দেশে করোনাভাইরাসে শনাক্তের সংখ্যা ৪ লাখের কাছাকাছি। কোভিড আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মানুষ (৮ অক্টোবর পর্যন্ত)। বেসরকারি একটি সংস্থা কেবলমাত্র সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর সংগ্রহ করে জানিয়েছে-দেশে এপর্যন্ত করোনা উপসর্গে (পরীক্ষা করা হয়নি) মারা গেছেন আরও অন্তত ৩ হাজার মানুষ। বর্তমানে প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা গড়ে ২০-৩০ জন। বিশেষ করে বয়স্করা ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্তরা বেশি বিপদগ্রস্ত। অনেক দেশের তুলনায় জনসংখ্যার অনুপাতে আক্রান্তের হার বেশি বাংলাদেশে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো-জনবল-জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা সামগ্রীর ঘাটতি, স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার-প্রণোদনার অভাব ও অনেকের আতঙ্কের কারণে রোগীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ঠিকমতো হচ্ছে না। আত্মকেন্দ্রিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। আক্রান্তরা অনেক ক্ষেত্রে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের পাশে পাচ্ছেন না। চীন ২ মাস এবং ইউরোপের অনেক দেশ ৩-৪ মাসের মধ্যে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশে ৭ মাস পরও সংক্রমণ চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিচারে – পরীক্ষার তুলনায় শনাক্ত ৫% এর কম হলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলা যায়। তার লক্ষণ দেশে দেখা যাচ্ছে না, এখানে শনাক্তের হার এখনো ১২%-এর ওপরে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ একটি দীর্ঘমেয়াদী বৃহত্তর সংক্রমণের দিকে যাচ্ছে। আরও কত মানুষের মৃত্যু ঘটবে আমরা জানি না। অথচ, সরকারের মন্ত্রীরা কোভিড নিয়ন্ত্রণে সফলতার দাবি করছেন।
মানুষের জীবন বাঁচাতে ব্যর্থ আওয়ামী লীগ সরকার
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষে চীনে প্রথম করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে, আর গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। প্রস্তুতির জন্য ৩ মাস সময় পেলেও সরকার দেশে ভাইরাসের প্রবেশ ঠেকানো ও সংক্রমণ সীমিত রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার সেইসময় ব্যস্ত ছিল শতকোটি টাকা ব্যয়ে মুজিববর্ষ উদ্বোধনের আয়োজনে। সংক্রমণ প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী টেস্ট, আইসোলেশন, ট্রেসিং, কোয়ারেন্টিন, লকডাউন–কোনোটাই এদেশে ঠিকমতো ও পর্যাপ্ত করা হয়নি। শুরু থেকেই পরীক্ষার সংখ্যা সীমিত রাখার নীতি অনুসরণ করে আসছিল সরকার। ঢিলেঢালা লকডাউন তুলে দেওয়ার পর জুন মাসে আক্রান্ত ও মৃত্যু যখন দ্রুত বাড়ছিল, তখন করোনা পরীক্ষায় ফি আরোপ করা হয়। ফলে পরীক্ষার সংখ্যা আরও কমে যায়। সীমিত করোনা পরীক্ষা, ফি আরোপ, সময়মতো রিপোর্ট না মেলা ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার আশঙ্কার কারণে পরীক্ষা করাতে মানুষের আগ্রহ কম। হাসপাতালে গেলে যথাযথ সেবা পাওয়া যাবে না ও জীবন ঝুঁকিতে পড়বে, এমন আশঙ্কায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা হাসপাতালে যেতে চাইছেন না। কোভিড চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোর শয্যা ফাঁকা পড়ে আছে, কিন্তু প্রতিদিন করোনায় মানুষ মরছে। হাটবাজার, রাস্তাঘাটসহ জনাকীর্ণ স্থানগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি, মাস্ক পরা ও শারীরিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না। এখনো পর্যন্ত আমেরিকা-ইউরোপের তুলনায় দেশে মৃত্যুহার কম হলেও, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা ভাইরাস যেকোনো সময় রূপ পরিবর্তন করে আরও বেশি জীবনঘাতী হয়ে ওঠার আশঙ্কা আছে। শীতকালে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসতে পারে এবং তার জন্য প্রস্তুতি দরকার-প্রধানমন্ত্রী নিজেই এ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। কিন্তু প্রস্তুতির তৎপরতা কিছু চোখে পড়ছে না। অনেকে বলছেন-করোনার প্রথম ঢেউ-ই এখনো শেষ হয়নি, দ্বিতীয় ঢেউ তো পরের কথা। দেশে কতদিনে এই রোগ কমবে-কেউ বলতে পারছে না। বর্তমানে সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারি কোনো ব্যবস্থা প্রায় নেওয়া হচ্ছে না। অথচ, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ আপনা-আপনি কমবে না। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে-সরকার জনগণকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছে, যারা মরার মরবে ও যারা বাঁচার বাঁচবে।
করোনায় অর্থনৈতিক দুর্দশা : সরকারের দায়িত্ব কী?
অন্যদিকে করোনাজনিত অর্থনৈতিক মন্দার অজুহাতে ছাঁটাই-বেতন কর্তন চলছে, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বাড়ছে। প্রবাসীরা অনেকে কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। করোনায় কর্মহীন মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিবর্তে আওয়ামী লীগ সরকার ২৫টি রাষ্ট্রীয় পাটকল বন্ধ করে দিয়ে ৬০ হাজার শ্রমিককে এক ধাক্কায় বেকার করে দিয়েছে, পাটচাষিদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। অর্থনৈতিক সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমজীবী মানুষ-কৃষক-নিম্নবিত্তকে সহায়তা দেওয়ার পরিবর্তে সরকার প্রধানত শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাকালে আর্থিক দুর্দশায় পড়া নাগরিকদের বাড়িভাড়া-ইউটিলিটি বিল সরকার প্রদান করছে। অথচ, বাংলাদেশে ভুতুড়ে বিদ্যুৎবিলের বোঝা চাপানো হচ্ছে, পানির বিল-গাড়িভাড়া বাড়ানো হচ্ছে। মজুতদার-কালোবাজারি-মুনাফালোভীদের সি-িকেট ব্যবসা ও সরকারি হস্তক্ষেপের অভাবে লাগামহীন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ আরও বেড়েছে। এরকম অবস্থায় মানুষ অসহায় ও আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় দিন পার করছে।
দুর্নীতি–লুটপাটই এই সরকারের ‘নীতি’
দেশের এই অতিমারির সময়েও যে বেপরোয়া দুর্নীতি-প্রতারণা ও জালিয়াতি হতে পারে, সেই নজির স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশে। চিকিৎসাকর্মীদের জন্য মাস্ক ও ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী(পিপিই) কেনায় দুর্নীতি, কোভিড পরীক্ষার নামে জালিয়াতি, অনুমোদন বা লাইসেন্স ছাড়া হাসপাতাল পরিচালনা, যোগ্যতা না থাকলেও বিভিন্ন হাসপাতালকে কোভিড পরীক্ষা ও চিকিৎসার অনুমতি দেওয়া ইত্যাদি ঘটনা ঘটেছে। দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলায় কয়েকজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজি কেলেংকারির পর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে পূর্বানুমতির বিধান করা হয়েছে। লকডাউন চলাকালে গরিব মানুষের জন্য বরাদ্দ করা চাল ও অর্থ আত্মসাতের অসংখ্য ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। সরকার আইওয়াশের জন্য ছোটখাট দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে একদিকে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। অন্যদিকে, এসব নিয়ে লেখালেখির কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত করোনার মধ্যেই ৮৭ জন সংবাদিক ও অনলাইন লেখককে ‘গুজব’ ছড়ানোর অভিযোগ এনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হাজার হাজার টাকায় বালিশ-পর্দা কেনা, স্কুলে খিচুড়ি বিতরণ ও গণগ্রন্থাগারের ভবন নির্মাণে অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে বিদেশ ভ্রমণ, সরকারি হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই বিল উত্তোলন-সংবাদপত্রে প্রকাশিত এধরনের অসংখ্য দুর্নীতির ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে কীভাবে হরিলুট চলছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানিয়েছে-মেডিকেল যন্ত্রপাতির দাম বাজার মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দেখানো ছাড়াও হাসপাতালের বিভিন্ন সামগ্রী ক্রয়ে সরকারের প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা গত পাঁচ বছরে হাতিয়ে নিয়েছে স্বাস্থ্যখাতের কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বিশ্বব্যাংকের ১ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকার অর্থায়নে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক ‘গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি’ প্রকল্পের ডিপিপি-তে গরীব মানুষকে হাত ধোয়া শেখাতে খরচ হবে ৪০ কোটি টাকা। আবার পাঁচ বছরে মাত্র ৯ জনের বেতন ভাতা ৩ কোটি টাকা, আছে বিদেশ ভ্রমণ, সেখানেও লাগবে ৫ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতে সামিট-ইউনাইটেডসহ ৯টি বড় গ্রুপ এবং কোম্পানির বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য পিডিবি গত এক দশকে ১৯ হাজার ২০৯ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে। অর্থাৎ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াই কেন্দ্রভাড়া বাবদ এ অর্থ দিয়েছে। প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও তিন বছর আগে এক হাজার মেগাওয়াটের ছয়টি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেয় সরকার। এদের বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে, যাতে ৬-৭ টাকার প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় পড়ছে ৩০০-১৫০০ টাকার বেশি। সম্প্রতি পুলিশের এজাহারে জানা গেছে-ফরিদপুরের ২ জন যুবলীগ ও ১ জন ছাত্রলীগ নেতা মিলে বিদেশে পাচার করেছেন ২০০০ কোটি টাকার বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন ড্রাইভারের শত শত কোটি টাকা সম্পদের তথ্য এসেছে। যুবলীগ নেতা ঠিকাদার জি কে শামীমকে গ্রেপ্তারের সময়ে শুধু তার অফিস থেকে পাওয়া গেছে ২০০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক একাউন্টের কাগজপত্র। আরেক যুবলীগ নেতা ‘স¤্রাট’ নিয়মিত সিঙ্গাপুরে ক্যাসিনোতে জুয়া খেলেন লাখ লাখ ডলার। সংবাদপত্রে এধরনের অসংখ্য খবর আসে। এসব দেখে কে বলবে-বাংলাদেশ গরিব দেশ!
সরকারি নিপীড়ন বাড়ছে
মানুষের জীবন বাঁচানোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া ও প্রয়োজনে জনগণের খাদ্য-জীবিকার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেয়ার জন্য যে দায়বদ্ধ মনোভাব ও জনসম্পৃক্ত ব্যবস্থাপনা দরকার, তার কিছুই এ স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের চরিত্রে নেই। রাতের আঁধারে ভোটডাকাতির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের জনগণের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নেই। বরং তারা গণবিক্ষোভ ঠেকাতে ও সমালোচনাকারীদের দমনে নিপীড়ন চালাচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত ২ বছরে হাজারের বেশি মামলা হয়েছে, দেড় হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সম্প্রতি কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে মেজর সিন্হার মৃত্যু, তাকে মাদকব্যবসায়ী সাজানোর চেষ্টা, মাদক দমনের নামে শুধুমাত্র ওই জেলায় ‘ক্রসফায়ারে’ দুই শতাধিক মানুষ হত্যা এসব ঘটনায় উঠে এসেছে-এদেশে সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে মানুষের জীবন কতটা নিরাপত্তাহীন। বেআইনী আটক, গুম, হয়রানিমূলক মামলা, পুলিশী হেফাজতে নির্যাতন, মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়, সভা-সমাবেশে বাধাদান-এসব চলছেই।
সরকারদলীয়দের ধর্ষণ ‘উৎসব’!
করোনার পাশাপাশি দেশ যেন নারী নির্যাতন-ধর্ষণ ও শিশু ধর্ষণের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। সিলেট শহরের ওপর এমসি কলেজ হোস্টেলে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করেছে। এরপরই নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে একজন মহিলাকে বিবস্ত্র করে কুৎসিত অত্যাচার করলো স্থানীয় যুবলীগের সাথে যুক্ত সন্ত্রাসীরা। প্রতিদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত অসংখ্য নারী-শিশু ধর্ষণের সংবাদের মধ্যে এঘটনাটি দেশের নারীসমাজসহ জনগণকে চরম আতঙ্কিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। যত খবর প্রকাশ্যে আসে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ধর্ষণের ঘটনা আড়ালে থেকে যায় লোকলজ্জা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে। দেখা যাচ্ছে-বেশিরভাগ ধর্ষকরা ক্ষমতাসীনদের সাথে যুক্ত অথবা তাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে লালিত। ধর্ষণের ঘটনা ফাঁস হলে মীমাংসার নামে ধামাচাপা দেওয়া ও অপরাধীকে বাঁচাতে মূল ভূমিকা পালন করে শাসকদলের স্থানীয় নেতা ও সরকারের অনুগ্রহপুষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা। ধর্ষণের মানসিকতা গড়ে তোলে যে পর্নোগ্রাফি, মাদক, গু-াতন্ত্র ও ভোগবাদী অপসংস্কৃতির বিস্তার-তারও প্রধান পৃষ্ঠপোষক ক্ষমতার সাথে যুক্ত প্রভাবশালীরা। ‘ইয়াবা’ বদি নামে খ্যাত কক্সবাজারের আওয়ামী এমপির দাপট, মহিলা লীগনেত্রী পাপিয়ার দেহব্যবসা চক্র, যুবলীগ নেতাদের ক্যাসিনো ব্যবসা, শাসক দলের এমপি-র আদম পাচার, বরগুনাসহ সারাদেশে সরকারি দলের নেতাদের আশ্রয়ে কিশোর গ্যাং-এর হাতে খুন-জখম, ছাত্রলীগ নেতা কর্তৃক গৃহকর্মী ধর্ষণ, নারী ও কিশোরদের বাধ্য করে বা ব্ল্যাকমেইল করে পর্নোচিত্র ধারণ-এধরনের অসংখ্য ঘটনা উল্লেখ করা যায়। মাঝে-মধ্যে জনমতের চাপে বা শাসকদলের অভ্যন্তরীণ ‘শৃঙ্খলা’ রক্ষার জন্য কিছু অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে আইওয়াশের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীরা পার পায়, উপযুক্ত বিচার হয় না-ক্ষমতাসীনদের সাথে তাদের যোগাযোগের কারণে। এই মাফিয়া শাসন ও অবক্ষয়ী সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া ধর্ষণের মহামারি রোধ করা যাবে না, নারীর মর্যাদা-নিরাপত্তা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করা যাবে না।
‘উন্নয়নের জোয়ার’-এর আসল চেহারা
করোনা মহামারিতে আমাদের দেশে ও বিশ্বে লাখ লাখ মানুষের অসহায় মৃত্যু, সাধারণ মানুষের আর্থিক দুর্দশা সবাইকে নতুন করে ভাবাচ্ছে। মানবসভ্যতার এত অগ্রগতি ও মানবজাতির সম্পদবৃদ্ধিতে কারা লাভবান হচ্ছে – ধনীরা না সাধারণ মানুষ? সে প্রশ্ন নতুন করে দেখা দিয়েছে। করোনাকালে আওয়ামী লীগ সরকারের তথাকথিত উন্নয়নের আসল চেহারা পরিষ্কারভাবে উন্মোচিত হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো প্রধান শহরেই বেশিরভাগ হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই-এর মতো প্রাথমিক জীবনরক্ষাকারী ব্যবস্থা নেই, আইসিইউ-এর জন্য হাহাকার তৈরি হয়েছে। জেলা-উপজেলা হাসপাতালগুলোর কথা বলাই বাহুল্য। সরকারি হাসপাতালগুলোর দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা এই একটি তথ্যেই বোঝা যায়। অথচ দেশের বেশিরভাগ গরিব মানুষের চিকিৎসার একমাত্র জায়গা এই সরকারি হাসপাতালগুলোই। অবহেলিত সরকারি হাসপাতালগুলোর জরাজীর্ণ অবস্থার কারণে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তরা তাদের চিকিৎসা করাতেন বেসরকারি ব্যয়বহুল হাসপাতালে, অনেকে যেতেন ভারতসহ বিদেশে। করোনায় দেখা গেল বেসরকারি হাসপাতালগুলো বেশিরভাগ বন্ধ, চালুগুলোতে চিকিৎসার পর্যাপ্ত আয়োজন ও দক্ষ-নিবেদিত ডাক্তারসহ জনবল নেই। বিদেশে যেতে না পারায় স্বচ্ছল ব্যক্তিদেরও চিকিৎসায় বিপন্ন দশার মুখোমুখি হতে হয়েছে। অন্যদিকে, দুয়েক মাস লকডাউনেই দেশের বেশিরভাগ পরিবার অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে, অর্থাৎ কাজ বন্ধ থাকলে অল্প কিছুদিন চলবার মতো সঞ্চয় নেই বেশিরভাগ মানুষের। ব্র্যাকের পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়েছে-করোনা পরিস্থিতিতে চরম দারিদ্র্য আগের তুলনায় ৬০% বেড়েছে। বিআইডিএস-এর জরিপ বলছে-করোনার কারণে দেশের ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার প্রচার করত-বাংলাদেশ নাকি বিশ্বে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হয়ে গেছে। করোনাকালে জনজীবনের দুর্দশায় ‘উন্নতি’র আড়ালে ধনী-গরীব বৈষম্য নগ্নভাবে প্রকাশিত হলো।
করোনা মহামারি কী শিক্ষা দিল
এই অবস্থা কেন হলো? আসলে দরিদ্র বাংলাদেশসহ তথাকথিত উন্নত দেশগুলোতেও আমরা দেখতে পাচ্ছি-পুঁজিবাদী সরকারগুলো সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার দায়িত্ব নেওয়ার চাইতে মালিকগোষ্ঠী-শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের মুনাফা ঠিক রাখতে বেশি তৎপর। শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ সকলরকম সেবাখাতকে বেসরকারিকরণ করে পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। চিকিৎসা সে-ই পাবে, যার টাকা আছে। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় অবহেলা করে জোর দেওয়া হচ্ছে ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসাসেবা ক্রয়ের ওপর। ফলে, বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর মিছিল আমরা দেখতে পাচ্ছি। উন্নত দেশগুলোতেও করোনার শিকার প্রধানত সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, দরিদ্র, কালো ও অভিবাসীরা। কারণ, জীবনযাত্রার নিম্নমানের কারণে তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল এবং তারা অস্বাস্থ্যকর ঘিঞ্জি পরিবেশে থাকে। তাদের পক্ষে ঘরে বসে থাকা সম্ভব নয়। আবার, তারা অর্থনীতির চাকা সচল না রাখলে শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের লাভও হবে না। তাদের মুনাফা অব্যাহত রাখতেই ট্রাম্প-বলসারেনোসহ বুর্জোয়া শাসকরা লকডাউনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও করোনার বিপদকে লঘু করে দেখাতে চায়। ফলে পুঁজিবাদসৃষ্ট শোষণ-বঞ্চনা ও বৈষম্য এ রোগ বিস্তারে প্রধান ভূমিকা রাখছে। যেখান থেকে নিস্তার পাচ্ছে না সুবিধাভোগী ও ধনীরাও।
অন্যদিকে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যবসায়িক স্বার্থে। মানববিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণে, সামরিক খাতে, গোয়েন্দা নজরদারিতে শাসকরা শ্রম-অর্থ-মেধা বিনিয়োগ করেছে। মানুষ বাঁচাতে রোগ প্রতিরোধ-নিরাময় গবেষণায় তার ছিটেফোঁটাও মনোযোগ দেওয়া হয়নি। বিজ্ঞানের চর্চা ও মৌলিক গবেষণা এভাবে অবহেলিত না হলে হয়তো অতিদ্রুত এই রোগের ওষুধ আবিষ্কার হতে পারত। এখনো, ভ্যাকসিন ও ওষুধ আবিষ্কারে মানবজাতির সকল মেধা-জ্ঞান ও সম্পদকে সম্মিলিত করে সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা নেওয়া হচ্ছে না। ভ্যাকসিনসহ চিকিৎসাবাণিজ্য ও বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে চলছে প্রতিযোগিতা।
পাশাপাশি, পুঁজিপতিদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নেশায় প্রকৃতি ধ্বংস করা হচ্ছে। বনভূমি কমে যাওয়ায় বন্যপ্রাণী লোকালয় ও মানুষের কাছাকাছি চলে এসেছে। মানুষ ও প্রাণীর দূরত্ব কমে যাওয়ায় তাদের শরীর থেকে অজানা সব ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের মধ্যে। সকলেই জানেন, এবারের নতুন করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি চীনের উহান শহরের একটি বন্যপ্রাণীর বাজার থেকে। ধারণা করা হচ্ছে-বাদুড় বা প্যাঙ্গোলিন এই ভাইরাসের মূল বাহক।
করোনা মহামারি শিক্ষা দিল-আমরা কেউ একা বাঁচতে পারব না, সামাজিক সংহতি ও সম্মিলিত প্রতিরোধ জরুরি। সবার স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা না গেলে কেউ নিরাপদ নয়। গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থা, মানুষের জীবিকার নিশ্চয়তা ও সাম্য ছাড়া মহামারি প্রতিরোধ সম্ভব নয়। ধনীদের মুনাফার লক্ষ্যে পরিচালিত অর্থনীতি নয়, চাই সব মানুষের জীবনমান উন্নত করার লক্ষ্যে পরিচালিত সমাজব্যবস্থা। তার জন্য চাই শোষকদের উচ্ছেদ করে শোষিতদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল এবং বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। যে সমাজে স্বাস্থ্য-চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্র নেবে, অর্থনৈতিক পরিকল্পনার লক্ষ্য হবে সকলের জীবিকা নিশ্চিত করা। যতক্ষণ তা প্রতিষ্ঠা করা না যাচ্ছে, ততক্ষণ মানুষের জীবন-জীবিকা ও গণতান্ত্রিক অধিকার যতটুকু সম্ভব, আদায়ে চাই লাগাতার গণআন্দোলন।
বিশ্বমন্দার কালো ছায়া : গণতান্ত্রিক অধিকার সংকুচিত হবে
আগেই বিশ্ব অর্থনীতিতে সংকট চলছিল, এখন করোনার প্রভাবে ভয়ঙ্কর মন্দার আশংকা দেখা দিচ্ছে। অসংখ্য কলকারখানা বন্ধ, ছাঁটাই, বেতন হ্র্রাস ঘটছে। পুঁজিপতিদের মুনাফার স্বার্থে অল্প শ্রমিক দিয়ে কম মজুরিতে বেশি খাটানো, অটোমেশন, ডিজিটালাইজেশন, ক্যাপিটাল ইনটেনসিভ উৎপাদন পদ্ধতি চালু হবে ব্যাপকভাবে। কাজের সময়ের কোনো সীমা থাকবে না। নির্দিষ্ট মজুরি বলেও কিছু থাকবে না। যখন তখন ছাঁটাই করে দিতে পারবে, যখন তখন কলকারখানা বন্ধ করে দিতে পারবে। আরেকটা দিক হচ্ছে, পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ায় শক্তি ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটবে। স্বার্থের সংঘাত আরও তীব্র হবে, যা দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ এমনকি সীমিত-স্থানীয় যুদ্ধেরও রূপ নিতে পারে। জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের ডিরেক্টর ইতিমধ্যেই হুঁশিয়ারি দিয়েছে-‘ক্ষুধার মহামারি’ আসছে। তাঁর হিসাবে ইতিমধ্যেই বিশ্বে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ প্রতিদিন ক্ষুধার্ত থাকে। এই সংখ্যা আরও বহুগুণ বাড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বাড়বে।
এর বিপরীতে বিভিন্ন স্তরের দুর্দশাগ্রস্ত জনগণ নানা স্থানে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভে ফেটে পড়বে। খাদ্যের দাবিতে ক্ষুধার্ত মানুষ, চাকরির দাবিতে কর্মচ্যুত শ্রমিক ও বেকার যুবক, চরম সঙ্কটগ্রস্ত খেতমজুর, গরিব ও মাঝারি কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী-এদের মধ্যে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠবে। একে ঠেকাতে বুর্জোয়া শাসন আগামী দিনে আরও কর্তৃত্ববাদী-ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠবে। জনগণের ওপর গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি আরও তীব্র হবে, গণবিক্ষোভ দমনে সরকার আরও নিষ্ঠুর ভূমিকা নেবে। জনগণের ঐক্যকে ভাঙার জন্য বুর্জোয়া শাসকরা উগ্র জাতীয়তাবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় হানাহানি, জাতিগত বিদ্বেষ ইত্যাদিকে উসকে দেবে।
আন্দোলনই বাঁচার একমাত্র পথ
এই পরিস্থিতিতে-জনগণের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর আক্রমণ মোকাবিলা করতে বামপন্থী দলগুলোকেই সক্রিয় ও উদ্যোগী ভূমিকায় এগিয়ে আসতে হবে। ক্ষুদ্র ও দুর্বল হলেও এদেশে তারাই একমাত্র জনগণের পক্ষের শক্তি। অনির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারের এক দশক জুড়ে স্বৈরতান্ত্রিক, গণবিরোধী ও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনে মানুষ অতিষ্ঠ। অবিলম্বে এর অবসান চাই। কিন্তু, বিকল্প কী? আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামাত-ক্ষমতা নিয়ে এদের যত বিরোধই থাকুক, অর্থনৈতিক নীতিতে তারা এক। আওয়ামী লীগ যেমন ২৫টি পটিকল বন্ধ করেছে, বিএনপিও পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী বন্ধ করেছিল। ‘ক্রসফায়ার-এনকাউন্টার’ নাম দিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আওয়ামী লীগ, বিএনপিও তেমনি অপারেশন ক্লিনহার্টে ‘হার্ট এটাক’ নাটক সাজিয়েছিল। কালো পোশাকের র্যাব তারাই প্রতিষ্ঠা করেছিল। বিএনপি দুর্নীতির ‘হাওয়া ভবন’ বানিয়েছিল, আওয়ামী লীগ সকল ভবনে দুর্নীতি ছড়িয়ে দিয়েছে। জামাতের সঙ্গে বিএনপি-র আপত্তি নেই, আওয়ামী লীগেরও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হেফাজতে ইসলাম ও ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের হাত ধরতে অসুবিধা নেই। ফলে-বিকল্প রাজনীতি চাই, জনগণের রাজনৈতিক শক্তির উত্থান চাই।
এখন কথা হলো-আওয়ামী লীগ-বিএনপি ‘খারাপ’ বলেই কি বামপন্থীরা ‘ভালো’ হয়ে গেল? এর জন্য বামপন্থীদেরও সত্যিকার ‘বামপন্থী’ হয়ে উঠতে হবে, যারা হবে জনঘনিষ্ঠ ও সংগ্রামী। বুর্জোয়া সংসদীয় রাজনীতির বিপরীতে জনগণের অধিকার আদায়ে আন্দোলনের শক্তি গড়ে তোলা ও মানুষের মধ্যে সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করাই হবে তাদের মূল লক্ষ্য। আবার, বামপন্থীদের মধ্যে থেকেও সঠিক বিপ্লবী শক্তি গড়ে উঠতে হবে-যারা গণআন্দোলনের পথে জনগণকে সংগঠিত ও শিক্ষিত করবে এবং জ্ঞানে-চরিত্রে-সংগ্রামে মানুষকে পথ দেখাবে। মানুষের বাঁচার দাবি নিয়ে আন্দোলনের কষ্টকর পথে তাদের আস্থা অর্জন না করে, যে কারো সাথে হাত মিলিয়ে বুর্জোয়াদের শক্তিশালী করে রাতারাতি বড় শক্তি হওয়ার রাস্তায় হাঁটলে তা আত্মঘাতী হবে। সঠিক পথে ঐক্যবদ্ধ বামপন্থী আন্দোলনের শক্তিবৃদ্ধির ওপরই দেশের শোষিত মানুষের ভবিষ্যত নির্ভর করছে।