করোনা ভাইরাস সংক্রমণের বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমজীবী জনগণের ঘরে ঘরে খাদ্য ও নগদ অর্থ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা না করে সরকারের লকডাউন ঘোষণা অপরিকল্পিত ও পূর্বপ্রস্তুতিহীন
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বাড়ার প্রেক্ষিতে আকস্মিকভাবে সরকার আগামী সোমবার থেকে একসপ্তাহ লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে। কোন পূর্বপ্রস্তুতি ও পরিকল্পনা ছাড়া লকডাউন ঘোষণা করায় জনগণ চরম দুর্ভোগ ও উদ্বেগে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। বাড়ি ফেরার তাগিদে লঞ্চ ও বাস টার্মিনালে মানুষের হুমড়ি খেয়ে পড়ার চিত্রেই তা স্পষ্ট। লকডাউনের সময়সীমা সম্পর্কে সরকারের অস্পষ্ট অবস্থান জনগণের অনিশ্চয়তা আরো বাড়িয়েছে। ১৪ দিনের নীচে লকডাউন অবৈজ্ঞানিক, ফলে লকডাউনের সময় বাড়ানো হবে কিনা, তা স্পষ্ট করে সরকার বলছে না, প্রয়োজনে বাড়ানো হতে পারে বলে বলা হচ্ছে। সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে জনগণের চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলে, ৪০ লক্ষ গার্মেন্টস শ্রমিককে উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত রাখার সিদ্ধান্তে জনস্বাস্থ্যবিদদের পরামর্শের চাইতে মালিকের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, তা স্পষ্ট। দেশের ৬ কোটি শ্রমশক্তির সাড়ে ৫ কোটি ২০ লাখ মানুষই অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে কাজ করে। দৈনিক আয়ের উপর নির্ভরশীল এসব শ্রমিক কাজ না করলে, তাদের আয় ও খাবার বন্ধ। লকডাউনের এক সপ্তাহ বা সময় বাড়ানো হলে, এ-সময় সাধারণ এ শ্রমজীবী মানুষেরা কি খেয়ে থাকবে, তাদের ঘরে ঘরে সরকারের পক্ষ হতে লকডাউন চলাকালীন সময়ের জন্য খাদ্য ও অর্থ পৌঁছে দেওয়া হবে কি’না – সে বিষয়ে কোন বক্তব্য ও পরিকল্পনা আছে বলে সরকার জানায়নি।
সরকারের পক্ষ হতে খাদ্য ও অর্থের ব্যবস্থা না করে লকডাউন ঘোষণা যে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্দশায় নিক্ষেপ করে, গত বছর তা আমরা দেখেছি। ক্ষুধার্ত, কর্মহীন মানুষ সরকারি ত্রাণের জন্য জেলায় জেলায় করোনার ঝুঁকি উপেক্ষা করে হাজারে হাজারে বিক্ষোভ করেছে। এবারও সে পরিস্থিতি তৈরি হতে চলেছে।
বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আসছে, এ বিষয়ে ছয় মাস আগে থেকেই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সরকারকে বার বার সতর্ক করেছেন। জানুয়ারিতে এদেশে করোনা ভাইরাসের ‘ইউকে ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া যাওয়ার পর, সংক্রমণ দ্রুত বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। কিন্তু গত দুইমাস যুক্তরাজ্য থেকে যাত্রী আসার বিষয়ে সরকার কড়াকড়ি আরোপ করেনি। ফেব্রুয়ারি থেকেই সংক্রমণ বাড়তে থাকার প্রবণতা দেখা গেলেও, সরকার নিয়ন্ত্রণমূলক কোন পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার পর দেখা গেল, সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ও পরিকল্পনাহীন। তড়িঘড়ি করে সর্বশেষ ২৮ মার্চ সরকার ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করে, তাও অস্পষ্টতা ও স্ববিরোধিতায় পূর্ণ। নির্দেশনায় একদিকে জনসমাবেশ নিরুৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছে, অন্যদিকে তার কয়েকদিনের মধ্যেই লক্ষ মানুষের সমাবেশ ঘটিয়ে সরকারি উদ্যোগে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হলো। সে ১৮ দফা নির্দেশনা কিছুটা কার্যকর করার আগেই আবার লকডাউন ঘোষণা করা হলো। স্বাভাবিক ভাবেই জনগণ প্রত্যাশা করেছিলো, গতবছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলা করার জন্য সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। সকল জনগোষ্ঠীকে সচেতন করা ও করোনা পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে সকল উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রয়োজনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে করোনা পরীক্ষার আয়োজন করা, সকল জেলা হাসপাতালে পর্যাপ্ত বেড, আইসিইউ, সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা তৈরি করাসহ আনুষঙ্গিক আয়োজন করা। কিন্তু প্রস্তুতির জন্য একবছর সময় পেলেও, সরকার সে প্রস্তুতি নেয়নি। অনেক জেলাতেই করোনা পরীক্ষার কোন আয়োজন নেই, সব জেলা হাসপাতালে আইসিইউ, সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্লান্ট নেই। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, করোনা সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ৩১ জেলার মধ্যে ১৫ টিতেই আইসিইউ নেই। অথচ গত জুনে প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি জেলা সদরে জরুরী ভিত্তিতে আইসিইউ স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সময়োপযোগী যেসব পদক্ষেপ দরকার ছিল, তা না নিয়ে সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য জনগণের উদাসীনতার উপর পুরো দায় চাপিয়ে, সরকার তার ব্যর্থতা আড়াল করতে চায়।
লকডাউন চলাকালীন ওয়ার্ডভিত্তিক বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী সংস্থা, প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে প্রতিটি শ্রমজীবি পরিবারে দুই সপ্তাহ চলার মতো খাদ্যসামগ্রী ও নগদ অর্থ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা, করোনা রোগীদের চিকিৎসা রাষ্ট্রীয় খরচে নির্বাহ করা ও প্রতিটি জেলা উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে পর্যাপ্ত সিট, আইসিইউ, সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী জরুরী ভিত্তিতে নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
(উৎস: সাম্যবাদ, এপ্রিল-মে ২০২১)