বাংলাদেশে শুরু হয়েছে করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ। গতবছর লকডাউনে নাজেহাল অবস্থায় পড়েছিল দেশের সব সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ। সে সময় সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের হাজার হাজার কোটি টাকা মালিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করলেও শ্রমিকের কোন কাজে লাগে নি। শিল্প-কারখানা, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ না করেই কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে, ছাঁটাই করেছে লাখ লাখ শ্রমিককে। অন্য দিকে দেশের শ্রমজীবী মানুষের সবচেয়ে বড় অংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকেরা কর্মহীন হয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটিয়েছে। বেসরকারি সংস্থার জরিপে লকডাউনের প্রথমেই প্রায় ১৪% মানুষের ঘরে কোন খাবার ছিল না। বর্তমানে করোনা মহামারী আবার ভয়ংকর চেহারা নেওয়ায় সরকার কোন আগাম প্রস্তুতি ছাড়াই ঘোষণা করেছে লকডাউন। শ্রমজীবী মানুষ কাজ হারিয়ে আরও অসহায়। কৃষকের আত্মহত্যার খবর এসেছে অনলাইন পত্রিকায়। এই পরিস্থিতি সামনে রেখে আবার এ বছর আসছে ১ মে, ‘মহান মে দিবস’। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের রক্তাক্ত ইতিহাস গড়ে ওঠার দিনটি। আর এই মহামারী দিনে এই দিবসটি যেন আরো প্রাসঙ্গিক এবং তাৎপর্যপূর্ণ।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ইউরোপ আমেরিকায় মুনাফার লোভে বুর্জোয়া শ্রেণী শ্রমিকদের দিয়ে করাতো অমানবিক পরিশ্রম। কাজের কোন নির্ধারিত সময় ছিল না। এমনকি দৈনিক ২০ ঘন্টাও কাজ করতে হত শ্রমিকদের। এ অবস্থায় পুঁজিবাদী দেশগুলোতে শ্রমঘণ্টা কমানোর দাবীতে গড়ে ওঠে বড় বড় আন্দোলন। শ্রমিকদের এসব আন্দোলন দমন করতে আমেরিকার ফেডারেল কোর্ট ইনজাংশন জারি করে। সে আদেশ অমান্য করে ধর্মঘট করায় ১৮৮৬ সালের এপ্রিল মাসে প্রায় ১৩শ শ্রমিককে গ্রেফতার করা হয়। এর প্রতিবাদে সে বছর ১ মে তারিখে শিকাগোসহ যুক্তরাষ্ট্রের শহর এবং শিল্পাঞ্চলগুলোতে ধর্মঘট পালন করা হয়। পত্র পত্রিকার তথ্যানুসারে সেদিন সারা দেশে প্রায় সাড়ে তিনলাখ শ্রমিক মিছিল করে। এ সময়ে বিনা কারণে ৩ ও ৪ মে তারখে শ্রমিকদের উপর গুলি চালায় পুলিশ। কিন্তু শ্রমিকদের যারা হত্যা করেছিল তাদের বিচার না করে বিচার শুরু হয় শ্রমিক নেতাদের। প্রহসনের সে বিচারে ফাঁসি দেয়া হয় স্পাইস, ফিশার, এঞ্জেলস ও পার্সন – এই চার মহান শ্রমিক নেতাকে।
এই প্রহসনের বিচারের প্রতিবাদে ঝড় ওঠে ইউরোপ আমেরিকায়। কমিউনিস্ট নেতা মহান ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস এর নেতৃত্বে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতির কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এ কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত হয় পরের বছর অর্থাৎ ১৮৯০ সাল থেকে সারাবিশ্বে ১ মে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস’হিসেবে পালন করা হবে। তখন থেকেই সারা পৃথিবীর মেহনতী মানুষের কাছে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের প্রেরণার দিন হিসেবে ১ মে পালিত হচ্ছে ‘মহান মে দিবস’। শ্রমিক শ্রেণীর মহান নেতা কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস এর ডাকে সাড়া দিয়ে সারা বিশ্বের মেহনতী জনতা শ্লোগান তুলেছে ‘দুনিয়ার মজদুর, এক হও। তাই মে দিবস শুধু শ্রমিকদের জন্য আনন্দ উদযাপনের দিন নয় বরং শোষণ-বৈষম্য-জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াইকে আরো গতিশীল করার শপথ নেয়ার দিন।
দেড়শো বছর আগে যে লড়াই শুরু হয়েছিল তা আজও অব্যাহত। পুঁজিবাদী নিয়মে অর্থনীতির চাকা সচল রাখে দেশের শ্রমজীবী মানুষ। অথচ এ ব্যবস্থায় সবচেয়ে অবহেলিত এই শ্রমিকেরাই। আজ থেকে আট বছর আগে এই এপ্রিল মাসের ২৪ তারিখে ঘটে বাংলাদেশের সাভারে রানা প্লাজা গার্মেন্ট ধ্বসের ঘটনা। ১১শর বেশি পোশাক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা ছিল শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্ব-ইতিহাসেরই অন্যতম ভয়াবহ শিল্প-দুর্ঘটনা। এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়। রানা প্লাজা এক নৃশংস হত্যাকা-, এক ভয়ংকর গণহত্যা। ভবনে ফাটল ধরার পরও শ্রমিকদের ডেকে এনে জোর করে কাজ করানো হয়েছে। এখন এও জানা যাচ্ছে যে ওই ভবন কোনো নিয়ম-নীতি মেনে তৈরি করা হয়নি। রানা প্লাজার কয়েক হাজার শ্রমিক মুনাফার শিকার হয়ে জীবন হারিয়েছেন, পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছে আরও অনেকে। গত আট বছরেও এই হত্যাকাণ্ডের কোন বিচার হয়নি।
এর আগে ২০১৪ সালে নভেম্বর মাসে আশুলিয়ায় তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে মারা যান ১২৪ জন শ্রমিক। একইভাবে ২০০৫ সালের ১০ এপ্রিল রাতে এই সাভারেই স্পেকট্রাম নামের ৮ তলা ভবন ধ্বসে আনুমানিক ৩ শত শ্রমিক নিহত হয়। ওই ঘটনার জন্য দায়ী মালিক-কর্তৃপক্ষের কোনো শাস্তি হয়নি। বিচার হয়নি ২০০৬ সালে চট্টগ্রামের কেটিএস এপারেল-এ শ্রমিক হত্যার। গেট আর অপরিসর সিঁড়ির কারণে শ্রমিকরা বেরুতে পারে না। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে, পদদলিত হয়ে, আগুনে পুড়ে মরে। কখনো ভবন ধ্বসে পড়ে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই চাপা পড়ে শত প্রাণ। প্রতিটি ঘটনায় গণহারে শ্রমিক মারা গেছে, অথচ কোন ঘটনাতেই মালিকের বিচার হয়নি।
রাষ্ট্রের কাছে শ্রমিকের জীবনের যেন কোন মূল্যই নেই। আর এই মহামারীতে তা অন্য যে কোন সময়ের চাইতে আরো বেশি স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে। করোনা পরিস্থিতির শুরুতে অপরিকল্পিত লকডাউনে বিপর্যস্ত শ্রমিকেরা সমস্ত বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়েই কাজ করেছে কল কারাখানায়, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। করোনা মহামারীর আঘাতে পুরো বিশ্বের অর্থনীতিই যখন টালমাটাল সে অবস্থাতেও বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে এদেশের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ। সবমিলিয়ে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) এক হাজার ৫৯২ কোটি ৩৫ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১ শতাংশ বেশি। অনেক দেশেই কাজ হারিয়েছেন অভিবাসী কর্মীরা। সরকারি হিসাবে গত ১ এপ্রিল থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ২৬ হাজার ৭৫৮ জন প্রবাসী কর্মী দেশে ফিরে এসেছেন। সব মিলিয়ে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে রেমিটেন্স বাবদে দেশে এসেছে ২১ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৯ সালের পুরো সময়ের চেয়ে ১৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি।
পুঁজিবাদের নিয়মে যেমন অর্থনীতির চাকা সচল রাখে শ্রমজীবী মানুষ তেমনি লাভের অংশ ভোগ করে মালিকেরা। ২০১৬ সালে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি-জিএফআই এর তথ্য নিয়ে সিপিডি তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, ১০ বছরে সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা বিদেশ পাচার হয়েছে। এ টাকা তৈরি হয়েছে শ্রমিকের রক্তে ঘামে আর পাচার করছে মালিকেরা। মহামারীর এই মানবিক বিপর্যয়ের সময়েও লাভের অংক বেড়েছে মালিকদেরই। হিসাব মতে দেশে নতুন কোটিপতিই তৈরি হয়েছে সাড়ে ৩ হাজার। শ্রমিকের স্বাস্থ্যঝুঁকির তোয়াক্কা না করে খোলা রাখা হয়েছে গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন ধরনের কল-কারখানা। এই সময়ে আবার ১০,০০০ কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজও দাবি করেছে গার্মেন্টস মালিকেরা। অন্যদিকে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের আবারো লকডাউনে দিশেহারা অবস্থা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ (২০১৭) অনুযায়ী, দেশের ৮৫ শতাংশ কর্মজীবী লোক এমন অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। দেশে মোট ৬ কোটি ৮ লাখ লোক মজুরির বিনিময়ে কোনো না কোনো কাজে আছেন। এর মধ্যে ৫ কোটি ১৭ লাখ ৪ হাজারই কাজের কোন নিশ্চয়তা নেই এমন কাজ করেন। গত লকডাউনে করোনায় অবশ্য তাঁদের জীবিকাই সবচেয়ে হুমকিতে পড়েছে। গত লকডাউনে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ সবকিছু প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। শহর-গ্রামনির্বিশেষে দিন আনে দিন খায় অসহায় মানুষেরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাঁদের অনেকের রোজগার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে সময় রাজধানীসহ বড় বড় শহরের রিকশাচালক, গৃহকর্মী, হোটেল কর্মী, বাস-টেম্পোচালকসহ হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। ফলে তাঁরা গ্রামে গিয়েছেন বাড়ি ভাড়া দিতে না পেরে বা নতুন কাজের সন্ধানে।
কিন্তু সংসার চালাতে গিয়ে বেশির ভাগই সে সময় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। গতবছরের ঋণ শোধ হয়নি এখনো। এরই মধ্যে আবার লকডাউন শুরু হয়েছে। কোনো কাজ পাচ্ছেন না তাঁরা। কিন্তু গতবারের অভিজ্ঞতায় তাঁরা এবার আর ঢাকা ছেড়ে যেতে চাচ্ছেন না। তাঁদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। আরো ভয়ংকর অসহায় অবস্থায় পড়তে যাচ্ছেন তারা। নগদ অর্থ এবং খাদ্য সহায়তা প্রদান ছাড়া এই সব শ্রমিকদের অনাহারে মৃত্যু ভিন্ন অন্যকোন উপায় থাকবে না।
এই করোনা বিপর্যয় কালে তাই মহান মে দিবসকে তাৎপর্যপূর্ণ করতে হলে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে আন্দোলন ভিন্ন অন্য কোন উপায় নেই। অন্যদিকে, সাধারণ সময়েও নামমাত্র মজুরি ছাড়া উৎপাদনের সুফল শ্রমিকেরা পায় না। পুঁজিবাদী সমাজে উদ্ধৃত্ত সম্পদের সিংহভাগ ভোগ করে মালিকেরা। তাদের হাতেই মূলত রাষ্ট্র-আইন-পুলিশ-বিচারবিভাগ সবকিছু। শ্রমিকদের এই দুঃসহ শোষণ থেকে মুক্তি দিতে হলে পুঁজিবাদ উচ্ছেদ করার সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। আর সেই সংগ্রামের প্রেরণা হিসেবেই উদযাপন করতে হবে মহান মে দিবস।
(উৎস: সাম্যবাদ, এপ্রিল-মে ২০২১)