। আবার রাজার নিরঙ্কুশ শাসনের অবসানের জন্য লড়াই যেহেতু তারা করেছে, তাই একটি গণতান্ত্রিক ও প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাও তাদের মধ্যে ছিল। এ দুটোর কোনোটাই পাকিস্তানের চিন্তার সাথে খাপ খায় না। পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোটা ধর্মভিত্তিক ও সামন্ত বৈশিষ্ট্যের। অপরদিকে ভারত তখন তার সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা নিয়ে এসেছে, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলছে। ফলে স্বভাবতই শেখ আব্দুল্লাহ্ ও কাশ্মীরের জনগণ অন্তর্ভুক্তির তুলনামূলক বিচারে ভারতকেই বিবেচনা করেছেন। গণপরিষদে পেশ করা শেখ আব্দুল্লাহ্ বক্তব্য থেকে আমরা পাই, “একটি রাষ্ট্রের প্রকৃত চরিত্র তার সংবিধানের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। ভারতীয় সংবিধান গোটা দেশের সামনে সেক্যুলার গণতন্ত্রের লক্ষ্য তুলে ধরেছে – কোনরকম ভেদাভেদ না করে সকলের জন্য ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও সমানাধিকারই যার ভিত্তি। এটাই আধুনিক গণতন্ত্রের দৃঢ় ভিত্তি। এটাই আধুনিক গণতন্ত্রের দৃঢ় ভিত্তিভূমি। এটার দ্বারা তাঁদের সেই প্রশ্নের জবাব হয়ে যায় যাঁরা বলেন যে, ভারতের জনসংখ্যার বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যেহেতু হিন্দু, তাই কাশ্মীরের মুসলসমানরা সেখানে নিরাপত্তা পেতে পারে না। … আমাদের কাশ্মীর রাজ্যের আন্দোলনেও সেক্যুলার গণতন্ত্রের এই নীতিগুলোর দিকে স্বভাবতই পাল্লা ভারী থেকেছে। এখানকার জনসাধারণ এমন কোনো নীতি কখনই মেনে নেবে না, যা অন্যান্য ধর্ম বা সম্প্রদায়ের মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো একটি বিশেষ ধর্মীয় বা সামাজিক গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখতে চায়।”
আরেকটা বিষয় শেখ আব্দুল্লাহ্ উল্লেখ করেছেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘আতিশ-ই-চিনার’-এ। তিনি পাকিস্তানের তুলনায় ভারতীয় যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরে জম্মু ও কাশ্মীরের উন্নয়নের সম্ভাবনা বেশি দেখেছিলেন। তাঁর ভাষায়, “ … ‘চাষীদের হাতে জমি’ — এই নীতিকে আমরা আইনসম্মত করতে পেরেছি এবং তাকে বাস্তবেও সফল রূপ দিতে সক্ষম হয়েছি। … যে পাকিস্তানে জমিদাররা দাপটের সাথে অবস্থান করছে, যেখানে অসংখ্য সামন্তী সুবিধা ও অধিকার অক্ষত অবস্থায় টিকে রয়েছে, সেই পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা নিজেদের যুক্ত করলে আমাদের এই সমস্ত অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচীগুলোকে তারা মেনে নেবে, সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত কি?”
শেখ আবদুল্লাহ আশা করেছিলেন ভারতীয় যুক্তরাজ্যের সাথে জম্মু ও কাশ্মীর যুক্ত হলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এখানে কোনোরকম হস্তক্ষেপ করবে না, বরং এই সংযুক্তি জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের জীবনের বিকাশ ও অগ্রগতি ঘটাতে সহযোগিতা করবে। আজ ২০১৯ সালে এসে কী নির্মম বাস্তবের মুখোমুখি হতে হলো আমাদের! কী বিরাট আশা ও স্বপ্ন নিয়ে কাশ্মীরের জনগণ ভারতের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন, কী নিষ্ঠুর প্রতিদান তারা পেলেন! কত গভীর ও তীব্র এই আঘাত তা বোঝা যায়, সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো আজ যখন শেখ আব্দুল্লাহকে ভারতের বশংবদ বলে আখ্যা দেয়, তখন কাশ্মীরীদের মধ্যেও এটা বিশ্বাস করার মতো একদল লোক পাওয়া যায়।
একের পর এক পদক্ষেপে ৩৭০ ধারাকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়েছে
শেখ আব্দুল্লাহ্ ও কাশ্মীরের জনগণের বিশ্বাসের মূল্য ভারত সরকার দেয়নি। ৩৭০ ধারায় সাংবিধানিকভাবে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা স্বীকৃত হয়েছিল। তাদের স্বতন্ত্র পতাকা, এমনকী তাদের রাজ্যপ্রধান ও সরকারপ্রধানেরা ‘সদর-ই-রিয়াসত’ এবং ‘প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। শেখ আব্দুল্লাহ্ কখনওই কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার পক্ষে হানিকর কোনোকিছুই কখনও মেনে নেননি। কিন্তু অন্তর্ভুক্তির পর থেকে ভারত সরকার কাশ্মীরের জন্য অপমানজনকÑএমন সিদ্ধান্ত একের পর এক নিতে থাকে। ফলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে শেখ আব্দুল্লাহ্ দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ‘ন্যাশনাল কংগ্রেস’-এর মধ্যেও ভারত সরকার তাদের অনুগত একদল লোক তৈরি করে। গোপালকৃষ্ণ আয়েঙ্গার যখন কেন্দ্রীয় সরকারের ‘পূর্বতন দেশীয় রাজ্যগুলির বিষয় সংক্রান্ত দপ্তরের’ মন্ত্রী হন, দ্বন্দ্ব তখন আরও তীব্র হয়। নেহেরু আয়েঙ্গারের পাশে দাঁড়ান। জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাকে ধাপে ধাপে বিলোপ করে অন্য রাজ্যগুলোর সাথে এক কাতারে তাকে নিয়ে আসার যে পরিকল্পনা আগে থেকেই চলছিল তা আরও গতি পায়। শেখ আব্দুল্লাহ্ সাথে ভারত সরকারের দ্বন্দ্ব অনিরসনীয় পর্যায়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৫৩ সালে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ ও গ্রেফতার করা হয়।
শেখ আব্দুল্লাহ্ গ্রেফতারের পর থেকে ভারত সরকার আইনসভার ক্ষমতাবণ্টন এবং কেন্দ্র, রাজ্য ও যুগ্ম তালিকা সংক্রান্ত ১৯৫০ সালের সাংবিধানিক (জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) নির্দেশিকা বারবার পরিবর্তন করেছে, ভারতীয় সংসদের অধিকারকে জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত করেছে। এরপর থেকে ধাপে ধাপে বিভিন্ন পদক্ষেপে তাদের বিশেষ মর্যাদাকে প্রায় বিলুপ্ত করে এনেছে। ৩৭০ ধারা দীর্ঘদিন ধরেই অকার্যকর হয়ে আছে। তারপরও সংবিধানে থাকার কারণে যতটুকু বা এটা নিয়ে কথা বলা যেত, সে রাস্তাও বন্ধ করে দেওয়া হলো। বলা যেতে পারে কাশ্মীর প্রসঙ্গে স্বাধীনতার পর থেকেই কংগ্রেস যে অনৈতিক ভূমিকা নিয়েছে, তার ধারাবাহিকতায় বিজেপির এই সিদ্ধান্ত।
ভারতের কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট ৩৭০ ধারাকে বাতিল কিংবা পরিবর্তন করতে পারে না
ভারতীয় সংবিধানে ৩৭০ ধারা ভারত সরকার দ্বারা অনুমোদিত হয়নি। অনুমোদিত হয়েছিল ১৯৩৫ সালের ‘গভর্মেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট’, ১৯৪৬ সালের ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট’, ১৯৪৭ সালের ‘দি ইন্ডিয়ান কন্সটিটিউশন অর্ডার’-এর প্রাসঙ্গিক ধারাগুলোর মাধ্যমে এবং অন্তর্ভুক্তির দলিলের মাধ্যমে। ৩৭০ ধারা যেহেতু ভারতীয় সরকার কিংবা পার্লামেন্টের অনুমোদনের মাধ্যমে সংবিধানে সংযোজিত হয়নি, সেহেতু সেটা বাতিলের ক্ষমতাও কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট কিংবা সরকার রাখে না। এটা পরিবর্তন বা বাতিল করার অধিকার আছে একমাত্র জম্মু ও কাশ্মীরের পার্লামেন্টের। সে যদি তার বিশেষ মর্যাদাকে পরিত্যাগ করে ভারতীয় যুক্তরাজ্যের সাথে একীভূত হয়ে অন্যান্য রাজ্যের মতো তারই একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত হতে চায়Ñতবেই ৩৭০ ধারা বাতিল হতে পারে, তার আগে নয়। অথচ আমরা দেখলাম, গত ৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতির নির্দেশে কোনো আলোচনা ছাড়াই এই ধারাকে বাতিল ঘোষণা করা হলো।
১৯৭৫-এর চুক্তি ও ’৮০-এর দশক
শেখ আব্দুল্লাহ্ ১৯৬৪ সালে মুক্তি পান। এরপরেও তাকে বারবার জেলে নেওয়া হয়েছে। তিনি বিভিন্ন মেয়াদে প্রায় ২০ বছরের মতো কারাগারে ছিলেন। এসময়ে ভারত সরকারের অনুগত একের পর এক পুতুল সরকার কাশ্মীরের শাসনক্ষমতায় বসানো হলো। এভাবে চলতে থাকলো কাশ্মীরের সাথে ভারত সরকারের বিশ্বাসঘাতকতার পর্ব। এরই মাঝে, ১৯৭৭ সালে শেখ আব্দুল্লাহ্ পুনরায় কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে শেখ আব্দুল্লাহ্ একটি অসম চুক্তি করলেন। ইন্দিরা গান্ধীর আশ্বাসে বিশ্বাস করা তাঁর উচিত ছিল না। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করলেন এবং সেটা তাঁর উপর জনগণের বিশ্বাসকে অনেকখানি মলিন করে দিল। ১৯৮২ সালে মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত শেখ আব্দুল্লাহ্ কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
এই দীর্ঘ সময়ে কাশ্মীরে শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ স্থাপন করে, চাকুরির সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে শেখ আব্দুল্লাহ্র ছেলে ফারুক আব্দুল্লাহ্ ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতৃত্ব দেন ও নির্বাচনে জয়ী হন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এই মন্ত্রীসভাকে রদ করে ও সরাসরি কেন্দ্রের শাসন জারি করে। রাজ্যপাল করা হয় জগমোহনকে। কাশ্মীরীদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার শুরু হয়। কাশ্মীরে একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘Half widow’ অর্থাৎ হাজার হাজার মেয়ে তারা জানে না তাদের স্বামী বেঁচে আছেন কি না। তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের মৃত্যুও নিশ্চিত করা যায়নি। কতটা ভয়াবহ এ নির্যাতন তা বোঝার জন্য এর চেয়ে বেশি বলার দরকার পড়ে না।
এ অবস্থায় একটা রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে যায় কাশ্মীরে। এই ক্ষোভ ও অপমানকে সঠিক সংগ্রামের পথ দেখাতে যখন নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়, শেখ আব্দুল্লাহ্র পরে তার পরবর্তী নেতারা যখন কমবেশি ভারত সরকারে খেলার পুতুলে পরিণত হন, রাজনৈতিক সেই শূন্যতার মধ্যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান ঘটে, কাশ্মীর সশস্ত্র আন্দোলনের দিকে পা বাড়ায়। গণতান্ত্রিকভাবে মতপ্রকাশের সকল অধিকার সংকুচিত হলে সশস্ত্র আনেন্দালনে মানুষ যাবেই, এটাই আন্দোলনের ঐতিহাসিক শিক্ষা। সীমান্তের অপর পাশে পাকিস্তানের মৌলবাদী শক্তিও এর সুযোগ নেয়। অথচ কাশ্মীরে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ইতিহাস খুবই বিরল। কাশ্মীরীরা খুবই শান্তিপ্রিয় ও অতিথিপরায়ণ। আজ তাদের জাত্যাভিমান ও মর্যাদাবোধের উপর ক্রমাগত আক্রমণ তাদের এক অংশকে এই জায়গায় ঠেলে দিয়েছে। আবার এই উগ্র-সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে সা¤্রাজ্যবাদীদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে।
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কাশ্মীরের সকল নাগরিকই এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে
কাশ্মীরের সকল ধর্ম ও মত নির্বিশেষে সকলেই ভারত সরকারের এ ধরনের আচরণের তীব্র বিরোধী। শুধু মুসলমানরাই কাশ্মীরে সমস্যা তৈরি করছে বলে যে অভিযোগ করা হচ্ছে, সেটা মোটেও সত্য নয়। ৩৭০ ধারা বাতিলের প্রতিবাদ করে জম্মু ও কাশ্মীরের ৬৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক স¤প্রতি একটি পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন প্রখ্যাত চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ, নাট্যকর্মী, সাংবাদিক, প্রাক্তন ভাইস এয়ার মার্শাল, গবেষক ও ছাত্রছাত্রীরা; যাঁদের অধিকাংশই কাশ্মীরী পÐিত, ডোগরা ও শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ। সরকারের এই পদক্ষেপকে তাঁরা ‘অসাংবিধানিক এবং জম্মু-কাশ্মীরের মানুষকে দেওয়া ঐতিহাসিক প্রতিশ্রæতির লঙ্ঘন’ বলে মন্তব্য করেছেন। পিটিশনে তাঁরা বলেছেন, যেভাবে গণতন্ত্রের সমস্ত রীতিনীতি লঙ্ঘন করে রাজ্যের বিধানসভার মতামতের তোয়াক্কা না করে গোপনীয়তার আড়ালে বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিয়ে জম্মু কাশ্মীরকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভেঙে দেওয়া হলো, তা কেন্দ্রীয় সরকারের চরম কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার প্রকাশ।
পিটিশনে তাঁরা বলেন, ‘‘আমরা, জম্মু-কাশ্মীরের জনগণ জোরের সঙ্গে বলতে চাই যে, আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে, আমাদের অনুমতি ছাড়াই আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গৃহীত সিদ্ধান্তকে আইনসঙ্গত বলা যায় না। এই একতরফা, অগণতান্ত্রিক এবং অসাংবিধানিক সিদ্ধান্ত যা আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হলো, আমরা তার নিন্দা করছি ও তা প্রত্যাখ্যান করছি।’’
অবিলম্বে জম্মু-কাশ্মীরের উপর অবরোধ জারির পরিস্থিতি হটিয়ে রাজ্যের মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগ অবাধ করতে হবে এবং সমস্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মুক্তি দিতে হবে বলে পিটিশনে দাবি তোলেন তাঁরা।
সবশেষে তাঁরা বলেন, ‘‘জন্মভূমির এই বিভাজনে যন্ত্রণাবিদ্ধ আমরা এই সংকটের সময়ে একজোট হয়ে দাঁড়ানোর শপথ নিচ্ছি। জাতপাত, সংস্কৃতি এবং স¤প্রদায়ের ভিত্তিতে আমাদের মধ্যে বিভাজন ঘটানোর যে কোনো অপচেষ্টা আমরা প্রতিরোধ করব।’’ (সূত্র : টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ১১ আগস্ট, ২০১৯)
ন্যাশনালিটি প্রশ্নে ভারতের বুর্জোয়াশ্রেণির ভূমিকা
ভারত বহু জাতিসত্তা অধ্যুষিত রাষ্ট্র। তার ন্যাশনালিটি সমস্যাটি এখনও অমীমাংসিতই থেকে গেছে। যে সংহতি এখানে গড়ে উঠেছে তা শুধুই রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে একটা জাতীয়তাবোধ বিকশিত হলেও জাতপাত, প্রাদেশিকতা, আঞ্চলিকতা – এসবের বিরুদ্ধে তৎকালীন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব লড়েনি। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় নেতৃত্বে থাকা জাতীয় বুর্জোয়াশ্রেণি ছিল শ্রমিকবিপ্লবের ভয়ে ভীত, ফলে সে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ে না গিয়ে আপোসের পথে হেঁটেছে। জাতপাত, কুসংস্কার, আঞ্চলিকতা – এগুলো সমাজমননে, এমনকী বুর্জোয়া আন্দোলনের নেতৃত্বের মধ্যেও ছিল। তার প্রভাব ভারতবর্ষ প্রতিষ্ঠার পরেও আমরা দেখতে পাচ্ছি।
আবার ভারতে একটি একচেটিয়া পুঁজিপতি শ্রেণি গড়ে উঠেছে। তারা গোটা দেশে তাদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সংহত করতে চায়। সেজন্য একটি অখন্ড ও সমসত্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা তাদের খুবই দরকার। বহুরকম জাতিসত্তা অধ্যুষিত দেশে প্রত্যেকটি জাতিসত্তার ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিকাশ ও অগ্রগতির অবাধ সুযোগ করে দিয়ে, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বমূলক পরিবেশ তৈরি করে সকল ক্ষেত্রে পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে ঐক্য স্থাপন করতে হয়। বড় বড় জাতিসত্তার দ্বারা ছোট জাতিসত্তার দমনের মাধ্যমে বড় জাতিসত্তার যে আধিপত্য বিস্তারের সম্ভাবনা থাকে. সেটাকে কোনোভাবেই সমর্থন না করে সকল জাতিসত্তার অবাধ ও মুক্ত বিকাশের পথ সুগম রাখতে হয়। বর্তমানের কোনো পুঁজিবাদী দেশেই আজ আর এটা সম্ভব নয়। উপরন্তু ভারতের পুঁজিপতি শ্রেণি বর্তমানে গভীর সংকটে নিমজ্জিত। প্রবৃদ্ধির হার কয়েক বছরের মধ্যে এখন সর্বনিম্ন, মারুতিসহ বড় বড় কোম্পানিগুলো লোক ছাঁটাই করছে, উৎপাদন বন্ধ রাখছে। গোটা দেশের উপর ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সংহত করা এখন তাদের জন্য খুব দরকার। স্থানীয় পুঁজির যে বিরাট ভূমিকা এখনও ভারতের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে আছে, সেটাকে পরাস্ত করে জাতীয় পুঁজির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা দরকার। ‘এক নেতা, এক পতাকা, এক ভাষা ও এক দেশ’ — বিজেপি’র এই শ্লোগানের মধ্য দিয়েই ভারতীয় পুঁজিপতিদের উদ্দেশ্য বোঝা যায়। সহজেই বোঝা যায় যে, বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে ঐক্য স্থাপনের স্বাভাবিক ও বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় তো সে যাবেই না, আজকের যুগে কোনো পুঁজিপতি দেশেরই যাওয়ার উপায় নেই। ফলে জুলুম, জবরদস্তি ও দমনের মাধ্যমেই সেটা সে করবে। কিন্তু যে বিষয়টা ভাবার মতো সেটা হলো, বিভিন্ন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে এসব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় (federal) যে কাঠামোটা থাকে, ভারত রাষ্ট্রের প্রবণতাটা সেইদিকেও আর থাকছে না। এই গতিমুখটা এখন মূলত এককেন্দ্রিক (unitary) ব্যবস্থার দিকে বেশি। সেটা ভারতের পুঁজিপতিশ্রেণির এখনকার নীতি নয়, অনেক আগে থেকেই সেটা ছিল। সেকারণে দেখা যায়, যখন দেশীয় রাজ্যগুলো ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় তখন বৈদেশিক বিষয়, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ ছাড়া কোনো বিষয় তাদের ছাড়তে হয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের ধাপে ধাপে লাগোয়া প্রদেশগুলোর সাথে মিলিয়ে দিয়ে, না হয় একাধিক দেশীয় রাজ্যকে সংযুক্ত করে প্রদেশ ঘোষণা করে তাদেরকে তা মেনে নিতে বাধ্য করা হয়। সেই দীর্ঘদিনের নীতি এখনও বলবৎ আছে, সংকট তীব্র হচ্ছে বলে আগ্রাসী মনোভাবও বাড়ছে। ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণিও রাষ্ট্র ক্ষমতায় এমন শক্তিকে পছন্দ করছে, যারা এই দমন-পীড়ন ও লাগামছাড়া পদক্ষেপকে নিষ্ঠুরভাবে প্রয়োগ করতে পারে, এর বিরুদ্ধে আসা সকল বাধাকে নির্মমভাবে মোকাবেলা করতে পারে। বিজেপির উত্থানের পেছনের এটাও একটা কারণ।
কাশ্মীরীরা এখন কী চায়
বেশ কিছু সময় ধরে কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবি জোরালো হচ্ছে। আমাদের দেশের বিভিন্ন চিন্তাশীল অংশেরও এমন মতামত যে, কাশ্মীর স্বাধীন হলেই ভালো। ব্যাপারটাকে আমরা একটু বিশ্লেষণ করে দেখি। স্বাধীনতা নিয়ে ‘জম্মু ও কাশ্মীর’ গণপরিষদে অলোচনা হয়েছে। সেখানে শেখ আব্দুল্লাহর বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য — “তৃতীয় যে পথটি আমাদের সামনে খোলা রয়েছে, তা নিয়েও আমাদের আলোচনা করতে হবে। পার্শ্ববর্তী দুই রাষ্ট্র থেকে দূরত্ব বজায় রেখে, কিন্তু তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে, আমরা নিজেদের পূর্ব সুইজারল্যান্ডের মতো গড়ে তুলব কিনা, সেই বিকল্প সম্পর্কে আমাদের বিবেচনা করতে হবে। বর্তমান অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথ এর মধ্যে রয়েছে — একথা ভেবে এই বিকল্পকে আকর্ষণীয় মনে হতে পারে। একটি পর্যটন নির্ভর দেশ হিসেবে আমরা এই বিকল্প থেকে বিশেষ কিছু সুবিধা অবশ্যই পেতে পারি। কিন্তু স্বাধীনতার প্রশ্ন বিচার করার সময় বাস্তব অবস্থা বিবেচনার বিষয়টি আমাদের কিছুতেই অবহেলা করলে চলে না। প্রথমত, আমাদের দেশ একটি ছোট দেশ, যার সাথে অনেকগুলি সীমানা যুক্ত হয়ে আছে। এই দীর্ঘ ও দুর্গম সীমান্ত এলাকাগুলিকে রক্ষা করার মতো যথেষ্ট শক্তি আমাদের নেই। এই অবস্থায় আমাদের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে রক্ষা করা খুব সহজ নয়। দ্বিতীয়ত, সকল প্রতিবেশী দেশের শুভেচ্ছা আমাদের পেতেই হবে। এদের মধ্যে এমন শক্তিশালী গ্যারান্টারদের আমরা পাব কি — যারা নিজেদের শক্তিকে একত্র করে, যেকোনো রকম আক্রমণ থেকে আমাদের স্বাধীনতা রক্ষায় সর্বদা নিশ্চয়তা দেবে? আমি আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই – ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত আমাদের রাজ্য স্বাধীন ছিল এবং তার ফল দাঁড়িয়েছিল এই যে, আমাদেরই প্রতিবেশী, যাদের সঙ্গে আমাদের বৈধ স্থিতাবস্থা চুক্তি ছিল, তারা আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছিল। আমাদের রাজ্য আক্রান্ত হয়েছিল। ভবিষ্যতেও এই ধরনের আক্রমণের স্বীকার আমরা হব না – এর কোনো গ্যারান্টি আছে কি?”
শেখ আব্দুল্লাহর সেই বিচার ও বিশ্লেষণ যে সর্বকালে, সর্বপরিস্থিতিতে এক হবে তা নয়। এই সময়ের বিশেষ পরিস্থিতিতে আমরা একে অন্যভাবেও ভাবতে পারি। কারণ আমেরিকার কোলের কাছে আমরা ছোট্ট দেশ কিউবাকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেখেছি। উত্তর কোরিয়া কিংবা ভিয়েতনামও ছোট দেশ, অথচ কোনো বাধাই তাদের আটকাতে পারেনি। কিন্তু কাশ্মীরের পরিস্থিতি কী বলছে? বর্তমানে কাশ্মীরের অভ্যন্তরের দ্বন্দ্ব গুলো বিশ্লেষণ করলে শেখ আব্দুল্লাহর এ সকল প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাচ্ছে কি? লাদাখ, বালতিস্তান আর কাশ্মীর উপত্যকার মানুষের উপজাতিগত আশা-আকাঙ্ক্ষা (nationality aspiration) কি এক? কাশ্মীরের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যেও আঞ্চলিক স্বশাসনের দাবি আছে। তিনটি মুখ্য ধর্ম অনুসরণকারী এথনিক ও ভাষাগত ৫/৬ টি আঞ্চলিক গোষ্ঠীর সমন্বয়ে কাশ্মীর গঠিত। এই আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলোর সবাইকে যুক্ত করে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিগত আশা-আকাঙ্ক্ষা এখানে গড়ে ওঠেনি। সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কোনো অবিসংবাদিত নেতারও আবির্ভাব সেখানে ঘটেনি। শেখ আব্দুল্লার পরে বিভিন্ন অংশে গোটা রাজনীতি বারবার বিভক্তই হয়েছে। এই ফ্যাক্টরগুলো কি স্বাধীনতার দাবিকে সমর্থন করে?
আবার কাশ্মীরের পাকিস্তানে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারেও অনেকে মত দিচ্ছেন। এর যুক্তি হিসেবে দেখানো হচ্ছে যে, পাকিস্তান অধ্যুষিত কাশ্মীর তো তুলনামূলকভাবে ভালো আছে। এই অত্যাচার তো সেখানে নেই। কথাটা আপেক্ষিক অর্থে ঠিক, কিন্তু এত বড় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এটাও ভেবে দেখা দরকার, যে জাতিগত মর্যাদাবোধ রক্ষার জন্য কাশ্মীরীদের এত অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে, পাকিস্তান তার মূল্য দেবে তো? পাকিস্তানের ইতিহাস কী বলে? একই ধর্মের শাসকগোষ্ঠী হলেই তাতে উপজাতিগত ও আঞ্চলিক প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে যায় না। পাকিস্তানে অন্য উপজাতিদের উপর পাঞ্জাবীদের আধিপত্য, বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেষ্টা কাশ্মীরীদের আত্মমর্যাদা বজায় রেখে চলতে পারার নিশ্চয়তা দেয় না।
আজ কোনো পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সঠিক পথে ন্যাশনালিটি সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নই একমাত্র এক্ষেত্রে একটা উদাহরণ তৈরি করেছিল। এখন এই একচেটিয়া পুঁজির যুগে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র মানেই বিভিন্ন উপজাতির উপর বৃহৎ উপজাতির দমন-পীড়ন চলবে, আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলবে। ধর্মের ভিত্তিতে কোনো ঐক্যই সম্ভব নয়। তা না হলে আমাদের দেশ স্বাধীন হতো না, ভারতের ভেতরে হিন্দু অধ্যুষিত বিভিন্ন রাজ্যের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার চিন্তা জন্ম নিত না। কিন্তু এ-ও ঠিক, এই প্রবল অত্যাচার ও নিপীড়নের মধ্য দিয়ে কাশ্মীরীরা আর চলতে পারে না। ভারত সরকার যদি মনে করে, এভাবে সে এই রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, তাহলে ভুল করছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এভাবে কোনো জনগোষ্ঠীকে দমিয়ে রাখা যায় না। সেক্ষেত্রে তার ভবিষ্যৎ কী হবে এবং কখন সেটা গুণগত পরিবর্তনে রূপ নেবে — সেটা জানার জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। ভারতের গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন জনগণ ও রাজনৈতিক এবং সামাজিক শক্তিগুলো যদি দেশের অভ্যন্তরে একটা প্রবল আন্দোলন তৈরি করতে পারে, ৩৭০ ধারার যথাযথ প্রয়োগে সরকারকে বাধ্য করতে পারে, তবে হয়তো মানুষকে আশ্বস্ত করা যাবে, মূল ভূখন্ডের লড়াই করা লোকেদের সাথে তাদের একটা ঐক্য তৈরি হবে। আরেকটা ব্যাপার হতে পারে, কাশ্মীরীদের মধ্যে যদি স্বাধীনতা কিংবা পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি – এর কোনো একটা দাবি স্থায়ী হয়, সেটা নিয়ে আন্দোলন হয়, তবে প্রগতিশীল না প্রতিক্রিয়াশীল কোন শক্তির হাতে তার নেতৃত্ব থাকছে তার উপর তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে। আরেকটা গতিপথ আছে, সেটা হলো বাইরের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর সরাসরি হস্তক্ষেপ – সেটা হলে শুধু কাশ্মীর নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলেই এর একটা দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক ফল বর্তাবে।